দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-৪৬+৪৭

0
6

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪৬

সোমবার। আজ গরম পরেছে অনেক। দুপুরে তাপমাত্রা আরো বেড়ে যায়। বাড়ির সামনের বাগানে রোদে অরোরাকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে তাইফা। পাশে গামছা, জামা-কাপড় হাতে দাঁড়িয়ে আছে অধরা। হঠাৎ বাইকের আওয়াজ শুনে সামনে তাকালো অধরা। তাওসিফ এসেছে। অধরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তাওসিফ বাইক পার্কিং করে এসে দাঁড়ালো। অধরা বিস্মিত নয়নে বলল,

“তুমি? এতো তাড়াতাড়ি ফিরলে আজ!”

তাওসিফ মুচকি হেসে সদ্য গোছস করা মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল,

“মেয়ের খালামণিরা কান্নাকাটি করছে তাকে দেখতে না পেয়ে। তাই আমার মেয়েকে নানুবাসায় রেখে আসার জন্য তাড়াতাড়ি চলে এলাম।”

অধরা বুঝলো তাওসিফ কার কথা বলছে। বড়ো আপা তাকেও কল দিয়ে পাগল করে দিচ্ছে। তাওসিফকেও নিশ্চয়ই জ্বালাচ্ছে। তাওসিফ মেয়ের জামা-কাপড় অধরার হাত থেকে নিয়ে বলল,

“তুমি যাও। গোসল করে রেডি হওয়া শুরু করো। বাবা আসলে আমরা বের হবো।”

তাইফা উঠে দাঁড়ালো। বলল,

“একদম। তোর বাবা আসুক। তারপর যাবি। বাইকে যেতে হবে না।”

তাওসিফ মৃদু হাসলো মায়ের দিকে তাকিয়ে। অধরা নিজেও হাসলো। কতো চিন্তা সবার। বাইকে বসে যদি বাবুকে সামলাতে সামলাতে না পারে। তাই বাবা ফিরলে বাবার গাড়িতে যাবে তারা। অধরা মেয়েকে চুমু দিয়ে শাশুড়ির সাথে ঘরের দিকে গেলো। তাওসিফ মেয়েকে নিয়ে বাগানে হাঁটতে লাগলো। কতো রকম গল্প শুনাতে লাগলো মেয়েকে। অরোরাও মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনতে লাগলো সেসব গল্প।
——————–

আজ নবকুঞ্জে অধরা আসবে এই খবর তানিশা ফোন করে জানিয়ে দিলো। নিজেও দ্রুত তৈরি হয়ে চলে গেলো নবকুঞ্জে। তানিশা যতক্ষণে নবকুঞ্জে পৌঁছালো ততক্ষণে হুলস্থুল কান্ড হয়ে গেছে। তুবা নিজে রান্নার তদারকি করছে। আসফিনের যতটুকু পছন্দ সে জানে বাকিটুকু নিজের স্বামী আর আঁখি বলে দিয়েছে। তার সব রান্না করছেন তিনি। মায়মুনা সহ সবায় কাজে ব্যস্ত। মায়মুনা চাইছে মেয়েটার মন ভালো হোক। মেয়েটা তাদের ক্ষমা করে দিক। আর কতোদিন বয়ে বেড়াবে এই পাপের বোঝা।

তানিশা আসতেই আঁখি ছুটে গেলো। মাসফিয়াকে কোলে নিয়ে বলল,

“ছোট চাচি, বড়ো আপা এসেছে। এবার বড়ো আপাকে জিজ্ঞেস করো। তোমার মেয়ের সমস্ত পছন্দ-অপছন্দ বড়ো আপার হাতের মুঠোয়। বড়ো আপার থেকে কেউ তোমার মেয়েকে বেশি চিনে না।”

তহুরা হেসে বলল,

“চিনবে কি করে রে? আসফিনের মা হয়ে গিয়েছিলো তানিশা।”

তানিশা মুচকি হাসলো। তুবা ছুটে গেলো তানিশার কাছে। বলল,

“এবার দুই দেখ তো মা। কোনটা বাকি রইলো। আর কি পছন্দ করে মেয়েটা। তুই ছাড়া কেউ জানে না ওর পছন্দ।”

তানিশা হেসে বলল,

“জানবে কি করে? কেউ খেয়াল রেখেছে কখনো?”

