#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২৯
কাঁপা কাঁপা হাতে অধরার গালে আলতো করে হলুদ ছুঁইয়ে দিলো আরাব। অধরা তাকিয়ে ছিলো প্রিয় বন্ধুর দিকে। আরাবও তাকালো। হাসলো আলতো করে। বিনিময়ে হাসি ফিরিয়ে দিলো অধরাও। আঁখি বলতে চাইলো, কথা বলছিস না কেন তোরা? কথা বল। কিন্তু বললো না। থাক না এমনই! কি দরকার মায়া বাড়ানোর। মায়ার বাঁধন ছিড়ে গেছে ওদের। জোড়া লাগানোর কোন সম্ভাবনা নেই। অধরা ভালো থাকুক। তার ভাইটার জীবনে নতুন করে কেউ আসুক। ভালোবেসে আগলে নিক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আঁখি। বিরবির করে বলে,
“সবকিছু অন্যরকম হলেও পারতো। এমনই কেন হলো?”
দীর্ঘক্ষণ একই ভাবে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেলো অধরা। আবার নাকি মেহেদী দিতে হবে। অধরা ডানে-বামে বড় আপা কে খুঁজলো। পেয়েও গেলো। আপা বলে ডাকতেই ছুটে এলো তানিশা। বলল,
“কিছু লাগবে বাবুন?”
অধরা একটু আহ্লাদী হলো। মায়া মায়া কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার আর ভালো লাগছে না। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হবো। মেহেদীও ঘরে দিব। এখানে না।”
তানিশা অমত করলো না। সায় জানালো তাই হবে। স্বস্তির শ্বাস ফেললো অধরা। কিছুক্ষণ পরেই অধরাকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। তানিশা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘরের মাঝে শুধু অধরা, তানিশা ও আঁখি। অধরা ঘরের এসেই যেন শান্তি পেলো। শাড়ির আঁচল ছড়িয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। তানিশা চোখ দুটো ছোট করে বলে উঠলো,
“উঠ, গয়নাগাটি খোল। ফ্রেশ হ। শুয়ে পরলি কেন?”
অধরা উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর নিজেই উঠে বসলো। ফুলের গহনা গুলো সযত্নে খুলতে লাগলো। তানিশা এগিয়ে এলো। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“বাবুন, কয়দিন আগে নাকি তোর ঘরের জিনিসপত্র সব এলোমেলো ছিলো?”
“হুম”
অধরা গম্ভীর স্বরে বলল। তানিশা গলার আওয়াজ আরো নিচে নামালো। অনেকটা ফিসফিস করে বলল,
“তুই জানিস তোর ঘরে কে এসেছিলো?”
অধরা মাথা তুলে তাকালো বড় আপার দিকে। ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। কোন উত্তর দিলো না। তানিশা বুঝে নিলো উত্তর। কিয়ৎকাল চুপ থেকে বলল,
“কে এসেছিলো বাবুন?”
অধরার গহনা খোলা শেষ। শাড়িতে লাগো পিন খুলতে খুলতে বলল,
“সময় হলে সব বলবো বড় আপা।”
তানিশা ভ্রূঁ কুঁচকে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বলল,
“সময় টা হবে কখন?”
