দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-৪২+৪৩

0
7

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪২

সূর্যের শেষ আলোক রশ্নি মিলিয়ে গেছে। চারদিকে চলে উঠেছে সোডিয়াম আলো। শাশুড়ির সাথে গল্প শেষ করে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো অধরা। ফোলা পেটটা নিয়ে খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে সে। ঘরের দরজার কাছে এসে থেমে গেলো অধরা। ঘর অন্ধকার! আলো জ্বালানো হয়নি? তরু-লতা সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাতি জ্বালায় তার ঘরে। তবে আজ কেন জ্বালায়নি? অধরা অপেক্ষা করে অন্ধকার সয়ে যাওয়ার। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকতেই কেউ তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো পিছন থেকে। অধরা ভরকে যেতে গিয়েও পারলো না। এই স্পর্শ তার চেনা। অধরা চাপা স্বরে প্রশ্ন করলো,

“কখন এলে?”

তাওসিফ এক হাতে প্রেয়সীর খোঁপা করে রাখা চুল গুলো খুলে দেয়। ছড়িয়ে পরে চুলগুলো। তাওসিফ পরম আবেশে মুখ ডুবায় চুলে। মাতাল করা কন্ঠে বলে,

“একটু আগে।”

তাওসিফের স্পর্শে শিউরে উঠে অধরা। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কিছুক্ষণ পর তাওসিফ ছেড়ে দেয়। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে অধরা বিছানায় বসায়। টেবিলের উপর থেকে আইসক্রিম এনে সামনে ধরে অধরার। মৃদু স্বরে বলে,

“আজকেই শেষ হ্যাঁ? আর খাওয়া যাবে না। বাবুর ঠান্ডা লেগে যাবে।”

অধরা আপত্তি করে না। আইসক্রিম হাতে নিয়ে বলে,

“আর খেতে চাব না।”

অধরার চোখেমুখে তৃপ্তির ছায়া। তাওসিফ গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। একফাঁকে অধরার ঠোঁটে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছে দেয় আলতো হাতে।অধরা খাওয়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে তাকায় তার দিকে। মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে ফের মন দেয় খাওয়ায়।
—————————–

ফয়জাল হাসান বিছানায় বসে আছেন। তুবা সর্তক দৃষ্টি মেলে তাকে দেখছে। বুঝতে চেষ্টা করছে কেমন মনোভাব এখন তার। তবে বুঝতে পারছেনা। তিনি বসপ আছে নির্লিপ্ত ভাবে। সাহস সঞ্চার করে তুবা ডেকে উঠলো,

“শোনো।”

ফয়জাল হাসান স্ত্রীর দিকে মুখ তুলে চাইলেন। বললেন,

“কিছু বলবে?”

তুবা নীরব হয়ে গেলো। ঠিক কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। সে। হাসফাস করতে লাগলো। ফয়জাল হাসান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলল,

“কি হলো? কিছু বলবে?”

তুবা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। বুঝালো কিছু বলতে চায়। ফয়জাল হাসান তার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। তুবা হুট করে বলে বসলো,

“মেয়েকে বাড়ি আনো।”

ফয়জাল হাসান ভ্রূঁ কুঁচকালেন। অবাক হয়ে বলল,

“অরু তো বাড়িতেই ছিলো। কোথাও গেছে নাকি?”

“অরুর কথা বলিনি।”

“তাহলে?”

তুবা অসহায় বোধ করলো। চিৎকার করে বলতে চাইলো আমার কি একটা মেয়ে? কিন্তু বলতে পারছে না। কি করে বলবে? অনেক চেষ্টার পর মুখ ফুটে বলল,

“আসফিন কে।”

ফয়জাল হাসান পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো নিজের স্ত্রীর দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নীরবে। শেষে বলল,

“কেন?”

