#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪৪
ড্রাইভিং সিটে বসে ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে আরাব। পাশে অরুমিতা। পিছনে বসেছে তুবা। তুবাকে কোন ভাবেই আটকে রাখা যায়নি। অরুমিতা আটকাতেও চায়নি। তার বোনটা একটু মায়ের ভালোবাসা পাক। দেরিতে হলেও পাক। বোনের কাছে মায়ের ভালোবাসা পৌঁছে দিতে ছুটে চলছে সে। তুবা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। তারপর হুট করে তাকায় সামনে। অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে,
“আর একটু জোরে চালাও না বাবা।”
আরাব লুকিং গ্লাসে তাকায় তুবার দিকে। তার বিস্ময় এখনো কাটেনি। বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কি চাইছে ছোট চাচি। আরাবের ভয় লাগছে। অরুমিতার কথায় তুবা নিয়ে আসলেও মনে মনে ভয় কাজ করছে তার। যদি হাসপাতালে গিয়ে কোন গন্ডোগোল পাকায়। আরাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমার ড্রাইভিং এর অভ্যাস নেই ছোট চাচি। জোরে চালালে ভয়ংকর কিছু ঘটো যেতে পারে।”
তুবা আর কথা বাড়ায় না। নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে বাইরে। মনে চলছে তার মিশ্র অনুভূতি। মেয়েকে দেখতে পাওয়ার আনন্দ সাথে ভয়!
———————-
তাওসিফ নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ আগে অধরাকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। জানলার কাঁচ ভেদ করে তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মি এসে পড়ে তাওসিফের মুখে। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ছোট শিশুটির মুখ। অধরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। তাওসিফ এগিয়ে আসে। অধরা উঠার চেষ্টা করে। তাওসিফ বলে উঠলো,
“উহু, নড়াচড়া করো না। আমি আসছি তো।”
থেমে যায় অধরা। তাওসিফ এগিয়ে আশে। পাশে এসে বসে। ফিসফিস করে বলে,
“আমাদের মেয়ে, দেখো অধরা।”
অধরা তাকায়। কি মিষ্টি দেখতে। তাওসিফ হাসে। আবার বলে,
“বলেছিলাম না তোমাকে? ছোট অধরা আসছে।”
অধরা মৃদু হাসে। হাত বাড়িয়ে দেয়। তাওসিফ আলতো করে মায়ের বুকে রাখে ছোট সোনাকে। তারপর বলে,
“আমার আম্মা, অরোরা তাহমিন।”
তাওসিফের চোখে খুশির ঝিলিক অধরা বিস্মিত নজরে তাকায় তাওসিফের দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“অরোরা?”
তাওসিফ হেসে বলে,
“হ্যাঁ, অরোরা তাহমিন। পছন্দ হয়নি?”
“হয়েছে।”
এমন সময় নার্স ঢোকে কেবিনে। তাওসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“স্যার, ম্যাম অনেক ক্লান্ত। তার রেস্টের দরকার।”
তাওসিফ অধরার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ঘুমাও এবার।”
অধরা অরোরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“বাবু থাক আমার কাছে।”
তাওসিফ মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে আনে। নিজের উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় অধরার কপালে। আলতো হাত বুলায় অরোরার পিঠে। মৃদু স্বরে বলে,
“তোমরা ঘুমাও। কিছু ফর্মালিটি বাকি আছে। আমি শেষ করে আসি।”
অধরা মাথা নাড়ায়। বেরিয়ে যায় তাওসিফ। ক্লান্ত অধরা বুকের উপর নিজের নাড়ি ছেড়া ধনকে নিয়ে পারি জমায় ঘুমের দেশে।
——————
আরাব হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামায়। দ্রুত নেমে আসে তুবা। তিনজন একসাথে হাসপাতালে প্রবেশ করলেও তুবার হাঁটার গতি বেশি। সে যেন ছুটছে। অরুমিতা ভাবে, এতো আদর জমানো মায়ের বুকে? মেয়ের টানে এভাবে ছুটছে? আরাব ভাবে, কি চায় ছোট চাচি? কি পরিকল্পনা তার? কোন ক্ষতি করবে না তো!
নিদিষ্ট ফ্লোরে পৌঁছে তুবা নিজের স্বামীকে দেখতে পায়। পাশে অধরার শশুর-শাশুড়ি আছে। তুবা এগিয়ে যায় স্বামীর দিকে। অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে,
“আসফিন কোথায়?”