“বিয়ের ঝামেলাটা শেষ হোক।”
তানিশা আর জোর করলো না। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“মনে থাকে যেন।”
অধরা হাসলো। তার মনে থাকবে না? না থাকুক। তাওসিফ কি ভুলে যাবে? যাবে না তো।
——————————–
“বিয়েতে ঝামেলা না করায় ভালো হবে আব্বু। এমনিতেই সন্দেহ তোমার উপর। আর তাছাড়া আয়মান সাহেব বলেও দিতে পারে ছোট চাচাকে যে তুমি আসফিনের জমির কাগজ নিতে গিয়েছিলে।”
ফারুক হাসান ভাবনায় মশগুল। গভীর ভাবে চিন্তা করছেন তিনি। তবে ছেলের কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। ছেলের কথায় যুক্তি আছে। ফারুক হাসান গম্ভীর স্বরে বললেন,
“হুম। ঠিক বলেছো।”
আবির পায়চারি করছিলো। সে থেমে তাকালো বাবার দিকে। উত্তেজিত হয়ে কিছুটা উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“অদ্ভুত সব প্লান তোমাদের। কি লাভ হলো নাটক অভিনয় করে। কিছু করতে পারলা ওর? কিছু করতে পারলে না। এরচেয়ে যদি আমার কথা শুনতে। ও রে একটু ভয় টয় দেখালেই এমনিই কাগজে সাইন করে দিত। ছোট ছিলো তখন ও। তা না করে কিসব করলে।যত্তসব আজাইরা।”
ফারুক হাসান তাকালেন ছেলের দিকে। আবিরের চেহারায় স্পষ্ট রাগ। ফারুক হাসান বিচলিত বোধ করলেন। কার উপর এতো রাগ? তার উপর? নাকি মায়মুনার উপর। তিনি চিন্তিত হলেন। সম্পত্তির লোভ বড়ো খারাপ জিনিস। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
———————————
দু’হাত দুই দিকে পেতে দিয়ে আছে অধরা। তার হাতে আঁকা হচ্ছে হরেক রকম আলপনা। কলকা, ফুল, পাতা, পাখির সমন্বয়ে ফুটে উঠছে সেসব। অধরা তাকিয়ে দেখছে। ডানহাতে মেহেদী পরিয়ে দেওয়া মেয়েটা হুট করে মাথা তুললো। অধরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আপু, বরের নাম কি?”
অধরা তাকালে। সবার সামনে এভাবে জিজ্ঞেস করার লজ্জা পেলো কিছুটা। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। পাশ থেকে ঘুতা দিলো কেউ তাকে। সবায় বলে উঠলো,
“কিরে আসফিন। বরের নাম বল।”
অধরা মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“তাওসিফ আবরার।”
তার মৃদু কন্ঠস্বর ওরা শুনতে পেলো না। পেলো না? নাকি ইচ্ছে করে শুনলো না।
“আরে জোরে বলো না। শুনতে পাইনি তো।”
লজ্জায় এবার লাল হয়ে গেলো সে। গলার স্বর কিছুটা উঁচিয়ে বলল,
“তাওসিফ আবরার।”
অধরাকে লজ্জা পেতে দেখে একসাথে হেসে উঠলো সবায়। অধরার লজ্জাকে আরো বাড়িয়ে দিতেই কিনা তার ফোনটা বেজে উঠলো ঠিক তখন। আঁখি ফোনটা নিয়ে এলো। সবায় জানতে চাইলো,
“কে কল করেছে?”
আঁখি এক পলক তাকালো অধরার দিকে। চোখের ইশারায় বুঝালো,
“কিরে? বলবো?”
অধরা এবার লাজে নুইয়ে পরলো। এই লোকটা কি ফোন দেওয়ার আর সময় পেলো না? সে জানে না আজ অধরা ব্যস্ত থাকবে। আঁখি ফোনটা এগিয়ে দিলো অরুমিতার দিকে। বোনের পাশে বসে আছে মেয়েটা। অরুমিতা ফোনটা রিসিভ করে বোনের কানে ধরলো। ওপাশ থেকে শোনা গেলো তাওসিফের উচ্ছ্বসিত স্বর,
“অধরা, কি করছো?”