“এই সময়ে মেয়েরা মায়ের কাছেই থাকে।”

ফয়জাল হাসান স্ত্রীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,

“মায়ের কাছেই আছে ও।”

তুবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। কি বলবে সে? বলার মতো কিছু আর খুঁজে পেলো না সে।
———————-

বিকেলের মৃদু রোদ ধরণীর বুকে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। তাইফা সোফায় বসে কাঁথা সেলাই করেছে। অধরা বসে আছে তার পাশেয়। দু’জনে গল্প করছে। এরমাঝে বেজে উঠলো কলিং বেল। অধরা উঠতে চাইলো কিন্তু তাইফা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলো তাকে। নিজেই গিয়ে দরজা খুললো। অধরার সেঝ চাচি আয়েশা এসেছে। অধরা ভীষণ খুশি হলো চাচির আগমনে। চাচিকে আপ্যায়ন করতে চাইলো নিজে। কিন্তু এবারেও বাঁধা দিলো তাইফা। অধরাকে চাচির সাথে গল্প করতে বলে নিজে গেলো নাস্তার ব্যবস্থা করতে।

অধরা খুশিতে বাক-বাকুম করে চাচির সাথে গল্পে মাতলো। আয়েশা বুঝলো মেয়েটা ভীষণ সুখে আছে। তার চোখের হাসি স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সুখবার্তা। আয়েশা হাসে। কিছুক্ষণ অধরার একটানা গল্প শোনার পর তিনি তার হাতের শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দেয় অধরার দিকে। অধরা অবাক হয়ে বলে,

“এতে কি আছে চাচি?”

“খুলে দেখো।”

অধরা খোলে। ছোট্ট চারটে কাঁথা৷ অধরা ঠোঁট এলিয়ে হাসে। বলে,

“তোমরা কি শুরু করেছো বলোতো! এতোগুলা কাঁথা লাগে? মাও বানাচ্ছে দেখো। ওইদিন আরাব দিয়ে গেলো কত্ত গুলো। তুমি আবার কেন করতে গেলে চাচি।”

“আমি করিনি এগুলো।”

“তাহলল?”

“তোমার আম্মু।”

অধরা চমকে তাকায়। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই শিথিল হয়ে আসে তার চমকানো ভাব। এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চায় না সে। দ্রুত চলে যেতে চায় অন্য প্রসঙ্গে। আয়শা বোঝে। তবুও আলতো স্বরে বলে,

“তুবাকে কেউ বলেওনি তোমার বাবু হবে এ কথা। আমার থেকেই শুনেছে। এরপর হুট করে এসে দিয়ে গেছে এগুলো।”

অধরা কি যেন বলতে চাইলো, তা আগেই সেখানে নাস্তা নিয়ে উপস্থিত গলো তাইফা। শাশুড়ির একদম সঠিক সময়ে আগমনে অধরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কি বলবে সে? বলার মতো কি আছে তার? মিসেস তুবা তাকে মেয়ে হিসেবে মানলো কবে? তাকে নিয়ে কিচ্ছু বলার নেই অধরার। কিছু নাহ!
———————-

চাচির দিয়ে যাওয়া কাঁথা গুলো সূক্ষ্ম ভাবে পরোখ করছিলো অধরা। নিপুণ হাতের সেলাই নয়। তবে খুব যত্ন করে করা। অধরা অবাক হয়। এতো যত্ন তুবা কার জন্য করেছে? অধরার বাবুর জন্য? অন্যভাবে বললে অধরার জন্য? অধরা বিশ্বাস হতে চায় না। কেমন যেন ঘোর লাগে। এরমাঝে ফোনটা বেজে উঠে সশব্দে। ধ্যান ভাঙে অধরার। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে ভেসে আদুরে আদুরে স্বর,

“আপুই, তুমি ভালো আছো?”

অধরা আলতো হাসে। মিষ্টি কন্ঠে বলে,

“আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

“আমিও ভালো আছি। আমার লিটল প্রিন্স সুস্থ আছে তো?”

অধরা হাসে। বলে,

“প্রিন্স? তুমি শিওর? প্রিন্সেস হলে?”

