দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-৪০+৪১

0
6

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪০

আরহাম-অণিতার বিয়ে উপলক্ষে নবকুঞ্জ থেকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে আজ। তাওসিফ ঘরের মাঝে পায়চারি করছে। সে বুঝতে পারছে না অধরাকে কিভাবে বলবে কথাটা। অধরা যদি কষ্ট পায়। ও বাড়িতে অধরা আদো যেতে চায়? বিয়ের পর ওই একবারই নবকুঞ্জে পা রেখেছিলো মেয়েটা। আর যায়নি। যখন ইচ্ছে হয় বাবার সাথে দেখা করে আসে। আর দাদুনিকে বেশ কয়েকবার তাওসিফ নিয়ে এসেছিলো তরুলতায়। তবে অধরা নবকুঞ্জে যায়নি। অধরা ঘরে এলো তখনই। তাওসিফের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে তোমার?”

“কিছু না তো।”

অধরা ভ্রূঁ বাঁকিয়ে তাকায়। বলে,

“কথা লুকাচ্ছ?”

তাওসিফ হাসে। তাদের সম্পর্কে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এই যেমন তার নীরবতার রাণী তাকে তুমি করে বলে, শাসন করে। তাওসিফ বলে,

“মোটেও না।”

অধরা আর কিছু না বলে ফের ঘরে থেকে বেরিয়ে যেতে নেয়। তাওসিফ এবার ডেকে উঠে,

“শোনো।”

অধরা পিছনে ফিরে তাকালো। তাওসিফ আমতা আমতা করে বলল,

” আরহাম আর অণিতা…”

“হ্যাঁ, বড়ো ভাইয়ার বিয়ে।”

অধরা হাসলো। তাওসিফ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। অধরা হেসে বলল,

“লাগেজ গুছিয়ে ফেলেছি। হলুদের দিন সকালে যাব। সেদিন, বিয়ের দিন আর বৌভাতের দিন থাকবো। পরের দিন চলে আসবো। মোট চারদিন। তুমি ছুটি নিয়ে নিও। কেমন?”

অধরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তাওসিফ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। কি হলো এটা? সে এদিকে টেনশনে ম*রে যাচ্ছিলো আর তার বউ লাগেজ অবধি গুছিয়ে রেখেছে। কপাল, কপাল! সবই কপাল!
—————————–

আরহাম-অণিতার বিয়ে উপলক্ষে আজ নবকুঞ্জে যাচ্ছে অধরা, তাওসিফ ও তরু-লতা। তাওসিফের বাবা-মা আগামীকাল যাবেন। অধরা তৈরি হয়ে তাইফার কাছে গেলো,

“কাল সকাল সকাল চলে আসবে কিন্তু মা।”

তাইফা হেসে সম্মতি জানালো। তারা চারজন বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।

অধরা এসেছে শুনেই হাঁকডাক শুরু করলেন নবনী আনজুম। আঁখি ছুটে গেলো তার কাছে। নবনী আনজুম বললেন,

“আসফিন কোথায়? আমার কাছে আসছে না যে।”

আঁখি হাসে। বলে,

“আসছে। বাইরে অনেক মেহমান। কথা বলছে। তোমার সাথে কথা না বলে থাকবে তোমার নাতনি?”

নবনী আনজুম অপেক্ষা করে। কখন আসবে মেয়েটা। তার আদরের নাতনিটা। অধরা আসে একটু পরেই। সাথে তাওসিফ। তরু-লতা অরুমিতাকে পেয়ে চলে গেছে ছাদের দিকে। তাওসিফ দাদুনিকে সালাম দিলো। নবনী আনজুম আদুরে ভঙ্গিতে দুইজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। দাদুনির সাথে কথা শেষ করে নিজের রুমে এলো তারা।

অধরা সবে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে। এমন সময় দরজায় নক করলো কেউ। অধরা বলে উঠলো,

“দরজা খোলা। ভিতরে আসো।”

অণিতা গুটি গুটি পায়ে ভিতরে এলো। অধরা বেশ অবাক হলো তাকে দেখে। তবে কিছু বলল না। অণিতা শুকনো ঢোক গিলে ডাকলো,

“আসফিন।”

“বলো আপা।”

অণিতা চমকে তাকায়। কতোগুলো দিন বাদে তাকে মেয়েটা আপা ডাকলো। চোখে জল এলো তার। গলাটা কেঁপে উঠলো। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,

“আমার উপর রাগ করে আছিস?”

