ধূসর অবেলায় সন্ধি পর্ব-০৩

0
206

#ধূসর_অবেলায়_সন্ধি
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_তিন

শীতকালীন সময়টাকে গ্রাম্য ভাষায় ঢালের সময় বলে। রোদহীনা এই সময়ে তিতাস গ্যাসের উৎপাদনও কমে আসে। ঢাকা শহরে রহান্ধনকার্য শুরুই হয় ভোরের আলো ফোটার পূর্বে। রোদের উত্তাপ বাড়ার সাথে সাথে তিতাস গ্যাসের পরিমাণও কমতে থাকে। মিশুদের গার্মেন্টসের একটি ভাগ গ্যাসের ওপর চলে। শীতকালীন সময়টাতে সেই ভাগ পুরোপুরি বন্ধ থাকে। যার ফলে অন্যান্য শ্রমিকদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পান থেকে চুন খসলেই চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পৃথিবীতে সবারই যে আপনি পছন্দের হবেন এটা ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই না। অপছন্দের মানুষটা যখন আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে তখন তাকে নিচে নামাতে কুৎসিত হতেও দ্বিতীয়বার ভাববেন না। মিশুর সাথেও ঠিক এমনটায় ঘটলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ভার্সিটির মধ্যে সুযোগ পেলো না মিশু। গাজীপুরের আজিমউদ্দিন কলেজেই এডমিশন নিয়ে রাখলো মিশু। হিসাবরক্ষক হিসাবে দুই মাস আগে নতুন একজন কর্মকর্তা নিয়োগ হলো। এমনিতেই বারো ঘণ্টা ডিউটি করতে হতো মিশুকে। নতুন সহযোগী হওয়ায় কাজের প্রেশারও কম হলো। মিশুর সাথে কাজ করতে লাগলো পয়ত্রিশ বছর বয়সী একজন মহিলা। যার স্বভাব ছিল অন্যের ভুল ধরা। নিজের ভুলগুলো অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। মাসের শেষ সময়ে ডে শিফট হলো মিশুর আর ভদ্রমহিলার হলো নাইট শিফট। সারাদিনের সব হিসাব নিকাশ নির্ভুলভাবে শেষ করে বাড়ি ফিরলো মিশু। পরেরদিন অফিস আওয়ারের আগেই মিশুর কাছে ম্যানেজার খবর পাঠালো যে, হিসাবে কিছু সমস্যা দেখা গেছে। যত দ্রুত সম্ভব অফিসে যেতে। মিশুর তখনো মুঠোফোন নেই, ভেবে রেখেছে পরের মাসে একটা বাটন ফোন কিনে নিবে। অগত্যা অনাহারেই মিশু অফিসে পৌঁছালো।

ভদ্রমহিলা বুকপকেটে দুইহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে মিশুর সামনে। মিশু তখন কাগজের পাতা উলটাতে ব্যস্ত। সে দেখতে পেলো, অফিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে গড়মিল দেখা দিয়েছে। সময়ের হিসাবও মিশুর ডিউটির সময় অথচ সে গতকাল সবকিছু সুন্দরভাবে শেষ করেই বাড়ি ফিরেছিল। ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলো,” এতোবড়ো ভুলটা আপনি কী করে করতে পারলেন, মিস মিশকা?”

মিশু কনফিডেন্সের সাথে উত্তর দিলো,” এসব আমি করিনি।”

ম্যানেজার মিশুর হাত থেকে কাগজ কেড়ে নিয়ে তাতে মিশুর স্বাক্ষর দেখালো এবং টেবিলের উপর সজোড়ে কাগজ রেখে বলল,” আপনি যদি নাই করে থাকেন তবে আপনার সিগন্যাচার আসলো কোথায় থেকে?”

