দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-৩১+৩২

0
6

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩১

সিঁড়ি বেয়ে বামছে বধূ সাজে সজ্জিত অধরা। ধীর পায়ে একটা একটা সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করছে সে। আঁখি দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরাব ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছু সময় অন্তর অন্তর ফুঁপিয়ে উঠছে সে। তার হাতে গাঢ় লাল একটা খাম।

কিছুক্ষণ আগে,
অধরার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলো না আরাব। অধরা তাড়া দিলো। বলল,

“এটা নে আরাব।”

আরাব এবার না চাইতেও তাকালো অধরার দিকে। অধোরার হাতে একটা খাম। গাঢ় লাল রঙ তার। মনে হচ্ছে রক্ত দিয়ে রাঙানো। আরাব খামের দিক থেকে মুখ তুলে অধরার দিকে তাকালো। অধরা হাতটা নাড়ালো। ফের বললো,

“নে না এটা।”

আরাব কম্পমান হস্তে খামটা নিলো। অধরা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,

“আমি যাই। ভালো থাকিস হ্যাঁ?”

আরাব তাকালো। কিছু বলতে পারলো না। অধরা আলতো হাসলো। তারপর পা বাড়ালো সিঁড়ি দিকে।

তাওসিফের নববিবাহিতা বধূ সিঁড়ি বেয়ে নামছে। ঠোঁটে তার নজর কাড়া হাসি। তাওসিফ সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। অধরা নিচে নামতেই চোখ পড়লো তাওসিফের চোখে। অধরা হাসলে। তাওসিফ বিনিময়ে হেসে চোখ টিপলো সাথে সাথে। অধরা লজ্জা পেলো। চোখ সরালো তাওসিফের থেকে।
————————————-

অবশেষ এলো সেই সময়, মেয়ে বিদায়ের সময়। নবনী আনজুম তার চেয়ারে বসে আছেন৷ চোখ ভর্তি জল। অধরা এগিয়ে গেলো তার দিকে। কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো এক দৃষ্টিতে। ধীর কন্ঠে বলল,

“আমার সাথে যাবে দাদুনি?”

নবনী আনজুম চোখ ভর্তি জল নিয়ে একটু হাসলেন। হেসে বললেন,

“তোমায় দেখতে যাব আসফিন। যখন মন চাবে তখনই যাব। তুমি মন খারাপ করো না কেমন? সব সময় হাসি-খুশি থেকো। দাদুনি সব সময় তোমার পাশে থাকবো।”

অধরা আলতো হেসে দাদুনিকে জড়িয়ে ধরলো। নবনী আনজুম কাঁদলেন। অধরা নীরবে আঁকড়ে ধরে রাখলো তাকে। এরপর এগিয়ে এলো তানিশা। অধরার বড় আপা। তানিশা খুব কাঁদলো। মায়েরা যেভাবে কাঁদে। তানিশাও তো মা। এই বাচ্চাটার। পেটে ধরেনি ঠিকই তবে পিঠে তো ধরেছে। তানিশার সাথে যোগ হলো আঁখি। কাঁদলো অনেক। অহি আর অণিতা এগিয়ে এলো। অণিতা কেঁদে বলল,

“ভালো থাকিস ছোট্ট সোনা।”

অধরা হাসলো। অহি কাঁদলো। কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। অপরাধবোধে ছেয়ে গেছে তার হৃদয়। অধরা ওদের ছেড়ে এগুলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার ভাইয়ার দিকে। আরহাম গোপনে চোখ মুছলো। বোন কাছে আসতেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মলিন হেসে বলল,

“ভালো থাকিস বাবুন। মন খারাপ করবি না কখনো আচ্ছা? ভাইয়াকে ভুলে যাস না কিন্তু।”

আরহামের গলা ধরে এলো। এই ছোট পরীটাকে সে কি কম ভালোবেসেছে? প্রতিদিন কারো জন্য কিছু না আনলেও অধরার জন্য চকলেট বরাদ্দ থাকতো সব সময়। আরহাম কান্না চাপিয়ে রাখতে চাইলো। অধরা ভাইয়ের চোখ মুছে দিলো। মাথা নাড়িয়ে জানালো কাঁদা যাবে না। আবির একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আরহামের কান্না দেখে সে একটু অবাক হলো। তার ক্ষীণ বিবেক তাকে প্রশ্ন করলো,

“আরহাম কেমন ভাই? আর তুই কেমন? ছিহ!”