অধরা আড়চোখে তাকালে আশেপাশের সবার দিকে। সবায় উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কান খরগোশের মতো খাড়া করে রেখেছো। অধরা মিনমিন করে বলল,
“হাতে মেহেদী লাগাচ্ছি।”
তাওসিফ মুচকি হাসলো। সে জানে। এমনি জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছে। সে এবার বলে উঠলো,
“বাহ! ভিডিও কল দিচ্ছি। আমার শালিকাকে বলো রিসিভ করতে। দেখি তোমার মেহেদী।”
অধরা হতাশ শ্বাস ফেললো। নাহ! এই লোককে নিয়ে পারা গেলো না। বুঝতেই যখন পারছেন পাশে শালিকা আছে তাহলে কেন ভিডিও কল করতে হবে? হুয়াই? সে জানে না সবাই লজ্জা দিবে অধরাকে। তা জানবে কেন। পচা লোক। অধরা মুখ ফুলালো। কিন্তু তাওসিফকে ঠেকায় কে? সে ফোন কেটে অলরেডি ভিডিও কল দিয়ে দিয়েছে। এবং অধরা পেয়ারি বেহেন অরুমিতা রিসিভও করে ফেলেছে। অরুমিতা ক্যামেরা অধরার হাতের দিকে করে দিলো। তাওসিফ দেখলো তার প্রেয়সীর হাতে আঁকা ফুল-পাতা। সে হাসলো। অরুমিতা এবার চঞ্চল স্বরে বলে উঠলো,
“মেহেদী দেখা শেষ ভাইয়া?”
তাওসিফ মুচকি হেসে বলল,
“জি শালিকা। শেষ।”
অরুমিতা মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে এবার কল কেটে দেই ভাইয়া।”
তাওসিফ শালিকার চালাকি বুঝলো। তাকে লজ্জায় ফেলতে চাইছে। তাওসিফ হাসলো। সে এসব কেয়ার করে নাকি। তাওসিফ বাঁকা হেসে বলল,
“মেহেদী দেখা তো শেষ শালিকা। এবার আমার বধূকে দেখান।”
অরুমিতা সহ রুমের সবায় হেসে উঠলো। অধরার লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। ওপাশ থেকে পাওয়া গেলো রাহাত, তানিম আর তুষারের হাসির শব্দও। হাসি কিছুটা কমে এলেই অরুমিতা বলে উঠলো,
“কিন্তু আপনি তো মেহেদী দেখতে ফোন করলেন ভাইয়া।”
তাওসিফ ফের হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,
“মেহেদী দেখতে চেয়েছি ঠিক৷ কিন্তু বউকে দেখবো না কখন বললাম?”
আবারও হাসির আওয়াজ। এবার তুষার বলে উঠলো,
“থাক আর কষ্ট দিয়েন না বেচারাকে।”
অরুমিতা নিজেও হেসে এবার ক্যামেরা অধরার দিকে দিলো। অধরা মাথা নিচু করে বসে আছে। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। এবং এমন নিলজ্জ সব কথা বলার জন্য তাওসিফের মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। তাওসিফ তাকালো লাজে কৃষ্ণচূড়ার রঙ ধারণ করা তার হৃদয়ের রাণীকে। পরনে তার হালকা গোলাপি জামা। তাওসিফ অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো। এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো রাহাত। চিৎকার করে বলল,
“আর কতো দেখবি? নজর লেগে যাবে সর শ্লা।”
তাওসিফ কটমট করে তাকালো রাহাতের দিকে। রাগী স্বরল বলল,
“তুই সর। জ্বালাবি না।”
অধরার পাশ থেকে তার খালাতো বোন বলে উঠলো,
“শুধু বউ দেখলে হবে দুলাভাই? শালিকারা কি দোষ করলো?”
তাওসিফ মৃদু হেসে বলল,
“শালিকাদেরও দেখবো। আধা ঘর ওয়ালি বলে কথা।”
এবার শুরু হলো ফোনের এপার ওপারে খেজুরে আলাপ। তাওসিফ অনায়াসে মিশে গেছে অধরার কাজিনদের সাথে। হেসে হেসে কথা বলছে। বহুক্ষণ চললো আড্ডা। অবশেষে বিদায় নেওয়ার সময় আবার মনে পড়লো বউয়ের কথা। আড়চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“বিদায় শালিকারা। আমার বউয়ের খেয়াল রাখবেন।”
অধরা ভেঙচি কাটলো। হু! এতক্ষণে মনে পরেছে? তাওসিফ দেখলো। কিন্তু কিছু বললো না। মনে মনে বলল,
“আপন ডেরায় আসুন আগে মহারাণী। আপনার সকল রাগে-অভিমান ভাঙানো হবে। আপাতত সব জমা থাক।”
#চলবে…?
