ধূসর অবেলায় সন্ধি পর্ব-০৪

0
203

#ধূসর_অবেলায়_সন্ধি
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_চার

গল্প অথবা উপন্যাসে লেখকের কলমে চরিত্ররা বিনা পরিশ্রমেই সুখের রাজ্যে ঘুড়ে বেড়ায়, কিন্তু বাস্তবে সুখ দুঃখ মিলেই তো জীবন। সুখের পর দুখ, দুঃখের পর সুখ। এভাবেই কালচক্রে মানুষের জীবন পাড় হয়ে আসছে। জেগে থেকে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর স্বপ্ন আদতে পূরণ হয় কী না জানা নেই। বাস্তবে পূরণ হলেও গোনা কজনের হয়। গননা করতে চাইলে, একশত জনের মধ্যে একজনই পাওয়া যাবে।

মিশুর অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার সময় ফারুখ সাহেবের মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়লো, একদম লাস্ট স্টেজ। দীর্ঘদিনের কাশি ও অপুষ্টির জন্য গলার কণ্ঠনালীতে ঘা হয়ে যায়। যার ফলে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি অসুখ গয়ো যায়। ফারখ সাহেব যেদিন খুব অসুস্থ হলো মিশু তখন দিশেহারা পথিক। চট্টগ্রামে নিহালের কাছে খবর পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। এভার কেয়ার হাসপাতালে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে সন্ধ্যায় রিপোর্ট হাতে পেলো মিশু। ক্যান্সার লাস্ট স্টেজে থাকা রুগীর অবস্থা অবশ্যই ভালো হবে না। এভার কেয়ার হাসপাতাল থেকে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, মহাখালীতে রেফার করলো। অচেনা ঢাকা শহরে একাই মিশু ফারুখ সাহেবকে মহাখালী নিয়ে গেলো। প্রায় তিন ঘণ্টা পর নিহাল মহাখালী পৌঁছালো। ফারুখ সাহেবকে তখন ইমারজেন্সীতে ভর্তি করানো হলো। নিহাল পৌঁছালে মিশুর খোঁজ করলো প্রথমে। মিশু তখন ভর্তির কাগজপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নিহালকে দেখতে পেরে হু হু করে কাঁদতে শুরু করলো। আমরা বাহ্যিক দিক থেকে যতোই শক্ত থাকি না কেনো, আপনজনের সামনে গেলে নরম হয়ে যাই। মিশু নিহালের আপন কেউ কী না জানে না কিন্তু নিহালকে দেখেই কান্নাগুলো দলাপাকিয়ে বের হয়ে আসলো। হয়তো মিশুর আশ্রয় দাতার এমন দুর্দশা দেখে! নিহাল ছুটতে ছুটতে মিশুর কাছে এলো। নিহালের চোখেমুখে অপরাধবোধের ছাপ স্পষ্টত। দূরে থেকে বাবার করুণ অবস্থার সময় কিছুই করতে পারলো না ভেবে। মিশুর হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে বলল,” ডাক্তার কি বলেছে?”

” হাতে তিনমাস কিংবা চারমাস সময় আছে, তারপরই!”

আর কথা বলতে পারলো না। হু হু করে কান্না শুরু করে দিলো মিশু। নিহাল কাগজগুলো নিয়ে রিসিপশনে চলে গেলো।

প্রায় দুই সপ্তাহ পর ফারুখ সাহেবকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। মিশু তখন মনপ্রাণ দিয়ে পিতা সমেত ফারুখকে সেবা করতে শুরু করলো। তিনবেলা খাবার থেকে শুরু করে গোসল করানো, ঔষধ খাওয়ানো সব একা হাতেই মিশু করতে লাগলো।
একদিন সকালে মিশুর ডাক পড়লো। নিহাল ডেকেছে মিশুকে। ড্রয়িংরুমে জমিজমার কাগজ খুলে কী যেনো দেখছে নিহাল। মিশু কাছে দাঁড়াতেই বলল,” আমাকে ডেকেছেন, ভাইয়া?”

নিহাল চোখের চশমাটা খুলে টেবের উপর রেখে বলল,” গত বছর তোমার একটা কথায় সাপোর্ট করেছিলাম, মনে আছে তো?”

মিশু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। নিহাল পুনরায় বলতে শুরু করলো,” অনার্সে তেমন ক্লাস করতে হয় না। সারাদিন মুটামুটি অবসরেই কাটিয়ে দাও। তাই আমি তোমার একটি চাকরির ব্যবস্থা করেছি।”

নিহালের কথার মাঝেই মিশু বলে উঠলো,” কিন্তু! চাচাকে এই অবস্থায় ফেলে চাকরি কীভাবে করব?”