অরুমিতা হেসে উঠে। অধরা কান খুলে শোনে ওর খিলখিল হাসি। মনটা কেমন করে উঠে। অধরা তো বরাবর চেয়েছিলো ছোট বোনটার সবচেয়ে কাছের, ভরসার যয়গাটা সে হোক। বোনটা তার প্রাণ খুলে হাসুক। কিন্তু, একটা ঝড়! অধরার জীবনটা কেমন এলোমেলো করে দিলো। অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবুও ভালো লাগে। আজকাল বোনটার সাথে বেশ ভাব হয়েছে তার। অরুমিতা হাসি থামিয়ে বলে,

“কোন সমস্যা নেই আপুই। প্রিন্সেস হলেও আমি তাকে ভালোবাসবো।”

অধরা মুচকি হাসে। ডাকে,

“অরু।”

“বলো আপুই।”

অধরা ইতস্তত করে। কি করে জিজ্ঞেস করবে? তবুও জিজ্ঞেস করে,

“তিনি ভালো আছেন?”

অরুমিতা নীরব থাকে কিছু সময়। তিনি? অরুমিতা বোঝে। হেসে বলে,

“সুস্থ হওয়ার পর থেকে তো ভালোই আছে।”

অধরা ওহ বলে। আর কথা বাড়ায় না। বোনের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দেয় ফোন।
———————-

ফয়জাল হাসান অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হলেন। বারকয়েক ডাকলেন তুবাকে। কিন্তু কোন সারা নেই। ডাইনিং এ নেই, রান্নাঘরে নেই। কোথায় গেলো তাহলে? ফয়জাল হাসান দোতালায় উঠলেন। অরুমিতার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন সেখানেও নেই। তাহলে গেলো কেথায়? হুট করে তার চোখ গেলো অধরার ঘরের দিকে। দরজাটা একটু খোলা। ঘর অন্ধকার। ফয়জাল হাসান মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। জ্বালালেন ড্রিম লাইট। আবছা আলোতে তিনি দেখলেন মেয়ের ঘর একদম পরিপাটি করে সাজানো। দেখলে মনে হবে না এক বছরের ও বেশি সময় ধরে এখানে কেউ থাকে না। মনে হচ্ছে অধরা বাইরে গেছে, একটু পরে এসেই বিছানায় শুয়ে পরবে। ফয়জাল হাসান আবছা আলোয় বারান্দায় একটা ছায়া দেখতে পেলেন। তার বুঝতে বাকি রইলো কার ছায় ওটা। সাথে বুঝে গেলেন ঘর পরিপাটি থাকার রহস্য। এবং অবাক হলেন সবচেয়ে বেশি। তিনি বারান্দায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন তুবা ভীষণ যত্ন করে পানি দিচ্ছে অধরা প্রিয় অপরাজিতা গাছটায়। গাঢ় নীল রঙের ফুল ফুটে আছে তাতে। ফয়জাল হাসান মৃদুস্বরে ডাকলেন,

“তুবা!”

তুবা পিছনে ফিরে তাকালো। হেসে বলল,

“তুমি এখানে?”

“প্রশ্নটা আমারো! তুমি এখানে?”

তুবার হাসি হাসি মুখটা নিমেষেই হারিয়ে গেলো। ছলছল চোখ নিয়ে বলল,

“আমার মেয়ের ঘর গোছাতে এসেছিলাম।”

ফয়জাল হাসান অবিশ্বাসের সাথে বললেন,

“তোমার মেয়ে?”

তুবা এবার ডুকরে কেঁদে উঠে,

“আমার মেয়েই তো।”

“মানতে না তো।”

এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তুবা। জড়িয়ে ধরে ফয়জাল হাসানকে। ফুঁপিয়ে উঠে বলে,

“এখন মানছি তো। এনে দাও না আমার মেয়েকে। একটু দেখবো। কতোদিন দেখি না। ঘরটা কেমন ফাঁকা দেখো না। নিয়ে আসো না মেয়েকে।”

ফয়জাল হাসান অসার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। স্তব্ধ হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য। কি বলবে ভেবে পায় না। শুধু ভাবে আসফিন কি সব ভুলে ফিরে আসবে মায়ের কোলে?

#চলবে…?

