ধোঁয়াশার শেষে পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
8

#ধোঁয়াশার_শেষে
সমাপ্তি পর্বের প্রথমাংশ
আলিশা আঞ্জুম

শুক্রবার, ভোর সাতটা। চারপাশ তখনো ঘুম জড়ানো। ঠিক সেই সময় জারার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় দশটি চকচকে কালো মাইক্রোবাস। বরপক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে তত্ত্ব। প্রতিটি গাড়ি যেন সাজানো রাজকীয় বাহন ভিতরে বয়ে এনেছে একশোটি ডালা, বউয়ের জন্য নিখুঁতভাবে প্রস্তুত করা। আছে আত্মীয়-স্বজনদের জন্য রকমারি উপহার, মিষ্টি, চকলেটের পসরা।

জারার জন্য পাঠানো হয়েছে ঝকমকে গহনার বাক্স। একেকটা যেন আলাদা করে গল্প বলে। সবকিছু এতটা পরিপাটি, এতটা জমকালো, যেন একটুও কমতি রাখা হয়নি।

বাড়িজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিয়েবাড়ির চিরচেনা ব্যস্ততা। কারো হাতে ফুল, কারো হাতে মিষ্টির বাক্স, কারো চোখে টুকরো আনন্দের ঝিলিক। বাতাসেও লেগে থাকে নতুন জীবনের মিষ্টি সুবাস।
.
জারাদের বাড়িটাও সাজানো হয়েছে বেশ জমিয়ে। নিকটাত্মীয় দের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। গোষ্ঠী বড় হওয়ায় ঘরোয়া বিয়ে করে করেও যেন হয়ে গেছে প্রায় দেড়শো মানুষ। কাকে রেখে কাবে ছাড়বে? জাহানারার ব্যাস্ততা বেড়ে গেছে। কেমন অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে। জাবেদ সাহেব ছোটাছুটি করছেন। জারা ইউভানের ডালার পানে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে। প্রতিটি জিনিস এতোটাই সুন্দর যে চোখ ফেরানো দ্বায় হচ্ছে । সবকিছুর মাঝে জারার সাদা আর সোনালী মিশেলের লেহেঙ্গার ওপরে রাখা একটা নোটে নজর আঁটকে গেল।সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা

” ওগো, তোমাকে দেখার জন্য তর সইছে না।”

এই একটা চিরকুট জারাকে এতোটা লজ্জা দিলো যে সে মুখে ওড়নার আঁচল দিয়ে হাসি লুকিয়ে ফেলল। অতঃপর কিছু একটা মনে হতেই তা সবার নজর এড়িয়ে মুঠোয় পুড়ে নিলো। কোন দুষ্টু কাজিন যূি দেখে তাহলেই হয়েছে। কিন্তু বরাবরই সন্ধ্যা হলো বাঘের খাঁচার সামনেই। রোজা নামের এক কাজিন পেছন থেকে হুট করে ছিনিয়ে নিলো নোটটা। হলুদ নোটের ওপর থাকা সুন্দর অক্ষর গুলো শব্দ করে পড়লো। এগিয়ে এলো বাকি সব কাজিনেরা। বলল কেউ

” উমম, ভাইয়া কিন্তু অনেক রোমান্টিক। দূরে বসেও প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে।”

আবার কেউ আওড়ালো

“প্রেম কাকে বলে কি কি আমি ভাইয়ার থেকে শিখতে চাই জারা আপু। আমার গার্লফ্রেন্ড টিকছে না।”

জারা শেষে বলা কথাটা আমলে নিয়ে তার চাইতে বয়সে ছোট কিন্তু উচ্চতায় বড় রিফাতের মাথায় গাট্টি দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। লজ্জা তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে।

.
দিনটা ভীষণ সুন্দর। জুমার নামাজ পরতে গেছে সবাই। জারা শুনেছে ইউভান মসজিদে নামাজ পর সেখানে কবুল বলবে। জারার বুকে ধুকপুক ধুকপুক সুর উঠেছে। হাতে মেহেদী। গায়ে জড়ানো হবু বরের পাঠানো লেহেঙ্গা। তাকে দেখতে লাগছে সত্যিই অপরূপা। গায়ে শুধু ঝকমক করা হিরার গহনা। ঘরের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। মনে হয় যেন কোন শুভ্র রাণী বসে আছে এই ঘরে।

তবে তার বদনখানি বিষন্ন৷ ভেতরঘর অস্থিরতায় পূর্ণ। বোনের হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে সে বিছানার ওপর। ঘর ভর্তি ছোট বড় কাজিনরা। সাজসজ্জায় একেকজন হৈ-হুল্লোড় কান্ড। ওরা ফটো উঠছে ফোনে। এসির মাঝে বসেও জারা স্বস্তি পাচ্ছে না।

.

