#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২+৩
পাথর ঢালা রাস্তা পার হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো অধরা। সন্ধ্যার নাস্তার আয়োজন করা হচ্ছে। রান্নাঘরে ব্যস্ত বাড়ির চার বধূ সাথে অধরার ছোট ফুপি। ডাইনিং এ দেখা হলো বড়মার সাথে। অধরাকে দেখে তিনি মুখ বাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। অধরার মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। কোন প্রতিক্রিয়া সে দেখালো না। অভ্যস্ত হয়ে গেসে এসবে। সে এগিয়ে গেলো সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ির সামনে এসে একপলক তাকালো সিঁড়ির পাশের ঘরটির দিকে। কি মনে করে আবার সেদিকে এগিয়ে গেলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আলতো স্বরে বলল,
“দাদুনি, আসবো?”
নবনী আনজুম বিছানায় শুয়ে ছিলেন। অধরার কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই উঠে বসার চেষ্টা করলেন। মুখে বললেন,
“কে? আসফিন? ভিতরে আসো।”
অধরা হাসলো। তার পুরো নাম অধরা আসফিন। অসফিন বলে তাকে সাধারণত বাড়ির মানুষ গুলো ডাকতো। এখন ডাকে দাদুনি,বাবা, বড় ভাইয়া, বড় আপু, সেজ আপা! বাকিরা তাকে ডাকতেই বোধহয় লজ্জা পায়। অধরা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। আর ভাবলো না। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। নবীন আনজুমকে বসতে সাহায্য করলো। হেসে বলল,
“এতো ব্যস্ত হয়ে পরো কেন? আমি কি চলে যাচ্ছি? ”
নবীন আনজুম মলিন হাসলেন। মলিন কন্ঠে বললেন,
“যাচ্ছোয় তো দাদু ভাই। আটকে তো রাখতে পারলাম না।”
অধরা হাসলো। নবীন আনজুমের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো সে। হাসিমুখে বলল,
“হাস্যকর কথা দাদুনি। তোমার ধারণা এতো সহজে আমার বিয়ে হয়ে যাবে? বাকি সবার মতো এটাও ভাগবে দেখে নিও।”
নবীন আনজুম নাতনির দিকে তাকালেন। তার নাতি-নাতনির সংখ্যা বিশ পার। তবে তার সবচেয়ে প্রিয় এই মিষ্টি মেয়েটা। অধরার দাদুও তার এই নাতনিকে ভালোবাসতেন খুব। আর তাই….। নাহ, আর ভাবলেন না। তিনি আলতো হাতে অধরার মুখমণ্ডল ছুঁয়ে দিলেন। বললেন,
“কেন তুমি এভাবে বিয়ে ভেঙে দাও আসফিন? এ বাড়িতে তো তোমার কিছু নেই। চলে গেলেই পারো।”
“তুমি আছো না?”
“মজা করো না।”
অধরা উঠে বসলো। দাদির হাতে হাত রেখে গম্ভীর স্বরে বলল,
“বিয়ে ছেলেখেলা নয় দাদুনি। জীবনের সাথে জীবন জুড়ে দেওয়া সহজ কথা নয়। আমার সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে হবে না তাকে? সত্য তো ঢাকা থাকবে না। এ বাড়িতে বেড়াতে আসলে সবার মুখোশ খুলে যাবে। তখন সব জানার পর সেও যদি ভুল বোঝে আমাকে! এমন ভুল বোঝাবুঝির আর একটা অধ্যায় চাই না আমি দাদুনি।”
নবীন আনজুম কথা হারিয়ে ফেললেন। কি আর বলবেন তিনি? অধরা কথা পাল্টে ফেললো,
“দাদুনি, নাস্তার টেবিলে যাবে না?”