আরহাম নিচে নামছিলো সিঁড়ি বেয়ে। সে বলে উঠলো,

“ভাব কম নে আপা। আমিও জানি আমার বোন কি পছন্দ করে।”

তানিশা ভাব নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। চুলোয় বসানো বিরিয়ানি নেড়ে দিয়ে বলল,

“তুই ভাব কম নে ভাই।”

আরহাম হেসে রান্নাঘরে ঢুকলো। অণিতার দিকে তাকিয়ে বলল,

“তোমাকে যা যা করতে বলেছিলাম করেছো?”

অণিতা উপর নিচ মাথা নাড়লো। তানিশা দুইজনের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে উঠলো,

“কি হচ্ছে? কি করা হয়েছে? আমাকে বল।”

“নাহ আপা। বলা যাবে না। ওটা আমার বোনের জন্য সারপ্রাইজ। বোন আসুক।”

ডাইনিং রুমে বসে রান্নাঘরের সব কথা শুনতে পাচ্ছে নবনী আনজুম। তার চোখ বেয়ে চল গড়িয়ে পরে। তার নাতনিটার দুঃখের দিন অবশেষে শেষ হলো। এই বাড়িতে শান্তিতে এবার পা রাখতে পারবে অন্তত। মেয়েটার সব সুখ নিজ চোখে দেখে যেতে পারাছেন তিনি। তার আর কিছু পাবার নেই। এই ম রে গেলেও দুঃখ থাকবে না তার!
——————–

বিকাল তিনটে নাগাদ বাড়ি থেকে বের হলো তাওসিফরা। তাওসিফ গাড়ি ড্রাইভ করছে। অধরা বাবুকে কোলে নিয়ে পাশে বসে আছে। তাওসিফ দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখে বলল,

“অধরা? তোমার কি মন খারাপ?”

“নাহ তো।”

“কেমন চুপচাপ হয়ে আছো। কেন যেন মনে হচ্ছে.. ”

তাওসিফ থেমে গেলো। অধরা তাকালো তাওসিফের দিকে। অরোরা ঘুমিয়ে পরেছে। তাই তাকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই। অধরা অরোরাকে আগলে রেখে বলল,

“কি মনে হচ্ছে?”

“তুমি বোধহয় নবকুঞ্জে ফিরতে চাইছো না।”

“কেন এমন মনে হলো?”

“মুখ গোমড়া করে বসে আছো তাই।”

“তেমন কিছু না।”

অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে চিন্তায় আছে। কি হবে, কি হচ্ছে অনেক কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। তুবা হঠাৎ এতো পরিবর্তন কি করে হলো? তার মাথায় আসছে না। সে চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি রাখে। তাওসিফ আর কিছু বলে না। চুপচাপ ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয় সে।
———————–

গাড়ির শব্দ শুনতে পেয়ে ছুটে বের হয় তানিশা, আঁখি, অহি, অরুমিতা। গাড়ি থেকে অধরা নামতেই তানিশা অরোরা কে কোলে তুলে নেয়। অরোরার ঘুম ভেঙে গেছে। তানিশার কোলে উঠে সে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। তানিশা হেসে বলল,

“কি আম্মু? কি দেখো তুমি?”

অরোরা দন্তহীন মারি বের করে হাসে। তানিশা আদর করে তাকে। অরুমিতা পাশ থেকে বলে,

“বড়ো আপ আমাকে দাও না অরোরাকে। তুমি বরং তোমার বাবুকে একটু আদর দাও।”

তানিশা হেসে অরোরাকে অরুমিতার কোলে দেয়। অধরার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টি করে বলে,

“কত বড়ো হয়ে গেলি রে বাবুন?”

বোনের বুকে মুখ গুঁজে অধরা লম্বা শ্বাস টানে। আলতো স্বরে বলে,

“অনেক বড়ো হয়ে গেছি আপা?”