শহরের জানজট ঠেলে, দশটা কালো প্রাইভেট কার এসে থামলো বউয়ের এলাকায়, মসজিদের সামনে। একে একে গাড়িগুলো থামলো, যেন কোনো রাজকীয় শোভাযাত্রা। কাঁচের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো যখন পড়ছিল, তখন তা যেন কোনো প্রাচীন রাজবাড়ির স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিল।

গাড়িগুলোর সামনে একদল লোক এগিয়ে গেল। সবার চোখে এক ধরনের গম্ভীর মহিমা। বরের গাড়ি থেকে যখন সে বের হলো, তার মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা আর রাজকীয় দৃষ্টি ছিল। সাদা আর হালকা সোনালী মিশেলে সাজানো পাঞ্জাবি, আর মাথায় বিয়ের পাগড়ি।যা তাকে রাজপুত্রের মতো লাগছিল।

মসজিদের গেইটে থামার পর, বর এবং তার সঙ্গীরা হেঁটে যাচ্ছিল, যেন এক পবিত্র যাত্রার অংশ। তাদের চলার পথে, জারি ছিল যেন এক নতুন ইতিহাসের অনুষঙ্গ।
.
জুমার নামাজ পড়া হলো। মসজিদে ভরপুর মানুষের সমাগম ছিল। এক অপূর্ব সৌন্দর্য বিরাজ করছিল সেখানে আকাশে বাতাসে পবিত্র আতরের সুবাস ভাসছিল। নামাজের পর, ইমাম বিয়ের কাজ শুরু করলেন। ইউভানকে ঘিরে সবাই বসলো, যেন এক পবিত্র মুহূর্তের সাক্ষী হতে চাইছে।

বিয়েটি হবে সুন্নাতি রীতি অনুসারে, যেখানে খেজুর ছিটানো হবে।একটি প্রাচীন প্রথা, যা বর এবং কনের জীবনে অমূল্য সুখ এনে দেয়। মসজিদের এক কোণে তাই রাখা ছিল বড় দু’টো খেজুরের প্যাকেট।

ইউভান বসে ছিল, যেন এই মুহূর্তটি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। পাঁচ বছর নয় মাসের অপেক্ষা। সে জানত, একদিন তার ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। সেই দীর্ঘ দিনগুলোর এক একটি মুহূর্ত, এক একটি অনবদ্য স্মৃতি, আজ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে এক তীব্র আবেগ। ভাসছে স্মৃতিতে জারার মুখটা। ইমাম সাহেব কাবিননামা হাতে নিলেন। বলতেই হয় সেখানে নির্ধারিত টাকার পরিমাণ ছিল
আটাশ কোটি তিনলক্ষ বিশ হাজার দু’শ পাঁচ টাকা। মোটামুটি রকমের (২৮/০৩/২০২০)৷ তারিখের সঙ্গে মিল রেখে ধার্য করা হয়েছে। এই তারিখটা ছিল জারাকে প্রথম দেখার তারিখ। ইউভানের বা হাতের তালুতে ঠাঁই পেয়েছিল একটা অক্ষর। ফুফু বলেছিল একটু নাকি মেহেদী দিতে হয়। ইউভান হাতের তালুতে তাই শুধু মাঝারি আকারে ইকরাকে দিয়ে লিখে নিয়েছে ‘J’ অক্ষর। সে সেই হাতের পিঠে তাকিয়ে থাকে। ইমাম তখন বলতে আরম্ভ করেছেন কাজি হিসেবে

” পিতা আরমান শাহ ও মাতা নয়নতারা ইরিন একমাত্র ছেলে ইউভান আহসান আপনি কি জাবেদ সাহেব ও জাহানারা বেগমের বড় মেয়ে জহুরা তাসনীম জারাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করবেন? রাজি থাকলে বলুন
‘কবুল’।

ইউভানের বুকটা কাপে। গলার স্বরও মৃদু কাপে যখন সে বলে
“কবুল।”
“আলহামদুলিল্লাহ, আবারও বলুন ‘কবুল'”
“কবুল।”
“আলহামদুলিল্লাহ, আর একবার বলুন।”
এবার ইউভান হঠাৎ থমকে যায়। বাধ্য হয় সে৷ কেননা গলা ভেঙে আসছে। চোখে জলের আগমন হচ্ছে। সে দ্রুত বলে
“কবুল।”

এরপর হঠাৎ সব কষ্ট মনে পড়ে তার। জারা এখন থেকে তার হয়ে যাবে। বিশ্বাসই হয় না যেন। একদম নিজের করে পেয়ে গেলো ইউভান?

.
কনের বাড়িতে বঁধুর ঘরে কাজি সাহেব। সকলের মাথায় কাপড়। জারা একা বিছানায় বসে৷ কাজি সাহেব অপেক্ষায় আছেন তিনবার কবুল শোনার জন্য। জারার গলা ধরে আসছে। কান্না হুটোপুটি খাচ্ছে। এমনটা হওয়াযেন নিয়ম। প্রতিটি মেয়ের জন্য। সে পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে ইউভানের কথা মনে করে। আনন্দ মুহূর্তের মাঝে তাকে গ্রাস করে। অতঃপর সে ধীর কন্ঠে বলে ফেলে

“কবুল, কবুল……”