অধরা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো তুবার সামনে। আলতো হেসে বলল,

“চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন।”

পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে চলে গেলো তার সবচেয়ে প্রিয় আশ্রয়ে বাবা! অধরার আব্বু! অধরার শান্তির জায়গা। অধরা গিয়ে সরাসরি আশ্রয় নিলো বাবার বুকে। ফয়জাল হাসান পরম স্নেহে মেয়েকে জড়িয়ে নিলো। কোন কথা ছাড়া এভাবেই থাকলো তারা অনেকক্ষণ। ফয়জাল হাসান কাঁদবেন ভেবেও হু হু করে কেঁদে উঠলেন। এতক্ষণ নীরব থাকা অধরার ফুঁপিয়ে উঠলো। ফয়জাল হাসান নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করে তাওসিফকে কাছে ডাকলেন। অধরার হাতটা তার হাতের মাঝে দিয়ে ধরা গলায় বললেন,

“আমার কলিজাটা তোমাকে দিয়ে দিলাম বাবা। দেখে রাখিও।”

তাওসিফ মুচকি হেসে বলল,

“দেখে রাখবো বাবা।”

অরুমিতা অধরার সাথে যাচ্ছে। তবুও তার মন খারাপ। নবকুঞ্জে আর তার আপুই থাকবে না। রাতবিরাতে বোনের ঘরে গিয়ে সে আর একা একা গল্প করতে পারবে না। বোনের মাথায় বালিশটা, উল্টে পরা কাঁথাটা আর ঠিক করে দিতে পারবে না সে। তাওসিফ অধরা আর অরুমিতার হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসলো। কাঁচের জানালা ভেদ করে অধরা তাকালো ছাদের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আর একজন। আর দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে পানি। সেদিকে খেয়াল নেই তার। দৃষ্টি শুধুই অধরার দিকে। অধরা হাসলে আরাবকে দেখে। নিচের দিকে মাথা এলিয়ে বসে থাকা তাওসিফও হাসলো। কিন্তু কেন?
——————————

আরাব,
কোথায় যেন পড়েছিলাম ছেলে-মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না। দু’জনের মাঝে যেকোনো একজনের অনুভূতি গাঢ় হয়। কথাটা হয়তো সত্যি। শুধু চাচাতো ভাই-বোনের সম্পর্কেই আমরা সীমাবদ্ধ ছিলাম না। তুই ছিলি আমার বেস্টফ্রেন্ড, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। অনুভূতিটা হয়তো আরো গাঢ় হয়েছে তোর দিক থেকে। আমিও হয়তো পিছলাতাম। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হওয়া খুবই সাধারণ। আমি বোধহয় সময়টুকু পাইনি। আমার জীবন আমাকে বয়ে নিয়ে গেছে অনেক দূরে। অল্প একটু বয়সে করে দিয়েছে অতিরিক্ত বুঝদার। পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বাস্তবতা নামক নিষ্ঠুর কিছু সত্যের সাথে।

প্রিয় বন্ধু হিসেবে আমি তোকে অনুভব করতে পারি। বুঝি তোর ভয়াবহ অনুভূতি। ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার তীব্র কষ্ট, একপাক্ষিক দহন, হৃদয়ের ছটফট। কিন্তু আমি নিরুপায়। কখনো তোকে ভালোবাসার নজরে দেখতে পারলাম না। তোর চাওয়া বাস্তবায়ন করতে পারলাম না।

ভালোবাসা হারানোর কষ্ট তীব্র হয়। তবে যে তোকে চায় না তাকে না পাওয়াই ভালো। আমি খুব করে চাইবো তোকে খুব করে কেউ ভালোবাসুক। যার ভালোবাসার কাছে তোর নিজের অনুভূতি খুব তুচ্ছ মনে হবে, মনে হবে এভাবে কখনো তুই কাউকে ভালোই বাসিসনি। তেমন ভালোবাসা তোর জীবনে আসুক। তুই ভালো থাক। আমার জন্য হলেও ভালো থাক।

