ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-০৩

0
11

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩

জারার ভয়কে জয় করে উপমা নিজের ফোন ঘেটে বের করে একটা ছবি। ঘোলাটে তার দৃশ্য তবুও স্পষ্ট বোঝা যায় আলভি কারো ঠোঁটের স্বাদে মাতোয়ারা হয়ে রয়েছে। জারা এমন দৃশ্য দেখে কেঁপে ওঠে ভেতর থেকে। দপ করে জ্বলে ওঠে বিষাদ বাতি। উপমা উনুনের ন্যায় জলন্ত চোখ নিয়ে বলে

— আলভি অসম্মানের যোগ্যও নয়। ও তো কুকুর বেড়ালের সমান।

জারা নিশ্চুপ রয়। উপমার সব কথা তার কান অব্দি পৌঁছায় না। উপমা তথ্য জোগাড় করে এনেছে। কাল যখন রাস্তায় সে এমন দৃশ্য দেখেছে তৎক্ষনাৎ সে পিছু নেয় তাদের। জানতে পারে মেয়েটা আলভির অফিসের চেয়ারম্যানের মেয়ে। এক মাসের সম্পর্ক তাদের। মাহা মেয়েটা প্রচন্ড চালাক। হয়তোবা সে আলভির সুদর্শন চেহারায় নজর দিয়েছে। অতঃপর ফাঁদে ফেলে নিজের করতে চাইছে। জারা সমস্ত তথ্য জানার পর মাথায় হাত রাখে। উপমা বোনকে শান্তনা দেওয়া বাণী খুঁজে পায় না। হঠাৎ সে অনুভব করে জারার অন্যরকম পরিবর্তন। উপমা যেহেতু ল ডিপার্টমেন্টের একজন স্টুডেন্ট। তার কাছে নিশ্চয়ই খোঁজ থাকবে ভালো কোনো এডভোকেট অথবা ব্যারিস্টারের।

.
পায়ে পট্টি বেঁধে ঘর গুছিয়ে ঝকঝকে করে জারা তৈরি হলো নতুন পোশাকে। হাত ভর্তি তার কাঁচের চুরিতে। গায়ে জরানো কালো শাড়ি। ঠোঁটে গাড় মেরুন লিপস্টিক। মোহনীয় এক রূপে সে অপেক্ষায় বসে রইলো আলভির বাসায় ফেরার। খাবার টেবিল থেকে সমস্ত প্লেট, বাসন গ্লাস সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আছে জ্বালানো মোম, সতেজ গোলাপের পাপড়ি। খাবার হিসেবে লেবুর জুস সঙ্গে পায়েস, মিষ্টি আর পোলাও, মাংস। আরো আছে বোরহানি, তেহেরী। সবই আলভির ভীষণ প্রিয়। জারা গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে খাবারের পানে। তার হাতের নিকট পরে থাকে গতরাতে আলভির করা দু’টো ম্যাসেজ।

ক্লান্ত আর অবসন্ন দেহ নিয়ে বাসায় ফিরে বিস্মিত হয় আলভি। আলো আঁধারের সন্ধিক্ষণে কে যেন বসে আছে টেবিলে। ঘরময় ফুলের সুবাস। ধীর পায়ে আর শান্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চোখ ঘোরানোর মুহূর্তে দৃষ্টিতে বাঁধা পড়ে মুচকি হাসি ঠোঁটে রাখা জারার পানে। আটকে যায় আলভি সেখানেই। পলক পরে না যেন। জারা চেয়ার থেকে উঠে আসে। পরম যত্নে আলভির হাত থেকে ব্যাগ আর কোট নিয়ে তার বাহুতে মাথা রেখে বুকে হাত রেখে আঁকিবুঁকি করতে করতে মোলায়েম সুরে বলে

” আজকের আয়োজন শুধু তোমার জন্য। কেমন হয়েছে? ”