চারিপাশে রব ওঠে আলহামদুলিল্লাহ-এর।

অতঃপর বিয়ে সম্পন্ন হয়। আজ থেকে নতুন জীবন শুরু হয় ইউভান ও জারার। কাজি বিদায় হলে একে একে ঘর ছাড়ে প্রতিটি সদস্য। ঘরে নাকি প্রবেশ করবে বর সাহেব। জারা খামচে ধরে থাকে বিছানার চাদর। চোখে পানি টলমল। আনন্দের? ইউভানকে পাওয়ার? ঘরের বাতাসে সুগন্ধি যুক্ত করে ধীর পায়ে রাজ্যে যেমন রাজা অভিষেক করে তেমন করেই আগমন ঘটায় ইউভান নিজের। ঘরে প্রবেশ করতে করতে তার প্রথম কথা হয়

” আমার সালাম রইলো আমার বউয়ের জন্য। ”

জারা মুখ তুলে চায়। ইউভানের ঠোঁটে মুচকি হাসি। জারার চোখে থেকে গড়িয়ে পরে এক ফোঁটা অশ্রু। বুকে ধুকপুক সুর। তবুও সে ফিসফিস করে জবাব নেয় সালামের। অতঃপর মাথা নিচু করে। ইউভান তাকিয়ে থাকে অপলক। সে যেন পলক ফেলতে ভুলে গেলো। এরপর ইউভান দু-হাত প্রসারিত করে দিয়ে ডাকে আলতো সুরে

“জারা…”

তার বুকে ঝাঁপিয়ে পরার আহ্বান জারা আমলে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ইউভানকে। হুহু করে কেঁদে ওঠে। শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা ঠেকিয়ে যেন নীরবে বলছে সে
” কি হতো যদি আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলতাম।”

ইউভান জারার মুখটা উঁচু করে আজ সরাসরি কপালে ঠোটের উঞ্চতা একে দিয়ে আবারও জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। জারার চুলের মাঝে মুখ লুকিয়ে সে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। সেই অপ্রকাশিত কান্না টুকু বেরিয়ে আসে এই বদ্ধ ঘরে বঁধুর কাঁধে মুখ লুকিয়ে। এতোদিন শুধু সে বলেছে’জারা ইউভানের’ আজ পুরো পৃথিবী বলতে বাধ্য ‘জারা শুধুই ইউভানের”। আর এই আনন্দটুকু যেন আকাশ পাতালের দুরত্বের মাঝে রাখলেও অকুলান হয়ে যাবে।

চলবে….

#ধোঁয়াশার_শেষে
#আলিশা_আঞ্জুম
সমাপ্ত পর্বের শেষ অংশ

বিদায় মুহূর্তে মায়ের থেকে একটা ছোট চুমু আর চোখের জল নিয়ে আবারও সে বাড়িতে, ইউভান রেসিডেন্সে আজ জারা প্রবেশ করলো নতুন পরিচয়ে, নতুন ভাবে রাণীর সমাদরে। তাকে তাজা গোলাপের সুবাসে মৌ মৌ করা গন্ধের সজ্জিত বাসর ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ইউভানের ঘরটা আজ বড্ড বেশি মোহনীয় সাদা মোমের উজ্জ্বল হলুদ আগুন শিখায়।
নরম আলোয় ভরা ঘরটা যেন নিঃশ্বাসও আটকে রেখেছিল।
জারা বসে ছিল মাথা নিচু করে। তার আঙুলের নখে খেলা করছিল লজ্জা। ইউভান ঘরে ঢোকে। আলতো ভাবে দরজা বন্ধ হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে এক হাঁটু গেড়ে বসে জারার সামনে।

” শুকনো মুখ কেন? ভয় পাচ্ছো?”
“না,”
জারা মৃদু গলায় বললো, মাথা না তুলে জবাব দেয়।
“তাহলে?”
“মন কাঁপছে…”

ইউভান তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো। নরম স্বরে বললো,
“আজকের রাত হবে তোমার মতোই কোমল, কথা দিলাম।”

জারা ধীরে ধীরে তার দিকে তাকালো। চোখে মিশে ছিল ভয়, বিশ্বাস আর একরাশ আবেগ।
ইউভান জারার দিকে তাকিয়ে রইল বারবারের মতোই। ঠিক জারার চোখের দিকে। ঘোমটা মাথার ওপর তুলে দিয়ে সে তাকিয়ে আছে। এভাবে কাটলো প্রায় বিশ মিনিট। অতঃপর যেমন করে হাজারটা পাথর গাড়িয়ে পরতে পরতে হঠাৎ একটা পাথর স্থির হয়ে যায় তেমন করোই স্থির হলো ইউভানের একটা কথা। জারার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে সে
“আমি কি আমার পরবর্তী ধাপে যেতে পারি?”

জারা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে মাথা নামিয়ে ফেললো। মুখের কোণে নরম হাসি ফুটে উঠলো।কোনো শব্দ এলো না।
কিন্তু নীরবতার সেই নরম সুরেই ইউভান সব বুঝে নিলো।
ভালোবাসায় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে জারার হাত নিজের হাতে নিলো।

ধীরে ধীরে, স্নিগ্ধ ভালোবাসায় দু’জনের মাঝের দূরত্ব হারিয়ে যেতে লাগলো।ঘরটা ভরে উঠলো নিঃশব্দ মুগ্ধতায়, যেখানে শুধু হৃদয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
.

