দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-১৯+২০

0
5

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৯

নিকষকালো অন্ধকার বাইরে। নিশাপতির আজ দেখা নেই। ধরণী তাই আঁধারে নিমজ্জিত। তরুলতার সামনের অংশে খোলা জায়গা। কিছুটা উঠানের মতো। তাওসিফ সেখানে পায়চারি করছে। হিসাব মেলাবার চেষ্টা করছে সে। অধরার পুরো অতীত শোনার পর থেকেই এই হিসাব মিলাতে চাচ্ছে। কিন্তু একটা জায়গায় গিয়ে আর মিলছে না। সে কি অংকে ভুল করেছে? তাওসিফ ভাবে। ভাবতে ভাবতে সময় যায়। হুট করে পায়চারি থামায় তাওসিফ। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে। ডায়াল করে নীরবতার রাণী নামে সেভ করা নাম্বারটায়। রিং হয়। তাওসিফ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে মুচকি হাসে। নামটা বোধহয় খুব শীঘ্রই চেঞ্জ করতে হবে। নীরবতার রাণী এখন তার কাছে সরব হতে শুরু করেছে।

রুমের দরজা বন্ধ। বারান্দার দরজা হাট করে খুলে রাখা। আজ অধরার প্রিয় বন্ধুর যদিও দেখা নেই তবুও অন্ধকারে আকাশ দেখছে অধরা। তার মন বলে এমন চাঁদ হীন আকাশ হলো মন খারাপ মন খারাপ আকাশ। সেই আকাশের দিলে তাকিয়ে তার বড়ো উদাস হতে ইচ্ছে হয়। আজ অবশ্য সে উদাস হয়নি। ঘরের আলো জ্বালিয়ে বারান্দার দরজা বরাবর ফ্লোরে বসে পার্থিব পড়ছে। ইয়া মোটা এক বই। কিন্তু অধরার ভীষণ পছন্দের। গল্পটা যেন একদম বাস্তব থেকে নেওয়া। প্রতিটা চরিত্র একদম চেনা। অধরা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। এরমাঝে তার ফোনটা বেজে উঠলো। অধরা বই থেকে চোখ সরালো। চোখমুখ কুঁচকে বিছানার উপর বাজতে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইলো। উঠতে ইচ্ছে করছে না। ভাবলো থাক। তার এতো দরকারি কল আসে না যে ধরতেই হবে। পরক্ষণেই তাওসিফের কথা মনে পড়লো। এবার আর বসে থাকতে পারলো না অধরা আসফিন। উঠে টেবিলে রাখলো বই। বিছানা থেকে ফোন নিয়ে স্ক্রিনে তাকালো। তাওসিফের কল দেখে হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। অধরা হাসিমুখে ফোন নিয়ে চলে গেলো বারান্দায়। রিং হতে হতে ততক্ষণে কল কেটে গেছে। অধরা অপেক্ষা করলো পরবর্তী কলের। তিন দিনেই দারুণ একটা বন্ডিং তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে। পুরো অবদান অবশ্যই তাওসিফের। অধরা আনমনে হেসে ফেললো। আবারও কল এলো। এবার দেরি না করে রিসিভ করলো অধরা। সে কিছু বলার পূর্বেই তাওসিফ বলে উঠলো,

“বই পড়া হচ্ছিলো বুঝি? বিরক্ত করে ফেললাম নাকি?”

“হ্যাঁ, বই পড়ছিলাম। আপনি কীভাবে বুঝলেন?”

“বুঝি বুঝি।”

তাওসিফ খুব ভাব নিয়ে বলল। অধরা হেসে উঠলো খিলখিল করে। বলল,

“কি বুঝেন?”

“তোমাকে!”

তাওসিফের নির্লিপ্ত উত্তর। অধরা থমকে গেলো। ধক করে উঠলো তার বুক। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেলো। ভেজা ঢোক গিলল সে। শ্বাস নিলো জোরে জোরে। তাওসিফ ওপাশ থেকে বুঝতে পারলো অধরার অস্থিরতা। সে মুচকি হাসলো। কিছু সময় চুপ থেকে পুনরায় বলল,

“অধরা, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো। তুমি যদি অনুমতি দাও তবে বলবো।”

অধরা অবাক হলো। কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা যে অধরার অনুমতি লাগবে। সে বিস্মিত স্বরে বলল,

“কি কথা?”