“তুমিও চলো।”
অধরা হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
“আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।”
নবীন আনজুম কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকলো নাতনির দিকে। মাথায় হাত রেখে বলল,
“কেন মিথ্যে বলো আমায়? জানোনা তোমার চোখ আমাকে বলে দেয় তোমার মনের সব কথা।”
অধরা কিছু বলল না। চুপ করে থাকলো। নবীন আনজুমও নীরব থাকলেন। অতঃপর বললেন,
“চলো।”
অধরা কথা বাড়ালো না। দাদুনির সাথে সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত এলো। অধরা সিঁড়িতে উঠতেই মেঝ আপু অহি এসে দাদুনির হাত ধরলো। অধরা এক পলক চাইলো সেদিকে। চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। দশ-বারোটা সিঁড়ি পার হতেই সেঝ আপু আঁখি হাত ধরে ফেললো অধরার। অধরা তাকাতেই বলল,
“এখন নাস্তার সময়। এটাও মনে করিয়ে দিতো হবে? উপরে উঠছিস কেন? নিচে চল।”
“আমি বাইরে থেকে এসেছি সেঝ আপা। ফ্রেস হয়নি।”
আঁখি ছোট ছোট চোখে অধরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঘরে গেলে তুই যে আর আসবি না আমি জানি না সেটা? কোন কথা বলবি না। খবরদার আসফিন।”
অধরা মলিন হাসলো,
“কেন জেদ করো আপা?”
আঁখি কিছু বলার আগেই সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা গেলো বাড়ির বড় ছেলে আরহাম কে। আরহাম ওদের সামনে এসে ভ্রূ কুচকে বলল,
“কি হয়েছে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন সিঁড়ির মাঝে।”
আঁখি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখো না ভাইয়া আসফিন খেতে যাচ্ছে না।”
অধরা অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি ভাইয়া, আর ফ্রেস ও হয়নি।”
আঁখি বলে উঠলো,
“খবরদার মিথ্যা বলবি না আসফিন।”
অধরা নিরুপায় হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে শুধু ডাকলো,
“ভাইয়া!”
আরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওই ভাইয়া ডাকটার মাঝে যে কত কথা লুকিয়ে আছে, আরহাম জানে। জানে আঁখিও। আরহাম আলতো স্বরে বলল,
“ওকে ছাড় আঁখি।”
আঁখি ছেড়ে দিলো অধরার হাত। অধরা ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। আঁখি অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমার আর ভালো লাগে না ভাইয়া। সত্যি আর ভালো লাগে না।”
আঁখি চোখ মুছতে মুছতে নিচে নেমে গেলো। আরহাম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে এতো নিরুপায় কেন?
————–
নবকুঞ্জের ডাইনিং রুমে জমজমাট আয়োজন। জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে প্রতিবার খাবার টেবিলেই মনে হয় এ বাড়িতে কোন উৎসব চলছে। বাড়ির বউরা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। ছোটরা হট্টগোল করে খাচ্ছে। আরামের প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন তহুরা; আরহামের মা। আরহাম দিরাজ স্বরে বলে উঠলো,
“আর একটা প্লেটে খাবার দাও মা।”
তহুরা আড়চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি বুঝলেন ছেলে কার জন্য খাবার দিতে বলেছে। তিনি চুপচাপ দিয়ে দিলেই ব্যাপারটা মিটে যেত, কিন্তু তিনি তা চাননি। তার বড় ছেলে-মেয়ে দু’টো কেন যে ওই ন*ষ্টা মেয়েটার জন্য এতো দরদ দেখায় তিনি সেটায় বুঝতে পারেন না। তিনি চাননা কোন ভাবেই এই দরদ বেশিদূর এগোক। তিনি ভ্রূ বাকিয়ে বললেন,
“কার জন্য খাবার আব্বা?”
আরহাম স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“আসফির জন্য।”
তহুরা কিছু বললেন না। তিনি শুধু আগুনে ঘি ঢেলেছেন। এখন চেতে উঠবে মেঝ বউ আর অধরার মা। তহুরার ভাবনা অনুযায়ী চেচিয়ে উঠলো মিসেস তুবা, অধরার মা। ক্ষ্যাপাটে স্বরে বলে উঠলো,
” সে কোন রাজার রাজকন্যা? নিজে এসে খেতে পারে না? বড় ভাইয়কে তার খাবার ঘরে নিয়ে যেতে হবে? এতো রং, ঢং সে কোথায় পায়? বিকালে যে নাচতে নাচতে বের হলো, তখন আলসেমি কোথায় ছিল?”