এক সপ্তাহের মাঝে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা কেটে গেলো যেন এক স্বপ্নের মতো। শত মানুষের ভিড়, হাসি, ফুলের ঘ্রাণ আর অনন্ত শুভেচ্ছার ভেতর দিয়ে দু’জনের চোখে ছিল কেবল একে অপরের ছায়া।

কয়েকদিন পর এক হালকা উষ্ণ বিকেলে যখন জারা ঘরে বসে শাড়ির আঁচল ঠিক করছিল তখন ইউভান হঠাৎ জারার সামনে একটা পাসপোর্ট আর টিকিট ছুঁড়ে দিলো।
“তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি। হানিমুন কিডন্যাপ।”
জারা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। মাত্র পরা সিল্কের শাড়ির আঁচলের ভাজ ঠিকঠাক করে নিয়ে শুধালো
“কোথায়?”
“সাদা বরফের দেশে। যেখানে শুধু তুমি আর আমি থাকবো।”

এরপরই ঘন্টা কয়েকের ব্যাবধানে উড়োজাহাজ ছুঁয়ে এলো মেঘের বুক।ওরা পাড়ি জমালো সুইজারল্যান্ডের এক ছোট্ট শহর স্নো-কাভার্ড এক স্বপ্নপুরী।

রাতে পৌছালো। ক্লান্ত ইউভান পৌঁছেই নিজেদের হোটেল রুমে পৌঁছে জারার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে বুকের মধ্যে গুটিয়ে নিলো। অতঃপর ধপাস করে জারাকে নিয়ে বিছানার মধ্যে পড়ে গেলো সে। বন্ধ করলো দুচোখ অবলীলায়। আর বলল

” প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব মি। এটা আমার ঘুমানোর সময়। আর এই মুহূর্তে তুমি আমার কোলবালিশ। সো নো নড়াচড়া ওকে?”

জারা ছটফট করল না। শুধু একটু সুবিধা করে নিতে চাইলো ইউভানের শক্ত বাঁধন থেকে। একটু ফাঁক ফোকর রাখতে চাইলো নিশ্বাস নেওয়ার জন্য।

.
পরদিন সকালে হাঁটতে বের হয় দু’জনে। জারার পরনে ছিল বাদামী বর্ণের শীতের লং কোট। মাথায় ছিল হালকা গোলাপি রঙের স্কার্ফ।ইউভান ছিল বরাবরের মতোই কালো জ্যাকেটে আবৃত। তবে আজ জারার সঙ্গে মিলিয়ে সে পরেছে গ্রে কালার প্যান্ট। জারার ঢিলেঢালা জিন্সটাও ছিল গ্রে রঙের।তাদের দু-হাতের বাঁধন ছিল খুবই অটুট।

বরফে মোড়া পথ। ঠান্ডায় লাল হয়ে যাওয়া গাল আর নিঃশব্দ ঝরা তুষারপাতের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলো তারা। জারা শীতে কাঁপছিলো। চেরি ফলের মতো লাল হওয়া গাল দু’টোর দিকে ইউভান তাকিয়ে তাকিয়ে বাঁকা হাসছিল। যেন সে সত্যিই সেগুলো চেরি ফল ভেবে বসেছে। ভাবতে ভাবতেই
হঠাৎ পেছন থেকে ইউভান জারার গালে নরম কামড় দিলো।
“শীত কমাতে এভাবে সাহায্য করতে হয়।”
ইউভানের সরল বাক্য। জারা রাগে গরম চোখে তাকিয়ে বলে
“বাচ্চাদের মতো বিহেভ করছেন আপনি।”
বলতে বলতেই গাল মুছে নিল এক হাত দিয়ে।
ইউভান হাসলো, কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
“তোমার সামনে আমি সবসময় বাচ্চা হবো, আর দানবও। বেছে নাও তুমি কাকে চাও।”

জারার রাগ উবে লজ্জা উদয় হলো। ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে রাখলো সে। পায়ের নিচে বরফ কচকচ করে বাজছিল। বাজছিল বুকে মাদল, ঢোল তবলা।
.
বরফের শহর নিস্তব্ধ ছিল। চারপাশে শুধু সাদা চাদর বিছানো। হঠাৎই ইউভান পেছন থেকে এক মুঠো বরফ তুলে এনে জারার গলায় ছুঁড়ে দিলো।

জারা চিৎকার করে ওঠে
“মিসফিটের বাবা, ঠান্ডা!”
সে ক্ষিপ্ত চোখে ঘুরে দাঁড়ালো। ঠোঁট ফুলিয়ে রাগ দেখালো।