#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩০
বিয়ের সাজে সেজেছে নবকুঞ্জ। চারদিকে শোরগোল। কোথাও বাচ্চাদের হুটোপুটি, কোথাও রান্নার আয়োজন, কোথাওবা অতিথিদের ব্যস্ততা। চারদিকে খুশি খুশি ভাব। তবে সবায় তো আর খুশি হতে পারে না। মায়মুনার অন্তর জ্বলে যাচ্ছে এই উৎসবে। কারো মুখের হাসি সহ্য হচ্ছে না। অধরাকে বধূ রূপে সজ্জিত অবস্থায় দেখে এসেছে মাত্র। মেয়েটাকে দারুণ লাগছে নতুন এই রূপে। যা আরো সহ্য হলো না মায়মুনার। এরমাঝে অহিকে দেখলো সেজে বের হচ্ছে অন্য মেয়েদের সাথে। মায়মুনার রাগ তরতর করে বেড়ে উঠলো। সে বাঁচছে না চিন্তায়। এই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে কতো বড়ো সর্বনাস হবে তাদের আর তার নিজের মেয়ে কিনা সেই বিয়ে হবার আনন্দে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মায়মুনা শীতল কণ্ঠে অহি ডাকলো। অহি মায়ের হঠাৎ রাগের কারণ বুঝলো না। সে ঘরে এসে অবাক চাহনিতে মায়ের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো তারপর বলল,
“কি হয়েছে মা? ডাকছো কেন? ওরা আমাকে ফেলে চলে যাবে তো।”
অহির মাঝে তাড়াহুড়ো ভাব। মায়মুনা আরো ক্ষেপে গেলো। মুহুর্তেই হিংস্র রূপ ধারণ করলো সে। হিসহিসিয়ে বলল,
“খুব আনন্দ হচ্ছে তাই না? ওই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে আর পাবি কক্সবাজারের রিসোর্ট? তোর জন্য মাগনা রেখে যাবে তো।”
অহি থমকালো। মায়ের হিংস্রতা দেখে অবাক হলো। নতমুখে বলল,
“ওটা দাদু অধরাকে দিয়ে গেছে মা। কেন ওটার পিছে পড়ে আছো?”
মায়মুনা ভ্রূঁ বাঁকিয়ে তাকালো মেয়ের দিকে। বড়োটা অতি ন্যায়বান সে জানে। তাইতো তাদের কোন কথা অণিতার কান অবধি যায় না। কিন্তু ছোটটা হঠাৎ এতো ন্যায় কথা বলতে শুরু করলো কেন? মায়মুনা তীক্ষ্ণ কন্যা বলল,
“এতো ন্যায়বাক্য কে শেখালো?”
অহির কি হলো কে জানে। সরাসরি তাকালো নিজের মায়ের চোখের দিকে। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“কাউকে শিখাতে হবে কেন মা? নিজে নিজে শিখেছি। অধরার সাথে তোমারা যা করেছো তা ভাবলেই গা ঘৃণ ঘৃণ করে। ভাবলেও ঘৃণা হয় যে না বুঝে তখন তোমাদের সঙ্গ দিয়েছি। আমি এখন বড়ো হয়েছি মা। বুঝি কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়।”
মায়মুনাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো অহি।
মেয়ের বেরিয়ে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো মায়মুনা। মনের ভেতর কু ডাকছে তার। বুকটা ভার হয়ে থাকছে কয়দিন ধরে। মনে হচ্ছে সব ফাঁস হয়ে যাবে। এবার যেন আরো নিশ্চিত হলেন তিনি। ঘরের শত্রু যখন বিভীষণ, ভয় তো পেতেই হয়!
