#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২১
সূর্য সবে আকাশে উঁকি দিচ্ছে। জানালার সাদা পর্দা গুলো মৃদু বাতাসে দুলেছে। ধীরে ধীরে বারলো সূর্যের তেজ। এবার আলোকরশ্মি চোখে বাঁধলো এক ঘুমন্ত রাজকন্যার। চোখ কুঁচকে ফেললো সে। কিয়ৎকাল পর উঠে বসলো। চারদিকে তখন ভোরের সতেজ হাওয়া। অধরা মুচকি হেসে উঠে পড়লো বিছানা থেকে। এলেমেলো বিছানাটা আরো অগোছালো করলো তারপর ফ্রেস হতে গেলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানা গুছিয়ে নিলো। ঘরটাও গুছিয়ে ফেললো গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে। অতঃপর বারান্দায় গ্রীল ধরে দাঁড়ালো৷ তাকালো বাইরের দিকে। মনে পড়লো আজ শুক্রবার। সবায় বাসায় থাকবে। জাম জমাট একটা ভাব থাকবে আজ পুরো বাড়ি জুড়ে। অধরার বহুদিন পর মন খারাপ হলো। মনে পড়ে গেলো পুরনো দিনের কথা। স্মৃতির এলব্যামে চোখ বুলাতে বুলাতে অধরা গেয়ে উঠলো,
“পুরানো সেই দিনের কথা
ভুলবি কিরে হায়
ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা
সে কি ভোলা যায়…..”
মনটা উদাস হলো বড়ো। সেই উদাসী ভাব কাটাতেই বোধহয় সেই ক্ষণে মনে পড়লো এক মন মাতাল করা যুবকের কথা। যার চোখে চোখ রেখে অধরা বলে ফেলতে পারে হাজার খানিক কথা। অধরা এবার আনমনে হেসে উঠলো বেশ শব্দ করে। দৃষ্টি আবার গেলো গ্রীলের বাইরে। বাগানের করবী গাছে হলুদ ফুল। পাশে বসা দু’টি পাখি। গাঢ় বাদামী রঙের। একসাথে বসে কি সুন্দর ডেকে উঠছে। অধরা মায়া মায়া চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আবারো গান খেলা করছে মাথায়। এবার গুনগুনিয়ে নয় বরং শব্দ করে গেয়ে উঠলো,
“তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবে সঙ্গে থাক
সারাদিন, সারারাত
তুই আমাকে আগলে রাখ
ঠিক এভাবে সঙ্গে থাক
সারাদিন, সারারাত….”
অধরা থামে। ঠোঁট এলিয়ে হাসে। চোখ বন্ধ করে। ভসে উঠে তাওসিফের মুখখানা। অধরা গ্রীলের সাথে মাথা ঠেকায়। আবারো তার কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়ায় ঘড় জুড়ে,
“মেঘলা আকাশে, রংধনু হাসে
তুই এঁকে নে, তুই মেখে নে
মুখচোরা আলো, রাস্তা হারালো
তুই খুঁজে নে, মন বুঝে নে
আমি তোর আয়না হবো আজ
তুই শুধু ইচ্ছেমতো সাজ
আমি তোর আয়না হবো আজ
তুই শুধু ইচ্ছেমতো সাজ
রোদ্দুরে, যায় উড়ে, মন জাহাজ…….”