মেঝ বউ মায়মুনা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু সুযোগ পেলো না। তার আগেয় আরহাম ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠলো,
“আমার বোনকে আমি খাবার দিয়ে আসছি তাতে সবার এতো জ্ব*লে যাচ্ছে কেন? আর রইলো এই টেবিলে এসে খাওয়ার কথা? আপনারা অতি ভালো মানুষ তো, তাই আমার বোন টেবিলে এসে একটা দানাও মুখে দিতে পারে না।”
আর কথা বাড়ালো না আরহাম। অমা*নুষদের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। নিজের প্লেটটি হাতে নিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেলো আরহাম। ডাইনিং টেবিলে বসা বয়সে বড় মানুষ গুলো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো আর ছোটদের মাঝে বেশিরভাগ সবাই খুশি হলো, আয়েশ করে খেতে বসলো তারা। তবে সবাই কি খুশি হয়? তাদের মাঝেও কয়েকজন জ্ব*লে গেলো!
আরহাম খাবারের প্লেট নিয়ে অধরার ঘরে ঢুকে দেখলো অধরা সবে ফ্রেস হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। অধরা ভাইকে ঘরে দেখে অবাক হলো। ওয়াশরুমে থাকায় সে এতক্ষণের ঝগড়া শুনতে পায়নি৷ আরহাম আলতো হেসে বলল,
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এসে খাটে বস।”
অধরা ভাইয়ের কথা অনুযায়ী খাটে বসলো। আরহাম হাঁটু গেড়ে নিচে বসলো। পাকোড়া ভেঙে ফু দিলো। তারপর বোনের মুখের সামনে তুলে ধরলো। ভাইয়ের প্রতিটি কাজ সূক্ষ্ম চোখে পরোখ করলো অধরা। তার হুট করে খুব কান্না পেয়ে গেলো। এই যে তাকে কয়েকটা মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে, তার অবাক লাগে। যেখানে তার মা তাকে অবিশ্বাস করে সেখানে এই মানুষ গুলো কি করে এতো বিশ্বাস রাখে তার উপর। অধরা ফুঁপিয়ে উঠলো। আরহাম কোন কথা বলল না। বোনের মুখে পাকোড়া দিয়ে অন্যহাত দিয়ে চোখ মুছে দিলো।
অধরার ছোট ফুপি ফৌজিয়ার ছোট ছেলে নীরব, বয়স কেবল ছয় বছর। আরহাম উপরে উঠে যেতেই তাকে পাঠানো হয়েছে কি হচ্ছে দেখতে। নীরব নীরবে এসে নীরবে নেমে গেলো। ছোট মানুষ সে৷ যা দেখেছে তাই অনায়াসে বলে দিলো,
“অধুপু কাঁদছে, ভাইয়া অধুপুকে খাইয়ে দিচ্ছে আর চোখ মুছে দিচ্ছে।”
কথাটা বলেই নীরব খাবারে মন দিলো। ফুঁসে উঠলো তহুরা। তার ছেলে ওই মেয়েটাকে খাইয়ে দিচ্ছে? এবার মেঝ সুযোগ মিস করলো না। বলে উঠলো,
“ন*ষ্টা মেয়ে! শান্তি দিবে না? একবার বদনাম রটায় লজ্জা হয় নাই; আবার দেখো না রং।”
মিসেস তুবার কানে কথা গুলো প্রবেশ করতেই ঝা ঝা করে উঠলো তার কান। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি। হনহন করে উঠে গেলেন অধরার ঘরের দিকে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো ছোটদের। নীরব এতক্ষণে বুঝলো সে বোধহয় ভুল কিছু বলে ফেলেছে, আচ্ছা অধুপুকে কি এখন মারবে? সে অসহায় চোখে তাকালো পাশে বসা তার বোন নিহা আর অধরার ছোট বোন অরুমিতার দিকে। ওদের দুজনের চোখেমুখে ভয়। আঁখি বসে থাকতে পারলো না, উঠে ছুট লাগালো তুবার পিছে পিছে, সেই সাথে উঠে দাঁড়ালো আরাব। অণিতা, অহি ও তুফা বুঝতে পারলো না উঠবে নাকি বসে থাকবে এখানে? অপর দিকে তহুরা ও মেঝ বউ মায়মুনা ঠোঁট বাকিয়ে হাসতে লাগলো। হাসতে লাগলো আরও দুজন। তবে নীরবে। বাড়ির সেঝ বউ আয়শাও ছুট লাগালেন উপরে। না জানি কি অঘটন ঘটায় তুবা! নবনী আনজুমের কলিজা ধরফর করে উঠলো। তিনি চিৎকার করে থামাতে চাইলো তুবাকে, পারলো না৷ এবার অনুরোধ করতে লাগলো কাউকে তাকে উপরে নিয়ে যেতে, একা একা উঠতে পারেন না তিনি। কিন্তু কেউ তার কথা শুনলো না। নবনী আনজুম দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে তার!