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪৩

সূর্য্যি মামার তেজ কমেছে। রোদ গায়ে লাগছে না। মৃদু বাতাস বইছে। তরুলতায় হাজির হলেন ফয়জাল হাসান। ফোলা পেট নিয়েই যেন ছুটে এলো অধরা। ঝাপিয়ে পরলো বাবার বুকে। ফয়জাল হাসান পরম আদরে মেয়েকে আগলে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তাইফা ফয়জাল হাসানকে দেখে খুব খুশি হলেন। অধরার খুশির যেন শেষ নেই। খই ফুটছে তার মুখে। রাজ্যের গল্প তার বাবার সাথে। ফয়জাল হাসান মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনতে লাগলেন মেয়ের কথা। নিজে যে কিছু বলতে এসেছিলেন বেমালুম ভুলে গেলেন তা। একসময় মনে পড়লো। কিন্তু মেয়ের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারলেন না। মেয়ের এখন শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিক পরিবর্তন ও হয়েছে। এসময় খুব সহজেই উত্তেজিত হতে পারে মেয়ে। তাই তিনি মেয়ের সামনে তুললেন না তুবার কথা। সন্ধ্যা অবধি মেয়ের কাছে থেকে ফিরে এলেন নবকুঞ্জে।

নবকুঞ্জে প্রবেশ করতেই দেখা পেলেন মায়ের। নবনী আনজুম ছেলে কাছে ডাকলেন। বর্তমানে তিনি একা হাঁটতে পারেন না। জোরে কথাও বলতে পারে না। শ্বাসকষ্ট বেড়েছে খুব। ফয়জাল হাসান চুপচাপ মায়ের পাশে গিয়ে বসলেন। নবনী আনজুম মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

“আসফিন কেমন আছে?”

“ভালো আছে মা।”

“শরীরটা ভালো?”

“হ্যাঁ।”

নবনী আনজুম মাথা নড়লেন। আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। আরো কিছুক্ষণ মায়ের পাশে নীরবে বসে থাকার পর ফয়জাল হাসান উঠে তার ঘরে গেলেন। তুবা বিছানায় বসে শুকনো কাপড় ভাজ করছিলো। ফয়জাল হাসানকে ঘরে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করলো,

“মেয়ের কাছে গিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ।”

“কেমন আছে আসফিন?”

“ভালোয় আছে।”

তুবা ইতস্তত করে বলল,

“কবে আসবে? আসতে বলেছো?”

ফয়জাল হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এগিয়ে গেলেন তার স্ত্রীর দিকে। তুবার দুই কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বললেন,

“মেয়েটার শারীরিক, মানসিক অবস্থা এখন ভালো নেই। তুমি তো জানো এ বাড়িতে ওর জীবনে কতো বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেছে। এই অবস্থায় কি করে এই বাড়িতে আসবার কথা বলি? ও সুস্থ হয়ে নিক। তারপর আসবে নাহয়।”

তুবার খুব কান্না পেলো। মেয়ের সাথে ঘটা সব ঘটনা মনে পড়তেই নিজেকে হীন মনে হলো। কতো জঘন্য মা সে! ছিহ! নিজেকে নিজের কাছেই ঘৃণা লাগলো তুবার। মেয়েকে একটা পলক দেখার জন্য, মেয়েটার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য, মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য কিংবা বুকের মাঝে একটু আগলে নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো মন। তবুও মেয়ের কথা ভেবে দমে গেলো তুবা। অপেক্ষা করতে লাগলো সেই মহেন্দ্রক্ষণের, যখন মেয়েটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে তৃষ্ণা মেটাবেন তিনি। বুকটা কেমন খা খা করছে তার। এতো শূণ্যতা! সব মেয়েটার জন্য।
————————-

মধ্য দুপুর। আজ রোদের তাপ বড্ড বেশি। ফ্যানের বাতাস যেন গায়ে লাগছে না। ভ্যাপসা গরমের মাঝে টেবিল সাজাতে ব্যস্ত তাইফা। শুক্রবার আজ। স্বামী, ছেলে এসে যাবে কিছু পরে। তরু-লতাও সাহায্য করছে মা কে। অধরা বসে আছে চুপচাপ। আধ ঘন্টা পরেই টেবিলে বসে পরলো সবাই। প্লেট, বাটি সরানোর শব্দ, চামচের টিংটং আওয়াজ আর তরু-লতার ঝগড়ায় মেতে উঠলো ডাইনিং রুম। অধরাও তরু-লতার সাথে মজায় ব্যস্ত হয়। হুট করে থেমে যায় অধরা। খাওয়ার মাঝে কেউ খেয়াল করে না। অধরার অস্থির লাগে। তবুও চুপ থাকে। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। তীব্র ব্যথায় চোখমুখ খিঁচে ফেলে মেয়েটা। পাশের চেয়ারে বসা তাওসিফের হাত ধরে ফেলে খপ করে। খাওয়া থামিয়ে অধরার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে তাওসিফ। চোখেমুখে বেদনার ছাপ মেয়েটার। তাওসিফ দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। অধরার হাত শক্ত করে ধরে বলে,

“কি হলো অধরা? খারাপ লাগছে?”