ইতি,
তোর বোন কম বেস্টফ্রেন্ড অধু

একবার, দুইবার, তিনবার……..! কতবার? আরাব ঠিক কতো বার পড়লো চিঠিটা? আরাব হাসলো। কি করুণ সে হাসির শব্দ। আচ্ছা, প্রেমের চিঠি হয়। কিন্তু? বিচ্ছেদেরও কি চিঠি হয়? যে চিঠিটাই প্রথম এবং শেষ। এরপর আর কখনো ওই ঠিকানা হতে চিঠি আসবে না। আরাব হো হো করে হাসলো। প্রেমের চিঠি না পাক, একটা বিচ্ছেদের চিঠি সে ঠিক পেয়ে গেছে। তার বিশ বছরের জীবনে প্রথম এবং একমাত্র চিঠি। এরপর আর কখনো আরাবের চিঠি পাওয়া হবে না। সত্যিই কি হবে না?
———————————

তরুলতার সামনে গাড়ি থামতেই অধরার একপাশ থেকে ছুটে নেমে গেলো তরু-লতা। বউ এসেছে রব শুনে ইতিমধ্যেই বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে অনেক মানুষের ভির। এরমাঝে দেখা গেলো মধ্যবয়স্ক দুই রমণী হাতে ট্রে নিয়ে এগিয়ে এলো। তাদের মাঝে একজন তাইফা, তাওসিফের মা। অন্যজনকে অধরা চিনে না। তবে বোঝা গেলো খুব নিকটাত্মীয়। তাওসিফকে আদেশ দিলেন তাইফা,

“অধরা কে নিয়ে নেমে আসো।”

তাওসিফ নামলো। তারপর অধরার লেহেঙ্গার একাংশ ধরে নামতে সাহায্য করলো। অধরা নামতেই। তাইফা তার মুখে মিষ্টি তুলে দিলো। দিলো নিজের ছেলের মুখেও। অপর মহিলাও দিলেন। তাওসিফ মৃদু হেসে বলল,

“আমার একমাত্র ফুপিমণি।”

অধরা মুচকি হেসে সালাম দিলো। এরপর তাইফা ও তাওসিফের ফুপি মিলে অধরাকে বাড়ির মাঝে নিয়ে গেলো। আরও কিছু নিয়ম পালন করলো তারা। তারপর অধরাকে বসানো হলো সোফায়। তরু-লতা এসে বসলো তার দুইপাশে। আত্মীয়রা সবায় বউ দেখতে দেখতে গল্প করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে অধরার হাঁসফাঁস লাগছে। আশেপাশে তাওসিফ নেই। নিজের সমস্যার কথা কাকে বলবে সে? এরমাঝে তাইফা এলেন। অধরার জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন তিনি। তিনি এসে অধরার সামনে প্লেট রেখে বললেন,

“আমি খাইয়ে দেই মা?”

অধরার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। মানুষটা এতো ভালোবাসা দিচ্ছে কেন তাকে? পরে যদি তার মায়ের মতো আর ভালো না বাসে? তখন? অধরার খুব কষ্ট হবে। অধরা চোখের জল গোপন করে বলল,

“আমার ভীষণ গরম লাগছে আম্মু। ফ্রেস হলে ভালো লাগতো।”

তাইফার খেয়াল হলো এমন ভাবে বলে উঠলো,

“সেটায় তো। একদম মাথায় ছিলো না।”

তিনি তরু-লতার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তরু, লতা ভাবিকে নিয়ে যাও ওর রুমে। জামা-কাপড় কোথায় রাখা দেখিয়ে দাও। ও ফ্রেস হোক। আমহ একটু পর খাবার নিয়ে যাচ্ছি।”

তরু-লতা, অধরার দুই হাত ধরে নিয়ে চললো অধরার নতুন ঘর অর্থাৎ তাওসিফের ঘরে।

#চলবে….?