ফয়জাল হাসান মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। প্রায় প্রতিদিন সকালেই তিনি মেয়েকে দেখে তারপর অফিসে যান। আর ছুটির দিনে নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢোকেন। আজও ব্যতিক্রম হলো না। নাস্তা হাতে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন তিনি। বহুদিন পর শুনতে পেলেন মেয়ের খোলা কন্ঠে গেয়ে উঠা গান। তার মেয়েটা গান গাইছে। ফয়জাল হাসান বড়ো অবাক হলেন। চোখ দু’টোয় অশ্রু জমলো। তিনি টেবিলে নাস্তার প্লেট রেখে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়ে তখনো গাইছে। কি সুন্দর কন্ঠস্বর তার মেয়ের। ফয়জাল হাসান হাসলেন। তাওসিফ নামের ছেলেটার জন্য মন থেকে দোয়া এলো তার। সবশেষে দোয়া করলেন ছেলেটা যেন কখনো পরিবর্তন না হয়, তার মেয়েটাকে আগলে রাখে আজীবন। ঠিক গানের লাইন গুলোর মতো।
অধরার গান শেষ হতেই সে জোরে জোরে শ্বাস নিলো কয়েকবার। অনেক দিন পর গলা ছেড়ে গান গাইলো। শ্বাস আটকে আসছে মনে হলেও তার ভালো লাগছে। গলাটা শুকিয়ে গেছে। গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে শ্বাস নিতে থাকলো অধরা। ফয়জাল হাসান মেয়েকে দেখলেন কিছুক্ষণ। আলতো স্বরে ডেকে উঠলেন,
“আসফিন, মা!”
অধরা চোখ মেলে চাইলো বাবার দিকে। হাসলো আলতো ভাবে। মুচকি হাসি ঠোঁটে ধরে রেখে বলল,
“শুভ সকাল বাবা।”
“নাস্তা করবো আসো। আমার প্রচুর খিদে পেয়েছে।”
অধরা কথা বাড়ালো না। সত্যি বলতে তারো খিদে পেয়েছে কিছুটা। আর বাবা নামক মানুষটাকে বুঝানোর মতো কোন শব্দও তার নেই। এখন তাকে খেতে হবেয়। অধরা বিছানায় বসলে। ফয়জাল হাসান মেয়ের সামনে বসে রুটি ছিড়ে পায়েস দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলেন। মাঝে চললো বাবা-মেয়ের হাসি ঠাট্টা।
—————————-
তরুলতায় চলছে নাস্তার আয়েজন। ছুটির দিন নাস্তা বেশ দেরিতেই করা হয়। তরু-লতা বরাবরের মতো খাওয়ার মাঝেও ঝগড়া করছে। তাদের বাবা মেয়েদের সাথে মজা করছে। তাইফা হতাস চোখে তাকালো। বাবা পেয়েছে একটা। বকা তো দিবে না, ঝগড়া থামাতেও বলবে না। ডাইনিং থেকে সরে তিনি ছেলের ঘরের দিকে গেলেন। দরজায় টোকা দিয়ে ডাকলো,
“তাওসিফ, তাওসিফ। কিরে? উঠবি না? তোর বাবা অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
ভিতর থেকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে তাওসিফ বলে উঠলো,
“আসছি মা।”
তাইফা নিশ্চিত হয়ে আবার গেলেন ডাইনিং এ। ছেলের জন্য খাবার বাড়লেন। দাঁড়িয়ে রইলেন পাশে। আজ আরো একদফা ঝগড়া চলবে ছেলের সাথে। সে এখনো মেয়েটাকে নিয়ে শপিং করতে যায়নি!
——————————
নবকুঞ্জে শুক্রবারে মজার মজার সব খাবার রান্না করা হয়। একসাথে খেতে বসলে মনে হয় বাড়ি ভর্তি মেহমান। উৎসব মুখোর এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অনেকদিন সেই উৎসব উৎসব দিনটা অধরার দেখা হয় না। দেখার আগ্রহ জাগে না। আজ হঠাৎ দেখতে ইচ্ছে হলো। দুপুরে ডাইনিং টেবিল ভর্তি হয়ে যখন সবায় বসলো অধরা দোতলা দেখে এসে সেই ভরা টেবিলে তাকালো। ছোটদের দুষ্টমি, একে অপরের সাথে কথা বলা সব চোখ ভরে দেখতে লাগলো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে। হুট করে তার চোখ পড়লো আবিরের উপর। পুরনো স্মৃতি মস্তিষ্কে আঘাত করলো খুব জোরে। যেভাবে বল এসে বারি খায় ব্যাট’স ম্যানের ব্যাটে। অধরা দু’হাত মুঠো করে নিলো। জোরে জোরে শ্বাস নিলো কয়েকটা। ঘরে হাঁটা দিলো নিজের ঘরে। পিছনে ফিরে চাইলো না। তবে তার মিশনের কথ মনে রইলো। তার মন বলছে আজ সে কিছু জানতে পারবেই!