ব্যাথায় চোখ বুজে আসে অধরার। কন্ঠ নালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হলো। তবুও ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,

“প্রচুর কষ্ট হচ্ছে।”

এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার ব্যথায় আত্মনাদ করে উঠলো অধরা। তাইফা বুঝলেন সব।।দ্রুত উঠে অ্যাম্বুলেন্স আসতে বললেন। তার অধরার কাছে গিয়ে বুকের মাঝে আগলে নিলেন তিনি। তাওসিফ কে বললেন দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে। ততক্ষণ নিজেই সামলে নিলেন অধরাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বলতে লাগলেন,

“কিছু হবে না মা। এইতো আর একটু। কষ্ট হচ্ছে খুব? এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে। সোনা মা। আর একটু ধৈর্য ধর।”

অধরা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে তবুও পারছে। এতো কষ্ট তার কখনো হয়নি। অ্যাম্বুলেন্স আসতেই দ্রুত অধরাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো তাইফা এবং তাওসিফ। তরু-লতা আর তাদের বাবাকে বাড়ির দিকটা সমালে তারপর আসতে বলল।

হসপিটালে পৌঁছাতেই ডাক্তার অধরাকে নিয়ে গেলো। আরো কিছু সময় তীব্র ব্যথার সাথে লড়াই করে অবশেষে ফুটফুটে এক মেয়ের জন্ম দিলো অধরা।

হসপিটাল করিডোরে চিন্তিত অবস্থায় পায়চারি করছে তাওসিফ। তার বুক কাঁপছে। প্রতিদিন কতো সংবাদ পাওয়া যায় সন্তান জন্ম দিতে মায়ের মৃত্যু! তাওসিফের আজই যেন সব সংবাদ মনে পরছে। অধরাকে হারিয়ে ফেলার ভয় গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। মনে মনে বারবার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে সে। প্রর্থনা করছে মা-সন্তান দুই জন-ই যেন সুস্থ থাকে। এরমাঝে তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো একটা শিশুকে কোলে নিয়ে বের হলো নার্স। এগিয়ে এলো তাওসিফের দিকে। বাচ্চাটা তাওসিফের কোলে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

“আপনার মেয়ে স্যার।”

তাওসিফ পরম আদরে কোলে নিলো মেয়েটাকে। দ্রুত নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার ওয়াইফ?”

“একদম সুস্থ আছে স্যার। এখনই কেবিনে পাঠানো হবে।”

তাওসিফ আলহামদুলিল্লাহ পড়লো। তাইফা উঠে এসে নাতনিকে দেখছে। কি মিষ্টি হয়েছে দেখতে। তাওসিফ মেয়ের দিক থেকে চোখই সরাতে পারছে না। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“এটা আমার মেয়ে মা!”

তাইফা হাসেন। হেসে বলে,

“হ্যাঁ, তোর মেয়ে। তাওসিফ মেয়ের কানে আজান দে। তোর বাবাকে ফোন করে বল দ্রুত আসতে। অধরার বাবাকেও বল।”

তাওসিফ মায়ের কথা অনুযায়ী কাজ করে। ফয়জাল হাসান অফিসে ছিলো। অফিস থেকে ছুটে এলেন তিনি। ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে তরু-লতা এবং তাদের বাবা। সবাই মেতে আছে ছোট প্রাণটিকে নিয়ে। ফয়জাল হাসান নিজেও গেলেন। কোলে তুলে নিলেন ছোট বাচ্চাটিকে। মনে পড়ে গেলো প্রায় বাইশ বছর আগের কথা। অধরার জন্মের কথা। তাওসিফের মতো সেদিন তার মুখে ছিলো প্রাপ্তির হাসি। ছোট, নিস্পাপ একটা শিশুকে তিনি কোলে নিয়েছিলেন কাঁপা কাঁপা হাতে। আজ সেই মেয়েটা মা হয়ে গেলো। ফয়জাল হাসানের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে অশ্রুকণা। নাতনিকে তার বাবার কোলে দিয়ে ছবি তুলে নেন। পাঠিয়ে দেয় বাচ্চার খালামণির কাছে।