অধরা বিগলিত হাসলো। বলল,

“মোটেও না। রাগ করবো কেন?”

“আমি যে কথা বলিনি তোর সাথে।”

অধরা ফের হাসে। মৃদুস্বরে বলে,

“আরাব, অরু, নীহা, নীরব কেউ তো কথা বলতো না আমার সাথে। তোমার ধারণা আমি ওদের উপর রেগে আছি?”

অণিতা মাথা নাড়িয়ে না বলল। অধরা হেসে বলল,

“তাহলে তোমার উপর রেগে থাকবো কেন?”

অণিতা একটু হেসে বলল,

“আমি কিছু দিলে তুই নিবি?”

“নিবোনা কেন?”

অণিতা খুশি হয়ে একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয় অধরার দিকে। হেসে বলে,

“এখানে হলুদ শাড়ি আছে। তোদের সবার একইরকম কিনেছি। আর ভাইয়ার পাঞ্জাবিও আছে।”

অধরা খুশিমনে প্যাকেট হাতে নেয়। বলে,

“তোমার শাড়ি একটু ইউনিক কিনেছো তো! নাকি সবার মতো নিয়েছো।”

অণিতা হেসে বলে,

“তোর ভাইয়া কিনেছে ওটা।”

অধরা হাসে। দুষ্টমি করে বলে,

“আমার ভাইয়া তাই না?”

অণিতা লজ্জা পেয়ে যায়। অধরা কি বুঝতে চেয়েছে সে জানে। ছোট বেলা থেকে সারাদিন আরহামকে ভাইয়া ভাইয়া ডেকে মাথা খারাপ করে দিতো সে। আর আজ ভাইয়া বলছে না। জীবন কাকে কোথায় নিয়ে যায়!

অণিতাকে লজ্জা পেতে দেখে অধরা হেসে ফেললো। বলল,

“হয়েছে, লজ্জা পেতে হবে না। তুমি যাও তো আপা। রেডি হও গিয়ে। আমিও শাড়ি পরে আসছি।”

অণিতা তাড়াতাড়ি আয় বলে বেরিয়ে গেলো। অধরা তাওসিফের দিকে পাঞ্জাবি এগিয়ে দিয়ে নিজে শাড়ি পরায় মনোযোগ দিলো।

অধরা তৈরি হয়ে গেছে। তাওসিফ বসে আছে বিছানায়। অধরা তাওসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি এখানে থাকবে? আমি ভাইয়ার কাছে যাচ্ছি।”

“যাও।”

তাওসিফ হাসে। অধরা মিষ্টি হেসে নিজের ঘর থেকে বের হয়। এগিয়ে যায় বড়ো ভাইয়ের ঘরের দিকে। আরহাম পাঞ্জাবি পরে রেডি হয়েছে। তার ঘরে তার বন্ধুরা সহ আরাব আর আরহাম ভাইয়ার নানাবাড়ির কাজিনরা আছে। অধরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলো,

“ভাইয়া।”

আরহাম তাকালো দরজার দিকে। অধরাকে দেখে মন ভালো হয়ে গেলো। সে নিজেই ইতস্তত করছিলো তার আদরের বোনটা আসবে কিনা। অধরা এগিয়ে এলো। এতো অপরিচিত মানুষ কাউকে পরোয়া করলো না। ভাইয়ের বুকে মুখ গুঁজলো সে। আরহামের চোখে পানি চলে এলো। কতদিন পর বোনটা নিজে থেকে কাছে এলো। সে পরম আদরে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অধরা ভাইকে ছেড়ে দিতেই আরহাম বললো,

“আমি ভেবেছিলাম তুই আসবিই না।”

“কেন আসবো না? আমার ভাইয়ার বিয়ে আর আমি আসবো না?”