মিসেস তুবা ঘরে ঢুকেই আরহামের হাতের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন নিচে। কাচের প্লেটটি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেলো। খাবর গুলো ছিটকে পড়লো দূরে। মিসেস তুবা খাট থেকে অধরা কে নামিয়ে ঢাক্কা দিয়ে ফেলো দিলেন ভাঙা কাচের টুকরো গুলো মাঝে। আঁখি ছোটমা বলে চিল্লিয়ে উঠলো। ভাবান্তর হলো না তুবার মাঝে। কাচের টুকরোর মাঝে পড়ে থাকা অধরাকে একের পর এক থা*প্পর, লা*থি মারতে লাগলেন। আরহাম হাত ধরে থামালো তাকে। কিন্তু তিনি যেন থামতে চাইলেন না। মুখে অশ্রাব্য সব গালি দিতে লাগলেন। বারবার বলতে লাগলেন,
“ম*রে যাস না কেন তুই? বল কেন? সহ্য হয় না তোকে। আর কত জ্বা*লাবি তুই? ম*রে যা। ল্যাটা চুকে যাক।”
ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় সবাই। আরহামের মা এসে জোড় করে আরহামের হাতে টেনে দূরে নিয়ে গেলো। ছাড়া পেয়ে মিসেস তুবা নির্মমের মতো আঘাত করে গেলো সবে বিশে পা দেওয়া মেয়েটাকে। অধরা নিশ্চুপ। কাচ দুহাতে গেথে গেছে, মুখ বাঁচাতে পুরো হাত বিছিয়ে দিয়ে রেখেছে সে। জ্ব*লছে হাত কিন্তু সে নীরব। একটা টু শব্দও করলো না। মিসেস তুবা শেষে জোড়ে দুটো লা*থি মেরে বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। সাথে বের হয়ে গেলো তহুরা, আরহামকে আর তুফাকে টেনে নিয়ে। অণিতা ও অহিও বের হয়ে গেলো। ছোটরা ভয়ে উপরে আসেনি। মায়মুনা আর তার ছেলেও আসেনি। ঘরে থাকলো কেবল আঁখি, আরাব আর তাদের মা। আঁখি অধরাকে বিছানায় উঠালো। আরাবকে বলল,
“ফাস্ট এইডস বক্স নিয়ে আয়।”
আঁখির চোখ দিয়ে অনবরত গড়িয়ে পরছে জল। আয়েশা বহুকষ্টে চোখের জল আটকে রাখলেন। মেয়েটার হাতের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তিনি জড়ানো কন্ঠে বলল,
“ঠিক করে ব্যান্ডেজ করে দিও আঁখি।”
আর কিছু বলতে পারলেন না। চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। অধরা বিছানয় শুয়ে হাসলো। হেসে বলল,
“আ’ম ওকে সেঝ আপা। তুমি যাও।”
আঁখি কোন কথা বলল না। আরাব আসতেই সদর্পণে বের করতে লাগলো কাচের টুকরো গুলো। আরাব বের হয়ে গেছে তখনই। আঁখি সুন্দর করে ব্যান্ডেজ করে দিলো ধীরে ধীরে। ক্লান্ত অধরার চোখে তখন ঘুম। আঁখি একটা ব্যাথার ঔষধ দিলো, এরপর বলল,
“ঘুমা। কিছু লাগলে আপাকে ডাকিস। ঠিক আছে?”
অধরা মাথা নাড়লো। আর কথা না বলে চোখ দুটো বুঁজে ফেলল। আঁখি বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নীরবে কাঁদতে লাগলো। বোনটার জীবনে নতুন সূর্যদয় কবে হবে?