নিহাল গম্ভীরমুখে বলল,” আমাদের চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার জীবন গুছাও। পৃথিবীতে লড়াই করে বাঁচতে শিখো।”

মিশু মাথা নিচু করে রেখেছে, সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ কেনোই বা নিহাল তার চাকরির ব্যবস্থা করলো জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো। প্রশ্নটা মনে দমিয়ে না রেখে বলল,” আমার চাকরির ব্যবস্থা কেনো করলেন?”

নিহাল বুঝতে পারলো, মিশু এত সহজে নিহালের সিদ্ধান্তঃ মানবে না। তাই সত্য জানিয়ে দেয়ার কথাই ভাবলো। দুইহাত হাঁটুর উপর রেখে বলতে শুরু করলো,” বাবাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাব। সেখানে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা করাবো। কাগজপত্র আসতে একসপ্তাহ সময় লাগবে। বাবার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। ভেবেছি, আমাদের বাড়ি, জায়গা জমি সব বিক্রি করে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবো। ছোটবেলা থেকে বাবা কোনোকিছুরই অভাব দেয়নি। আমি শেষ পর্যন্ত বাবার চিকিৎসা করতে চেষ্টা করব। যেহেতু আমি একজন শিক্ষিত মানুষ সাথে ব্যংকারও। সেখানে গিয়ে কিছু করে হলেও খেতে পারব। আর রইলো তোমার চাকরির কথা! বাবা তোমাকে রাজকন্যার মতো এবাড়িতে না রাখতে পারলেও, আদর বা অভাব কোনোটারই কমতি রাখেনি। আমি তোমাকে আগেও বলেছি,আমি বাবার আদর্শে বড়ো হয়েছি। বাবা যাকে যেমন ভালোবাসবে, আমিও তাকে তেমনই ভালোবাসবো, সম্মান করব, স্নেহ করব। আমরা চলে গেলে তোমার যেন পুনরায় পথেঘাটে ঘুরতে না হয় তাই চাকরির ব্যবস্থা করলাম। আশা করছি বাবার কথা ভেবে হলেও তুমি না করবে না!”

মিশু গুনগুন করে কেঁদেই যাচ্ছে। ভাগ্য তারসাথে এভাবে খেলছে কেনো? উপরওয়ালার কাছে কত-শত অভিমান জমা হচ্ছে! উপরওয়ালা কী তাকে সুখের সন্ধান দিবে না? নিহালের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ রইলো মিশু। নিহালের চাকরির প্রস্তাব স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করলে সে। তবে তারা যতদিন দেশে আছে ততদিন ফারুখ সাহেবের সেবা করার জন্য নিহালের কাছে অনুরোধ করলো মিশু। নিহাল অমত করেনি।

সন্ধ্যায় রান্না করছিল মিশু। নিহালকে বাহির থেকে আসতে দেখে চা বসালো সে। গরম গরম চায়ের সাথে দুটো বিস্কুট সাজিয়ে নিহালের সামনে রাখলো মিশু। ক্লান্ত নিহাল চা পেয়ে সময় অপচয় করেনি। চায়ে চুমুক দিয়ে মিশুর উদ্দেশে বলল,” পাশে বসো তো?”

মিশু গুটিপায়ে এগিয়ে বসলো। নিহাল মিশুর দিকে তাকিয়েই চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আকস্মিক মুচকি হেসে বলল,” তোমার চা টা অনেক মিস করব, মিশকা। যাই বলো, তোমার চা কিন্তু দারুণ হয়। আমার সব ক্লান্তি নিমিষেই যেনো দূর হয়ে যায়।”
মিশু কিছু বলল না। হাতের আঙুল ফোটাতে লাগলো। নিহাল চা শেষ করে বলল,” আগামীকাল একটু ভালো কিছু রান্না করতে পারবে?”

” পারব। কে আসবে?”

নিহাল বলল,” বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে। আগামীকাল কয়েকজন এসে সব দেখে যাবে সাথে অর্ধেক টাকা দিয়ে যাবে।”

মিশুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তার ইচ্ছে করছে নিহালদের সাথে চলে যেতে। যদি মিশুর এই ক্ষমতা থাকতো তো চলেই যেতো। কিন্তু না আছে তার কাছে টাকা না আছে সম্পদ। চাইলেও যেতে পারবে না সে। নিহাল হেসে চলে গেলো।

বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেলো। নিহাল বাড়ির আসবাবপত্রও বিক্রি করতে শুরু করলো। কিছু জিনিস মিশুর জন্য রেখেও দিলো। নিহালরা চলে গেলে মিশু মিরপুর থাকবে।নিহাল সেখানে একটি ফ্ল্যাট ঠিক করে দিয়েছে।

