ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব-০৫

0
965

#ধরিয়া_রাখিও_সোহাগে_আদরে
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পাঁচ

ডিভোর্স পেপার সামনে নিয়ে মুখোমুখি বসে আছে মেহরিশ ও সায়র। নিরবতার আঁধার কাটিয়ে সায়র শান্ত বাক্যে বলল,
“আপনি এই সম্পর্কের থেকে মুক্তি চান? নাকি আনায়ার কথা চিন্তা করে আহিলকে চান?”
মেহরিশ চমকে তাকালো সায়রের দিকে। সায়রের ঠোঁটের কোনে শূন্য হাসি। নিষ্প্রাণ যাকে বলে। মাঝে কেটে গেছে দুইদিন। দুইদিনে ছেলেটা মেহরিশের সাথে কোনোরকম কন্ট্রাক্ট করেনি। মেহরিশ কয়েকবার কন্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করেছিল বোধহয়। কিন্তু ফলাফল এসেছে শূন্য। মেহরিশ আর সায়রের চোখেচোখ পড়তেই সায়র দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। মেহরিশ বরং আগের ন্যায় তাকিয়ে রইল। নিরবতা ভেঙে শান্ত বাক্যে সায়রের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“ আমাকে ফেস করতে ভয় পাচ্ছেন, সায়র?”
সায়র তাকাল না। স্থির স্বরে উত্তর দিল,
“ধরে নিন তাই।”
মেহরিশের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি টেনে বলল,
“আমাকে ভালোবাসবেন না, সায়র?”
সায়র এবার চমকে তাকাল। মেহরিশের ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখে কিছুটা অবাক হলো। পরক্ষণেই কিছু ভেবে বলল,
“ভালোবাসবো না৷ ভালোবাসি৷ আর সারাজীবন বাসবো। আপনি আমার থাকলেও বাসবো। না থাকলেও বাসবো। আপনি ভালো না বাসলেও আমার আপত্তি নেই। জোর করে সায়র কখনো কিছু আদায় করে না। সায়র অর্জন করে নেয়। আপনি মেহরিশ আমার কাছে থাকলে আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য হবেন। ভালো তো আপনি বাসবেন। যদি থাকেন…।”
মেহরিশ হেসে ফেলল। বলল,
“থাকবো না। যাবো না কোথাও। দূরে গেলে নিজেকে যে হারিয়ে ফেলব, সায়র।”
“আমি থাকতে আপনি কখনোই হারাবেন না, মেহরিশ।”
সায়রের কথা শেষ হতেই মেহরিশ প্রশ্ন করল,
“আহিলকে লাগবে না?”
সায়র মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল,
“না লাগবে না। আমি আমার কলিগ ইশমিতাকে ডেকেছি। ও কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে উপস্থিত হবে। ইশমিতা একজন ডিভোর্স লইয়ার। আপনি আহিলকে কেন ডিভোর্স দিতে চান, কী কারণ আমি যতটুকু জানি সবটাই ইশমিতাকে খুলে বলেছি। ও বলেছে, আপনি সাইন করে দিলেই ডিভোর্স হয়ে যাবে। আর আনায়াকে নিয়েও চিন্তার কারণ নেই। আনায়া আপনার কাছেই থাকবে।”
মেহরিশ হাঁফ ছাড়ল। দশ তলা বিশিষ্ট একটি বিল্ডিং এর ছাদে খোলামেলা, সবুজ গাছপালায় ভরা একটা বাঙালি রেস্তোরাঁ এটা। মেহরিশ উঠে দাঁড়ালো। কার্নিশ ঘেষে দাঁড়ালো। কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া সিল্কি চুলগুলো খোলা রয়েছে। শীতল হাওয়া বইছে চারদিকে। এখানে তো আরো বেশি বাতাস। প্রচন্ড শীতে মেহরিশের দাঁত কাঁপানো শুরু হয়ে গেল। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সায়র দূর থেকে মেহরিশকে দেখছে। লম্বায় ৫ফুট ২/৩ইঞ্জি হবে হয়তো! গায়ের রঙ ফর্সা। বেশি ফর্সা না, বাঙালী মেয়েরা যতটুকু ফর্সা হলে স্নিগ্ধ লাগে ততটুকু ফর্সা। কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো ‘ভি’ শেপে কাটা। বাতাসের দাপটে উড়ছে এলোমেলোহীন গতিতে। শীতে ফর্সা মুখটা কেমন ফ্যাকাস লাগছে! মেহরিশের বাম চোখের নিচে গাঢ় তিলটা বড্ড আকর্ষণীয়! দেখলেই মায়া চলে আসে। চোখ বন্ধ করে রাখায় কী স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। দেখে মনে হচ্ছে যেন, একটা পুতুলকে কেউ বাক্সে ভর্তি করে সাজিয়ে রেখেছে। শীতে কাঁপছে। তবুও সরে আসছে না। হয়তো জীবনের সব বিষাদগুলো হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে। হয়তো এই শীতল হাওয়ায় নিজের ভেতরে পুড়ে যাওয়া ক্ষতটাকে ঠান্ডা করছে। সায়র আর বসে থাকতে পারলো না৷ নিশ্চুপ উঠে গিয়ে দাঁড়ালো মেহরিশের পাশে। মেহরিশ তবুও টের পেলো। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই স্নিগ্ধ সুরে ডেকে উঠল,
“সায়র!”
সায়র চমকাল। ভড়কে উঠে বলল,
“বুঝলন কী করে আমি?”
মেহরিশ চোখ খুলল। সায়রের দিকে তাকিয়ে হেসে জবাবে বলল,
“আপনার পারফিউমের স্মেইলটা বড্ড নেশালো যে, তাই।”