স্ত্রীকে হঠাৎ হাসপাতালে দেখে চমকে যায় ফয়জাল হাসান। অবাক কন্ঠে বলে,
“তুমি এখানে? কার সাথে এলে?”
তখনই তার নজর যায় অরুমিতা আর আরাবের দিকে। আর কিছু জিজ্ঞেস করেন না তিনি। তুবা ফের বলে,
“কোথায় আসফিন?”
“ঘুমাচ্ছে।”
“আমি একটু দেখে আসি।”
তাওসিফ আসে তখনই। তুবাকে দেখে সে নিজেও অবাক হয়। আশা করেনি তুবা আসবে। অরুমিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আরাবকে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো ভাই?”
আরাব হাসে। বলে,
“ভালোয় আছি।”
তুবা তাওসিফকে দেখে। তাওসিফের সামনে গিয়ে এবার বলে,
“আমার মেয়ে কোথায়? একটু দেখবো।”
তাওসিফ তাকায় ফয়জাল হাসানের দিকে। তিনি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাওসিফ তুবা কে নিয়ে কেবিনে যায়। তুবা এক পা দু পা করে এগোয়। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। তার বুকের উপর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে একটা শিশু। তুবা ভাবে, তার বুকে কখনো এমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে তার আসফিন? উহু! মনে পরে না৷ কোনদিন বুকে বোধহয় ঠাঁই হয়নি মেয়েটার। আজ তুবার খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে একবার বুকে টেনে নিতে। তাওসিফ শ্বাস রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় লাগছে তার। যদি অধরার ঘুম ছুটে যায়। ঘুম থেকে উঠে চোখের সামনে তুবাকে দেখে কেমন রিয়েক্ট করবে অধরা? যদি খুব রেগে যায়৷ তখন কি করবে তাওসিফ। তুবা এগিয়ে৷ যায়। তার মনে হয় কতকাল পরে মেয়েকে দেখছে সে। অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সে মেয়েকে। তারপর হাত বাড়িয়ে দেয়। আদুরে হাতে মাথায় হাত বুলায়। ঘুমের মাঝে একটু নড়ে উঠে অধরা। তাওসিফের বুক কাঁপে। তুবা মেয়ের হাত ধরে বসে। চোখে জল। কতো কিছু বলার আছে মেয়েকে। অরুমিতা কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে তার মায়ের নতুন রূপ। চোখে পানি জমে তার। পিছনে ঘুরে নিঃশব্দে কেঁদে উঠে।।আরাব পাশেই ছিলো। আলতো ভাবে হাত রাখে সে অরুমিতার মাথায়। ফিসফিস করে বলে,
“সব ঠিক হয়ে যাবে অরু। সব। কাঁদিস না।”
অরুমিতা মাথা তুলে তাকায় আরাবের দিকে। মেনে নেয় সব ঠিক হয়ে যাবে।
———————
অধরার যখন ঘুম ভাঙলো তখন তুবা তার পাশেই বসা। অধরা দেখলো, তবে কোন রিয়েক্ট করলো না। তাওসিফ যেন এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। কেবিনে এলো আরাব আর অরুমিতা। অরুমিতার আজ যেন বাঁধ ভাঙা খুশি। অরোরাকে কোলে নিয়ে সে হাজারো আহ্লাদে মেতে উঠলো। আরাব হেসে বলল,
“মা হয়ে গেলি অধু।”
অধরা হেসে বলে,
“এবার তুইও বিয়ে করে বাপ হয়ে যা প্লিজ।”
“বেকার আমি, মেয়ে দেবে কে?”