———————————
ভারি লেহেঙ্গা, ভারি সাজ, চারদিকে আনন্দ অথচ অধরার মন খারাপ। অল্প না খুব বেশিই খারাপ। মন খারাপের কারণটা আরো বেশি অসহ্যকর। অধরা চাইছে মাথা থেকে এসব বের করতে কিন্তু পারছে না। তার মন খারাপের বিচিত্র কারণটি হলো তার মা। এর আগে অধরা যতগুলো বিয়ে দেখেছে কিংবা গল্প উপন্যাসে পড়েছে সব গুলোতেই দেখা যায় বরযাত্রী আসার আগে মায়েরা ব্যস্ত হয়ে পরে মেয়ের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! অধরা তুবাকে একবারো নিজের আশেপাশেও দেখেনি। খাবার খাইয়ে দেওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। অধরা নিজের মন খারাপের কারণ ভেবে নিজেই তাচ্ছিল্য হাসলো। ঠিক তখন ভাতের থালা নিয়ে উপস্থিত হলো তানিশা। অধরার পাশে বসা মেয়েটাকে তাড়া দিয়ে বলল,
“দেখি দেখি, একটু সরো তো। বরযাত্রী চলে আসবে। ও কে খাবারটা খাইয়ে দেই।”
মেয়েটা সরে বসলো। অধরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বড় বোনের দিকে। উহু, অধরার মা রূপী রমণীর দিকে। এতক্ষণের মন খারাপ হওয়ায় উবে গেলো। এই তো তার মা। তানিশা ভাতের লোকমা মুখে তুলে দিতেই অধরা হাসলো। খুব মূল্যবান কিছু পেয়ে যাওয়ার পরের হাসি!
অধরার খাওয়া শেষ হতেই নিচ থেকে ভেসে এলো,” বর এসেছে, বর এসেছে” কলরব। অধরার ঘরে অবস্থানরত প্রায় সবায় চলে গেলো নিচে। তানিশাকেও ছুটে যেতে হলো অন্য কাজে। সবায় যখন বর বরণ করে নিচে ছুটছে তখন দেখা গেলো লেহেঙ্গা দুই হাতে ধরে উপরে উঠে আসছে একটা মেয়ে। কেউ এতো খেয়াল করলো না। যারা করলো তারা ডাকলো,
“আরে অরুমিতা আসো, গেইট ধরবে না?”
অরুমিতার ছোট্ট স্বর,
“তোমরা যাও।”
অরুমিতা বোনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মৃদুস্বরে বলল,
“আপুই, আসবো?”
নিচ থেকে হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে আসছে। বরযাত্রীর গাড়ি থামানোর শব্দও অধরা শুনেছে। সবায় যখন নিচে যেতে ব্যস্ত তখন অরুমিতা কেন তার ঘরে? অধরা অবাক হলো। বলল,
“আসো।”
অরুমিতা ধীর পায়ে ঘরে এলো। বসলো বোনের পাশে। খাটে বসে পা দুলাতে লাগলো সে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো ঘরের আশপাশ। একপাশে অগোছালো অবস্থায় সাজগোজের জিনিস দেখে উঠে গিয়ে সেগুলে গুছিয়ে রাখতে লাগলো। অধরা এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বোনকে দেখছিলো। এবার কন্ঠে বিস্ময় ঢেলে বলল,
“তুমি নিচে যাওনি?”
অরুমিতা মাথা নাড়িয়ে না জানালো। অধরা অবাক হয়ে বলল,
“কেন?”
“তুমি একা ঘরে তাই!”
অধরা হাসলো। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে মনে মনে বলল,
“যে মানুষটা কখনো তোকে ভালোবাসেনি তার জন্য তুই একটু আগে মন খারাপ করেছিলি? দেখ তাকিয়ে এই মানুষ গুলো কতো ভালোবাসে তোকে।”
অধরা ঠোঁটের ভাজে হাসি ধরে রেখে বলল,
“আমি একা থাকতে পারি তো।”
অরুমিতা এবার বোনের দিকে তাকালো। কেমন করে যেন হাসলো। রহস্যময় কন্ঠে বলল,
“আজ তোমার মন খারাপ যে!”