অরুমিতা অনলাইন ক্লাস করছিলো। বাবার নাম্বার তেকে মেসেজ আসতেই ক্লাস ফেলে মেসেজ চেক করতে গেলো। জরুরি না হলে বাবা মেসেজ করে না। ইনবক্সে ঢুকতে চমকে গেলো অরুমিতা। মিষ্টি একটা বাচ্চার ছবি। তাওসিফ ভাইয়ার কোলে। মানে! অরুমিতা কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। যতক্ষণে জ্ঞান ফিরে ততক্ষণে ইয়াহু বলে চিল্লিয়ে উঠে সে। ছুটে বের হয় ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে চেচিয়ে উঠে,

“আঁখি আপা, অহি আপা, অণিতা আপা, আরাব ভাইয়া, নীহু, নীরব দেখে যা। আমি খালামণি হয়ে গেছি রেএএএ।”

অরুমিতা গলার আওয়াজে রান্নাঘরে থেকে বেরিয়ে আসে ঘরের গিন্নিরা। ছুটে আসে বাচ্চারাও। ততক্ষণে অরুমিতা সোফায় বসা দাদুনির পাশে বসে। দাদুনির হাতে ফোন দিয়ে বলে,

“দেখো দাদুনি আমাদের ছোট সোনা। কি মিষ্টি হয়েছে না দেখতে?”

নবনী আনজুমের চারদিকে তখন ভির করে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চারা। তহুরা উঁকি দিয়ে দেখে বলে উঠলো,

“ওমা! এ তো দেখি একদম ছোট আসফিনের মতো দেখতে।”

সবাই দেখে সায় জানালো। এই খুশির ঢেউয়ের মাঝে ছুটে এলেন তুবা। আয়েশা বলল,

“দেখেছো নাতনিকে? একদম অবিকল আসফিনের মতো হয়েছে।”

তুবা ফোনটা হাতে নিলো। ছবিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। আদুরে একটা বাচ্চা চোখ বুঝে বাবার কোলে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। তুবা অধরার ছোট বেলা মনে করার চেষ্টা করলো। কেমন ছিলো অধরা দেখতে? এমন আদুরে? ঠোঁট দুটো এভাবে ফুলিয়ে রাখতো? চোখ গুলো এমন সুন্দর ছিলো? তুবার মনে পরলো না। কোনদিন অধরার দিকে ভালো করে তাকিয়েছে কওনা তাও মনে করতে পারলো না। তবে ছবির বাচ্চাটিকে দেখলো মনোযোগ দিয়ে। সবায় বলছে তার অধরা নাকও এমন ছিলো দেখতে। এমন আদুরে অধরার জন্য কেন তবে তার ভালোবাসা আসেনি। এতো কষ্টে পেটে ধরেও কেন মায়া জন্মায়নি? তুবা নিজেকে প্রশ্ন করে। উত্তর পায় না। কিছুক্ষণ গভীর ভাবে ছবি দেখার পর হুট করে সে বলে উঠে,

“আমি হাসপাতালে যাব। আমার মেয়েকে দেখতে যাব।”

তুবার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে বাড়ি ভর্তি মানুষ। তাদের সবার চোখে বিস্ময়। তুবার বলা কথা হজম হচ্ছে না তাদের। তবে এসবে যেন কিছু যায় আসে না তুবার। সে আবার বলে উঠে,

“আমি হাসপাতালে যাব। কোন হাসপাতালে আছে আসফিন? কেউ নিয়ে যাবে আমাকে? অরু? কোথায় আছে বল। আমি এক্ষুনি যাব।”

অরুমিতা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। যেন স্বপ্ন দেখছে সে!

#চলবে…?