“আমি খুঁজে এনে দিব যা।”
আরাব হাসলো। তুবা মেয়েকে ভালো আছে কিনা, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করতে চাইলো। বলতে চাইলো অনেক কথা। কিন্তু এতো মানুষের মাঝে বলতে পারছে না। কেমন সঙ্কোচ হচ্ছে। এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে সে।
অধরাকে আজ হাসপাতালে থাকতে হবে। অনেক ব্লাড গিয়েছে, আজকের রাতটা অবজারভেশনে রাখতে চায় ডাক্তার। দরকার হলে রক্ত দিবে নাহয় কালই ছেড়ে দিবে। আপত্তি করলো না কেউ। তরু-লতা, তাইফা আর তাওসিফের বাবা চলে গেলেন। তাওসিফ জোর করে তার মা’কে পাঠিয়ে দিয়েছে। তুবা যেতে চাইলো না। ফয়জাল হাসান আরাব কে বলল,
“বাবা, অরুমিতাকে নিয়ে তুমি চলে যাও। আমি পরে তোমার চাচিকে নিয়ে আসছি।”
আরাব সম্মতি জানালো। তারা দুইজন অধরার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
——————
গাড়ি চকবাজারের গুলজার মোর থেকে চট্টেশ্বরী রোডের দিকে মোর নিলো। প্রথম কিছু জায়গায় একটু আকটু জ্যাম থাকলেও আস্তে আস্তে রাস্তা ফাঁকা হতে লাগলো। এই রোডে পাকলিক বাস, অটো চলে না। পুরো রাস্তা জুরে প্রাইভেট কার, রিক্সার ছড়াছড়ি। মেডিকেল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসের সামনে আসতেই রাস্তা একদম ফাঁকা হয়ে গেলো। রাস্তাটা বেশ নীরব। দুই ধারে পাহাড়। আী বেশ অন্ধকার। উঁচু নিচু রাস্তা বেয়ে গাড়ি চলছে আপন গতিতে। অরুমিতা তাকিয়ে আছে বাইরে। এবারে ষোলতে পা দিয়েছে মেয়েটা। কয়দিন পর ক্লাস টেনে উঠবে। আরাব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাইরে নয়। অরুমিতার সকল ধ্যান তার দিকে। চোরা চোখে বারবার সে আরাবকেই দেখছে। আরাব নিজের কথা ভাবে। এমন বয়সে সেও কারো দিকে এভাবে তাকাতো। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তাকে দেখতো। এই চোখের ভাষা সে বোঝে। বোঝে বলেই ধমকে বলতে পারেনা এভাবে দেখবি না আমাকে। নিজে যে কষ্টটা মনের মাঝে পুষেছে তা অন্য কাউকে দিতো ইচ্ছে হয় না। আরাব ঘেমে উঠে। কিন্তু কি করবে সে? জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে হুট করে ব্রেক কষে সে। গাড়ি থামায় রাস্তার একপাশে। অরুমিতা কিছুটা ভরকে যায়। অবাক হয়ে তাকায় আরাবের দিকে। আরাব তাকায় না। সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,
“বয়স কতো তোর?”
অরুমিতা অবাক হয়ে বলে,
“ষোলো।”
“এটা আবেগের বয়স জানিস?”
অরুমিতা এবার একটু বোঝে। কিন্তু কিছু বলে না। আরাব আবার বলে,
“আজ আবেগে যা ভালো লাগছে, কাল আর তা ভালো লাগবে না। দুচোখে দেখতেও ইচ্ছে হবে না।”
অরুমিতা মুচকি হাসে। মৃদুস্বরে বলে,
“আপুইও তো তোমার আবেগের বয়সের ভালোলাগা। এখন বুঝি আপুইকে তোমার ভালো লাগে না?”
আরাব চোখ বন্ধ করে ফেলো। বলে,
“সবারটা আমার মতো হবে?”
“আমারটা হবে না বলছো কি করে।”
আরাব এবার তাকায় অরুমিতার দিকে। অরুমিতা নিজেও তাকিয়ে থাকে। আলতো স্বরে বলে,
“আমার নাহয় আবেগের বয়স, তোমার তো নয়! তুমি ঠিক করে আগলে নিলেই হলো।”
আরাব চোখ সরিয়ে ফেলে। কিছু বলে না আর। আবার ছোটায় গাড়ি। মনের মাঝে চলে ঝড়। কি চাইছে মন? আরাব বোঝে না। বুঝতে পারে না!
#চলবে….?
#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪৫
হাসপাতাল থেকে সন্ধ্যার আগে আগে বিদায় নিলেন তুবা ও ফয়জাল হাসান। তুবার যদিও চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু ফয়জাল হাসানের কথায় ফিরে এলেন। হাসপাতালে থেকে অবশ্য কোন লাভই হতো না। মেয়েকে তার দরকার অতি কাছে। একান্তে কথা বলা খুব প্রয়োজন। মেয়ের মুখে একবার আম্মু ডাক শুনতে পাবার আশায় তার প্রাণ বুঝি যায় যায়৷ যে ডাক শুনলেই আগে রাগে মাথা ফেটে যেতো তার, আজ সেই ডাক শুনতে না পেয়ে দিশেহারা সে। তুবা অস্থির হয়ে উঠে। স্ত্রীর অবস্থা দেখে বেশ ভয় পায় ফয়জাল হাসান। সুস্থ হয়ে উঠছে খুব বেশিদিন তো হয়নি। চবার যদি আগের অবস্থায় ফেরত যায় তাহলে কি হবে ভাবতেই ভয় লাগছে তার। ডাক্তারের সাথে একবার কথা বলা দরকার। আর একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দেন তিনি। তুবার দৃষ্টি তখনো বাইরে। কেমন উদাস!