আলভি গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায় জারার পানে। কালো শাড়ির রঙ ছাপিয়ে জারার ফর্সাা ত্বক যেন ঝিলমিল করছিল মোমের রক্তিম আলোয়। সে কি উপেক্ষা করতে পারবে আজ জারাকে? চোখের পলকে জারার কোমড় পেচিয়ে ধরে এক হাতে। জারা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেকে। খাবার টেবিলে এগিয়ে গিয়ে বাটি থেকে পায়েস নেয় প্লেটে। মিষ্টি রাখে দু’টো। বলে

“অফিস থেকে এসেছো। আগে কিছু খেয়ে নাও। ”

আলভি দ্বিমত করে না। পেটে তার ক্ষুধা। টেবিলে সাজানো খাবার তাকে সত্যিই আকর্ষণ করছে। সে এগিয়ে যায়। জারা চেয়ার টেনে বসার ব্যাবস্থা করে নিজে দাড়িয়ে থাকে পাশে। আলভি দু চামচ পায়েস খেয়ে যেন স্বাদে পাগলপ্রায় হয়। জারার হাতের পায়েস সত্যিই অনন্য। নিজে আরো একটু নেয়। খাওয়া শেষ হলে পানি পান করে সে। অতঃপর জারার নিকে আবারও লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে এক পদ দুপা করে এগিয়ে যায় জারার নিকট। জারার ঠোঁটে রহস্যের হাসি। আলভি যখন জারার খুব নিকটে পৌঁছায় তখন সে কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই মাথা ঘুরে যায় তার। চোখ বুঁজে আসে অলস্যে। হঠাৎই ঢলে পড়ে সে জারার কাঁধে। অতঃপর? অতঃপর জ্ঞানশূন্য। জারা হাসে। রহস্যের হাসি রূপ নেয় লুকিয়ে রাখা কষ্ট ও ক্ষিপ্রতায়। পায়েসে মেশানো ঘুমের ওষুধ সঠিক সময়ে কাজ করেছে। শুধু পায়েস কেন? প্রতিটা খাবারে সে মিশিয়েছিল ঘুমের ওষুধ।

আলভির টলতে থাকা দেহকে মাটিতে লুটিয়ে দিয়ে জারা নিজের কাজে লেগে পড়ে। পকেট হাতড়িয়ে বের করে আলভির ফোন। অতঃপর আলভির ফিঙ্গার দিয়ে লক খুলে সে প্রথমেই ঢোকে ম্যাসেঞ্জারে। সেখানে পেয়ে যায় মাহাকে। তাদের হাতি, তামাশা আর প্রেমলিলা দেখে নিয়ে গ্যালারি থেকে আলভি ও মাহার রঙ তামাশাভরা ফটো নিজের ফোনে সেন্ড করে। ম্যাসেজের কিছু স্ক্রিনশটও নিয়ে নেয়। অতঃপর হঠাৎ তার মনে হয় একবার কি বাজিয়ে দেখবে মাহা নামক মেয়েটাকে? যদি সে প্রমাণ করতে পারে তারা জারার অনাগত সন্তানকে ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই মেরে ফেলার মতো প্ল্যানে যুক্ত ছিলো তবে কি ওদের শাস্তি দেবে আদালত? ভাবনাটা মনে জায়গা নিতেই জারা ঢিপঢিপ করা বক্ষ নিয়ে কম্পমান হাতে লিখে মাহার হোয়াটসঅ্যাপে

” জারা তো অপারেশন করে ফেলেছে? ”

মিনিট দুয়েক গড়িয়ে যেতেই ম্যাসেজ সিন হয়৷ উত্তর আসে ওপাশ থেকে

” কিসের অপারেশন? ”

জারা ভাবে। একটু ভাবতেই তার মাথায় আসে মাহা হয়তোবা এ সম্পর্কে অবগত নয়। সে চটজলদি বলে

” আরে কিছু না। বাদ দাও।”

