ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে পর্ব-১২

0
309

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ১২
#_আরজু_আরমানী

” কোন ছেলের চিঠি সেটা আগে বল রাত্রি?”

শোয়া থেকে উঠে বসলাম। মা, বড় দুই ফুপি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অগ্নিচোখে। যেনো এক্ষুনি আমাকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিবে। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুলকুল বললেন,

” নষ্টামি করে আর কত? এবার বিয়ে করে আমাদের উদ্ধার কর। আমার ছেলেকে কষ্ট দিয়ে তুই কখনো সুখে থাকতে পারবি না। ”

আমি তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে। মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে। আমি কোনো জবাব দিলাম না। তাতের সাথে কথা বলে নিজের রুচি বোধের পরিচয় দিতে চাইনা। আমার ফুপিরা আমার গায়ে হাত তুললেন না ঠিকই কিন্তু আঘাত করতে ছাড়লেন না। আমি তাদের কথার কোনো জবাব দিলাম না। কিছুক্ষন বকাঝকা করে তারাও চলে গেলেন। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। আমি বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ছোট ফুপির ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। ফুপির জামা ধুয়ে বারান্দার একপাশে মেলে দিলাম। মাগরিবের আযান দিয়ে ফেলেছে। আমি ওযু করে জায়নামাজ নিয়ে নামাজে দাড়িয়ে গেলাম।

_____________________

প্রিয় রাত্রি,

পত্রের প্রথমে প্রিয় লিখতে হয় বলেই লেখা। তুমি আবার রাগ করিওনা। আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালোই আছো। আমি ভালো নেই। আমি পুলিশের চাকরি রিজাইন দিয়েছি। এই পেশাটা করতে গিয়ে আমাকে বারবার ঘুষের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমি বারংবার নিজের চরিত্রকে এই ঘুষের থেকে আড়ালে রেখেছি। কিন্তু আমি ক্লান্ত। এভাবে আর চলা যায় না। এখানে থাকলে আমি আমার সততা ধরে রাখতে পারবোনা। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে আমি এই চাকরিটা ছেড়েছি। আমার বড় মামার বিজনেস আছে ইতালিতে। আমি সেখানেই চলে যাবো। আমার ফ্লাইট আজ রাত ০৮ঃ৫০ মিনিটে। জানিনা আবার কবে ফিরবো আমার এই প্রিয় মাতৃভূমিতে। তোমাকে একটা অনুরোধ করছি। প্লিজ আমার এই অনুরোধটা রাখবে। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় তোমাদের বাসার পাশের প্লে গ্রাউন্ডে একবারের জন্য এসো। আমি তোমার কাছে শুধুমাত্র দশ মিনিট চাইছি। আসবে তো? আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো। ভালো থেকো।

————————- ইতি,
———————— আয়ান রহমান সাদ।

চিঠিটা পড়ে আমার মাথা ঘুরে গেলো। এটা কেমন অদ্ভুত বাসনা। আমি দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকালাম। এখন রাত নয়টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। আরো এক ঘন্টা আগে সাদের ফ্লাইট বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে। তার চলে যাওয়াতে আমার তেমন কোনো খারাপ লাগেনি। তবে তিনি আমায় লাস্টবার প্লে গ্রাউন্ডে যেতে কেন বললেন? আমি মা এবং ফুপুদের কারনে বিকালে চিঠিটা পড়তে পারিনি। আমি সাদের নাম্বারে কল করলাম। কিন্তু তার ফোন বন্ধ। আমি আমার ফোনটা কোলের উপর রেখে দিলাম। বেতের চেয়ারটায় বসে আছি। চিঠিটা ভাজ করে খামের ভিতর রেখে দিলাম। তিনি তো আমায় ফোন করতে পারতেন। তবে কেন তিনি চিঠি দিলেন ? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। বারান্দার বাতিটা বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ বসে আছি। ফোনটা বেজে উঠলো। তামিম ভাইয়া কল করেছেন। আমি ফোন রিসিভ করতেই তিনি আমায় বললেন,

” লাচ্ছি খাবি। আমি নিজে হাতে বানিয়েছি।”

” না।”

” কেন? লাচ্ছি তো তোর খুব প্রিয়।”

” সব জিনিস কি আর চিরদিন প্রিয় থাকে? আমার এখন আর লাচ্ছি খেতে ভালো লাগেনা। রাখছি।”

ফোন কেটে দিলাম। আমার কেমন যেনো ভালো লাগছে না কিছু। এই ভালো না লাগার কোনো কারন খুঁজে পাচ্ছি না। ফোনের মিউজিক অন করলাম,

” তুমি রবে নিরবে…..