সায়রও হেসে ফেলল৷ জিজ্ঞেস করল,
“মন খারাপ, মেহরিশ?”
“মন খারাপ এতদিন ছিলো। কেন জানেন?”
“কেন?”
মেহরিশ কার্নিশের সাথে পিঠ ঘেষে হাত দুটো বুকে গুঁজে দাঁড়াতেই সায়র মেহরিশের হাত ধরে ফেলল। কার্নিশ থেকে সামান্যয দূরে এনে দাঁড় করাল। তা দেখে মেহরিশ হাসল। ছেলেটা ভালোবেসে যত্ন করতে ভুলে না। সায়র এবার শান্ত স্বরে বলল,
“এবার বলুন৷ কেন?”
মেহরিশ বলে উঠল,
“এতদিন একটা অসুস্থ সম্পর্কের বন্ধনে আটকে ছিলাম। তার দেওয়া বিশ্বাসঘাতকতার আঘাতে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হতো। একটা অসুস্থ মানুষকে ভালোবেসে নিজের জীবনের মূল্যবান সময় গুলো নষ্ট করেছি। মা হওয়ার মতো অনুভূতির মাস গুলোতে আমি সুখ অনুভব করতে পারিনি। প্রতিটা মূহুর্তে যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। তাই মন খারাপ ছিল। আজ আমি সে যন্ত্রণা, সব অপবাদ, মিথ্যা ভালোবাসার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাবো। আজ তো আমার সুখের দিন। আমার আজ বড্ড সুখ অনুভব হচ্ছে, সায়র। আমাকে এক সুখে সুখী করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, সায়র। আপনি আমার জীবনে আসা এক টুকরো সুখের আলো। যার আলোতে আলোকিত হয়ে আছি আমি।”
সায়র আজ মেহরিশকে দেখছে। যে মেয়েটা দুইদিন আগেও সায়রকে বলেছে ভালোবাসতে পারবে না সেই মেয়েটার প্রত্যেকটা আজ সায়রকে জানান দিচ্ছে, মেহরিশ তোমাকে চায়। তোমাকে ভালোবাসতে চায়। ইশ! সত্যিই কী তাই? সায়রের যে খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে। শক্ত করে প্যাঁচিয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে মেহরিশকে। কিন্তু নাহ! তা করা যাবে না। মেহরিশ যতদিন নিজের মুখে সায়রকে ভালোবাসার কথা না বলবে, ততদিন সায়র ভাঙবে তবুও মচকাবে না। সায়র শান্ত বাক্যে হঠাৎ বলে উঠল,
“মেহরিশ, দুঃখ মনের ভেতর পুষতে নেই। যত দুঃখ পুষবেন তত বাঁচতে ভুলে যাবেন। চায়ের ধোয়ায় যেমন স্বাদ উড়িয়ে দেই, ঠিক তেমনি ধোয়ার সাথে দুঃখ গুলো উড়িয়ে দেওয়া উচিত। বাঁচতে শেখা উচিত। হাসিতে মত্ত থাকতে হয়। বিষাক্ত অনুভূতি গুলোকে মাটি চাপা দিয়ে, সুখের অনুভূতিকে অনুভব করতে হয়।”
মেহরিশ ছোট্ট করে শুধু বলল,
“করব। জীবনকে দ্বিতীয় বার অনুভব করব।”
সায়র কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে ইতস্তত হয়ে প্রশ্ন করল,
“একটা প্রশ্ন করব, মেহরিশ?”
“করুন।”
“এত বছর আপনি আহিলকে কেন ডিভোর্স দেননি?”
মেহরিশ থেমে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে জবাব দিল,
“মায়ার টানে। আহিল আমাকে ভালো না বাসুক। আমি তো সত্যিকারের ভালোবেসেছিলাম। তাই মানুষটাক দ্বিতীয় বার সুযোগ দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। ভেবেছিলাম মানুষটা নিজের ভুল বুঝবে। আমার কাছে ফিরে আসবে। ফিরলো তো বটেই কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করতে।”
বলেই হেসে ফেলল। সায়র আর কথা বাড়ালো না। শুধু ভরসা দিয়ে বলল,
“যেখানে এসে মনে হবে আফসোস করে লাভ হবে না। সেখান থেকে উপসংহারের সমাপ্তি ঘটিয়ে, নতুন করে সূচনা লিখতে হয়৷ সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনার উপর ভরসা রাখুন। তার পরিকল্পনা সুন্দর। ধৈর্য ধরুন। চোখ বন্ধ করে এগিয়ে যান তাকে ভরসা করে। এক সময় গিয়ে উপলব্ধি করবেন সবটা খোলা আকাশের মতো সুন্দর।”
বলেই সায়র ভেতরে এসে বসল। মেহরিশকে একটু একা ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভাবুক না হয় নিজেকে নিয়ে একটু।


ইশমিতা এসেছে। ডিভোর্সের নিয়ম কানুন সবটা মেহরিশকে বুঝিয়ে বলেছে। সবশেষে মেহরিশ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিল। জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরক্ষণেই উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। গলা ফাটিয়ে বলে উঠল,
“মুক্ত। আজ থেকে আমি মুক্ত।”
আকাশে উড়তে থাকা কয়েকটা পাখিকে ডেকে বলে উঠল,
“এই পাখি শুনছো, আজ থেকে আমিও তোমাদের মতো মুক্ত আকাশে উড়তে পারব। মন ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারব। আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু আজ। খুব খুশি আমি। খুব খুশি।”

#চলবে