মাত্র গাড়ি থেকে নেমে বাসার গেইটের নিকট গিয়েছিল মাহা। হঠাৎ থমকে দাড়ায় সে। বিষয়টা গোলমাল লাগে তার। কিছু একটা ভেবে মাহা তৎক্ষনাৎ রওনা হয় আলভির বাসার উদ্দেশ্যে। জারা তখন ফোন করে সংগ্রহ করা সব ফটো পাঠিয়ে দেয় উপমার নিকট। একটু পরই হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। জারা চমকে ওঠে। এ-সময়ে কে হতে পারে? দরজা খুলবে না পণ করলেও কলিং বেলের শব্দ থামে না। তা যেন সেকেন্ডের সঙ্গে বাড়তে থাকে। জারা দরজার নিকট এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই দেখা মেলে ফর্মাল ড্রেস পরিহিত এক মেয়ের। মেয়েটাকে প্রথম দেখায় চিনতে পারল না জারা। তবে দৃষ্টি একটু গাঢ় করতেই বুকের খাচার পাখি লাফিয়ে উঠলো। মস্তিষ্ক জানান দিল এই সেই মেয়ে যে জারার আজন্মকালের শত্রু হয়ে উঠেছে।

মাহা কুঁচকানো ভ্রুতে তাকিয়ে থাকে জারার পানে। অতঃপর জিজ্ঞেস করে

” আলভি কোথায়? ”

” কেন?”

মাহা জবাব দেয় না। জারার সাজসজ্জা তার মনে সন্দেহের বীজ বপন করে। সে ঘরে ঢোকে জারাকে এড়িয়ে। জারা বাঁধা দিতে চেয়েও যেন পারে না। ঠাঁই দাড়িয়ে থাকে দরজার নিকট। বুকের সঙ্গে দু-হাত আড়াআড়ি ভাবে রেখে সে পরখ করে মাহার আচরণ। মাহা ঘরে আলভির স্থির দেহ দেখে রাগ সমেত ফিরে আসে জারার নিকট। তবে জারা ভীষণ স্বাভাবিক যেন। মাহা দাঁতে দাঁত চেপে বলে

” কি করেছো ওর সঙ্গে তুমি? ”

জারা হাসে। মুচকি হাসি দিয়ে সে বিছানার ওপর বসে। পায়ের ওপর পা তুলে হাতে একটা জলন্ত মন নিয়ে জবাব দেয়

” এই ধরো ঠকে যাওয়ার আগেই একটু শক্ত হয়ে পরকীয়া করা পুরুষ কে বিষ খাইয়ে দিয়েছি।”

মাহার চোখেমুখে যেন ঘোর অমাবস্যা নামে। সে দুপা পিছিয়ে যায়। জারা টেবিল থেকে আলভির আধ খাওয়া পায়েস এনে মাহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে

” খাবে? আলভির এঁটো। ভালোবাসা গাঢ় হবে। খাও খাও। ওপারে গাঢ় ভালোবাসা নিয়ে সুখে থাকবে তোমরা। জারা নামক কাটা থাকবে না।”

মাহা ত্রাসে মেঝেতে পরে যায়৷ জারা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিল তার দিকে। মাহা দ্রুত এঘর ছেড়ে একরকম পালিয়ে যায় যেন। জারা তখন শব্দ করে হাসে। মিনিট না গড়াতেই তার হাসি পরিণত হয় কান্নাতে। হাতে থাকা আলভির এঁটো পায়েসের বাটি থেকে ছুড়ে ফেলে অজানা দিকে।

.
ভোরের প্রথম আলো জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হয়ে সরু রশ্মির আদলে ঘরে প্রবেশ করে। ঝিলিক খেলে আলভির চোখেমুখে। চোখের পাতা খুলে যায় আলভির। তড়াক করে উঠে বসে। মনে করার চেষ্টা করে কেন সে এভাবে ফ্লোরে পরে আছে।

চলবে….