তানিশা উত্তর দেয় না। বোনকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তাওসিফ গারি পার্ক করে আসে। আঁখি এবার বলে,

“বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবে তোমরা? ভেতরে চলো।”

সবাই এবার ভেতরের দিকে যায়।

অধরা ভেতরে গিয়ে দাদুনির পাশে ছুটে যায়। দাদুনি অধরার গায়ে হাত বুলায়। চুমু খায়। ড্রয়িং রুমে সবায় বসে আছে। সবার সাথে হালকা কথাবার্তা বলতেই অরোরা কেঁদে উঠে। অধরা ওকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরো যায়।

নিজের ঘরে ঢুকে অবাক হয় অধরা। একদম পরিষ্কার! সে আসবে বলে সব গোছানো হয়েছে? অধরা অরোরাকে আবার ঘুম পারিয়ে দেয়। নিজের বই গুলো ধরে দেখে, কোন ধুলাবালি জমে নেই। অধরা বারান্দায় যায়। তার গাছ বেঁচে আছে। কে পানি দেয় রোজ? বাবা? অধরা ভেবে পায় না।

তাওসিফকে খাবার দেওয়া হয়েছে। সে অবাক হয়ে বলে উঠলো,

“এতো কিছু কেন? আমি এতোটা খেতে পারবো না।”

“পারতে হবে। ”

আরহাম বলে উঠলো। আরহাম আরে কিছু আইটেম উঠিয়ে দিলো তাওসিফের প্লেটে। তাওসিফ কাঁচুমাচু করে বলল,

“বড়ো ভাইয়া হন বলে কিছু বলতেও পারছি না।”

আরহাম হেসে উঠলো। অরুমিতা এবার বলল,

“আপনি নাকি চলে যাবেন ভাইয়া?”

“হ্যাঁ।”

“এটা ঠিক না।”

তাওসিফ হেসে বলল,

“আবার আসবো।”

আর কোন কথা হলো না। তুবা খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। তাওসিফ যতটুকু পারলো খেলো।।এর
পর না করে দিলো। খাওয়া শেষে উপরে উঠে এলো সে। বিছানায় মেয়ের পাশে বসে বলল,

“আমি এবার যাই।”

অধরা তাওসিফের দিকে তাকিয়ে আছে। তাওসিফ মেয়েকে আদর করে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে এলো অধরার দিকে। হুট করে কোমড় জড়িয়ে ধরলো। তারপর মুখ ডুবিয়ে দিলো অধরার কাঁধে। বড়ো বড়ো কয়েকটা শ্বাস নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

“কখনো তোমাকে ছাড়া থাকিনি। আমার ভীষণ কষ্ট হবে।”

অধরা দুষ্টমি করে বলল,

“তাহলে এখানে থেকে যাও।”

তাওসিফ মুখ উঠালো। অধরার কপালে, গালে, ঠোঁট চুমু খেয়ে বলল,

“এবার আসি।”
———————

সন্ধ্যায় সকলে একসাথে বসে নাস্তা করলো। আবির কেও দেখা গেলো সে সময়। আবির অধরাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। অধরাও নিলিপ্ত ভাবে উত্তর দিয়েছে। আরাব নিচে নামেনি। সবাই বেশ অবাক হয়েছে। কি হলো আবার ছেলেটার। নাস্তার পর্ব চুকিয়ে সবায় বসে গল্প করছিলো। অহি অরোরাকে কোলে নিয়ে বলল,

“আসফিন? বাবাকে দেখিয়ে আনি বাবুকে।”

“যাও।”

অধরা দ্বিমত করে না। অহি আর আঁখি যায় ওদিকে। অধরা নিজে উঠে দাঁড়ায়। সবায় ভাবে নিজের ঘরে যাচ্ছে। অধরা আরবের ঘরে গেলো। দরজা লক করলো। কোন সাড়া নেই। বেশ কয়েকবার লক করার পর ঘুম ঘুম চোখে উঠে আসে আরাব। দরজা খুলে অধরা কে দেখে অবাক হয়ে বলে,

“তুই কখন এলি?”

“সেই বিকাল বেলা। তুই কি করিস? বের হচ্ছিস না কেন?”

“ভিতরে আয়।”

আরাব ঘরের মধ্যে যায়। বিছানায় বসে। অধরা গিয়ে বসে চেয়ার টেনে। আরাব বলে,

“পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে আমাদের ডিপার্টমেন্টে। পড়া হয়নি সারাবছর। কাল সারারাত পড়েছি। এখন ঘুমাচ্ছিলাম। শুনতে পায়নি কিছু।”

“খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে ঘুম?”

“খেয়ে নিব এখন। অরোরা কই?”