ইউভান ঠোঁট কামড়ে হাসে। হুট করে চোখ টিপে বলে
“গরম করার জন্য আমার বুক আছে জান। আসো জড়িয়ে ধরি।”
বলেই আবার দুষ্টু দুষ্টু হেসে এগিয়ে এলো।জারা দৌড়ে পালাতে চাইল, কিন্তু ইউভান দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেললো।দুটো হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনলো।জারা প্রাণপণে ছটফট করলো, আর ইউভান আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
“ভালোবাসার শাস্তি দিবো আজ।”
ইউভান ফিসফিস করে বললো।
তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে পড়ছিল জারার কানের কাছে।
জারা লজ্জায় চুপ। বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপছিলো।
ইউভান তাকে কোলে তুলে কেবিনের ভেতরে নিয়ে এলো।
ফায়ারপ্লেসের সামনে বসিয়ে দিলো।

তারপর ধীরে ধীরে জারার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে আওড়ালো
“জান, তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন?”
বলেই নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো জারার আঙুলের মাথায় এক এক করে।আঙুল ছুঁয়ে সে যেন প্রতিটা মুহূর্তে প্রেম লিখছিলো।

জারা মাথা নিচু করে বসে ছিলো, চোখ তুলে তাকাতে পারছিলো না।তার গাল লাল হয়ে উঠেছিলো, ঠোঁট কাঁপছিলো নরম কাঁপনে।
ইউভান জারার কাঁধে মাথা রেখে বলে
“চলো, দুজনেই বরফের মতো গলে যাই আজ।”
তারপর সে জারার কপাল, নাক, ঠোঁট… প্রতিটি জায়গায় অতি মৃদু চুমু এঁকে দিলো। এমনভাবে যেন সময়টাকে ধরে রাখতে চাইছে।

ওরা দুজন পাশাপাশি শুয়ে রইলো আগুনের আলোয়।
হাতের আঙুল একসাথে মেলানো, দুটো নিঃশ্বাস মিশে এক হয়ে গেছে। বরফের দেশ, আগুনের উষ্ণতা আর দুটো পাগল করা হৃদয়ের গল্প তৈরি হচ্ছিলো আজও চুপিসারে।
.
কাটল দিন হাসি, আনন্দ আর ইউভানের দুষ্টুমিতে। পনেরো দিন সুইজারল্যান্ডে থাকার পর দেশে ফেরার পালা। জারা দাড়িয়ে ছিল লাগেজ নিয়ে কাউন্টারে। ইউভান রিসিপশনে কথা বলেছিল কিছু নিয়ে। সম্ভবত বিল পে করছে সে। জারা উদাস হয়ে যখন তাকিয়ে ছিল এদিক-সেদিক তখন হঠাৎই একটা দৃশ্যে তার চোখ আঁটকে যায়। বিলাসবহুল এই হোটেলের একটা বিশাল LED স্ক্রিনে চলছে গাব্রিয়েল গেভারার এড। মাই ফল্ট মুভির এই নায়কের প্রতি যেন জারার দূর্বলতা একটু অন্যরকম ছিল। সে হা হয়ে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। এরমাঝে ইউভান এগিয়ে আসে। পকেটে ওয়ালেট রেখে খোলা বোতামের শার্ট নিয়ে সে যখন আসছিল তখন তার চোখ কুঁচকে যায়। অফ হোয়াইট কালার টিশার্ট ঝাকিয়ে সে যেন নিবারন করতে চায় তার গরম ভাব। এতো নিচু তাপমাত্রাতেও গরম অনুভব হওয়া সম্ভব? সম্ভব! যখন শখের নারী তাকিয়ে থাকে অন্য কোনো পুরুষের দিকে। ইউভান ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে উল্কার বেগে জারার চোখে হাত রাখে। আঁধার নামায় সামনে। জারা চমকে ওঠে। সুবাসের দরুন বোঝে এটা ইউভান।

“কি করছেন?”
ইউভানের চোখে স্পষ্ট রাগ। সে গম্ভীর স্বরে বলে
“তুমি কি আমাকে জেলে পাঠাতে চাও?”
“মানে?”
“আমার ইচ্ছে করছে তোমার পছন্দের তারকাকে খু ন করতে।”
জারা ইউভানের হাত সরানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়। অতঃপর অবাক কন্ঠে বলে
“এটা শুধু একটা পিকচার। আমি ওভাবে তাকাইনি। সত্যি।”
ইউভান তবুও হাত সরায় না। তার গার্ডরা এসেছে একটু আগে। ওরা লাগেজ নিয়ে হাঁটতে থাকে। আর ইউভান জারার চোখে আঙ্গুল রেখে।
“আমি পরে যাবো।”
“পরবে না আমি আছি।”
“ছাড়ুন। আপনি এমন হিংসুটে জানতাম না।”
জারার ঠোঁটে মৃদু হাসি।
“আর একবার তাকালে তোমাকেই শেষ করে ফেলব আমি। এই চোখ শুধু আমাকে দেখবে।”
ভয়ঙ্কর রাগ ইউভানের মাঝে এই মুহূর্তে।
কথা বলতে বলতে সে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসে। অতঃপরই জারার চোখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়।