“তোমার অতীত নিয়ে।”

অধরা এবার ভয় পেয়ে গেলো। অধরার কি বোঝার ভুল? তাওসিফও অন্য সবার মতো। অধরার অতীতে তবে তাওসিফেরও সমস্যা। তবে কেন তিনদিন তার সাথে ঘুরলো-ফিরলো। কেন তার অতীত জানার পরই রিয়েক্ট করলো না। কেন অধরার মাঝে মায়া সৃষ্টি করলো। এক্সপেকটেশন তৈরি করলো। অধরার নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হতে লাগলো। শুধু একটা বাজে অতীতের জন্য আর কত কিছু বিসর্জন দিতে হবে তাকে। অনেকদিন পর তার কান্না পেলো। কিন্তু সে কখনো অন্যের সামনে নিজেকে দুর্বল প্রকাশ করবে না। তাই কান্না গুলো গিলে ফেললো অনায়াসে। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

“জি বলুন।”

তাওসিফ বুঝলো অধরার মনের ভাবনা গুলো। সে নিঃশব্দে হাসলো। সে বলে উঠলো,

“প্রথমেই বলে নেই তোমার অতীত নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। আর না কখনো সমস্যা হবে। বাট আমার কাছের কাউকে বিনা দোষে শাস্তি পেতে হবে আর অপরাধী খোলা বাতাসে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে ব্যাপারটা আমার ঠিক হজম হচ্ছে না।”

তাওসিফ থামলো। আলতো স্বরে ডাকলো,

“অধরা, শুনতে পাচ্ছো?”

তাওসিফের এতক্ষণে বলা কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো অধরা। এতক্ষণ মন খারাপ করে কান্না পাচ্ছিলো, এবার তার খুশিতে কান্না পেলো। একটা মানুষ তাকে নিয়ে এতো ভাবে? কিন্তু কেন? অধরা চোখ মুছে নেয়। কান্না লুকানোর চেষ্টা করে। যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখে উত্তর দেয়,

“জি পাচ্ছি।”

তাওসিফ বুঝলো অধরা কাঁদছে। এই ব্যাপারে এখন কিছু বলল না। পরে বুঝে নিবে। সে পুনরায় বলল,

“তোমার পুরো বর্ণনা অনুযায়ী, আবিরের ঘরে আসা, তোমার মেঝ চাচির দরজায় আসা এবং অহির সেদিন ছাদে না যাওয়া সব মিলিয়ে আমার মনে হয় এটা একটা ষড়যন্ত্র। কিন্তু ঠিক কিসের সেটা আমি বুঝতে পারছি না। অধরা তুমি কি কখনো খুঁজে দেখেছিলে কেন করা হলো এসব?”

অধরা পুরো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। সত্যিই তো! সে এভাবে কেন ভাবেনি এতোদিন। অধরা উত্তর দিলো,

“না! আমি এভাবে ভাবিই নি।”

“অধরা, লক্ষ্য করো। এই ঘটনার পর তোমার মানসিক অবস্থা, সব কিছু থেকে সরে যাওয়ার কারণে আমার মনে হয় সে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলো তা সফল হয়নি। সেহেতু সামনে তোমার বিয়ে, তুমি বাড়ি ছাড়বে। আমার মনে হয় যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তারা আবার এই বিষয়ে কথা বলবে। নতুন করে ছক সাজাবে।”

তাওসিফ থামে। অধরা নীরব শ্রোতা। তাওসিফ শ্বাস নিয়ে ফের বলে,

“এখন তোমার কাজ হবে একটু বেশি নিজের রুমের বাইরে থাকা। চোখ-কান খোলা রাখা। আমি আশা করছি তুমি জেনে যাবে ষড়যন্ত্র কারা করেছে এবং কেন করেছে। জাস্ট তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে।৷ আমি জানি তুমি নিজের ঘরের বাইরে স্বাচ্ছন্দ্যে বোধ করো না।”

অধরা নিশ্চুপ। তাওসিফ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার আলতো স্বরে ডাকলো,

“অধরা।”

“হু”

“শুনেছো কি বলেছি। পারবে?”

“পারবো।”

অধরার কন্ঠে দৃঢ়তা। তাওসিফ হাসলো। সে জানে অধরা পারবে। এবং তার অংক যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে পুরো রহস্য উদঘাটন হবে। তাওসিফ ঠোঁট বাকিয়ে বিরবির করে বলল,

“আবির! জাস্ট ওয়েট এন্ড সি। বেঁচে থাকা মুশকিল করে দেব তোর।”

—————————-
“আম্মা, বিয়ের তারিখ তো সামনে আগায় আসতেছে। কাকে কাকে দাওয়াত দেওয়া হবে আর আয়োজন নিয়ে তোমার মতামত দাও।”

নবনী আনজুম তার ছোট ছেলের দিকে তাকালেন। বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি। মন খারাপ করা কন্ঠে তিনি বললেন,

“আসফিন চলে যাবে ফয়জাল! আটকায় রাখতে পারলাম না?”