আরহাম হাসে। উত্তর দেয় না। এখন অন্য কোন বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। ভাইয়ের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে আশেপাশে তাকায় অধরা। আরাব নেই। সে খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়।

ভাইয়ের ঘরে থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই তাওসিফের দেখা পায়। অধরা এগিয়ে যায় তার দিকে। তাওসিফ হেসে বলে,

“তোমাকে মারাত্মক সুন্দর লাগছে কেন?”

অধরা হেসে বলে,

“কারণ আমি সুন্দর। হু!”

তাওসিফ হাসলো। অধরা জিজ্ঞেস করলো,

“আরাবকে দেখেছো?”

“ছাদে যেতে দেখলাম।”

“আচ্ছা, ছাদো যাবে? আসো। আমি একটু যাই।”

“যাও।”
—————————-

সিঁড়ি মাঝ বরাবর। ছাদটাও তাই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। সিঁড়ি ঘরের দুই পাশে দুই ভাগ। একপাশে চলছে হলুদের স্টেজ বানানোর কাজ। ওপর পাশ বেশ শান্ত। এদিকে কারো খেয়াল নেই। আরাব এককোণে রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। অধরা এগিয়ে যা সেদিকে। আরাবের পাশে বসে। আরাব চমকায়। আচমকা মুখ ফুটে বের হতে চায় কিছু। কিন্তু বলে না। মানসপটে ভেসে উঠে আগের কথা। সকাল-সন্ধ্যা, কখনো বা রাত; তারা দুইজন ছাদে এসে এভাবে রেলিং এ পা ঝুলিয়ে বসে থাকতো। প্রতিবার অধরা বসার পরই আরাব বলে উঠতো,

“পরে যাবি তো।”

অধরা মুখ ভেঙচি দিতো। বলতো,

“বলছে তোকে!”

আজও আরাব বলতে চাইলো, পরে যাবি তো। কিন্তু বলতে পারলো না। আরাব নিজেকে কিছুটা সমালে নিয়ে বলল,

“এখানে আসলি যে?”

“মন চাইছে।”

অধরার নির্লিপ্ত কন্ঠ। আরাব চুপ হয়ে যায়। কি বলবে খুঁজে পায় না। অধরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

“এদিকে ফিরে বস।”

“কেন?”

“শাড়ি পরেছি। ওদিক হতে গেলে পরে যাওয়ার চান্স আছে।”

আরাব আর কথা বাড়ায় না। পা গুলো ছাদের উপর রাখে। তবে অধরার দিকে তাকায় না। অধরা বলে,

“তাকা এদিকে।”

“কেন?”

“আমারে দেখার জন্য। তাকাইতে কইলাম না?”

আরাব তপ্ত শ্বাস ফেলে। এতো জেদি কেন মেয়েটা? সব জেদ কেন তাকেই দেখাতে হবে? আরাব তাকায়। তার বুক কেঁপে উঠে। অধরা নিজেও তাকায়। কিছু সময় পর বলে,

“আমাকে দেখলে সরে আসতে হচ্ছে তোর। মানে আমি যেখানে থাকবো তুই থাকবি না। তাই তো?”

আরাবের চোখ ছলছল করে। বলে,

“কখন বললাম সেটা?”

“বলতে হবে কেন? আমি ভাইয়ার ঘরে যেতেই তুই চলে এলি কেন?”

আরাব চুপ থাকে। উত্তর দেয় না। অধরা বলে,

“আরাব! তুই কখনো আমাকে বলেছিস তুই আমাকে চাস?”

“নাহ!”