.
সময়, সে যে পদ্মপাতার শিশির বিন্দু। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলো। ইউভান এখন তারকার চাইতে কম নয় যেন। এমন করে পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে সে, যেন আইন শব্দের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে থাকে ওতোপ্রোতো ভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে রাজ্যে সে একজন নামকরণ ব্যারিস্টার। তারকাদের কেইস লড়ে। কখনোবা বড় বিজনেসম্যান দের কেইস। তবে সবই একই ধারায়। যদি তার মনে হয় এটা সত্যির ওপর দাড়িয়ে আছে তবেই। ডাক পড়ে তার বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে। বাবার খ্যাতি এড়িয়েও যে সে নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে পারে তা যেন প্রমাণ করার তোড়জোড় ছিল তার মাঝে। আজ এই মুহূর্তে সে জিতেছে একটা বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে আসা মিথ্যা অপবাদের কেইসে। বাসায় ফেরার মুহূর্ত এখন। বড্ড ব্যাস্ত। টেকওয়ে কফি হাতে ছুটছে দ্রুত পায়ে। বাসায় অপেক্ষা করছে ওরা। চারিপাশে দশ থেকে পনেরো জল দেহরক্ষী যেন দৌড়ে যাচ্ছে ইউভানের সঙ্গে। রাজকীয় ভঙ্গিতে সে যখন নিউইয়র্কের এয়ারপোর্টে পৌঁছায় তখন হঠাৎ জেঁকে ধরে তাকে এক ঝাঁক রিপোর্টার আর ক্যামেরা ম্যান। ফ্লাশ জ্বলে বিরতিহীন ভাবে। তারা সবাই উৎসুকভাবে ইউভানকে প্রশ্ন করার জন্য অপেক্ষা করছে। একজন রিপোর্টার সামনে এসে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলো,

“Mr. Yuvan, you just won a huge case in New York, how does it feel to be on top of the game?”

ইউভান ঠাণ্ডা মাথায় মৃদু হাসলো, এক মুহূর্তে সবার দৃষ্টি তার দিকে চলে আসলো। এরপর সে স্যাভেজভাবে উত্তর দিলো,

“It feels great… but let me tell you something. I don’t play the game to win, I play the game because I own it. Winning is just a bonus.”

তার এই কথায় রিপোর্টারদের একে একে চুপ হয়ে যেতে হলো, আর ইউভান সোজা পা চালিয়ে চলে গেল। পকেটে ভাইব্রেট হয় তার ফোন। হাতের ভাঁজে থাকা কোর্টের কালো নির্ধারিত পোষাক তার এসিস্ট্যান্ট জুনাইদ এর হাতে দেয়। কফিটা তুলে দেয় বামের এক দেহ রক্ষীর হাতে। দ্রুত ফোন বের করে বলে ওঠে বড্ড আদুরে স্বরে

“ ইয়েস, পাপা।”

ওপাশ থেকে ভেসে আসে ফুপিয়ে ওঠা স্বর। বাবার কন্ঠ পেয়ে সে হয়ে গেছে আরো দুঃখী। যেন রাজ্যর সব দুঃখ ঝড়ে পরলো ছোট আদুরে কন্ঠ থেকে। কান্নার দমকায় থেমে আসা কন্ঠ স্বর ইউভানকে জানায়

“ মাম্মাহ আমাকে বকেতে।”

জারা তখন লাঠি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে ছিল রণমুর্তি রূপে ছেলের সামনে। বলে শাসিয়ে

“আবার কান্না করে? কাঁদলে মারবো এবার।”

“আপনি…আপনি কথা বলবেন না। পঁচা মাম্মাহ…. জাইন আহাদ ইহান এখন পাপার সঙ্গে কথা বলছে।”

কন্ঠে ছিল বিড়ালের মতো গর্জন। মা’কে দেখে তার ভয় আবার যেন ফোনের ওপাশে বাবা থাকায় এক বুক সাহস।

“বাবা, বাসায় ফিরে আমরা রেস করবো ঠিক আছে? তোমার মাম্মাহ কে বকেও দেবো। তুমি চোখের পানি মুছে নাও।”

ইউভানের কথা শুনে নাক মুখ ফুলিয়ে রাখা ইহান ছোট হাতে চোখ মুছে নেয়। কেঁপে ওঠে তার ছোট শরীর। জারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কোমরে গুঁজে রাখা শাড়ির একাংশ খুলে দিয়ে উল্টো পথে একটু পর হাঁটতে হাঁটতে বলে

“তোমাকে নিয়ে আর আমি পারছি না ইহান। তুমি বেশি বেশি করছো ইদানীং। খাবার খাওনি বলেই আমি বকেছি। এটা নিয়ে আবার তোমার বাবার কাছে বিচার দিতে হবে?”