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৩২

তাওসিফ ঘরে প্রবেশ করে দেখলো তার সদ্য বিবাহিত বউ চুপটি করে বসে আছে বিছানায়। তার দুই বোন দুইপাশে বসে জুরে দিয়েছে রাজ্যের গল্প। অধরা মনোযোগ সহকারে তাদের গল্প শুনছে ঠিকই, তবে চেহারায় তার ক্লান্তির ছাপ। তাওসিফ তরু-লতার দিকে তাকিয়ে বলল,

“এখানে কি?”

তরু বলল,

“মা পাঠিয়েছে। ভাবিকে জামাকাপড় দিতে, ফ্রেস হওয়ার জন্য।”

তাওসিফ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,

“এই তার নমুনা? মা আর মানুষ পায়নি! যা এখান থেকে। নতুন একটা মেয়ে এসেছে তার খবর না নিয়ে এখানে বসে আছিস। অরুমিতার কাছে যা। আমার শালিকা যেন একটুও বিরক্ত না হয়।”

লতা কপাল চাপড়ে বলে উঠলো,

“এই রে, অরুর কথা তো ভুলেই গিয়েছি। তরু, দ্রুত চল।”

তরু উঠে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের দিকে ফিরে মুখ ভেঙচি কাটলো। বলল,

“আজ তোমাদের জীবনে বিশেষ দিন বলে এতো সহজে ভাবিকে ছেড়ে দিলাম। অন্য সময় আর পাবে না। হু।”

তাওসিফ তরুর মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

“হু হু, দেখবো নে।”

তরু-লতা বের হয়ে যেতেই তাওসিফ তাকালো অধরার দিকে। মৃদু হেসে বলল,

“গহনা গুলো খুলে ফেলো। হালকা লাগবে।”

অধরা গহনা খোলায় মনোযোগ দিলো। তাওসিফ এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে। আলমারি খুলে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। পিছে ফিরে তাকালো অধোরার দিকে। জিজ্ঞেস করলো,

“শাড়ি না থ্রিপিস?”

অধরা তাকালো। তাওসিফের চোখে চোখ পড়লো। অধরা ভাবার মতো করে বলল,

“শাড়ি।”

তাওসিফ হাসলো। গোলাপি রঙের একটা শাড়ি বের করে রাখলো বিছানার উপর। অধরার ততক্ষণে গয়না খোলা শেষ। অধরো দোনোমোনো করছিলো। তাওসিফ বলল,

“কোন সমস্যা?”

অধরা আমতা আমতা করে বলে উঠলো,

“গয়না গুলো…….”

“আমি রাখছি। তুমি ফ্রেস হয়ে নাও।”

অধরা চলে গেলো বাথরুমে। তাওসিফ উঠিয়ে রাখলো তার বধূর অলঙ্কার।
—————————

অধরা বেরিয়ে এলো কিছুসময় পরই। কুঁচি করার অংশের শাড়ি হাত দিয়ে জাপ্টে ধরে আছে। ঘরে এসে দেখে তাওসিফ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। অধরা পরলো বিপাকে। কি করবে এখন? ডাকবে? নাকি না। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে অধরা সবে তাওসিফকে ডাকবে অমনি চোখ খুলে তাকালো তাওসিফ। অধরা থতমত খেয়ে গেলো। কি বলবে সেটায় যেন ভুলে বসলো। এদিকে তাওসিফ তাকিয় আছে এক দৃষ্টিতে। তার চোখ সরছেই না অধরার উপর থেকে। সদ্য গোসল থেকে বের হয়েছে। ভীষণ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। তাওসিফ সব ভুলে তাকিয়ে রইলো। অধরা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। কিছু সময় পর মিনমিন করে বলে উঠলো,

“একটু হেল্প করবেন? শাড়ির কুচি একা ঠিক করতে পারছি না।”