ফয়জাল হাসান হাসলেন। বললেন,

“মেয়েদের তো যেতেই হয় আম্মা। আমার মেয়েটা শুধু আগে আগে চলে যাচ্ছে। তবুও মেয়েটা ভালো থাকুক আম্মা। তিনদিন ধরে তাকে বেশ খুশিই মনে হচ্ছে। ছেলের খোঁজ নিয়েছি আমি। বেশ ভালো। পরিবারও ভালো। শুধু দোয়া করো মেয়েটা যেন সুখী হয়। আর গুমরে মরতে না হয়।”

নবনী আনজুম চোখ মোছেন। নাতনিটা তার কত প্রিয়, আদরের। তার জন্য দোয়ার কমতি হয় না কখনো। তিনি বিরবির করে বললেন,

“ভালো থাকবে। আমার আসফিন ফুলের মতো। যে যত্ন নিবে সে বুঝবে ফুলের কতোটা সুবাস।”

তারপর মা-ছেলে বসে বিয়ে নিয়ে মত বিনিময় করতে লাগলো।
—————————

অধরা বুঝতে পারছে না সে কিভাবে কি করবে। বাহিরে সে খুব কম যায়। খাবারটা অবধি টেবিলে খায় না। তবে সে জানবে কি করে? নিজের মনে ভাবতে ভাবতে অধরার মাথায় হুট করে একটা কথা খেলে গেলো। যখন সবায় একসাথে থাকবে তখন নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে কথা উঠবে না। তাহলে? তারমানে এমন সময় গুলো যখন বাড়ির সবায় যে যার ঘরে থাকে সেই সময়কে অধররা কাজে লাগাতে হবে। খুব সহজ করে বললে অধরাকে অন্যের ঘরের কথা আড়াল থেকে শুনতে হবে। মিশন শুরু হবে আগামীকাল থেকে। দেখা যাক! কি ফলাফল হয়।

#চলবে…?

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২০

“তাওসিফ, বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে অথচ তুই অধরাকে নিয়ে শপিং এ যাচ্ছিস না! বাকি সব আয়োজন সমানতালে এগোচ্ছে। বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়েছে, কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা হয়েছে এমনি কি কি করা হবে সব কিছুর একটা পরিকল্পনা করা হয়ে গেছে অথচ তুই এখনো মেয়েটাকে শপিং করতে নিয়ে যাচ্ছিস না কেন?”

তাওসিফ শুয়ে ছিলো বিছানায়। তাইফা কথা গুলো বলতে বলতে ছেলের ঘরে ঢুকলো। তাওসিফ মায়ের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ল রইলো। তাইফা চা হাতে দিতেই তাওসিফ ওষ্ঠ প্রসারিত করে বলে উঠলো,

“ধন্যবাদ মা।”

তাইফা চোখ কটমট ছেলের দিকে তাকালেন। তাওসিফ চায়ে চুমুক দিয়ে বাঁকা চোখে তাকালো মায়ের দিকে। তাইফা ছেলের কাঁধে মেরে বলল,

“খবরদার তাওসিফ। এভাবে রাগ কমবে না আমার। কি ভেবেছিস তুই হ্যাঁ? আমার একমাত্র ছেলের বউকে আমি বউ না সাজিয়ে ঘরে আনবো?”

“আমি সেটা কখন বললাম।”

“তাহলে শপিং করছিস না কেন?”

“করবো তো।”

তাইফা এবার সরু চোখে তাকালো ছেলের দিকে। তাওসিফ মুচকি মুচকি হাসছে। চোখ ছোট করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“কবে?”

এবার শব্দ করে হেসে উঠলো তাওসিফ। মনে মনে আওড়ালো জাদু জানে মেয়েটা। নাহয় তার জন্য তার সাথে তার বাপ, মা এমনকি দুই বোন পর্যন্ত ঝগড়া করে? মেয়েটা বাড়িতে পা না দিয়েই সব দখল করে নিয়েছে, না জানি এ বাড়িতে আসলে কি হবে। তাওসিফ তার মনের মাঝে চলা শেষ কথাটা বলেই দিলো,

“তোমার বউ মা ঘরে আসার পর আমার এ বাড়িতে জায়গা হবে তো মা।”

তাইফা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল,

“আমার বউমার মন মতো থাকলে জায়গা পাবি নাহয়….”