কেবিনের বেডে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে অধরা। তাকিয়ে দেখছে একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়ানো তাওসিফের দিকে। কোলে তার মেয়ে, উহু! তাদের মেয়ে অরোরা। তাওসিফ অরোরাকে কোলে নিয়ে কেবিনের মাঝে হাঁটছে। গান শুনচ্ছে, গল্প করছে। কিছুক্ষণ বাদেই অরোরা কেঁদে উঠলো। তাওসিফ যেন দিশেহারা হয়ে গেলো। আদুরে স্বরে বলল,
“মা, আমার আম্মা। কাঁদে না বাবা। কি হলো? গান শুনবে আম্মা?”
অধরা মুচকি হাসলো। তারপর জোরে বলল,
“শুধু মেয়েকে শুনালে হবে? মেয়ের মাও গান শুনতে চায়।”
তাওসিফ তাকালো অধরার দিকে। হেসে বলল,
“তাই নাকি?”
অধরা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। তাওসিফ এসে বসলো অধরার পাশে। অধরা কোলে তুলে নিলো অরোরাকে। আলাতো করে বুকের সাথে চেপে নিয়ে বলল,
“কাঁদে না সোনা। এই তো আম্মু, দেখো।”
ছোট অরোরা পিটপিট করে চাইলো। নিমেষেই কান্না বন্ধ হলো তার। মুখে আঙুল পুরে চুপ করে লেপ্টে থাকলো মায়ের বুকে। তাওসিফ অবাক হয়ে মেয়ের কান্ড দেখলো। অভিমানী স্বরে বলল,
“এটা কি হলো আম্মা? এখনই আম্মার পক্ষ নিচ্ছেন? এসব ঠিক না।”
অধরা ফিক করে হেসে বলল,
“বেশ করেছে। তুমি এবার গান শুনাও জলদি। অরোরা গান শুনতে চায়।”
তাওসিফ এক নজর তাকালো মা-মেয়ের দিকে। তার মনের প্রশান্তি। তার দুটো ভালোবাসা, তার সামনে বসে। তাওসিফ চোখ বন্ধ করে গেয়ে উঠে,
“এসোনা ভাসি প্রেম সাগরেরই মোহনায়
কতটা দূর নেই জানা
প্রেম সেতো বাধা মানে না,মানে না..
প্রেমের সাগর ভেজা চাঁদর
তোমার মাঝে নাও আমাকে
নিবীর করে বাসবো ভাল
ভিষণ আদর দেবো তোমাকে।
আকশেরই সীমানায় গোধূলির সাঝ
তোমাকেই বলে দিয়ে যায় ঠিকানা
ঐ চোখে কি নেশা, কেমন ব্যাকুলতা
অসীম আকুলতা, এই তো ভালোবাসা…..”