তাওসিফের ধ্যান ভাঙলো অধরার কথায়। কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বিছানা থেকে নামলো সে। অকপটে বসে গেলো হাঁটু মুড়ে। অধরা হাসলো। তনু মনে বয়ে গেলো অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি। সে কুচি করতে শুরু করলো। তাওসিফ সুন্দর করে গুছিয়ে দিলো সে কুচি। শাড়ি পরা সম্পূর্ণ করে অধরা মৃদু হেসে তাকালো তাওসিফের দিকে। মিষ্টি করে বলল,

“ধন্যবাদ।”

তাওসিফ হাসলো। অধরার ঘোমটা ঠিক করে দিলো। হেসে বলল,

“বউকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়া সব ছেলেদের ফ্যান্টাসি। আমার তো সোনায় সোহাগা ভাগ্য। প্রথম দিনেই বউয়ের কুচি ঠিক করে দিলাম। খুব শীঘ্রই শাড়িও পরিয়ে দিব।”

অধরা ভীষণ লজ্জা পেলো। লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করলো তার গাল। অধরাকে লজ্জা থেকে বাঁচাতেই তখনই দরজায় অপর পাশ থেকে শোনা গেলো তাইফার গলার স্বর,

“তাওসিফ, অধরা কোথায়? হয়েছে ওর? খাবারটা খাইয়ে দেই। বাইরে সবায় অপেক্ষা করছে।”

অধরা মৃদুস্বরে বলে উঠলো,

“আমি আসছি মা।”

বলেই বেরিয়ে গেলো ঘরে থেকে। তাওসিফ হাসলো। আনমনে বলল,

“এতো লাজুক কেন মেয়েটা?”

এরই মাঝে ঘরে প্রবেশ করলো তুষার, রাহাত। রাহাত ঘরে ঢুকে সরু চোখে তাকালো তাওসিফের দিকে। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

“কি মামা? এতক্ষণ ঘরের মধ্যে কি করলা? বাসর ডান?”

তাওসিফ ওদের দৃষ্টিতে কোন পাত্তা না দিয়ে বিছানায় বসে বলল,

“কিয়ের বাসর? আগে প্রেম হোক তারপর বাসর।”

তুষার তাওসিফের পাশে বসে বলল,

“এখনো প্রেম হয় নাই দোস্তে?”

তাওসিফ কিছু বললো না। হাসলো একটু। তানিম ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠা কন্ঠে বলল,

“কার প্রেম ভাই? তোদের মাঝে কে প্রেমে পড়লো? রাহাত তোর না বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তুই কেন প্রেমে পড়বি?”

রাহাত আশ্চর্য হয়ে বলল,

“আমি আবার কখন কার প্রেমে পড়লাম?”

“তুই পরোস নাই? তাইলে তুষার? কিরে?”

তুষার বিরক্ত হয়ে বলল,

“অর্ধেক কথা শুনে লাফাস কেন? কেউ কারো প্রেমে পড়ে নাই। ভাবি এহনো তাওসিফের প্রেমে পড়ে নাই। সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল।”

তানিম বিজ্ঞ দের মতো মাথা নেড়ে বলল,

“ভালো হইছে। এখন চব্বিশ ঘণ্টা ঘরের মধ্যে থেকে ভাবিরে পটা।”

রাহাত উঠে দাঁড়ালো। তাওসিফকে টেনে তুলে বলল,

“ভাবিকে পটানোর জন্য তোরে প্রতিদিন আমরা নিত্য নতুন টিপস দিব। এবার চল। ছাদে সবাই বইসা আছে তোর জন্য। একটু আড্ডা দিয়া আসি।”

চার বন্ধু বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
———————————-

অধরাকে খাইয়ে দিচ্ছে তাইফা। সোফায় বসা তারা। আশেপাশে অনেক মানুষ। তাওসিফের ফুপু পাশেই বসে আছে। অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। আজ যেন তার খুশির দিন। একমাত্র ভাইপোর জন্য এমন একটা মিষ্টি মেয়ে এসেছে ঘরে, তার আর কি চাই। এতো মেহমান, সবার মানসিকতা তো আর এক হয় না। তাদের মাঝে একজন বলে উঠলো,

“বউ আনতে না আনতে বউয়ের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছ? বলি তাহলে আর কাজ কামে হাত দিবে?”