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে ধরায়। রাতের খাওয়া দাওয়া সমাপ্ত ঘটেছে নবকুঞ্জে অথচ কেউ খবর নেয়নি বাড়ির একটা মেয়ের। নেয়নি বললে ভুল হয়ে যাবে আবার। নবনী আনজুম খাবার খাননি আজ। আদরের নাতনিটা যে ঘুমে। আঁখি বেশ কয়েকবার ডেকেছে। উঠেনি অধরা। আরহাম উসখুস করেছে। কিন্তু বাড়ির অন্যদের তেমন যায় আসেনি।সন্ধ্যায় নির্মম অত্যা*চার করার পরও তাদের মাঝে দয়া হয়নি একটুও। খাওয়া শেষে যে যার রুমে ঘুমোতে চলে গিয়েছে। অধরার বাবা ফয়জাল হাসান আজ বাড়ি নেই। ব্যবসায়িক কাজে বাইরে গেছেন। সুযোগটা তাই আজ পেয়েছিল বাড়ির কুৎসিত মানুষগুলো।
রাত তখন এগারোটা। অরুমিতা ধীর পায়ে বোনের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে চলার চেষ্টা করছে সে, যাতে কেউ বুঝতে না পারে। তখনই নিহা বের হলো তার ঘর থেকে। সে কিছু বলার পূর্বেই হাতের ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল অরুমিতা। নিহা চুপ হয়ে গেলো। নিহার হাত ধরে অরুমিতা অধরার ঘরে প্রবেশ করলো। দরজা হালকা চেপে দিলো। এবার নিহা ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“অধুপুর ঘরে এসেছিস কেন?”
অরুমিতা উত্তর দিলো না। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বোনের কাছে। ঘুমন্ত অধরাকে দেখে তার ভীষণ মায়া হলো। অরুমিতা আলতো হাসলো। মায়া তার প্রতিদিনই হয়, আজ নতুন নয় অবশ্য। সে আলতো হাতে বোনের কপাল ছুঁয়ে দিলো। নিহা বুঝলো না কেন অরু অধুপুর কপালে হাত দিচ্ছে? অধুপুর তো হাতে ব্যাথা। কিন্তু প্রশ্নটা করলো না। নিহা জানে না গোপনে হলেও বোনের প্রায় সব খেয়াল রাখে অরু। সে জানে তার বোনের হুটহাট জ্বর আসে। আজও এসেছে। অরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বোনের হাতের ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে দিলো। তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। ফিসফিস করে বলল,
“বেশি ব্যাথা করে আপুই?”
নিহা অবাক হলো। সে আগে কখনো অরুমিতার সাথে অধরার ঘরে আসেনি। আসলে অবাক হতো না। অরুমিতা বোন জাগলে তার সামনে আসতে পারে না, ভীষণ জড়তা, বড়রা চায় না আরও হাজরটা ঝামেলা। কিন্তু ঘুমন্ত বোনের সাথে সে প্রাণখুলে কথা বলে। বোন উত্তর দেয় না তাতে কি?অধরা শিখিয়েছে এই আপুই ডাক। অরুমিতাও ছিলো বড্ড বোন ভক্ত, এরপর কি সব হলো আপুর থেকে সবাই দূরে দূরে রাখতো ওকে। চাইলেও যেতে দিত না। প্রথম প্রথম প্রচুর কাঁদতো অরুমিতা। মিসেস তুবা মানে তার মা রেগে যেত এতে। কতবার মার খেয়েছে বোনের কাছে যাওয়ার আবদার করায়! ধীরে ধীরে ছোট্ট অরুমিতা বায়না করা বন্ধ করে দিলো। ছোট সেও বুঝে গেলো তার আবদার কেউ রাখবে না, তখন থেকেই আড়ালে বোনের কাছে আসার চেষ্টা তার। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল অন্যখানে। কথায় বলে না যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। অরুমিতার ক্ষেত্রেও তাই হলো। অরুমিতা ছোট মানুষ, সে বুঝেনি আপুইকে কেন কষ্ট দেওয়া হচ্ছে কিংবা আপুই মানসিক ভাবে ঠিক নেই। অবুঝ অরুমিতা যখন বোনের কাছে চুপিচুপি গিয়ে হাজার কথার বন্যা বয়ে দিলো তখম অধরা নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“এ ঘরে কেন এসেছো অরুমিতা? চলে যাও। কেউ দেখলে তোমায় মারবে। আমার কাছে আসবে না। কখনো না।”
ছোট অরুমিতা ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে ফেললো। এত কষ্ট করে সে বোনের কাছে এলো আর বোন চলে যেতে বলছে? সে আরও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু বিধস্ত অধরা ক্ষেপে গেলো অনায়াসে। কিছুটা চিৎকার করে বলে উঠলো,
“যাও অরুমিতা। বের হও!”