থামলো তাইফা। তাওসিফ ভ্রূ উঁচিয়ে তাকালো মায়ের দিকে। তাইফা হাতের আঙ্গুল দরজার দিকে করে ঠোঁট চেপে হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

“বাইরে।”

তাওসিফ হু হা করতে হেসে উঠলো। এক ফাঁকে ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করলো পরিচিত নাম্বারটায়।
—————————

মধ্য ভোজের আয়োজন চলছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে খাবারের সুবাস। ছেলে-মেয়েরা অনেকেই বাড়ি নেই। তাই হৈ হুল্লোড় তেমন নেই। অধরা নিজ ঘরে বসে আছে৷ সব ধ্যান সামনে থাকা খাতার পাতায়। যেখানে নানা রঙের মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে নতুন কোন শিল্প। অধরার গালে কোন ফাঁকে সবুজ রঙ লেগে গেছে। হাতে রঙের প্রলেপ। এসবে খেয়াল নেই তার। কপালে একটা মাছি পড়তেই হাত দিয়ে সরালো অধরা। কপালেও রঙ লেগে গেলো। তবুও একটু মনোযোগ অন্যত্র সরলো না। এরমাঝে ফোনটা বেজে উঠলো। অধরা শুনলো না। পরপর বাঝলো বেশ কিছু বার। কিন্তু বালিশের নিচে থেকে শব্দ অধরার কান পর্যন্ত গেলো না। অধরার চোখ, কান, মন সবার খেয়াল এখন শুধু এবং শুধুই সমানে থাকা কাগজের নগন্য টুকরোয়।

তাওসিফ বেশ কয়েকবার কল করারা পর যখন অধরা রিসিভ করলো না তখন বেশ অবাকই হলো সে। কি হলো আবার মেয়েটার? অধরাকে ওই বাড়িতে একটুও সেভ মনে হয় না তার।
———————————

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে গেছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে সবাই ঝিমোচ্ছে বোধহয়। নবকুঞ্জে নীরবতা। অধরা নিজের ঘর থেকে বের হলো। রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে একা একা বসে খেলো। ডাইনিং রুমে একা একা কিছুক্ষণ ঘুরলো। তারপর শুরু হলো তার মিশন। তার সন্দেহ তার মেঝ চাচিকে। তাই দেরি না করে সেই ঘরের দিকেই এগিয়ে গেলো। না হ! কোন সাড়া শব্দ নেই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সরে এলো সেখান থেকে। নিজের মায়ের ঘর, বড় চাচির ঘরের পাশ দিয়েও ঘুরে এলো। তবে জানতে পারলো না কিছু। অধরা আশা হারালো না। একদিনই সব জানতে পারবে এমন আশা করাটা বোকামি। সে শিস বাজাতে বাজাতে তার দাদুনির ঘরের দিকে এগোতে লাগলো। তখনই বাড়িতে প্রবেশ করলো আঁখি। অধরাকে শিস বাজাতে দেখে কতক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকলো। ধীর ধীরে এগিয়ে এসে বলল,

“তুই আসফিন?”

অধরা ভ্রূ বাঁকিয়ে তাকালো আঁখির দিকে। কোন উত্তর দিলো না। আঁখি গলা পরিষ্কার করে আবার বলল,

“তুই সত্যি আসফিন তো? না মানে আসফিন তো এমন বখাটেদের মতো শিস ফিস বাজায় না।”

অধরা সরু চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিলো। হাসলে আঁখিও। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো ছোট বোনকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“মন ভালো?”

“হু”

আঁখি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো। এমন হাসিখুশি মেয়েটা যখন নেতিয়ে পড়েছিলো সেই সময়ের স্মৃতি এসে ধাক্কা দিলো মানসপটে। আঁখি মনে মনে দোয়া করলো সব সময় যেন বোনটার দেহে প্রাণ থাকে। বেঁচে থেকেও মরে যওয়ার মতো আর না হয়। অধরাকে ছেড়ে তাট নাক টেনে বলল,

“খেয়েছিস?”