কেউ খেয়াল না করলেও আরহাম বোনকে খেয়াল করলো। বোনের মায়া মায়া মুখটা দেখেই সামনের প্লেটে থাকা নিজের প্রিয় বিরিয়ানি আর ভালো লাগছে না। বোনটার জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব। রোস্টের বাটির দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। অধরার ভীষণ প্রিয়। আরহাম অস্থির চোখে তাকালো আঁখির দিকে। আঁখি তাকাতেই ইশারা করলো সে। অধরার চলে যাওয়া দেখলো আঁখি। ইশারায় ভরসা দিলো সে খাবার শেষ করে নিয়ে যাবে। আরহাম কিছুটা স্বস্তি পেলো। তবে খাবারের স্বাদ আর পেলো না।
—————————-
নির্জন দুপুর। চারদিকে কোলাহল নেই। কর্মব্যস্ত দিনের কিছুটা অবসর সময়। সেই অবসরে ক্লান্ত গৃহিণী একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। নবকুঞ্জে ছোটদের একটু আকটু আওয়াজ পাওয়া গেলেও বাকি সব নীরব। ছোটরা ছাদের চিলেকোঠায় খেলছে, অধরা জানে। সে হাঁটতে লাগলো করিডর দিয়ে। আবিরের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গালাগালির শব্দ শুনতে পেলো। নিশ্চয়ই কোন বন্ধুর সাথে ঝগড়া করছে। তাই বলে এমন ভাষা? ছিহ! অধরা দাঁড়ালো না। পরে আবার একবার এসে ঘুরে যাবে নাহয়। এখন এই গালাগালি শোনা যাবে না। এগিয়ে গেলো সে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলো মেঝ চাচা-চাচির ঘরের সামনে। কথা শোনা যাচ্ছে। অধরা আরো কিছুটা দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো কি কথা হচ্ছে।
“এই কি হলো? আয়মান সাহেবের সাথে কথা বলেছো?”
মায়মুনার চিন্তিত স্বর। অধরা ভ্রূ বাঁকালো। আয়মান সাহেব! মানে তাদের পারিবারিক উকিল। তার সাথে মেঝ চাচার কি কাজ? অধরা অবাক হলো। আরো ভালো করে শুনতে চেষ্টা করলো। ফারুক হাসান চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো,
“তাকে আকারে ইঙ্গিতে বুঝাতে চেয়েছি কাগজটা লাগবে। সে সরাসরি বলেছে অধরাকে লাগবে।”
অধরার বুক ছলকে উঠলো। তাকে? তাকে কেন লাগবে? কিসের কাগজ? অধরা ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করে। মায়মুনা বলে উঠলো,
“ওনাকে টাকা দাও। তবুও কাগজটা চাই। চাই মানে চাই। ওই রিসোর্ট আমার লাগবেই!”
ফারুক হাসান বিরক্ত নিয়ে বলল,
“চাই বললেই পাওয়া যায়? তাহলে তো এতোদিন পেয়েই যেতে!”
মায়মুনা মুখ ঝামটি মেরে বলল,
“আমার পুরো পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছে তোমার ভাই। কত কষ্ট করে নাটক সাজিয়ে মেয়েটার চরিত্রে দোষ লাগালাম। ভাবলাম সবায় দূর দূর করবে তখন ওর সম্পত্তির ব্যাপার উঠবেই না। কিন্তু হলো উল্টো। তোমার ভাইয়ের মেয়ের উপর কি জবরদস্ত বিশ্বাস! মেয়ের কলঙ্ক সে চোখেও দেখে না। এখন কিভাবে পাবো ওই কাগজ? রিসোর্টা একবার পেয়ে গেলে কত লাভ ভাবতে পারছো?”