কথা শেষ করেই অরুমিতা নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেলো। অধরা চমকে তাকালো বোনের দিকে। কিছু সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরুমিতার পানে। পরক্ষণেই মুচকি হাসলো। তার বোনটা এত্তো বোঝে কেন? কে বলবে অধরা থেকে ছোট এই মেয়েটা?
———————————–
বর গেইটের সামনে দাঁড়ানো। তাওসিফের বন্ধুদের সাথে পাল্টাপাল্টি ঝগড়া চলছে অধরার কাজিনদের। তাওসিফ সেসবে ধ্যান নেই। সে অবাক হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। অহি তাওসিফের দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝলো সে কাউকে খু্ঁজছে। অহি বলে উঠলো,
“কাকে খুঁজছেন দুলাভাই? আসফি তো এখানে নেই।”
তাওসিফ হাসলো। হেসে বলল,
“আমার শালিকাকে খুঁজছি। আপাতত শালিকা হলেই চলবে, বউকে পরে নিজেই খুঁজে দিব।”
এবার যেন সবাই নড়েচড়ে দাঁড়ালো। আরে! অরুমিতা তাদের মাঝে নেই। কোথায় গেলো মেয়েটা? সবাই আশেপাশে তাকালো। আঁখি একটু দূরে ছিলো। সে এবার বলল,
“আমি খুঁজে নিয়ে আসছি ভাইয়া।”
আঁখি অধরার ঘরে গিয়ে দেখেলো অরুমিতা বোনের পাশে চুপচাপ বসে আছে। আঁখি দরজার সামনে থেকে ডাকলো,
“অরু, আয়। তোর দুলাভাই তোর হাতে মিষ্টি না খেয়ে বাড়িতে ঢুকছে না।”
অরুমিতা বোনের দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে স্পষ্ট প্রশ্ন,
“আপুই, আমি যাব?”
অধরা আলতো হেসে বলল,
“যাও।”
অরুমিতা আঁখির পিছুপিছু চলে গেলো। অধরা বোনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
———————————-
বর এবং তার বধূ পাশাপাশি বসা। বিয়েটা অবশেষে হয়েই গেলো একটু আগে। তাওসিফের চোখেমুখে সুখ সুখ ভাব। মুখে বিস্তৃত হাসি। এই অনাবিল আনন্দের কারণ জানে তার তিন বন্ধু। তাইতো তাদেরও খুশির শেষ নেই। তরু-লতা অধরার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অবশেষে তাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ছবিতে দেখা মেয়েটাকে সম্মুখে ভাবি ডাকতে পারার স্বপ্ন। আপাতত তারা তাদের ভাবির পাশে দাঁড়িয়ে ঠিক করছে কি কি করবে ভাবির সাথে।
অধরা চারপাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আর কিছু সময় পর নবকুঞ্জ থেকে বিদায় নেবে সে। এরপর আসা হবে না হয়তো। কে জানে? অধরা হাসলো। নজর পরলো মিসেস তুবার দিকে। হেসে হেসে গল্প করছেন তিনি। আহ! কত খুশি আজ তিনি। তার অপছন্দের মানুষ চলে যাচ্ছে, এরচেয়ে খুশির খবর আর কি হতে পারে? অধরা দৃষ্টি অন্যত্র সরালো। এবারে চোখ পরলো দাদুনির দিকে। অদূরে একটি চেয়ারে বসে অপলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। অধরার মন তাকে বলল,
“তুই চলে যাচ্ছিস বলে কেউ খুশি হলে কেউ কষ্টও পাচ্ছে। দাদুনির দিকে তাকিয়ে দেখ তার চোখ কেমন ছলছল করছে।”
অধরা মলিন হাসলো। সে কি মিস করবে না? করবে তো! দাদুনির ওমন ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না অধরা। চোখ নামিয়ে নিলো। তাওসিফ তখনই মাথা কিছুটা নিচে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“দাদুনিকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই?”