“তুমি তো আমার চেহারা দেখেই বুঝে যাও। তুমিই বলো।”

আঁখি হাসলো। দুই গাল টেনে বলল,

“খেয়েছিস। এখন দাদুনির রুমে যাচ্ছিস। আচ্ছা যা। আমিও ফ্রেস হয়ে আসছি।”

অধরা মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো তার দাদুনির রুমে আর আঁখি চলল নিজের রুমের দিকে।
—————————

ফোনটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মৃদু শব্দ হচ্ছে। কিন্তু তা কারো কানে পৌঁছাতে পারছে না। কারণ ঘরে কেউ নেই। ফোনের মালিক ফোন ঘরে রেখে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপরদিকে যে ফোন করছে তার অবস্থা নাজেহাল। তাওসিফ ভয়ে অস্থির। এই কয়েকদিন যতবার ফোনে কথা হয়েছে অধরা প্রথম বা দ্বিতীয় রিং এই কল রিসিভ করেছে। তবে আজ কেন করছে না। এতক্ষণে বোধহয় পঞ্চাশ এর বেশিবার কল গেছে অধরার নাম্বারে। কিন্তু কোন খোঁজ নেই মেয়েটার। তাওসিফ টেনশনে ঘেমে উঠছে বারবার। অবশেষে সে কল করলো আঁখির নাম্বারে। রিসিভ হলো। কিছুটা শান্ত হলো তাওসিফ। আঁখি হ্যালো বলতেই তাওসিফ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

“অধরা কোথায়? কেমন আছে? সব ঠিকঠাক?”

আঁখি অবাক হলো খুব। অধরাকে দেখে এলো খুশিতে বাক-বাকুম করছে তবে তাওসিফ এতো অশান্ত কেন? তাওসিফের গলার স্বর স্পষ্ট বলে দিচ্ছে সে ঠিক নেই। আঁখি ধীর কন্ঠে বলল,

“হ্যাঁ, সব ঠিকঠাক। কেন? কোন সমস্যা ভাইয়া?”

তাওসিফ জোরে শ্বাস নিলো। মৃদুস্বরে বলল,

“অধরাকে ফোনে পাচ্ছি না। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

“ও কে দেখলাম দাদুনির ঘরে যাচ্ছে। ফোন হাতে ছিলো না।”

তাওসিফ যেন এবার হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। বলল,

“উফস! আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আসলে ও সব সময় একবার, দুবার কল করলেই রিসিভ করে সেখানে আজ এতোবার দেওয়ার পরও যখন রিসিভ হচ্ছিল না তখন টেনশনে হচ্ছিল খুব।”

তাওসিফ থামলো। আঁখি ফোনের এবারে মুচকি হাসছে। তাওসিফ ফের বললো,

“তুমি তো জানো আমার অবস্থা! আমি ভয় পাই ভীষণ। ”

আঁখি হেসে বলল,

“সব সময় এমন থাকবেন ভাইয়া। কয়দিন ধরে আমার বোনটা হাসছে। একটু আগে শিস বাজাতে বাজাতে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো। মনে হচ্ছে আবার বাচ্চা অধরাকে ফিরে পেয়েছি। সব আপনার জন্য।”

তাওসিফ হাসলো। হাসিমুখে বলল,

“ভরসা রাখো।”

আঁখি কথা বলতে পারলো না। শুধু হু বলল। তাওসিফ আর কথা বাড়ালো না। বিদায় জানিয়ে কল কাটলো। আঁখির অবস্থা সে বোঝে। হাসিখুশি বোনকে খুঁজে পেয়ে কতটা খুশি তাও তাওসিফ বোঝে। ফোনটা রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে বসলো সে। শ্বাস নিলো জোরে জোরে। পরক্ষণেই ডান হাতটা নিয়ে রাখলো বুকের বাম পাশে। ঠিক হৃদপিণ্ডে উপর। ধুকপুক ধুকপুক শব্দটা এখনো আছে। তাওসিফ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। চোখ দুটো বন্ধ করে বিরবির করে বলে উঠলো,

“আর একটু হলে নির্ঘাত মরে যেতাম! তোমার অতীত নামক বিষাক্ত তীর গুলো একদম বুকে এসে ঢুকে গেছে নীরবতার রাণী। চাইলেও বের করতে পারছি না তাদের। এতো ভয় আমি কবে পেয়েছি সত্যি জানি না।”

তাওসিফ থামে। হৃৎস্পন্দনের স্বাভাবিক হয় ধীর ধীরে। ফুসফুসের কার্যক্রমও সঠিক অবস্থায় আসে। তবে ক্লান্তি যেন দূর হয় না। তাওসিফ পা দুটো সামনের টেবিলে উঠিয়ে দেয়। চেয়ারের পেছনে মাথা রেখে চোখ বুঁজে ফেলে। ঠোঁটে লেপ্টানো বাঁকা হাসি। তাওসিফ ফের বিরবির করে বলে উঠে,

“ভালোবাসি নীরবতার রাণী।”

#চলবে…?