“পারছি। কিন্তু উপায় কোথায়? ভেবেছিলাম আয়মান সাহেব কাগজ চাইলেই দিয়ে দিবে। কিন্তু তিনি কোনভাবে আমাদের পারিবারিক সমস্যা আঁচ করেছেন। কোনভাবে কাগজ দিতে রাজি হচ্ছে না।”
আর, আর কোন কথ শুনতে পারলো না অধরা। কাঁপা কাঁপা পায়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। এতো অসহায় লাগলো নিজেকে। আর বুঝতে চাইলো মানুষের লোভের কারণ। কি নেই মেঝ চাচার? কিসের অভাব মেঝ চাচির! তবুও কেন এতো বড়ো ষড়যন্ত্র! কেন তাকে কলঙ্কে মাখালো। অধরা দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে উঠলো। তীব্র ঘৃণা এসে গ্রাস করলো তার মাঝে। মেঝ চাচা এমন একটা কাজ করতে পারলো! কিভাবে করলো? তার না দু’টো মেয়ে আছে! অধরা চোখ মুছলো। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আমাকে একটু শাসিয়ে বললেই বোধহয় কাগজে স্বাক্ষর করে দিতাম চাচি। আমার গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগানোর দরকার ছিলো না। আমার জীবন থেকে পাঁচটা বছর নষ্ট করার দরকার ছিলো না। ভুল যখন করেই ফেলেছেন তখন সেই কাগজ আর পাবেন না। আমি থাকতে তো কখনো না।”
অধরা নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠে দাঁড়ালো। বাবা-মায়ের রুমের সামনে গিয়ে ডেকে উঠলো,
“বাবা, একটু দাদুনির রুমে আসো। জরুরি দরকার।”
তুবা বিরক্ত হয়ে তাকালো। ফয়জাল হাসান দ্রুত শোয়া থেকে উঠে ঘরে ছাড়লেন। তার মেয়ে পাঁচ বছরে প্রথমবার ঘরে এসে ডাকলো তাকে। নিশ্চয়ই বড়ো কোন সমস্যা। দেরি না করে তিনি চলে গেলেন তার মায়ের ঘরে। অধরা তার দাদুনির পাশে বসা। ফয়জাল হাসান মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি হয়েছে মা?”
“আমার নামে থাকা সব সম্পত্তির কাগজ চাই আমার আব্বু এবং সেটা আজকেই। আয়মান আঙ্কেলকে বলো আমি তার সাথে তার বাড়িতে বিকেলে দেখা করবো। তাকে আসতে হবে না। আর আমি যে কাগজ নিচ্ছি সেটা বাড়ির কেউ জানবে না।”
ফয়জাল হাসান এবং নবনী আনজুম অবাক হলেন। অধরার কখনো সম্পত্তির ব্যাপারে আগ্রহ ছিলো না। তবে আজ কি হলো? ফয়জাল হাসান ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমাকে কি তাওসি……..”
“না বাবা, কেউ না। কেউ কিচ্ছু বলেনি আমাকে। আমি সব বলবো তোমাদের। তবে এখন না। প্লিজ আর প্রশ্ন করো না আমাকে। এটা রিকুয়েষ্ট আমার।”
ফয়জাল হাসান মেয়েকে উত্তেজিত করতে চাইলেন না। কয়েকটা কথা বলতেই কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে অধরা। ফয়জাল হাসান আলতো করে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন,
“আচ্ছা মা।”
কল লাগালেন তিনি আয়মান সাহেবকে। সব বললেন। আপত্তি জানালেন না উকিল সাহেব। অধরা চুপ করে দাদুনির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো। ফয়জাল হাসানকে নবনী আনজুম ইশারায় চলে যেতে বললেন। ছেলে চলে যেতেই নাতনির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে আসফিন? আমাকে বলবে?”
অধরা আহ্লাদ পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“এই পৃথিবীর মানুষ গুলে এতো লোভী হয় কেন দাদুনি? তাদের লোভ যে কারো জীবন নরক বানিয়ে দিতে পারে সেটা তারা বোঝে না কেন?”