“অহি আপার কাছে।”

“থাকবি কয়দিন তাই বল।”

অধরা আরাবের বই খাতা উল্টিয়ে বলল,

“ভাবছি এ বাড়িতেই থেকে যাব। থাকতে দিবি না তোরা?”

আরাব হেসে বলল,

“তোর বাড়িতে তুই থাকবি। আমরা রাখার কে?”

দুই বন্ধুর কথা বড়লো। সেই সাথে হাসির শব্দ। অরুমিতা সবে এসে দাঁড়িয়েছে আরাবের রুমের সমানে। তখনই শুনতে পেলো অধরা আর আরবের হাসির শব্দ। অরুমিতা থেমে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিচে নেমে যায়। একটু মন খারাপ হয় তার। গত তিনদিন ধরে ঠিকমতো নিচে নামে না আরাব। কাথাও কারো সাথে বলেনি ঠিকমতো। আপুই এর সাথে ঠিকি কথা বলছে। মন খারাপ কে দূরে সরিয়ে অরুমিতা নিজেই নিজেকে বুঝাই,

“আপুই, আরাব ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর বেস্ট ফ্রেন্ড সব সময় অন্যরকম হয় তাই না? কুল অরুমিতা। মন খারাপ করার মতো কিছু হয়নি।”

তবুও মন কি শোনে? মন তার মতো করে খারাপ হয়েই থাকে। শূণ্যতা অনুভব করে।
———————–

ফয়জাল হাসান বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হলেন। নাস্তা শেষ করে মেয়ের ঘরে যাবে ভাবলেন। তুবা জানালো মেয়ে ঘরে নেই। ফয়জাল হাসান অরুমিতা কে বলল অধরাকে নিজের ঘরে আসতে বলতে। অরুমিতা গুটি গুটি পায়ে আরাবের ঘরের সামনে দাঁড়ালো। অধরা তখন আরাব কে বলছে,

“এই? তুই মেয়ে পছন্দ করেছিস?”

“নাহ।”

“কেন?”

“বেকার ছেলেকে মেয়ে কে দিবে?”

“তুই পছন্দ করে। বাকিটা আমি দেখবো।”

অরুমিতা জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে। তারপর ডাকে,

“আপুই।”

অধরা পিছু ফিরে তাকায়। হেসে বলে,

“বলো অরু।”

“আব্বু তোমাকে ডাকছে। তোমার ঘরে বসে আছে।”

অধরা উঠে দাঁড়ালো। আরাব কে বলল,

“রাতে খাবার খেতে নিচে নামবি। নাহয় তোর খাওয়া বন্ধ।”

অধরা চলে গেলো। অরুমিতা এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে নিজের জায়গায়। আরাব উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের বই গুলো গুছিয়ে রাখতে গিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিছু বলবি?”

অরুমিতা কেঁপে উঠে একটু। মাথা তুলে বলে,

“কাউকে পছন্দ করো আরাব ভাইয়া?”

“নাহ।”

অরুমিতা কিছুটা উসখুস করে। আরাব ওর দিকে তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। অরুমিতা ফট করে বলে,

“আমাকেও না?”

আরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। উত্তর দেয় না। অরুমিতা কিছুটা ভরকে যায়। আরাব বলে উঠে,

“যা এখন।”

অরুমিতা নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। আরাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে। সে নিজেই বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে কি করা উচিত তার!
———————

ফয়জাল হাসান মেয়ের ঘরে বসে আছে। ঘরের রূপ দেখছে। তুবা খুব যত্ন নেয় ঘরের। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। অধরা ঘরে এলো। আলতো স্বরে ডাকলো,

“আব্বু।”

ফয়জাল হাসান মেয়ের দিকে তাকালেন। হেসে বললেন,

“আমার মা! কেমন আছো মা?”

অধরা হাসে। এতো সুন্দর করে ডাকে কেন আব্বু? বলে,

“আমি ভালো আছি আব্বু।”

“নানুভাই কোথায়?”

“অহি আপা, আঁখি আপারা নিয়ে আছে।”

ফয়জাল হাসান নিজের পাশে ইঙ্গিত দিয়ে বলল,

“বসো মা।”

অধরা বসে। ফয়জাল হাসান মনে মনে কথা সাজায়। কিভাবে শুরু করবে ঠিক করে। অধরা তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। কি নিয়ে অস্থির হয়ে আছে আব্বু? কি এমন বলবে তাকে।

ফয়জাল হাসান এবার বলল,

“তোমার আম্মুর উপর তোমার অনেক রাগ আসফিন?”