দিন যতোই ফুরাতে থাকলো মিশুর মন খারাপ ততোই বাড়তে শুরু করলো। অবশেষে সেই মন খারাপের দিনটি চলে আসলো যেদিন নিহাল ও ফারুখ সাহেবের চলে যাবে। মিশু সকাল থেকেই কেঁদে যাচ্ছে। ফারুখ সাহেব আগে থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছেন। দুইটা থেরাপি দিয়ে মাথার চুল থেকে শুরু করে ভ্রু ও চলে গেলো। বিদায়ের সময় ফারুখ সাহেব মিশুর মাথায় হাত রেখে দোয়া করে গেলো। নিহাল চলে যাওয়ার সময় মিশুর হাতে একটি খাম তুলে বলল,” নিজের খেয়াল রেখো। বদ্ধ ঘরে তুমি একজন দুর্বল নারী হলেও সারা পৃথিবীর সামনে শক্তিশালী নারী হয়ে দাঁড়াবে। তোমাকে আমি কখনোই ভুলবো না। ভালো থেকো।”

নিহাল ও ফারুখ সাহেব চলে গেলো। মিশু মিরপুরের বাড়ির বারান্দায় সকাল থেকেই বসে রইলো। দূর আকাশের বুকে যখনই উড়ুজাহাজ দেখতে পেতো তখনই বিড়বিড় করে বলতো,” আপনারা সুস্থ থাইকেন।”

————————

মিরপুরের বাসায় একমাস কে’টে গেলো। মিশু এখন চাকরি করে, রাত জেগে পড়াশোনা করে। সময় পেলেই বাহিরে বের হয়ে যায়। মিশুর মতো হাজারো মানুষদের দুঃখ সুখ নিজের চোখে দেখে। ফারুখ সাহেবের জন্য মিশুর মন খুব কাঁদে। নিহালের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
মিশু জীবনে কিছু করতে চায়। গরীব অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে চায়। তারজন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। টাকা পেতে চাইলে শিক্ষিত হতে হবে মিশুকে। এভাবে ঘরে বসে থাকলে হবে না। মিশুর সহকারী ধানমণ্ডিতে ওয়েব ডিজাইনের কোর্সের কথা বলেছিল। হাতে কিছু টাকা জমিয়ে মিশু সেখানে ভর্তি হয়ে যাবে ভেবে রাখলো।

ছুটির দিনে মিশু বইখাতা ঘাটাঘাটি করছিল। মিশু নতুন ফোন নিয়েছে, সিম ফারুখ সাহেবেরই। অফিস থেকে শুধু ফোন আসে। এখন পর্যন্ত কোনো বন্ধু বানাতে পারেনি সে। মূলত ইচ্ছে হয়নি বন্ধু বানানোর। রাস্তাঘাটে বেরোলে ভাইবোনের সম্পর্ক দেখলে মিশুর মন খারাপ হয়। বড়োভাই মামুনের কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে বিয়ের আগে তাদের ভাইবোনের সম্পর্কের কথা। যেকোনো খাবার মামুন একা কখনো খেতো না। মিশুকে নিয়ে তিনজন মিলে খেতো। কতো ইদ মিশুদের জামা ছাড়া করতে হয়েছে! মামুনের সামর্থ না থাকলেও ইদের পরে তার মন ভালো করার জন্য একশত টাকা পকেটে নিয়ে মিশুকে নিয়ে মেলায় যেতো। দুই ভাইবোন সারা মেলা ঘুরে বুট বাদাম খেতে খেতে বাড়ি ফিরে আসতো। তখন কী দিন- ছিল। সবই তো ঠিক ছিল! কিন্তু, একজনের কারণে সব ছারখার হয়ে গেলো। লোকসমাজে শোনা যায়, বিয়ের পর নাকি শাশুড়িরা ছেলের বউদের শান্তিতে থাকতে দেয় না। ননদ যখন তখন এই সেই বলে খোঁটা দিতে থাকে। মিশুর মা তো সরল ছিলেন, মন ছিল কাগজের মতো ধবধবে সাদা। ছেলের বউকে মাথায় তুলে রাখবেন, বলতেন। অথচ হলো সব উলটো। মিশুর ভাবি হালিমাই হলো পরিবারের বিচছেদের কারণ।

অতীতের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিশু। তৎক্ষনাৎ তার মুঠোফোন বেজে উঠলো। বিদেশি নাম্বার দেখে মন খুঁতখুঁত করতে শুরু করলো। রিসিভ করেই কানে ধরলে নিহালের ভাঙা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো। নিহাল বলল,” বাবা আর নেই, মিশকা। আমাকে এতিম করে দূরে চলে গেছে।।আমি একা হয়ে গেলাম মিশকা, আমি একা হয়ে গেলাম।”

লাইন কে’টে গেলো। মিশকার হাত থেকে ফোন মাটিতে ফেলে দিলো। আল্লাহ বলে চিৎকার করে জমিনে লুটিয়ে পড়লো। হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকলো কিছুক্ষণ। দু হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বলল,” আল্লাহ, চাচাকে জান্নাতবাসী করো।”

চলবে……………….