মিশু স্বাক্ষরের জায়গাটুকু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলল,” এটা আমার স্বাক্ষর না, কেউ নকল করে বসিয়ে দিয়েছে।”

ভদ্রমহিলা নিরপরাধী হয়ে বলল,” তোমার স্বাক্ষর নকল করে আমার কী লাভ হবে, মা! তুমিই হয়তো ভুল করেছো।”

মিশু বারবার বলছিল সে নিরপরাধ কিন্তু ম্যানেজার শুনলো না। উলটো মিশুকে দোষারোপ করে কাজ থেকে বের করে দিলো।

মিশুর জীবনটা পুনরায় অন্ধকারাচ্ছন্নে ঘিরে ফেলল। হাতে নেই কাজ, সময়টাও খারাপ। আশেপাশের গার্মেন্টসগুলোতে কাজ নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলো কিন্তু চাকরি পেলো না। এদিকে নতুন মাস শুরু হয়ে গেল। ঘরভাড়া, দোকান বাকী সবকিছু পড়ে রইলো। মিশুর হাতে হাত গুটিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। এরমধ্যে মিশুর বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া চেয়ে বসলো, মহিলাটির শরীর ভালো না। চিকিৎসা করাতে হবে, বিপদে পড়েছে বলেই টাকা চাইছে। মিশু পুনরায় কাজ খুঁজতে শুরু করলো। এবার মানুষের বাসায় ঝি-য়ের কাজ খোঁজা শুরু করলো। যুবতী মেয়ে দেখে কেউই কাজে নিলো না।

কনকনে শীতের এক সকালে মিশু কাজের সন্ধানে বের হলো। দুইদিন ধরে পেটে কিছুই পড়েনি। ঐদিকে মিশুর বাড়ির মালিক ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। টাকা না দিলে ঘরে ঢুকতে দিবে না। গায়ে একটি পাতলা শাল জড়িয়ে তাই বের হয়ে আসলো মিশু। অনেক পথ হেঁটে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলো তখন ফুটপাতেই বসে পড়লো। শীতে কাঁপছে মেয়েটা, চোখ মুখ ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করছে। দুই হাতের তালু ঘষছে সমানতালে।

ডায়াবেটিস রোগীদের প্রধান ঔষধ হচ্ছে নিয়মিত হাঁটা। ফারুখ সাহেব রোদ-বৃষ্টি, শীত-গরম কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করেন না। সকাল সকাল হাঁটতে বের হয়ে যান। ভদ্রলোকের একটি ছেলে ছাড়া কেউ নেই। স্ত্রী পাঁচ বছর আগে মা’রা গিয়েছে। শেষবেলায় বিভিন্ন শখ পূরণ করেই সময় কাটান। মিশুকে জড়োসড়ো অবস্থায় বসে থাকতে দেখে হাটার গতি কমিয়ে দেন ফারুখ সাহেব। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ধীরপায়ে আগান মিশুর দিকে। নরম গলায় বলতে শুরু করেন,” এখানে বসে আছো কেনো, মা!”

স্নেহভরা কণ্ঠস্বর শুনে মিশু চোখ তুলে তাকালো। ফারুখ সাহেবের হাস্যজ্বল মুখখানা তখনো মিশুর উত্তর আশায় অপেক্ষা করতে থাকলো। কাঁপতে থাকা মিশু উত্তর দিলো,” আমাকে একটা কাজ দিতে পারবেন, চাচা? আমার একটা কাজের খুব প্রয়োজন।”

ফারুখ সাহেব বুঝতে পারলেন শীতের কারণে মিশুর অবস্থা খুবই শোচনীয়। সময় অপচয় না করে মিশুকে নিয়ে একটি চায়ের দোকানে বসলেন। গরম গরম চায়ের অর্ডার করে মিশুকে জিজ্ঞেস করলেন,” বাড়িতে তোমার কে কে আছে, মা?”

জবাবে মিশু বলল,” কেউ নেই,চাচা!”
” একা এই ঢাকা শহরে কীভাবে আসলে?”