অধরা চমকে তাকালো তাওসিফের দিকে। তাওসিফ কি করে বুঝলো অধরার মন খারাপ? তাও আবার দাদুনির জন্য। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
“আপনি কি করে বুঝলেন আমার দাদুনির জন্য মন খারাপ?”
তাওসিফ ঠোঁট বাকিয়ে হাসলে। উত্তর দিলো না। তার আগেই তুষার বলে উঠলো,
“এভাবে সবার সামনে তো ফিসফিস করা যাবে না ভাবি। আমরাও শুনতে চাই, কি কথা হচ্ছে।”
অধরা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। তাওসিফ মৃদু হাসলো।
————————————
অধরা আশেপাশে তাকালো। কোথাও আরাব নাই। অধরা জানে আরাব কোথায়। অধরা নিজের আশেপাশে সবার দিকে তাকালো। কিছু পরেই সে চলে যাবে। এখনই কাজটা করতে হবে। অধরা আঁখির দিকে তাকালো। ইশারায় ডাকলো। আঁখি এলো। অধরা কিছুটা ফিসফিস করে বলল,
“আপা আমি একটু উপরে যাব।”
তাওসিফ তাকালো। অধরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“জরুরি?”
অধরা উপর-নিচ মাথা নাড়লো। তাওসিফ মুচকি হেসে বলল,
“যাও।”
অধরা আঁখির সাথে উপরে গেলো। নিজের ঘরে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিছু একটা বের করলো সে। আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি একটু আসছি আপা।”
আঁখি হাসলো। সায় জানালো। অধরা চলে গেলো আরাবের রুমের সামনে। ধীর কন্ঠে ডাকলো,
“আরাব। দরজা খোল।”
একটু একটু করে বেড়ে ওঠা অনুভূতি গুলো আজ ছিন্নভিন্ন। আরাব শুধু একপলক দেখে এসেছিলে অধরাকে। বধূ রূপে কেমন লাগছে তাকে তাই দেখতে চেয়েছিল। তারপর নিজের ঘরে চলে আসে। এতো মানুষের ভিরে কেউ খেয়াল করেনি আর। কি করে দেখতো আরাব এই বিয়ে? আজন্ম কল্পনায় যে মেয়েটা তার নামে কবুল বলে আজ আরাব কি করে দেখতো বাস্তবে সেই মেয়েটা অন্য কারো নামে কবুল বলে ফেলেছে। আরাবের হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। কতক্ষণ যে চোখের পানি ফেললো। ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে রইলো সিলিং এর দিকে। হঠাৎ প্রেয়সীর কন্ঠ শুনে চমকে গেলো আরাব। দরজার দিকে তাকালো। নিজেকে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আর কতক্ষণ ভ্রমের মাঝে থাকবি? আসবে না অাসফিন আর। কখনো না।”
আবার ভেসে এলো আওয়াজ,
“আরাব, দরজা খুলতে বলেছি।”
আরাব থমকায়৷ শুকনো ঢোক গিলে কয়েকটা। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। তাকালো সামনে বধূ সাজে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রেয়সী। কি ভাগ্য তার! তার প্রেয়সী বধূ সেজেছে অন্য কারে জন্য। তার জন্য নয়। আরাব কথা বলল না। দু’চোখ ভরে দেখতে লাগলো। অধরা নিজের হাত বাড়িয়ে দিলে আরাবের দিকে। আরাব চমকে উঠলো। থরথর করে কাঁপতে লাগলো সে। বুকে ঢিপঢিপ শব্দ। তাকাতে পারছে না অধরার হাতের দিকে।
অধরার হাতে কি কিছু আছে? যা সে আরাবকে দিকে চায় নাকি নিজের হাতটিই বারিয়ে দিলো সে?
#চলবে…?