অধরা চুপ করে থাকে। উত্তর দেয় না। ফয়জাল হাসান মেয়ের মাথায় হাত রাখে। আলতো স্বরে বলে,

“তোমার আম্মু বিপিডি তে আক্রান্ত ছিলো আসফিন। তুবার কিছু আচরণ অস্বাভাবিক ছিলো। আমি এতোটা পাত্তা দেয়নি। ভেবেছি ও এরকম। তুমি বিপিডি সম্পর্কে জানো নিশ্চয়ই! এ সময় আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না৷ তুবা এতো তাড়াতাড়ি বেবি নিতে চায় নি। কিন্তু ভাগ্যে অন্যকিছু ছিলো। তুমি হলে। ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। একটা রোগ ওর মনটাকে কঠিন করে তুললো। তোমাকে সহ্য করতে পারতো না। তোমাকে অনেক অনেক কষ্ট দিয়েছে তোমার আম্মু। কিন্তু ও তো তখন স্বাভাবিক ছিলো না। দীর্ঘ চিকিৎসার পর যখন ও স্বাভাবিক হওয়া শুরু করলো প্রতিটা মুহুর্ত তুবা অপরাধ বোধে ভুগতে লাগলো। তোমার ঘর ও গুছায় একা একা। বসে থাকে এই ঘরে। কান্না করে। তোমাকে দেখতে চায়। মা, আমি জানি মায়ের উপর তোমার অনেক রাগ। এতো সহজে কমার নয়। তুমি সময় নাও। রাগ পুসে রেখো না। অভিমান রাখো। ধীরে ধীরে গলিয়ে ফেলো সেটা। আম্মুর কোলে একদিন মাথা রেখো। একদিন আম্মু বলে ডাকিও।”

ফয়জাল হাসান থামলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

“আমি জানি তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিবে মা।”

তিনি বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। অধরা নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। কিছু বলতে পারলো না।

#চলবে…?

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪৭

চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে পৃথিবী। যদিও পূর্ণিমা নয়। সম্ভবত চার-পাঁচ দিন বাদেই পূর্ণিমা। অধরা বহুদিন পর নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে, দেখছে মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশটাকে। আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারা গুলোকে। অধরা আনমনে তাকিয়ে ভাবে, নিজের ঘর থেকে আকাশ দেখতেও বুঝি অন্যরকম লাগে। অধরার মন কেমন করে উঠলো। নিজের জীবন নিয়ে ভাবে সে। কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো তার জীবনটা শেষমেশ? আবির ভাইয়া এখনো মাথা উঁচিয়ে কথা বলে না তার সমানে। চাচা বার কয়েক দেখতে চেয়েছে তাকে, সে যায়নি। চাচিও কেমন ছোট হয়ে কথা বলে। তার খারাপ লাগে কিন্তু! ক্ষমারা ঠিক করতে পারে না। বারবার মনে পড়ে যায় তার কৈশোরের গল্প। যেখানে বিষাদ ছাড়া কিছু নেই। সে তো একটু ভালো থাকতে পারতো। কিন্তু সবায় মিলে তার ভালো থাকাটা কেমন ছিনিয়ে নিয়েছে। তারপর ভাবে আজ সন্ধ্যায় বাবার বলা কথা গুলো। মা নামক মানুষটাকে কি করে ক্ষমা করবে সে? তার পুরো শৈশব, কৈশোর কি জঘন্য ভাবে নষ্ট করেছে মানুষটা! সে এখন মেয়ে বলে জড়িয়ে নিলেই অধরা সব ভুলে যাবে? আর যদি সব না’ই ভুলে, তাহলে কি করে অধরা মায়ের জায়গায় বসাবে তাকে? মা হওয়া কি এতো সহজ? নিজের বিধ্বস্ত জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে যায় অধরা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বহুদিন পর বসে বারান্দায়। পা ছড়িয়ে বসে আকাশ দেখে। তার একাকী সময়ের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ঐ আকাশ, গ্রীল বেয়ে উঠে জাওয়া অপরাজিতা গাছটা। আকাশটা তার মনের যত কথা জানে, আর কেউ জানে কি? অবশ্যই না। অধরা বসে থাকে। কতো কথা জমে আছে কিন্তু আকাশকে বলতে ইচ্ছে করছে না আজ!