#চলবে….?
#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২২
বিকাল বেলা। নবকুঞ্জে হৈ চৈ শুরু হয়েছে। অধরা কোন দিকে পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো৷ সোজা চলে গেলো তার দাদুনির রুমে। নবনী আনজুম তসবিহ হাতে যিকির করছিলেন। অধরাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি তসবিহ পাশে রাখলেন। মুচকি হেসে বলে উঠলেন,
“যাচ্ছ আসফিন?”
অধরা কোন কথা না বলে দাদুনির পাশে বসলো। দাদুনির দিকে তাকিয়ে বলল,
“দাদুনি, আমি যদি সেসব কাগজপত্র নিয়ে নিজস্ব কোন সিদ্ধান্ত নেই তুমি কি রাগ করবে?”
নবীন আনজুম হাসলেন। অধরার গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল,
“ওসব তোমার আসফিন। তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারো। কোন বাঁধা নেই।”
অধরা মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ দাদুনি। আসি।”
নবনী আনজুম বিনিময়ে হাসলেন। অধরা বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
———————
কোতোয়ালি থানার বাম পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা র সাথেয় আয়মান সাহেবের বাসা। বেশ বড়ো বাড়ি। বিশাল বাগান আছে। আছে একটা পুকুরও। অধরা পিচঢালা রাস্তা পারি দিয়ে এগিয়ে গেলো। দরজা খুললো মিষ্টি একটা মেয়ে। সে মুচকি হেসে বলল,
“আসফিন আপু?”
“হ্যাঁ!”
“আসো ভিতরে আসো। অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্য। বাবাকে আসতে বলছি।”
অধরাকে সোফায় বসিয়ে সে দুই পা এগিয়ে আবার পিছে ফিরে এলো। ভ্রূ নাচিয়ে বলল,
“চা না কফি?”
“চা।”
অধরা মুচকি হেসে জবাব দিলো। মেয়েটা হেসে বলল,
“বাবা ঠিকই বলেছিল তুমি বেশি চুপচাপ। আমার নামটা অবধি জিজ্ঞেস করলে না। আমি আয়রা। শোন, বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে আমার সাথে আড্ডা দিও কিছুক্ষণ।”
অধরা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। আয়রা হাসতে হাসতে চলে গেলো। কিছুক্ষণ বাদেই নেমে এলো আয়মান সাহেব। অধরা দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিলো। আয়মান সাহেব মৃদু হেসে বলল,
“বসো মা। কেমন আছো তুমি?”
“ভালো আছি আঙ্কেল।”
অধরার মৃদু স্বর। আয়মান সাহেব হাসলেন। মেয়েটা শান্ত খুব। তিনি জানেন। নাহিদ হাসান তার ভীষণ ভালো বন্ধু ছিলো। তিনি বেঁচে থাকতে নবকুঞ্জে প্রায় যাওয়া আসা করতেন তিনি। ছোটবেলা থেকে মেয়েটাকে দেখছে। শান্ত মেয়েটার হঠাৎ কি কাজ তার কাছে তিনি ধারণা করতে পারলেন না। তিনি হেসে বললেন,
“কোন দরকার মা?”
“জি আঙ্কেল।”
“বলো।”
অধরা চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো। এরমাঝে চা নিয়ে এলো আয়রা। চা দিয়ে চলে গেলো। আয়মান সাহেব বলল,
“চা নাও মা।”
অধরা চায়ে চুমুক দিলো। চায়ের কাপ আবার আগের জায়গায় রেখে বলল,
“আমার নামে থাকা সম্পত্তি গুলোর কাগজ গুলো আমাকে দিন আঙ্কেল। আর একটু বলে দিন কোথায় কোথায় সম্পত্তি আমার?”
আয়মান সাহেব কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অধরার দিকে। তারপর বলল,
“তোমার মেঝ চাচাকে কি তুমি কাগজ গুলো নিতে বলেছিলে?”
