#ধোঁকার_ছায়া (শেষ পর্ব)
লেখক: #আবু_সালেহ
সায়রা আয়রাকে কোলে নিয়ে নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে।
রাতের আকাশে পূর্ণ চাঁদ, কিন্তু তার মনে তখনো অসংখ্য প্রশ্ন।
নিহাল তার পাশে এসে দাঁড়াল।
“আমার বাবা ধরা পড়েছে।”
সায়রা ধীরে ধীরে তার দিকে তাকাল।
“কীভাবে?”
নিহাল গভীর শ্বাস নিল, যেন বহুদিনের ভার নামল তার বুক থেকে।
“ইশরাত নিজেই পুলিশের কাছে প্রমাণ জমা দিয়েছে। আমার বাবার লুকানো কুকর্ম, পাচারের রেকর্ড, তার বেআইনি ব্যবসার সব কিছু সে তুলে দিয়েছে তদন্তকারীদের হাতে।”
সায়রা বললো,,
মৃত মানুষ কে কিভাবে শাস্তি দিবে?
,,,
হউক মৃত কিন্তু দোষি তো,, সে বেচে গেছে এসব প্রমাণ বের করে।
সায়রা বিস্মিত হয়ে বলল, “সে এটা করল?”
নিহাল হালকা মাথা ঝাঁকালো।
“হ্যাঁ। ও বলেছিল, প্রতিশোধের একটাই উপায়—আমাদের বাবা যেন তার কৃতকর্মের উপযুক্ত শাস্তি পায়।”
সায়রা চুপ হয়ে গেল।
“তাহলে এখন?”
“বাবা এখন জেলে। আদালত মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। প্রমাণ শক্তিশালী, তাই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।”
সায়রার মনে এক মুহূর্তের জন্য একটা চিন্তা এল—একটা সময় নিহাল তার বাবার বিরুদ্ধে কিছু করতে ভয় পেত। আজ সে নিজেই দাঁড়িয়ে আছে সত্যের পক্ষে।
সে নিঃশ্বাস ফেলল।
“এটাই প্রাপ্য ছিল তার।”
—
২
সায়রার মনে আরেকটা প্রশ্ন খচখচ করছিল।
নিহাল কি ইশরাতের সঙ্গে সত্যিই বিয়ে করেছিল?
সে ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করল, “ইশরাত তো তোমার বোন… তাহলে কিভাবে…”
নিহাল চোখ বন্ধ করল, যেন মনে করার চেষ্টা করছে।
“ও আসলে আমার সরাসরি আপন বোন নয়। ইশরাতের মা যখন বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন, তখন ওনার অন্য এক জায়গায় বিয়ে হয়েছিল। সেই সংসারে জন্ম ইশরাতের। কিন্তু কিছু পারিবারিক জটিলতায় তার মা বাবাকে ছেড়ে আমার বাবার কাছে চলে আসেন, আর তখন থেকেই ইশরাত তার ছায়াতলে বেড়ে ওঠে।”
সায়রার শ্বাস স্বাভাবিক হলো।
“তাহলে তোমাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক নেই?”
“না, নেই। কিন্তু সম্পর্ক ছিল অন্য জায়গায়—অন্ধকার অতীতের সম্পর্ক, প্রতিশোধের সম্পর্ক।”
সায়রা আবার চুপ হয়ে গেল।
নিহাল বলে চলল, “ইশরাত চেয়েছিল আমার বাবাকে ধ্বংস করতে। আর সেই পথেই ও আমাকে বাধ্য করেছিল ওর সঙ্গে বিয়ের নাটক করতে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কখনোই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল না।”
সায়রার মনে কেমন যেন হালকা লাগল, যদিও সে নিজেকে বোঝাতে চাইছিল, তাতে কিছু যায় আসে না।
—
৩
নিহাল ধীরে ধীরে বলল, “ইশরাত চলে গেছে।”
সায়রা তাকাল তার দিকে।
“কোথায়?”
“জানি না। সে কেবল বলল, তার প্রতিশোধ শেষ হয়েছে। এবার সে নতুন জীবন শুরু করতে চায়।”
সায়রা জানত, ইশরাত যা করেছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সে যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছে, যা কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।
সায়রা ধীরে ধীরে আয়রার ছোট্ট হাতটা ধরল।
নিহাল বলল, “তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?”
সায়রা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “আমি জানি না… তবে তুমি চেষ্টার সুযোগ পেতে পারো।”
নিহালের চোখে আশা জ্বলল।
সে আয়রার ছোট্ট হাতটা আলতো করে ধরল।
“আমি শুধু চেষ্টা করব না, তোমাকে আবার প্রেমে ফেলব।”
সায়রা ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “আবার?”
নিহাল মুচকি হেসে বলল, “হুম। কারণ তুমি এখন আমাকে ঘৃণা করো, কিন্তু আমি জানি, তোমার সেই পুরোনো ভালোবাসা এখনো হারায়নি।”
সায়রা মুখ ঘুরিয়ে বলল, “বিশ্বাস তো হারিয়ে গেছে।”
নিহাল কপট হতাশার ভঙ্গিতে বলল, “আহারে! তাহলে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে।”
সায়রা অবাক হয়ে তাকাল, “কী করতে হবে?”
নিহাল আয়রার দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রথমত, মেয়েকে আমার পক্ষ নিতেই হবে। তারপর তুমি নিজেই বাধ্য হবে আমাকে ক্ষমা করতে।”
সায়রা এবার সত্যি সত্যি হেসে ফেলল, “বুদ্ধি খারাপ হয়ে গেছে তোমার?”
নিহাল কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “একদম। ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পেতে পাগল হতে হয়।”
সায়রা একটু লজ্জা পেলেও মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি কিন্তু এত সহজে পটে যাব না।”
নিহাল মুচকি হেসে বলল, “দেখা যাবে।”
তারপর হঠাৎ আয়রার ছোট্ট হাতটা ধরে বলল, “মা কিন্তু অনেক রাগী, তাই না আয়রা? তোমাকে বলছি, বাবাকে একটু সাহায্য করো, কেমন?”
সায়রা হেসে কাঁধে একটা চাপড় দিল, “উফ! বাচ্চাকে ব্যবহার করছো?”
নিহাল কপট গম্ভীর হয়ে বলল, “যুদ্ধ জিততে সবকিছুই করা যায়।”
সায়রা হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকালো।
তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল।
গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “ঠিক আছে নিহাল… তবে চেষ্টা করো।”
নিহাল এবার সত্যিকারের স্বস্তির হাসি দিল।
সে হাত বাড়িয়ে সায়রার গাল ছুঁয়ে দিল আলতো করে।
সায়রার গাল গরম হয়ে উঠল, কিন্তু সে সরল না।
নিহাল আস্তে আস্তে বলল, “তুমি জানো, আমি আজও তোমার চোখের দিকে তাকালে হারিয়ে যাই?”
সায়রা এবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “বোকা!”
নিহাল মুচকি হাসল, তারপর আয়রার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো আয়রা, তোমার মা লজ্জা পাচ্ছে!”
সায়রা এবার সত্যিই লজ্জা পেয়ে আয়রাকে আঁকড়ে ধরল, “তুমি চুপ করবে?”
নিহাল এবার আয়রাকে কোলে নিয়ে বলল, “না, কারণ আমি তোমাকে হাসাতে চাই, সায়রা। যেমন আগেও পারতাম।”
সায়রা এবার হালকা হেসে ফেলল।
হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু সে জানত—ভালোবাসা কখনো হারায় না।
ধোঁকার ছায়া আজ কেটে গেছে।
নতুন আলো আসছে।
(শেষ)