মেয়ের ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে এক পলক তাকালো তুবা। অরোরা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। অধরা নেই বিছানায়। তুবা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে। মেয়ের দেখা পেলো সেখানেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। দৃষ্টি আকাশ পানে। তুবা জানে মেয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু আকাশ। মেয়ের ডায়েরি পড়ে অনেক কিছুই জেনেছেন তিনি। জেনেচেন মেয়ের একা থাকার গল্প, আকাশের সাথে বন্ধুত্বের গল্প, মা’কে মিস করার কথা, অপরাজিতা গাছটাকে সে কতো ভালোবাসে সেই কথা, গল্পের বই গুলো তার কতোটা প্রিয় সেটাও। জেনেছেন মায়ের সংজ্ঞা বলতে মেয়ে যে তানিশাকে বোঝো সেটাও। তুবার কিছু দৃশ্য চোখে ভাসে। ছোট তানিশার কোলে বসা তার মেয়ের দৃশ্য, অধরার গায়ে হাত তুললে তানিশার ছুটে আসার দৃশ্য। তিনও জানেন তানিশার কাছে অধরা মানে তার জীবন। অধরার কিছু হলে তানিশা কোন না কোন ভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে। মায়ের চেয়ে কম কিছু নয় সে অধরার কাছে। তুবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেলো। মেয়ের পাশে বসে পরলো চুপটি করে। অধরা নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব পেশে চমকে গেলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে নিজের মা’কে দেখে অবাক হলো। কিন্তু কিছু বলল না। আগের মতো বসে রইলো। তুবা মেয়ের দিকে তাকালো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ঘুমাওনি কেন?”

“ঘুম আসছে না।”

“আকাশ দেখছো।”

“হু।”

“আকাশ ভালোবাসো খুব তাই না?”

“হু।”

তুবা চুপ হয়ে যায়। অধরা নিশ্চুপ। নীরবতা বিরাজ করে তাদের মাঝে অনেকক্ষণ। তুবা আবার বলে উঠে,

“আমার উপর তোমার অনেক রাগ আসফিন?”

অধরা চুপ করে থাকে। রাগ? কই নাতো! রাগ কেন করবে সে? রাগ করার অধিকারটা সে পেয়েছিলো কবে। অধরা হাসে। হাসির শব্দ কানে যায় তুবার। মেয়ের দিকে তাকায় সে। অধরা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসি থামিয়ে আলতো স্বরে বলল,

“রাগ করার অধিকার আমার কোনকালে ছিলো?”

তুবার বুকের ভেতর কি যেন দুমড়ে মুচড়ে গেলো। বুকটা শূণ্যতায় হাহাকার করে উঠলো। হৃৎপিণ্ড টা দ্রিম দ্রিম শব্দে বেজে উঠলো। উত্তর খুঁজতে চাইলো মস্তিষ্ক। কিন্তু হায়, কোন উত্তর যে নেই। তুবা চুপ হয়ে গেলো আবার। অধরা নীরব। সে যেন আজ কথা বলতে ভুলে গেছে। তুবা জোরে জোরে শ্বাস নিলো। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বলল,

“মা হিসেবে আমি জঘ*ন্য আসফিন। অস্বীকার করি না আমি। এমন জঘ*ন্য মা আর কখনো কারো না হোক। নিজের করা দোষের শেষ নেই আমার। ক্ষমার অযোগ্য সব অপরাধ। তবুও ক্ষমা চাইছি। পারলে ক্ষমা করে দিও।”

তুবা দুই হাত জোর করে তাকালো অধরার দিকে। অধরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কোন কথা বলল না। কোন উত্তর অবশ্য আশাও করে না তুবা। চোখ দিয়ে জল পরছে তার। চোখের পানি না মুছেই আবার বলল,

“ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ গুলো যদি কোনদিন তোমার মনে হয় ক্ষমা করা যায় তাহলে আমার কোলে ফিরে এসো। আম্মু তোমাকে কখনো বুকে জড়িয়ে নেই নি। সেদিন নিব। আগে হাজার মার খেয়েও আম্মু ডাকতে, আজ কতোদিন ডাকো না। থাক! সেই সুদিনে ডেকো। আম্মু অপেক্ষা করবো আসফিন।”