“লাস্ট পাঁচটা বছর আমি একা ছিলাম আরাব! আমি জানি তুই আমার কথা ভেবেই আমার সাথে কথা বলিশনি। কিন্তু তুই চাইলে অন্যভাবেও চিন্তা করতে পারতি আরাব! আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তুই। বাসায় না হোক বাইরে কথা বলতে পারতি, বলতে পারতি তুই পাশে আছিস। পারতি না?”

আরাব চুপ। অধরা বলে,

“শুধু ভালোবাসলে হয় না। সাহস করে এগিয়েও যেতে হয়। আমার বিয়ের পর কান্নাকাটি করে পুরো বাসা না জানিয়ে বিয়ের আগে কান্নাকাটি করা উচিত ছিলো তোর।”

অধরার কথা বলার ধরণ দেখে আরাব হেসে ফেললো। অধরা নিজেও হাসলো একটু। বলল,

“এভাবে আমাকে দেখেই সটকে যে পরছিস, সবায় ভাবছে দেবদাস হয়ে গেছিস তুই।”

আরাব হেসে বলে,

“সরি, ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দেন।”

ফিক করে হেসে ফেলো অধরা। আরাব নিজেও হাসে বলে,

“না হলি বউ, আবার আগের মতো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যা। আমার মনে হচ্ছে আমি প্রেমে ছেঁকা খেয়েছি আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড শান্তনা দিচ্ছে।”

অধরা হাসে। বলে,

“তোর মনে আছে? একবার আমার জন্মদিনে তুই বলেছিলি আমি যা চইবো তাই দিবি। আমি বলেছিলাম ভেবে বলবো। আমি কিন্তু আর চাইনি।”

“হুম”

“এখন চাইবো। দিবি?”

“দিব।”

“শিওর?”

“হ্যাঁ, বল।”

“তোকে যতগুলো মেয়ে প্রপোজ করবে সব আমাকে বলবি। তারপর দুইজন মিলে খোঁজ খবর নিয়ে তোর বউ কে হবে ঠিক করবো। আচ্ছা?”

আরাব উঠে দাঁড়ায়। হেসে বলে,

“তোকে খুঁজতে হবে না। আমি খুঁজে নিবনি।”

“সত্যি?”

অধরা জাবতে চায়। আরাব হেসে বলে,

“তো দেবদাস হবো আমি?”

দুইজন হু হা করে হেসে উঠে। অধরাকে না পাওয়ার ব্যথা তার আছে। তবে আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে। যায় অধরার মতো একটা বন্ধু আছে তার দুঃখ থাকতে নেই। আরাব নিশ্চয়ই আবার কাউকে৷ ভালোবাসবে তবে অধরাকে নিয়ে তার যত আবেগ ছিলো তা হয়তো থাকবে না। এই যা!

#চলবে…?

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪১

গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে সময়। এগিয়ে যায় নিজ গন্তব্যের দিকে। আচ্ছা, সময়ের কি গন্তব্য আছে? কোথায় তার যাত্রার শেষ! কে জানে? সময় তার নিজ গতিতে চলছে। সেই সাথে কেটে যাচ্ছে দিন, সপ্তাহ, মাস! দেখতে দেখতে কেটে গেছে এক বছর। এই এক বছরে কতো কি ঘটে গেলো। আবির সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে। মাদকের কালো ছোঁয়া থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। আবির তরুলতায় এসেছিলো। অনেক আকুতি নিয়ে ক্ষমা চেয়েছে অধরার কাছে। ফারুক হাসানও কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। যদিও হাঁটতে চলতে এখনো পারে না। তিনিও কান্নাকাটি করে বলেছে, ক্ষমা করে দিস মা। মায়মুনাও বহুবার ক্ষমা চেয়েছে। অধরা নিশ্চুপ থেকেছে প্রতিবার। বলতে পারেনি কিছুই। কি বলবে সে? মুখে ক্ষমা করেছি বললেই তো আর ক্ষমা করা হয় না। মন থেকে ক্ষমা করতে হয়। অধরা যেদিন মন থেকে ক্ষমা করতে পারবে সেদিন নাহয় বলবে কিছু।

দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠেছে তুবা। অগ্নিগিরির মতো রাগ কোনায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। এখন সে দীঘির জলের মতো শান্ত। এক সময় যে তুবা মায়মুনা কুটচালে গা ভাসাতো আজ সে শান্ত জা আয়েশাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। নিজের মতো করে থাকে, কারো সাথে ঝামেলা করতে যায় না। অরুমিতার সব খেয়াল রাখে। সুস্থ জীবনে ফিরে সুখী হয়েছে সে। নিজে নিজে ভাবে তুবা। আসলেই কি তাই?

সূর্য টা ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম আাকাশের দিকে। কখন যেন হারিয়ে যাবে নীলাকাশের মাঝে। অধরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। অপেক্ষা করে সূর্য ডুবে যাওয়ার। মনে মনে বলে, “এতো দেরি কেন সন্ধ্যা নামতে?” অধরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সেই মহেন্দ্রক্ষণের। সূর্য ডুবে যখন রক্তিম আভা ছড়িয়ে যাবে আকাশ জুরে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে ফিরে আসবে আপন নীড়ে। তরুলতার সামনে এসে থামবে একটা কালো রঙের বাইক। নিজের নীড়ে ফিরবে একজন মানুষ। অধরা তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।

অধরার অপেক্ষার প্রহরের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাইকটা এসে থামলো তরুলতার সামনে। তাওসিফ হেলমেট খুলে বাড়ির ভিতরে এলো। অধরা বারান্দা থেকে ছুটে এলো ঘরে। ততক্ষণে তাওসিফ ঘরে এসেছে। হেলমেট টেবিলের উপরে রেখে এগিয়ে এলো তাওসিফ। ঠোঁট ছোঁয়ালো অধরার কপালে। মুচকি হেসে বলল,

“ফ্রেশ হয়ে আসি।”

অধরা মাথা নাড়িয়ে সরে দাঁড়ায়। তাওসিফ ওয়াশরুমে চলে যায়। তাওসিফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখলো অধরা তার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে। তাওসিফ অধরাকে পাশে বসিয়ে নাস্তা শেষ করলো। পুরোটা সময় উসখুস করলো অধরা।তাওসিফ অবাক হলো তবে কোন প্রশ্ন করলো না। খাওয়া শেষ করে সে এবার ঘুরে তাকালো অধরার দিকে। দুই হাতের আঁজলায় তুলে নিলো অধরার মুখটা। আদুরে কন্ঠে বলল,

“কি হয়েছে? বলো আমাকে। এতো অস্থির হয়ে আছো কেন?”

অধরা মায়া মায়া চোখে তাকায় তাওসিফের দিকে। মানুষটা এমন কেন? এতো যত্ন করে কেন? অধরা আরো একটু এগিয়ো আসে। মুখ লুকায় তাওসিফের বক্ষে। তাওসিফ মুচকি হেসে মাথায় বিলি কাটতে থাকে। ফের শুধায়,

“বলো অধরা। কি হলো?”

মাথাটা একটু তোলে অধরা। মুখটা নিয়ে যায় তাওসিফের কানের কাছে। ফিসফিস করে বলে,

“আপনি বাবা হবেন তাওসিফ আবরার।”

তাওসিফ চমকায়। শরীরটা মৃদু কেঁপে উঠে। গলা শুকিয়ে যায়। অধরা ততক্ষণে ফের মুখ লুকিয়েছে তার বুকে। তাওসিফ আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয় অধরাকে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

“স..সত্যি?”