অরোরাকে কোলের মাঝে জড়িয়ে রেখে প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলে অধরা। অনুভব করে গানের প্রতিটি লাইন। তাওসিফ আনমনে গেয়ে যায়। অধরা এক সময় মাথা এলিয়ে দেয় তাওসিফের কাঁধে। চোখ বুজে থাকা অধরার দিকে তাকিয়ে গান শেষ করে তাওসিফ। গান শেষ হওয়ার পরেও অধরা একই ভাবে বসে থাকে। তাওসিফ আলতো হাতে জড়িয়ে নেয় তাকে। কেউ কোন কথা বলে না। অরোরাও নিশ্চুপ। নীরবে নিভৃতে শুধু অনুভব করে তারা।
——————–
বাড়ির দক্ষিণ দিকে আরাবের ঘরে। জানালা দিয়ে দেখা যার বাড়ির পিছন দিক। গাছপালায় ভরে থাকায় জায়গাটা নীরব থাকে সব সময়। দখিনা হওয়া বয়ে আসছে। জানলা হাট করে খুলে রাখা। তাই উড়ছে আরাবের বইয়ের পাতা। আরাব আনমনে তাকিয়ে থাকে জানালায় বাইরে। কি ভাবছে নিজেও জানে না সে। অনেক ভাবনার মাঝে হুট করে এলো অরুর ভাবনা। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েটা কেন তাকে অনুভব করবে? অরুমিতার সাথে খুব ভাব করে কখনো কথা হয়নি তার। সাধারণ কথা হয় শুধু। তবে কি করে তাকে চাইছে মেয়েটা! কতটুকু চেনে সে আরাবকে? অবুঝ মেয়েটা কি চাইছে কে জানে। তারপর ভাবে সে কি পারবে অরুকে চাইতে? আর যদিও চায়, তবে অরুর ভালোলাগা যদি কখনো শেষ হয়ে যায়? আবেগ বন্ধ হয়ে যায়! তখন? তখন আরাব কি করবে? আরো একবার হারানোর কষ্ট সইতে পারবে? আরাব নিজের মাথা চেপে ধরে। নিজেকে নিজে শুধায়
“কুল আরাব কুল! শান্ত হয়ে বস।”
কিন্তু শান্ত হয় না মন। উত্তাল সমুদ্রের মতো অশান্ত সে। শোনে না কোন কথা। ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে তীরে। শেষমেশ এই ভয়ংকর সমুদ্রে স্বেচ্ছায় ডুবতে চাইবে কে? দেখা যাক!
——————
তানিশা আর দাদুনির মাঝে বসে আছে অরুমিতা। তার হাতে ফোন। অরোরার ছবি দেখাচ্ছে দুইজনকে। তানিশা দেখছে আর চোখ মুছছে। তার বাচ্চাটা কতো বড়ো হয়ে গেছে। মা, হয়ে গেছে। কেমন মা মা দেখাচ্ছে। তানিশা কেমন আত্মিক শান্তি পায়। দাদুনিও দেখে উচ্ছ্বসিত মুখে। কতক্ষণ পর পর বলে উঠে,
“দেখো তানিশা, কেমন মিষ্টি হয়েছে দেখতে। একদমই আসফিনের মতো। মায়ের মতো হবে।”
তানিশা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,
“বাবার মতো হলেও কোন সমস্যা নেই দাদুনি। তাওসিফ দেখতে কম সুন্দর নয়।”
নবনী আনজুম হাসেন। কথা মিথ্যে নয়। এরমাঝে দোতালা থেকে নেমে আসে আরাব। অরুমিতা ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আঁড়চোখে তাকায় তার দিকে। আরাব বুঝে যায়। জোরে শ্বাস টানে সে। হাসিমুখে বলে,
“বড়ো আপা, কখন এলে?”
তানিশা তাকায় আরাবের দিকে। বলে,
“এই তো আসলাম একটু আগে। আরাব? আসফিন কবে আসবে রে? বাবুকে দেখা হলো না।”
“বাবু না অরোরা বলো। ভাইয়া নাম দিয়েছে। আসবে এখানে। ও সুস্থ হলেই।”
অরুমিতা বলল,
“অরোরা?”
“হুম অরোরা তাহমিন।”
তানিশা বলে উঠলো,
“বাহ! কি সুন্দর হয়েছে নামটা। একদম দু’জনের সাথে মিলানো।”
আরাব হাসে। তখনই চোখ যায় অরুমিতার দিকে। কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরাবের অস্বস্তি হলো। কথা কাটিয়ে আবার উপরে চলে গেলো সে। বিক্ষিপ্ত হলো মন। মেয়েটা এতোটা মশগুল হলো কবে? আরাব আরো আগে টের পেলো না কেন? আরাব চিৎ হয়ে শুয়ে পরে বিছানায়। আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না কিছু!
—————–
“মিস্টার তাওসিফ, আপনার স্ত্রী একদম সুস্থ আছে। আজই বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। তবে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে খেয়াল রাখবেন। উনার শরীর খুব দুর্বল।”
“জি রাখবো। আজ তাহলে আসি।”
ডাক্তার মাথ নেড়ে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। তাওসিফ সব কিছু গুছিয়ে নিতে লাগলো। বাড়ি ফিরবে একটু পরে। অরোরা ঘুমিয়ে আছে। আচ্ছা মেয়ে হয়েছে তার। সারারাত না ঘুমিয়ে এখন আরাম করে ঘুমাচ্ছে। বাবাও একখানা পেয়েছে। আহ্লাদী বাবা সারারাত কোলে নিয়ে কেবিন জুরে হেঁটে বেরিয়েছে। মেয়ের কান্না থামাতে যা যা করতে হয় সব করেছে। মেয়ে তার নাছোড়বান্দা। তবুও কান্না থামায়নি। তাওসিফের চোখ ফুলে আছে, সারারাত না ঘুমানোর ফল। তবুও তার চেহারায় ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। অধরা চেয়ে থাকে মানুষটার দিকে।
তাওসিফের হুট করে নজর যায় অধরার দিকে। অধরা এক দৃষ্টিতে তাকেই দেখছে। তাওসিফ হাসে। দুষ্টু হেসে বলে,
“এভাবে কি দেখছেন ম্যাম? এখনো সুস্থ হননি ততেই আর একজনকে আনার প্লানিং করছেন নাকি?”