আর কিছু বলতে পারলো না তুবা। উঠে দাঁড়ালো। ছুটে বের হয়ে গেলো। অধরা অসহায় চোখে একবার তাকালো মায়ের চলে যাওয়ার দিকে।।তারপর আবার তাকালো আকাশের দিকে। বিরবির করে বলে উঠলো,

“মায়েরা এমন করুন করে ক্ষমা চাইলে মেয়েদের মনে কি পাথর জমে থাকতে পারে আকাশ? মেয়েদের মন যে বড়ো দুর্বল!”
——————–

রাত বারোটা। আরাব বই নিয়ে বসে আছে। মাথাটা ধরেছে খুব। এক কাপ কফির এখন খুব দরকার। কিন্তু নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না। এই সময় কেউ বোধহয় জেগে নেই। সবায় নিজের ঘরে চলে গেছে আরো আগে। আরাব টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো।
অরুমিতা গুটি গুটি পায়ে উঠে এলো দোতলায়। হাতে কফির মগ। আরাবের রুমের সামনে এসে শুকনো ঢোক গিলল কয়েকটা। তারপর মৃদু স্বরে ডাকলো,

“আরাব ভাইয়া, আসবো?”

আরাব অবাক হয় না। অরুমিতার মনের অবস্থা সে বোঝে। খুব ভালো করেই বোঝে। সে নিজেও এ কাজ হাজার বার করেছে। কারণে-অকারণে অধরার ঘরে গিয়ে তাকে জ্বালিয়েছে। আরাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“আয়।”

অরুমিতা ধীর পায়ে ঘরে এলো। টেবিলে কফির মগটা রেখে বলল,

“তোমার কফি।”

এবার একটু অবাক হলো আরাব। অবাক হয়ে বলল,

“আমি তো কফি চাইনি!

” তুমি যেদিন রাত জাগো সেদিন বারোটার আশেপাশের সময়ে কফি বানাও।”

আরাব বিস্মিত স্বরে বলল,

“সেটা তুই কি করে জানিস? তুই তো অনেক আগে ঘুমিয়ে যাস।”

অরুমিতা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কি করে সে বলবে যেদিন তুমি জেগে থালো সেদিন আমিও জেগে থাকি। জেগে থেকে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনি। আরাব কতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ সরালো। হতাশ কন্ঠে বলল,

“অনেক দূর এগিয়ে গেছিস অরু! এতোটা আগানো ঠিক হয়নি!”

অরুমিতা তাকায় আরাবের দিকে। আবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো বা আঁড়চোখে দেখে আরাবকে। আরাব কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর চোখ তুলে তাকায় অরুমিতার দিকে। অরুমিতার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। সে একমনে দেখে চলছে আরবকে। আরাব নিজেও তাকায়। বুঝতে চেষ্টা করে কি চাইছে এই পুচকে মেয়েটা! কি চলছে তার মনে? মোহ? ভালোলাগা? নাকি সত্যি আরাবের মতো ফেঁসে গেছে সে? আরাব অরুমিতা চোখে মুগ্ধতা ছাড়া আর কিছু আপাতত খুঁজে পেলো না। বিরক্ত হলো আরাব। নিজের উপর! এমন কেন হচ্ছে। সে কেন বুঝতে পারবে না?

আরো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর আরাব গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

“আমাকে দেখা শেষ?”

অরুমিতা ভরকে গেলো। এতক্ষণ ঘোরের মাঝে ছিলো সে। হুট করে আরাব কি বলেছে বুঝে উঠতে পারেনি। সে চমকে বলে বসলো,

“অ্যাঁ?”

আরাব বিরক্তি নিয়ে বলল,

“বলেছি আমাকে দেখা শেষ? শেষ হলে এবার ঘরে যা। গিয়ে ঘুমা।”

অরুমিতা দুই পা পিছালো। আবার সামনে এসে বলল,

“তোমাকে দেখা শেষ হয়নি, হবেও না কখনো।”

কথাটা বলেই এক ছুটে আরাবের ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে। আরাব স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার যাওয়ার দিকে। মনে মনে বলল,

“মেয়েটা দিনদিন ভয়ংকর ভাবে ফেঁসে যাচ্ছে।”

কিন্তু কি করণীয় আরাবের?

#চলবে…?