“হুম।”

তাওসিফের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে এক ফোঁটা জল। তাওসিফ অধরাকে বুক থেকে উঠিয়ে পাগলের মতো চুমু খায়। ফের বুকের মাঝে নিয়ে বলে,

“তুমি, তুমি জানো? আমি কতোটা খুশি হয়েছি। অধরা আমি খুশিতে পাগল হয়ে যাব।”

অধরা হাসে। দেখে মানুষটার পাগলামি। সে তৃপ্তি পায়। এই তো তার সুখ, শান্তি!
—————————–

তরুলতায় চলছে আনন্দ উৎসব। তাওসিফ ও তার বাবা বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে এসেছে। আশেপাশের বাড়ি গুলোতে বিলি করাও শেষ। তরু-লতা আনন্দে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না৷ একটা ছোট্ট পুতুল আসবে তাদের বাড়িতে, হাসবে, খেলবে, তরু-লতাকে ফুপি বলে ডাকবে! তরু-লতার খুশি হতে আর কি চাই। তাইফা সোফায় বসে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে অধরাকে। কিছু সময় পর পর চোখ মুছছেন তিনি। অধরা অবাক হয়ে বলে,

“মা, ও মা? তুমি কাঁদছো কেন?”

তাইফা চোখে জল নিয়ে হাসে। বলে,

“এটা সুখের কান্না। তুই বুঝবি না। আমি আজ কত্তো খুশি হয়েছি তুই জানিস?”

অধরা হাসে। বলে না কিছু। তাইফার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে থাকে। আর নিজের ভাগ্যকে শুভেচ্ছা জানায়। এতো ভাগ্যবতী সে!

এ বাড়িতে অধরার আদর যত্ন কম ছিলো না কখনোই, তবে এখন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। তাইফা আগে থেকেই তাকে কোন কাজে হাত দিতে দিতো না, এখন আরো দেয়না। মেয়েটার দিন কাটে শুয়ে বসে। তরু-লতাও সারাদিন খেয়াল রাখে তার। কলেজে যাওয়ার আগে হাজারবার শুধায়,”ভাবি তুমি কিছু খাবে? কি আনবো বলো।” নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে অধরার পছন্দের খাবার নিয়ে আসে। তাইফা প্রতিদিন রান্নার আগে জিজ্ঞেস করে,”কি খেতে মন চায় মা? বল আমাকে।” তাওসিফের কথা নাহয় আর নাই বললাম। অধরা শুধু ভাবে, এতো সুখ তার কপালে ছিলো?
————————-

কেটে গেছে আরো কয়েক মাস। সময় দুপুর। তুবার ভীষণ একা একা লাগছিলো। অরুমিতা বাসায় নেই। কথা বলার জন্য তাই গেলো আয়েশার ঘরে। আয়েশা বিছানায় বসে সেলাই করছিলো। তুবা গিয়ে তার পাশে বসলো। ছোট্ট কাঁথাটা দেখে বলে,

“হঠাৎ ছোট কাঁথা সেলাই করছো ভাবি। কার জন্য?”

আয়েশা বিগলিত হাসলো। বললো,

“আসফিনের বাবুর জন্য।”

তুবা চমকে উঠে। মস্তিষ্কে বারি খায় কথাটা। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে,

“আসফিন!”

আয়েশা মাথা নাড়ায়। তুবার নিজেকে কেমন ভারশূণ্য লাগে। আসফিন, তার মেয়ে? দোতালার ফাঁকা ঘরটায় যে মেয়েটা চুপচাপ একাকী থাকতো যে আদুরে মেয়েটা, তার বাচ্চা হবে? সবায় জানে! সে কেন জানে না? তাকে কেন কেউ বলেনি। ফয়জালও বললো না। তুবা ভীষণ অবাক হয়ে বলে উঠলো,

“আসফিনের বাবু হবে?”

আয়েশা কিছুটা অবাক হতে চেয়েও হতে পারলো না। তুবার না জানাটায় স্বাভাবিক। জানলেই বরং অবাক হতে হতো। এই মুহুর্তে আসফিন নামক ভীষণ আদুরে মেয়েটার জন্য তার মায়া হলো। মেয়েদের বাচ্চা হওয়ার আগে তারা থাকে মায়ের কাছে, মা আদর যত্ন করে আগলে রাখে মেয়েকে। মেয়ের বাচ্চা হবে শুনলে কতো খুশি হয় মায়েরা। আহা আসফিন! মায়ের আদর পাওয়া তো দূরে থাক, তার মা জানেয় না সে সাড়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা!