অধরা চুপ থাকলো। কোন কথা বলল না। আয়মান সাহেব বুঝলো অধরা বলতে চাইছে না। তিনি এ নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না। বললেন,
“একটু দাঁড়াও। আমি আসছি।”
অধরা মাথা নাড়লো। আয়মান সাহেব উঠে চলে গেলেন। অধরা চুপ করে বসে রইলো। কিছু সময়ের মধ্যে ফিরে এলেন তিনি। হাতে একটা ফাইল। অনেক গিলো কাগজ ওখানে। অধরা মুচকি হেসে বলল,
“সবার কাগজ?”
আয়মান সাহেব হাসলেন। মুখে বললেন,
“হুম।”
অধরা তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নতুন গুলো কপি করা। মানে আসল কাগজ নিয়ে নেওয়া হয়েছে। বড়ো আপু, বড়ো ভাইয়ার কাগজ তাদের কাছে?”
আয়মান সাহেব মাথা নাড়িয়ে এবারো সহমত পোষণ করলেন। অধরা চুপ থাকলো এবার। আয়মান সাহেব তার কাগজ গুলো বের করে টেবিলে রাখলো। অধরার সামনে। কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল,
“কক্সবাজারে একটা রিসোর্ট আছে তোমার দাদুর। সেটা সম্পূর্ণ তোমার। রিসোর্টের টাকা সব জমা হয় ব্যাংকে। ম্যানেজার তোমার দাদুর পছন্দের একজন মানুষ। তিনি কর্মচারীদের বেতন দেন এবং দরকারি কাজে টাকা ব্যবহার করেন। বাকি টাকা ব্যাংকে রাখা হয়। তোমার একাউন্টে।”
অধরা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“আমার একাউন্টে মানে? আমার তো কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই!”
আয়মান সাহেব হাসলেন। অধরার চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোমাদের কম্পানির ৮০ পার্সেন্ট শেয়ার তোমার বাবা চাচাদের। সবার ২০% করে। তোমার ছোট ফুপুর ১০%। বাকি ১০% কার জানো?”
“নাহ।”
আয়মান সাহেব আবার হাসলেন। বললেন,
“তোমার।”
অধরা এবার বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলে উঠলো,
“কিহহহহ!”
আয়মান সাহেব হাসলেন। কথা বললেন না। অধরা বসলো। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি সত্যি বলছেন?”
আয়মান সাহেব কাগজ এগিয়ে দিলো তার দিকে। অধরা তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দাদু কি কোন অন্যায় করেছে অন্যদের সাথে?”
আয়মান সাহেব মাথা নাড়লেন,
“নাহ, ওদের সম্পত্তির পরিমাণ অনেক। যা ইচ্ছে করতে পারে ওরা। তোমাকে তোমার দাদু ভালোবাসতেন খুব। তার পছন্দের জায়গা তোমাকে দিয়েছে। অন্যদের প্রতি অন্যায় হবে কেন? তোমার বড়ো ভাইয়ার নামে আছে বিশাল এক বাগান বাড়ি। জমিও আছে। তেমন তোমাকেও দিয়েছে। অন্যায় কোথায়?”
অধরা চুপ থাকলো। আবার প্রশ্ন করলো কিছু পরে,
“কোম্পানির ১০% শেয়ারের টাকা?”
“তোমার একাউন্টে।”
“আমার একাউন্ট!”