ভয়ে বের হয়ে যায় অরুমিতা। অভিমানে আসা বন্ধ করে দেয় বোনের কাছে। যখন সে তৃতীয় শ্রেণি পারি দিয়ে চতুর্থ শ্রণিতে উঠলো, আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলো অনেক কিছু। এরপর পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে একদিন আঁখি আপুর কাছে আবদার করলো সব জানতে, কেন আপুকে বাড়ির কেউ পছন্দ করে না? তাও আবার হঠাৎ করে? কেন আপু তাদের সাথে মিশে না? কথা বলে না? আঁখি সেদিন অনেকক্ষণ চুপ ছিল।তারপর তাকে নিকৃষ্ট কিছু মানুষের কথা বলেছে। অরুমিতা সেদিন ফুঁপিয়ে কেঁদেছে সারারাত। বোনের উপরে করা সব অভিমান দূরে সরিয়ে রেখেছে। এরপর থেকে সে গোপনে বোনের কাছে আসে। একা একা বোনের সাথে কথা বলে। ছোট হয়েও বড় বোনের মতো ঘুমন্ত অধরাকে আদর করে দেয়, কাঁথা উড়িয়ে দেয়, মাথার নিচে বালিশ ঠিক করে দেয়। এসব কথা নিহা জানে না। তাই তো অবাক হলো। অরুমিতা ফের ফিসফিস করে বলল,
“সব ঠিক হয়ে যাবে আপুই। দেখো সব!”
আস্তে করে বোনের কপালে চুমু এঁকে দিলো অরুমিতা। সে বিছানায় বসে বোনের হাত নিজের উরুর উপর রাখলো। তখনই ঘরে প্রবেশ করলো আরাব। অরুমিতা আর নিহাকে দেখে চমকে উঠলো, বের হয়ে যেতে চাইলো ঘর থেকে। অরুমিতা বলে উঠলো,
“যেও না ভাইয়া, আমরা কাউকে কিছু বলবো না; তুমিও বলো না।”
আরাব দাঁড়িয়ে গেলো। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো; সেও কাউকে কিছু বলবে না। অরুমিতা বোনের দিকে আরও কিছু সময় তাকিয়ে থেকে উঠে গেলো। দাঁড়িয়ে আরাবের দিকে তাকালো। মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলল,
“বেশিক্ষণ থেকো না ভাইয়া। চলে যেও। সাবধানে বের হবে, কেউ যেন না দেখে।”
আরাব অবাক হলো। তার জানামতে অরুমিতা অধরার পাশে ভিরে না। আজ হঠাৎ এতো দরদ? অরুমিতা বোধহয় আরাবের মনে উদিত হওয়া প্রশ্ন বুঝলো। মাথা নিচু রেখেই একটু হাসলো। হেসে বলল,
“ভালোবাসা সব সময় প্রকাশিত হতে হয় না ভাইয়া!”