তাইফা হাসলেন। আরো এক লোকমা ভাত অধরার মুখে দিয়ে বললেন

“আমি তো কাজের মেয়ে আনিনি ভাবি, আর একটা মেয় এনেছি। তরু-লতা তো কাজে হাত দেয় না। ও কে দিতে হবে কেন?”

“সংসার লাটে উঠবে দেখিও।”

তাইফার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। বলল,

“সেটায় তো ভাবি। আমার সংসারে কেউ নাক গলাক সেটা আমি চাই না। আমার সংসার আমিই সামলাতে পারবো। যখন আমি থাকবো না, পুরো সংসার তার অধীনে যাবে তখন সে একাই সামলানো শিখে যাবে।”

অধরা মুগ্ধ হয়ে দেখলো তার শাশুড়িকে। আর ভাবলো নিজের মায়ের কথা। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বায়। চোখ দুটো জলে টলমল করে উঠলো। আশেপাশে কে আছে কিছুর পরোয়া করলো না তাইফা। শাড়ির আঁচল টেনে চোখ মুছে দিলো পুত্র বধূর। মুখে বলল,

“এই বাড়িতে কান্নাকাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কাঁদলেই দেওয়া হবে ভয়ঙ্কর শাস্তি।”

অধরা হেসে ফেললো। মৃদু স্বরে বলল,

“আর কাঁদবো না।”
—————————–

তরু-লতার বারান্দায় খাঁচার মাঝে সুন্দর চারটি পাখি। নাম লাভবার্ড। কিয়ৎকাল পর পর চেচিয়ে উঠছে পাখি গুলো। অরুমিতা খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে তাদের দেখছে। তরু-লতা আসতেই ওদের পাখি নিয়ে অনেক প্রশ্ন করলো অরুমিতা। লতা খুশি মনে উত্তর দিলো সেসবের। পাখির প্রতি এতো আগ্রহ দেখে তরু বলল

“তুমি চাইলে আমাদের দু’টো পাখি নিয়ে যেতে পারো।”

অরুমিতা মুখ ভার করে বলল,

“না, তোমাদের কাছেই থাক।”

“কেন নিবে না?”

মন খারাপ হলো অরুমিতার। হালকা করে বলল,

“আম্মু বকা দিবে। রাখতে দিবে না ওদের।”

তরু বলে উঠলো,

“তোমার আম্মু কি খুব রাগী?”

অরুমিতা হাসলো। উত্তর দিলো না। তার আগেই লতা বলে উঠলো,

“আচ্ছা ভাবি চলে আসার সময় সবায় কাঁদলেও তোমার আম্মু কাঁদলো না কেন? ওনাকে তো বাহিরে দেখিনি।”

অরুমিতা অপ্রস্তুত হাসে। বিষণ্ণ কন্ঠে বলে,

“হয়তো মায়ের বেশি খারাপ লাগছিলো তাই দূরে ছিলো।”

লতা ওহ আচ্ছা বলে মেনে নিলেও মানতে পারলো না তরু। ও বাড়ির অনেকে যখন কাঁদতে ব্যস্ত তখন পানি খেতে বাড়ির ভেতরে গিয়েছিলো তরু। তখন দেখেছে মিসেস তুবা কত হেসে হেসে কথা বলছিলো কিছু মানুষের সাথে। কিন্তু সে কিছু বলল না।

তরু-লতাকে কে যেন ডাকলো। ওরা বাইরে গেছে একটু। অরুমিতা পাখির খাঁচাটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাখি গুলো ওকে দেখছে, থেকে থেকে ডেকে উঠছে। অরুমিতার হুট করে মনে হলো পাখি গুলো তার সাথে কথা বলছে। তাকে জিজ্ঞেস করছে,

“তোমার মন খারাপ কেন?”

অরুমিতা আনমনে হাসলো। কিছু ব্যথিত নয়নে পাখি গুলোর দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

“আম্মু কেন আপুকে পছন্দ করে না? কেন আপুর জন্য তার একটুও কষ্ট হয় না? আমার মা আমার বোনকে পছন্দ করে না, এটা কি মানুষকে বলা যায়? বলোতো?”