অধরা প্রথমে কথার মানে বুঝলো না। যতক্ষণে বুঝলো সে ফুঁসে উঠলো। রাগ দেখিয়ে বলল
“নিজে অসভ্য বলে তুমি সাবায়কে নিজের মতো ভাবো নাকি?”
তাওসিফ অবাক হয়ে গেছে এমন ভাব ধরে বলে,
“আমি? আমি অসভ্য? কেমনে বলতে পারলে তুমি।”
অধরা ভেঙ্গচি কেটে বলল,
“অবশ্যই তুমি অসভ্য! যেনতেন অসভ্য নও, চরম অসভ্য।”
ঝগড়া আরো কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো তাওসিফের। কিন্তু তার আদরের কন্যার তা পছন্দ হলো। বাবা-মায়েট ঝগড়া থামানোর অভিপ্রায়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে। অধরা দ্রুত পাশ থেকে কোলে তুলে মেয়েকে। হাতের কাজ ফেলে ছুটে এলো তাওসিফও। দুইজনের হাজারো আদুরে বাণীকে তোয়াক্কা না করে তড়া স্বরে কেঁদে চললো অরোরা তাহমিন। কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ দৃশ্য খানা মন দিয়ে দেখলেন তাইফা। মন ভরে গেলো তার। ছেলের সুখের সংসারের একাংশ দেখলে মায়ের মন তো খুশিতে ভরে উঠবেই।
——————-
সুন্দর এই পৃথিবীতে আজ অরোরার চতুর্থ দিন। তাওসিফ অফিসে যাওয়া শুরু করেছে গতকাল থেকেই। আজ অফিস থেকে ফিরে দেখলো তার মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে তার মা। দুইপাশে বসে আছে তার দুই বোন। ফুপিদের সাথে ভালোয় খেলছে তার মেয়ে। ফুপিরা কতো কথা বলছে। তার মেয়ে তাকিয়ে দেখছে। কখনো দন্ত হীন মাড়ি বের করে হাসছে। অধরাও পাশে বসা। তাওসিফকে দেখে উঠে দাঁড়ালো সে। তাওসিফ মুচকি হেসে বলল,
“বসে থাকো। আসতে হবে না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
অধরা মাথা নেড়ে বসে পরলো আবার। তাইফা অরোরাকে তরুর কোলে দিলো। ছেলের নাস্তা টা নিয়ে আসবেন।
তাওসিফ ফ্রেশ হয়ে এসেই মেয়েকে কোলে নিলো। বাবার কোলে গিয়ে আরো খুশি ছোট অরোরা। বাবার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর পর সে হাসছে। তাইফা নাস্তা নিয়ে এসে আবার কোলে নিলো নাতনিকে। তাওসিফ নাস্তা খেতে খেতে বলল,
“ও বাড়িতে যাবে না আসফিন? দাদুনি, বড়ো আপা, আঁখি সবায় অরোরাকে দেখার জন্য মুখিয়ে আছে।”
অধরা অমত করলো না। নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল,
“তুমি যেদিন সময় পাবে, সেদিন চলো।”
“আমি বরং তোমায় রেখে আসি। বৃহস্পতিবার অফিস শেষে আবার যাব। সেদিন থেকে শুক্রবার বিকেলে ফিরে আসবো।”
“আচ্ছা।”
অধরা বললো। মন খারাপ হলো তরু-লতার। চারদিন তাদের আদুরে বাচ্চাকে ছাড়া থাকতে হবে। লতা বলল,
“শুক্রবারের বেশি একদিনও থাকবে না ভাবি। আমরা মিস করবো।”
অধরা মৃদু হেসে বলল,
“যথাআজ্ঞা, ননদিনী।”
#চলবে…?