আয়েশার আরো আফসোস হলো কেন তার ছেলেটা আর কয়দিন আগে বলেনি সে আসফিনকে ভলোবাসে। তাহলেই মেয়েটা নিজের একমাত্র ছেলের বউ করে নিতো আয়েশা। মায়ের মতো করে আদর করতো, একটুও কষ্ট দিতো না। সেইসাথে ভালো থাকতো তার ছেলেটা। আয়েশার আফসোসের পাল্লা ভারি হলো। আসফিনের কষ্টে বুক ভারি হলো তার। আয়েশা জানেই না আসফিনকে ভীষণ রকম ভালেবাসা দু’টি ছেলের মা’ই একই রকম আদূরে। আসফিন ভালো আছে খুব!

তুবা কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে নিজের ঘরে চলে এলো। আলমারি খুলে নিজের নতুন কিছ ওড়না বের করলো। ওড়না গুলে হাতে নিয়ে বার কয়েক ভবালো একা একা পারবে সে? পরক্ষণেই মন কে বুঝালে পারতে হবে। তুবা কাঁচি, সুই, সুতা নিয়ে বসলো। কাঁথা সেলাইয়ের জন্য। ছোট কাঁথা, আদুরে কোন বাচ্চার জন্য!
—————————–

ফয়জাল হাসানকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি তুবা। নিজের মতো করে ডুবে আছে তার কাজে। আনাড়ি হাতে করে যাচ্ছে কাজ। অবশেষে পাঁচদিনে চারটি কাঁথা সেলাই করে ফেলেছে সে। কাঁথা গুলো সুন্দর করে ভাজ করে তিনি গেলেন আয়েশার রুমে। বললেন,

“ভাবি, তোমার কাঁথা গুলোর সাথে এগুলোও একটু পাঠিয়ে দিবে?”

আয়েশা ভীষণ অবাক হলো। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো তুবার দিকে। একি দেখছে সে? তুবা? যে নিজের মেয়েকে মেয়ে বলেই মানতে নারাজ সে কাঁথা সেলাই করেছে মেয়ের জন্য? আয়েশা নিজের অবাক ভাব কাটিয়ে বলল,

“কাঁথা তো গতকাল আরাব গিয়ে দিয়ে এসেছে।”

ছোট একটা বাক্য। অথচ তুবার মন আকাশে কালো মেঘের রেখা দেখা দিলো। আয়েশা তার হাত ধরলো। মুচকি হেসে বলল,

“রেখো যাও। আমি নাহয় গিয়ে দিয়ে আসবো।”

তুবা ভীষণ খুশি হলো। আয়েশার ঘরে কাঁথা রেখে আর নিজের ঘরে গেলো না। বহুদিন ধরে বদ্ধ মেয়ের ঘরটায় গেলো। ঘরটায় ধুলোবালি জমেছে। তবে জিনিসপত্র সব সাজিয়ে রাখা। বারান্দায় থাকা নীলকন্ঠ গাছটা শুকিয়ে গেছে। তুবা বাথরুম থেকে পানি এনে গাছের গোড়ায় দিলো। নিয়ে এলে ঝাড়ু, বেলচা, মোছার কাপড়। পুরো দুপুর লাগিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে ফেললো মেয়ের ঘর। তারপর বিছানায় বসে দম নেয়। আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলায় মেয়ের জিনিসগুলোয়। স্বামী ঘরে ফিরলে কি কি বলবে ঠিক করে নেয়। যদিও ভয় কাজ করে মনে। মনে পড়ে নিজের করা কৃতকর্মের কথা। আফসোস হয়, কান্না পায়।

#চলবে…?