“ দিতে হবে…বাবা নেওক্কে থেকে ফিরলে আমি নানু বাসায় চলে যাবো।”
“যাও তাড়াতাড়ি। তুমি খুব বিরক্তিকর।”
“আমি থাকবো না এখন এখানে। আপনি বকছেন এখনো। আমি চাচ্চুর এপানমেন এ যাবো।”

বলতে বলতে ডিভান থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে ইহান বেরিয়ে যায় দ্বিতীয় তলা থেকে। জারা তাকিয়ে দেখে নীরবে। এতোটা জেদি হয়েছে ছেলেটা! দরজা খুলে দেয়। ইহান সিঁড়ি বেয়ে রয়ে সয়ে নামতে নামতে চলে যায় নিচ তলায় আমাদ এর এপার্টমেন্ট এর দিকে। রেসিডেন্সের চারিপাশে ছিল গার্ড। চিন্তা হলো না জারার। শুধু ইহান যতোক্ষণ না আমাদ এর ঘরে পৌঁছালো ততক্ষণ তাকিয়ে দেখলো। অতঃপর দরজা খোলা রেখেই চলে গেলো কিচেনে রান্না করতে। ইউভান আসছে। রান্না চলছে তাই। বিয়ের পর পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইউভান চাকরিতে যুক্ত হতে দেয়নি৷

.
আমাদ এর ঘরে গিয়ে ইহান একইভাবে বিচার দিলো আমাদ এর নিকট। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক ছবিকে বিছানার ওপর রেখে সে আঙ্গুল উঁচিয়ে উঁচিয়ে বলল কিছু। আবার বলল

“তুমি কবে আসবে চাচ্চু? মাম্মাহ বলেছে আমি বড় হলে আসবে? তুমি জানো….আমি…..আমি কুইক বড় হওয়ার জন্য কমপেন খাই!”

কথাটা বলে সে তার উচ্চতার অর্ধেক উঁচু ছবিটা বিছানায় রেখে তারওপর শুয়ে পড়ে। মুহূর্তে চোখে নামে ঘুম। দরজার বাহিরে দাড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে গার্ড তখন পাহাড়ায় ছিল ইহানের জন্য। ছোট বাচ্চাটা কেন যেন এই রুমের ওপর আর এই ওই ছবিটার ওপর বড্ড আকৃষ্ট। আকৃষ্ট তো সকলেই হয়। যখন আমাদ এর ছবিটা দেখে। মনে হয় কোন কল্প রাজ্যের রাজকুমার।

ইহানের কারণেই ইউভান এই ঘরগুলো জাঁকজমকপূর্ণ করে প্রতিমাসে। কেউ রাত্রিযাপন করে না এখানে। শুধু ইহান রজনী যাপন করে মাঝে মাঝেই। এই দৃশ্যের সাক্ষী হয় কেবল আমাদ এর পরে থাকা কিছু দামী আসবাবপত্র। সাক্ষী হয় একটা ডায়েরি। টেবিলের ড্রয়ারে সে গুমরে মরে। তার মালিকের ফিরে আসার অপেক্ষায় যেন। নয়তোবা তাকে কেউ পড়ে ফেলবে, জমে থাকা ধুলো কেউ মুছে দেবে সযত্নে এই আশায়। ডায়েরির শেষ পাতায় কি অনিকের পর আর কেউ চোখ বুলাবে না? দেখবে না সেখানে লিখে যাওয়া এক অমল ব্যাথা। না পাওয়ার আক্ষেপ আর গুমরে মরার ছটফটানি।

১৩.০৩.২০২৫ [ উপমার বিয়ের তারিখ ]

“জীবনে দুইজন মানুষকে ভালোবেসেছিলাম আমি।
প্রথমজন, যার গর্ভে জন্ম, দ্বিতীয়জন যার চোখে আমি বাঁচতে শিখেছিলাম।
আমার মা…
যে শিখিয়েছিল ভালোবাসা মানে নিঃস্বার্থ দেওয়া,
আর উপমা…
যার জন্য আমি শিখেছিলাম, ভালোবাসা মানে নিজের সমস্তটা হারিয়ে ফেলা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত…
দু’জনেই চলে গেছে।
মা চলে গেছে সাদা কাপড়ে মুড়ে।
আর উপমা চলে গেছে কারো প্রেমে পড়ে, যাকে আমি আমার করতে পারিনি।

ভালোবাসা?
তা তো এখন আমার জন্য একটা অভিশাপের নাম।আমি যাকে ভালোবাসি, সে চলে যায়।
আমি যাকে আঁকড়ে ধরি, সে ফসকে যায় আঙুলের ফাঁক গলে। সবসময় আমিই কেন দুর্ভাগা হই?

উপমা…
ভালো থাকো তুমি। শুধু চাইবো, তুমি কখনো টের না পাও, কি ভীষণ ভালোবেসেছিলাম তোমায়!

.
বিকেলের আকাশটায় তখন নরম রোদ আর নীলচে মেঘের পালক। ইউভান রেসিডেন্সের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে সজাগ নিরাপত্তার প্রহরা। হঠাৎই দূর আকাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল একটা দমকা শব্দ। ঢুংঢুংঢুংঢুং। যেন আকাশ কাঁপছে। ঘুমের সঙ্গে সন্ধি করা ইহান তড়াক করে উঠে বসে। হেলিকপ্টারের শব্দ তার বড্ড চেনা। অস্থির ভঙ্গিতে বাহিরে বের হয় সে। মেয়ে গার্ডটা কোলে তুলে নেয় ইহানকে। ছাদের দিকে ছোটে।

ছাদে থাকা গার্ডরা ওপরে তাকাল। একটা চকচকে সাদা-কালো রঙের দামী হেলিকপ্টার আকাশের বুক চিরে নেমে আসছে! তার শরীরজুড়ে ইউভানের ব্যক্তিগত লোগো।

নীচে, ছোট্ট ইহান কোল থেকে মেনে পরে। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে।
“দেখো সবাই, বাবা আসছে!”