অপরিচিত মানুষকে বলবে কী বলবে না ভাবতে ভাবতে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একে একে বলতে শুরু করলো মিশু। ইতিমধ্যে চা চলে আসলো, ফারুখ সাহেব চায়ের কাপ মিশুর হাতে তুলে দিয়ে মিশুর কথা শোনার জন্য মনোযোগী হলেন। এদিকে দুইদিন পেটে কিছু না পড়ায় মিশুর ক্ষুধাও লেগেছে প্রচুর। খালি পেটে চা খেলে নির্ঘাত বমি করে দিবে সে। চায়ের কাপ হাতে রেখেই ঘোরাতে লাগলো মিশু। ফারুখ সাহেব কী বুঝলেন কে জানে! দোকানদারের কাছ থেকে রুটি নিয়ে মিশুর হাতে দিলো। লজ্জায়, আড়ষ্টতায় মিশু রুটি নিয়ে চায়ের সাথে ভিজিয়ে খেতে শুরু করলো। প্রায় এক দেড় ঘণ্টা মিশুর জীবন বৃত্তান্ত শুনে ফারুখ সাহপব মিশুকে নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। মিশু প্রথমে রাজি হতে চাইছিল না। ঢাকা শহরে বিশ্বস্ত লোকের প্রচুর অভাব। সামনে বসে থাকা লোকটি আদতে বিশ্বাসযোগ্য হবে? পরক্ষণে মনকে প্রশ্ন করলো, লোকটা এতোক্ষণ যাবত তার সাথে আছে, তার জীবনের বৃত্তান্ত ঘটনা শুনছে। চেহারা দেখে খারাপও মনে হচ্ছে না। নানান কল্পনা জল্পনা করে মনকে বুঝিয়ে ফারুখ সাহেবের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো মিশু। শর্ত রাখলো, সে বিনা পরিশ্রমে তার বাড়িতে উঠতে রাজি নয়। ভদ্রলোক তাই মেনে নিলেন। মিশুকে নিয়ে প্রথমে তার পুরোনো ভাড়া বাড়ি গেলেন। ধার দেনা পরিশোধ করে মিশুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলেন।

——————-

ফারুখ সাহেবের বাড়ি এসে মিশুর জীবন নতুন করে চলতে শুরু করলো। ফারুখ সাহেব লোকটি খুবই পরোপকারী। চলতে পথে, বাড়িতে যেই সাহায্যের হাত বাড়াক খালি হাতে ফিরে যায় না। মিশু সারাদিন ঘরবাড়ির কাজ করে, রাত হলে পড়াশোনা করে। এভাবেই চলছিল মিশুর জীবন।

একদিন সকালবেলা ফারুখ সাহেবের ছেলে বাড়িতে আসে। ফারুখ সাহেবের ছেলের নাম নিহাল। বয়স বত্রিশ। এখনো বিয়ে করেনি। চট্রগ্রাম ইউসিবি ব্যাংকে চাকরি করে। মিশু তখন ঘুম থেকে উঠে বাহিরে ঝাড়ু দিচ্ছিল। ফারুখ সাহেব মেয়েদের কখনো কাজে রাখেননি। সাত সকালে বাড়ির সামনে যুবতী মেয়েকে কাজ করতে দেখে আশ্চর্য হলো। কিছুটা ধমকে স্বরে বলে উঠলো, ” তোমাকে ঝাড়ু দিতে বলেছে কে?”

মিশু মাথা তুলে নিহালকে দেখে মাথায় কাপড় দিলো।নিহালকে মিশু চেনে,ফারুখ সাহেব ছবিতে দেখিয়েছিল। সালাম জানিয়ে মিশু বলল,” আমি প্রতিদিনই ঝাড়ু দেই। আপনি বাসায় যান, ভাইয়া। চাচা হাঁটতে বের হয়েছেন।”

নিহাল কিছু বলল না। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। ঘরে এসে পরিপাটি দেখতে পেয়ে ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