অধরাকে অসহায় দেখালো। আয়মান সাহেব হাসলেন। বললেন,
“তোমার দাদুনি জানে।”
অধরা মাথা নাড়লো। বলল,
“আমি তাহলে যাই আঙ্কেল?”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন তিনি। অধরা বের হলো। আয়রা সামনে পরলো। সে কিছু বলার আগে অধরা বলে উঠলো,
“আমি আর একদিন এসে তোমার সাথে কথা বলবো। আজকে যাই প্লিজ। মাথায় চাপ পরে গেছে।”
আয়মান সাহেব ঘরে থেকে বেরিয়ে এসে তার মেয়ের পাশে দাঁড়ালো।৷ বলল,
“আজ আপুকে যেতে দাও।”
আয়রা মুচকি হেসে বলল,
“বাই আসফিন আপু।”
অধরা বাই বলে চলে এলো। রিকশায় বসে সে পুরো ঘটনা মাথায় সেট করতে লাগলো।
তার দাদা নাহিদ হাসান। তার বাবার দাদা নাইমুল হাসান। নাইমুল হাসানের বাবা অর্থাৎ, নাদির হাসান ছিলো একজন বিরাট জমিদার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় জমিদারের বংশধররা তাদের বাপ দাদার সম্পদ নষ্ট করে। কিন্তু উল্টো ঘরে নাদির হাসানের ক্ষেত্রে। তার ছেলে নাইমুল হাসান সম্পত্তি নষ্ট ডো দূর বরং আরো বাড়ায়। তার একমাত্র ছেলে নাহিদ হাসান সম্পূর্ণ সম্পত্তির মালিক হয়। নাহিদ হাসান নিজ যোগ্যতায় নিজস্ব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। বাপ-দাদার সম্পত্তিয় হাত দিতেই হয়নি তার। প্রায় দুইশত শতক সম্পত্তি পড়ে থাকলো এমনি। তিনি তার আট সন্তানের জন্য নিজের তৈরি ব্যবসা, বাড়ি সব সম ভাবে দিয়েছেন। আর তার পৈত্রিক সম্পত্তি আট সন্তানের সকল ছেলে-মেয়ের জন্য বরাদ্দ করেছেন। বাচ্চা জন্মানোর পরপরই তিনি তার নামে উইল করে আয়মান সাহেবের কাছে কাগজ রেখে দিতেন। আাঠারো হয়ে গেলে সে তার কাগজ নিতে পারতো। কিন্তু কোম্পানির শেয়ার! অধরা সত্যি অবাক হয়ে গেছে। কেমনে কি হলো? দাদু তার জন্য এতসব করলো কেন?
বাড়ি পৌঁছেয় দাদুনির রুমে চলে গেলো অধরা। দাদুনির পাশে বসে ছুড়ে দিলো প্রথম প্রশ্ন,
“কোম্পানির শেয়ার কেন?”
“তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় ছিলো তোমার দাদুর। তুমি জানো কেমন ব্যবহার করা হতো তোমার সাথে। ধরো যদি কোন ভাবে তোমার বাবাও তোমার মায়ের সাথে তাল মিলাতো তখন? তোমার দাদু ভালোবাসতো তোমায়। কোন রিস্ক নিতে চায়নি সে।”
অধরা হাসলো। এবার বলল,
“আমার একাউন্ট?”
“তোমার নামে খোলা। পাসওয়ার্ড তোমার আর আমার জন্মদিন।”
অধরা সরু চোখে তার দাদুনিকে দেখে বলল,
“কত টাকা আছে বলোতো?”
দাদুনি ঠোঁট চেপে হাসলেন। বললেন,
“চেক করে নিও।”
অধরা উঠে যেতে বলল,
“হু, দেখে নিব।”
উপরে যেতে যেতে অধরা কল করলো তাওসিফের নাম্বারে। তাওসিফ অপেক্ষায় ছিলো। কল রিসিভ করেই বলে উঠলো,
“অধরা! কি হয়েছে? কাল থেকে ঠিকঠাক কল উঠাচ্ছো না? ইজ এভরিথিং ওকে?”
অধরা মুচকি হাসলো। বলল,
“জি সব ওকে। দেখা করতে পারবেন? আপনার মিশন সম্পূর্ণ করেছি।”
তাওসিফ উত্তেজিত বোধ করলো। বলল,
“সত্যি?”
“হু।”
“বলোওও।”
“ফোনে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এমনিও দেখা করতে হবে। শপিং করছি না বলে আমাকে তোমার শাশুড়ি দিনরাত বকা দিচ্ছে।”
অধরা হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,
“পরে কল করি? বাইরে থেকে আসলাম।”
“ওকে। কাল দেখা হচ্ছে।”
#চলবে….?