পাখি গুলো চুপ করে শুনলো অরুমিতার কথা। কে জানে বুঝলো কি না। তবে তারা আর ডাকলো না। চেঁচালো না। অরুমিতার মন খারাপে চুপ করে রইলো।
———————————

সময় রাত বারোটা। প্রথম এ ঘরে যখন ঢুকেছিলো তখন ফুল দিয়ে সাজানো ছিলো না। সম্ভবত সন্ধ্যার আগে বউ চলে আসবে বলেই তখন সাজানো হয়নি। সে এতক্ষণ তার শাশুড়ি সহ অন্যদের সাথে ছিলো। এর মাঝেই ঘরটা কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। গোলাপ, রজনীগন্ধা আর বেলির সুবাসে মুখরিত হয়ে আছে পুরো ঘর। অধরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সব। ছুঁয়ে দিলো ফুল গুলোকে আলতো করে। পরক্ষণেই তাকালো ঘড়ির দিলে। সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। অধরা দরজার দিকে তাকালো। নাহ! এখনো তাওসিফ আসার কোন নাম গন্ধ নেই। অধরার একটু মন খারাপ হলো। বিছানার এক কোণে চুপ করে বসে রইলো সে।

তাওসিফ এলো একটার সময়। ঘরে ঢুকতেই দেখলো তার বউ চুপ করে বসে আছে। তাওসিফ এগিয়ে এলো। চোখ গেলো ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছানার দিকে। আনমনে হেসে ফেললো সে। এসব কার কাজ জানে সে। অধরার সামনে এসে মৃদুস্বরে বলল,

“এখনো ঘুমাওনি?”

অধরা তাওসিফের দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বলল না। তার কেন যেন ভীষণ অভিমান হলো। চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো,

“একে তো দেরি করে এসেছেন আবার বলছেন ঘুমাই নি কেন! এই দিন দিন তো বারবার আসে মানুষের জীবনে।”

কিন্তু চাপা অধরা নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলো না। তাওসিফ কিছুটা অবাক হলো। ফের কিছু একটা বলতে গিয়ে দেখলো অধরার নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। তাওসিফ থমকে গেলো। বুঝতে চেষ্টা করলো কি হয়েছে? অধরা রেগে গেছে কেন? তাওসিফ অধরার পাশে বসে আদুরে স্বরে বলল,

“কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে? রেগে আছো কেন?”

অধরা নিশ্চুপ। তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। তাওসিফ ভরকালো। ঢোক গিলে ফের বলল,

“কথা বলো অধরা।”

নাহ, সে কথা বলছে না। তাওসিফের নিজের মাথায় নিজের বারি দিতে ইচ্ছে করছে। কেন সে মেয়েটাকে একা রেখে গেলো। তাওসিফ এগিয়ে আসে। গলার স্বর আরো নরম করে বলে,

“আমাকে তো বলো কি হয়েছে? আমরা না বন্ধু।”

অধরা এবার ডুকরে উঠলো। অভিমান মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,

“কিসের বন্ধু? এসেছেন কেন? আসতেনই না। আমি একা একটা অপরিচিত জায়গায় বসে থাকি। কিছু হোক আমার। আপনার কি?”

তাওসিফ ঠোঁট চেপে হাসলো। এতক্ষণে বুঝলো মহারাণীর রাগের কারণ। তাওসিফের হাসি দেখে তেঁতে উঠলো অধরা। চিল্লিয়ে বলল,

“খবরদার হাসবেন না।”

তাওসিফ হাসি থামালো। দু’হাতের আঁজলায় অধরার মুখটা তুলে মৃদুস্বরে বলল,

“রাগলে আপনাকে দারুণ লাগে বউ।”

অধরার রাগ রূপান্তরিত হয় লাজে। চোখ নামিয়ে নেয় সে। তাওসিফ ঝুঁকে আসে। আলতো চুমু খায় অধরার কপালে। নেশাক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

“আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হোক। ভালোবাসায় ভরে যাক প্রতিটা মুহুর্ত। আর আমাদের ভালোবাসাবাসি টাও হয়ে যাক।”

#চলবে…?