_________________________

কৃষ্ণচূড়ায় আবৃত কলেজ ক্যাম্পাসটা খুব ভালো লাগছে। আজ কলেজে প্রথম দিন। সব নতুন মুখ। কেউ চেনা পরিচিত নয়। সবার মাঝে এক অন্যরকম উৎকন্ঠা। ছেলেরা – মেয়েরা কলেজে এসে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। এতো মানুষের মধ্যে আমার একটুও ভালো লাগছেনা। চারপাশের ডাকাডাকিতে আমার মাথা ধরে গেছে। আমি একাডেমিক ভবনের সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে পড়লাম। অন্যান্য মেয়েরাও আছে। মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। আমি মাথা চেপে ধরেছি। হিজাব পড়া অবস্থায় মাথাটাকে বিশাল একটা পাহাড়ের মতো লাগছে। পানি খেয়ে চুপচাপ বসে আছি। কিছুক্ষন পর সবাই একাডেমিক ভবনে ঢুকলো। আমিও সবার সাথে ঢুকে বসলাম। রুমের মধ্যে যেন মাছ বাজার বসানো হয়েছে। এতো হাউমাউ, চেচামেচি মাছ বাজারেও হয়না। মাথা ব্যাথাটা সমানে বেড়ে চলেছে। স্যাররা ক্লাস রুমে ঢুকলেন। একজন স্যার মাইক নিয়ে সবাইকে চুপ করে বসতে বললেন। এইবার সবাই চুপ হয়েছে। একে একে সব স্যাররা পরিচিত হলেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কেমন অস্থির লাগছে। আমার পাশের বেঞ্চে বসে ছিলো একটা ছেলে। ও আমাকে বললো,

” কি হয়েছে তোমার?’

” কিছুনা।” সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললাম। কিন্তু সে আমার কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। আমাকে বললো,

” আমার মনে হচ্ছে অনেক মানুষের মধ্যে থেকে তোমার মাথা ধরেছে। বাইরে চলে এসো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আমার যেতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু মাথা ব্যাথার তোড়ে আর বসে থাকতে পারলাম না। পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে ছাত্রী কমন রুমে ঢুকলাম। হিজাব খুলে মাথায় পানি দিলাম। কমন রুমে তোয়ালে ছিল। ওটা দিয়ে মাথা মুছে আবার হিজাব পরে নিলাম। মাথা ব্যাথা কিছুটা কমেছে। ক্যাম্পাসের বাইরে এসে দাড়ালাম। দুপুরের সময় এদিকে তেমন গাড়ি দেখছিনা। কতক্ষন দাড়িয়ে থাকার পর একটা রিকশা এলো। ওটাতে উঠে একটা ফার্মেসিতে এসে মাথা ব্যাথার ঔষধ কিনে খেয়ে নিলাম। একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসে পরলাম। কিন্তু এখন ঘুম পাচ্ছে। বাসায় যেতে হবে। বসা থেকে উঠে রাস্তায় এসে দাড়ালাম। আমার সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়ির কাচ নামিয়ে কলেজের সেই ছেলেটা বললো,

” তোমার বাসা কোথায়? ”

” কেন?”

” আমি পৌছে দিতাম।”

” দরকার নেই। আপনার বাসা কোথায়? ”

” প্লে গ্রাউন্ডের পাশে।”

” হ্যাঁ আমিও ওদিকেই যাবো।”

” চলে আসো। এমনিতেও আমরা ক্লাসমেট।”

ছেলেটার কথা শুনে মনে হলো নিশ্চয়ই ভালো। এই মুহুর্তে আমার ভীষন ঘুম পাচ্ছে। বাসে কিংবা রিকশায় যাওয়াটাকে ঠিক মনে হচ্ছে না। কিন্তু ওনাকেও বিশ্বাস করতে পারছিনা। তবুও গাড়িতে উঠে পরলাম। গাড়ি চালাতে চালাতে ছেলেটা বললো,

” তোমার নামটা কি জানতে পারি?”

” রাত্রি। আপনার নাম?”

” ইশতিয়াক হোসেন। ”

তেমন আর কোনো কথা হয়নি তার সাথে। আমার বাসার সামনে আসতেই নেমে পরলাম।তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় চলে এলাম। ড্রেস পাল্টে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে ফ্যানের নিচে বসলাম। আজ দুপুরে তিশাদের বাসায় দাওয়াত। আমি ওদের বাসার সামনে এসে কলিংবেল টিপলাম। ফুফু দরজা খুললেন। আমি তিশার রুমে ঢুকলাম। তিশা আমায় বললো,

” বিয়ে ফাইনাল। ”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” কার?”

” আমার।”

তিশার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। আগামী সপ্তাহে এশা আপুর বিয়ে। ওর বিয়ের কথা উঠছে কেন?

” তোর বিয়ে কবে?”

তিশা ভ্রু নাড়িয়ে বললো,

” এশা আপুর যেদিন। আমরা দুজনেই আপাতত পড়াশোনা করবো। যখন তামিম ভাইয়ার পড়াশোনা কমপ্লিট হবে, তখন ওনার কাছে চলে যাবো। ”

” দারুন। শপিং কবে করবি?”

” আজ সন্ধ্যা থেকেই। তুই কিন্তু যাবি আমার সাথে। তোকে ছাড়া আমি কোনো কিছুতে আগাবো না।”

আমি হাসলাম ওর কথা শুনে। আমি ঘাড় কাত করে ওকে সম্মতি জানালাম। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

” তুই আমার অক্সিজেনের মতো রে রাত্রি। তোকে ছাড়া আমি কিছু চিন্তা করতে পারিনা। এক কলেজে ভর্তি হতে পারিনি তো কি হয়েছে? মন তো একসাথেই জুড়ে আছে। ”

চলবে……..