সব কাজ শেষ করে মিশু দুপুরের পর পড়তে বসেছিল। মিশুকে এবাড়ির একটা ঘর দিয়েছেন ফারুখ সাহেব।নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন মিশুকে। পড়াশোনা নিয়ে সাপোর্ট করেছেন মিশুকে। মিশু ভেবেছে, এবার চাকরির খোঁজ করবে। এভাবে অন্যের বাসায় কতোদিন আর পড়ে থাকবে! মিশুর ভাবনার মাঝে দরজায় কষাঘাতের শব্দ শুনতে পেলো মিশু। দরজা খুলে নিহালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা অবাক হলো। বিস্মিত স্বরে বলল,” ভাইয়া, আপনি? কিছু লাগবে?”

নিহাল স্বাভাবিক স্বরে বলল,” চা বানাচ্ছিলাম, চিনি খুঁজে পাচ্ছি না।”

মিশু দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। দুপুর তিনটা বাজে, এসময় চা পান করে কে? নিহালের মতো মানুষরাই নিশ্চয়ই। মিশু কিছু না বলে চিনি বের করে দিলো। শুধু তাই নয়, চা বানিয়ে নিহালের দিকে এগিয়ে গেলো।
চা পেয়ে নিহাল খুশি হলো। শায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো। দুপুরের পর এক কাপ চা না পান করতে পারলে নিহালের ভালো লাগে না। এক সপ্তাহের ছুটিতে নিহাল এসেছে। বাবার কাছে মোটামুটি মিশুর বায়োডাটা শুনে নিয়েছে। মিশুর এখানে থাকা নিয়ে নিহালের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কোলাহল মুক্ত বাড়িতে নতুন কেউ আসলে বরঞ্চ ভালোই লাগে নিহালের। বাবার সাথে সময় কাটানোর জন্য একজন মানুষ তো আছে! এবার নিহাল কর্মস্থলে ফিরে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। চা পান করতে করতে নিহাল জিজ্ঞেস করলো,” কীসে যেনো পড়ো?”

” অনার্স প্রথম বর্ষে।”
” এখানে থাকতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো!”
মিশু কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সমস্যা না মিশুর নয়, নিহালদের হওয়ার কথা! এই যে, বিনা পরিশ্রমে মিশুকে দুইহাত ভরে দিয়েই যাচ্ছে; এই ঋণ কীভাবে সে পরিশোধ করবে? মিশু মিনমিন করে উত্তর দিলো, ” ভেবেছি এবার একটা চাকরির খোঁজ করব, এভাবে আপনাদের ঘাড়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না।”

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নিহাল বলল,” খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছো। মেয়েদের লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে, নয়তো পৃথিবীর লড়াইয়ে লড়াই করতে পারবে না। তবে তোমার কথায় কিছুটা সংশোধন করে দিচ্ছি, তুমি বাবার ঘাড়ে চড়ে এখানে আসোনি বরং বাবা তোমাকে নিয়ে এসেছে। এতটুকু সময়ে যা বুঝলাম, বাবা তোমাকে মেয়ের মতোই স্নেহ করবে। তুমি এখানে থেকেই পড়াশোনা, চাকরি করতে পারবে। ভেবো না, আমি ভিলেন হয়ে দাঁড়াবো। বাবার আদর্শে বড়ো হয়েছি, মানুষকে মানুষ ভাবি।”

মিশু নত মাথায় শুনে গেলো। কথায় আছে, শিক্ষিত মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে দশবার ভেবে নিতে হয়। নিহাল মানুষটা খারাপ নয় ঠিক ফারুখ সাহেবের মতো। নিহাল পুনরায় বলল,” তা কী ভাবলে, কোথায় চাকরি করবে? ব্যাংকে নাকি কোম্পানিতে।”

মিশু কী বলবে বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারলো, জীবনের এই পর্যায়ে আরো একটা শিক্ষা নিলো। শিক্ষিত মানুষের কদর অনেক বেশী।

চলবে…………………….