আর কিছু বলল না। ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আরাব আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকলো অরুমিতার যাওয়ার দিকে। সে ভাবতো মেয়েটা ছোট কিন্তু আজ মনে হলো বয়সের চেয়েও বেশি ম্যাচিউর অরুমিতা।
আরাব খুব ধীরে অধরার চুলে বিলি কাটতে লাগলো। নয়ন বেয়ে অশ্রু গড়ালো তার। সে মুছলো না। পড়তে দিলো। আরাব আর অধরা সমবয়সী। আরাব ছয়মাসের বড় অধরা থেকে। সমবয়সী হওয়ার সম্পর্কটা ছিল সব সময় বন্ধুর মতো। যেমন ঝগড়া, মারামারি করতে দুজন তেমনি একজন অন্যজনকে ছাড়া থাকতেও পারতো না। কত স্মৃতি জমা পড়ে আছে তাদের। আরাব ধীর স্বরে বলতে লাগলো,
“আজকে যা ঘটলো, তা চাইনি কখনো আমি অধু, তাই তোর থেকে দূরে দূরে থাকি। যারা একবার তোর গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছে, তারা বারবার তোর দিকে আঙুল তুলবে। চাইনি সেটা আমি পাখি। তুই ভবিস আমিও ওদের মতো তোকে অবিশ্বাস করি? কখনো না পাখি, তোকে আমার থেকে ভালো কেও চেনে না। আমি কিভাবে তোকে অবিশ্বাস করি পাখি? তোকে অবিশ্বাস করা মানে নিজেকে অবিশ্বাস করা!”
আরাবের চোখ বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পরছে পানি। সে চোখে অশ্রু নিয়ে তাকিয়ে রইলো অধরার নিষ্পাপ মুখটার দিকে। তখনই অধরার ফোনে মেসেজের টোন বাজলো। স্কিনে শো হলো ছোট মেসেজটা। না চাইতেও আরাবের চোখ গেলো সেদিকে। মেসেজটা এসেছে তাওসিফ আবরার নামে সেভ করা নাম্বার থেকে,
“আমাকে বলতে চাওয়া কথাগুলো তুমি সম্পূর্ণ করোনি কিন্তু, কাল সমাপ্ত করতে আসবে। আমি স্বপ্ন উদ্যানের সেই বেঞ্চটিতে একই সময়ে অপেক্ষা করবো!”
আরাব মেসেজটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে তাকালো অধরার দিকে। আলতো হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। হাসিমুখে বলল,
“মানুষ ভালোবাসার মানুষকে আপন করতে দুনিয়া এফোড় ওফোড় করে ফেলো, আর আমি এক ব্যর্থ পুরুষ তোকে পরিবারের মানুষদের হাত থেকেই রক্ষা করতে পারিনা৷ আমার কিসের অধিকার তোকে ভালোবাসার? তোর জীবনে কোন রাজপুত্র আসুক পাখি, তোকে ভালো রাখুক। তোর ভালো থাকা ছাড়া এই ব্যর্থ প্রেমিক পুরুষ আর কিচ্ছু চায় না।”
আর কথা বলতে পারলো না আরাব। চোখের পানি মুছে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই, অথচ তার ধারণা ভুল। আঁখি দেখলো তাকে। আরাবের চোখের জল আঁখির মনে ঝড় তুলে দিলো। মনে মনে বলল,
“বড় ইচ্ছে ছিল ভাই, আসফিকে তোর জন্য বউ সাজাবো, তা আর হলো না রে। এ বাড়িতে আসফি ভালো থাকবে না ভাই।”
সূর্যের আলো ফুটতেই ঘুম ছুটে গেলো অধরার। চোখ মুখ কুঁচকে হাতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে হাতে ব্যাথা অনুভব করলো, সাথে সাথে মনে পড়লো গত সন্ধ্যার কথা। তাচ্ছিল্যের হাসি চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়লো তার। হাতের দিকে তাকালো। সেঝ আপা এসব ছাইপাঁশ লাগিয়ে দিয়েছে মনে হয়। অধরা একহাতে ফোনটা নিলো। লক খুলতেই নোটিফিকেশন সামনে পরলো। তার তেমন কোন বন্ধু নেই যে খোঁজ নিবে, তাই অবাক হলো। মেসেজ অপশনে গিয়ে দেখলো মেসেজটা এসেছে তাওসিফের নাম্বার থেকে। অধরা কৌতূহল বশত ওপেন করলো। তার ধারণা ছিল তাওসিফ বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা বলবে অথচ তাওসিফ আবার দেখা করার কথা বলেছে। অধরা তাকিয়ে থাকলো মেসেজটার দিকে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দেখা করা আসলেই উচিত। তাওসিফকে জানাতে হবে সব। এতসব কথা না জানিয়ে বিয়ের পীড়িতে বসা অসম্ভব।
#চলবে…?