হেলিকপ্টারটা ঠিক ছাদের উপর থামল। রটার ঘূর্ণায়মান। বাতাসের প্রবল ঝাপটায় চারপাশ কাঁপছিল।
হেলিকপ্টারের দরজা খুলতেই ইউভান ঝট করে নামল।
চোখে সানগ্লাস, গায়ে হালকা জ্যাকেট। সে এগিয়ে এসে ইহানকে গার্ডের কোলে থেকে তুলে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিল।
“বাবা!”
ইহান চিৎকার করে জড়িয়ে ধরল ইউভানকে। তার ছোট্ট হাতদুটো বাবার গলায় শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরেছে।

” আমার চ্যাম্প!”

ইহান এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মুখ ছোট্ট করে বাঁকাল, তারপর এক দুষ্টু হাসি দিয়ে জেদ ধরে বসল হঠাৎই
“আমি এখনই নানুর বাড়ি যাব! হেলিকপ্টারে করে! না গেলে রাগ করব!”

ইউভান হেসে মাথা ঝাঁকাল।
“এখনই?”
“ইয়েস।”
“হাহ! যথাআজ্ঞা ইউভানের পুত্র।”

ইহান বাবার কোলে বসেই হেলিকপ্টারে চড়ে বসল।
ইউভান শক্ত করে তাকে বেল্ট পরিয়ে দিল।
পাইলট সিগন্যাল দিল। হেলিকপ্টার আবার বাতাসে ভাসতে শুরু করল। নীচে ছোট হতে থাকা শহর, চারপাশের আলো— আর মাঝখানে বাবা-ছেলের এক টুকরো ছোট্ট, অপূর্ব জগৎ।

ইহান বাবার হাত ধরে হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে মুগ্ধ হয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে ছিল স্বপ্নের আলো আর ইউভানের মনে ছিল একটাই কথা:
এই ছোট্ট হাতটা চিরকাল ধরে রাখার জন্যই সে এই বিশাল পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে যাবে।
.

রাত তখন গাঢ় নীল। ইউভান ক্লান্ত অথচ প্রশান্ত মনে গাড়ি পার্ক করে ঢুকল বাসায়। দরজা খুলতেই জারা ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে ছিল, হাত ক্রস করে বুকে রাখা, ভ্রু কুঁচকে।
চোখেমুখে ফুটে আছে সুস্পষ্ট অভিমান।

“বাহ, বাহ, সাহেব এসে গেছেন!”
জারা ঠোঁট গোল করে বলল।
ইউভান হালকা হেসে জ্যাকেট খুলে ঝুলিয়ে রাখল।
“কি হলো আবার?”
সে একেবারে নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করল, যদিও চোখের কোণে চাপা হাসি লুকিয়ে ছিল।

“কি হবে? কিছু হয়নি! গার্ড থেকে শুনেছি আপনি ছেলেকে নিয়ে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে দিলেন নানুর বাড়ি! একবার আমাকে বলারও প্রয়োজন মনে করলেন না?”
জারার গলা ভরা ছিল কৃত্রিম রাগ আর ঈষৎ অভিমান।
ইউভান তার দিকে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। জারা এক পা পিছিয়ে এল, কিন্তু চোখ সরালো না। সে ঠিক করেছিল আজকে সহজে মাফ করবে না।
ইউভান হঠাৎ থেমে কোমর ভাঁজ করে নিচু হয়ে বলল,
“আজ্ঞে, কোর্ট-মার্শাল শুরু হয়ে গেছে নাকি? তাহলে প্রথম অভিযোগ কী?”
জারা ভ্রু তুলল।
“প্রথম অভিযোগ — বাবা-ছেলে মিলে মায়ের সাথে ষড়যন্ত্র!”
“আর দ্বিতীয়?”
ইউভান আরও কাছে এগিয়ে এল, তার চোখে দুষ্টু হাসি।
“দ্বিতীয় অভিযোগ — আমার না বলা ছাড়া, ছেলে কোথাও যাবে না!”
জারা হাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। ইউভান হঠাৎ তার হাত ধরে কাছে টেনে নিল। জারা হকচকিয়ে গেল, তার চোখের রাগ যেন মধুর হয়ে ঝরে পড়ল।

“শাস্তি কী আমার, ম্যাডাম?”
ইউভান ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ঠোঁটের কোণে এক টুকরো দুষ্টু হাসি।
জারা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল,
“কিছু না।”
একথা বলেই সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো ইউভানের থেকে। ইউভান জোর করলো না। সে জানে এই অভিমান জারা বেশি সময় ধরে রাখতে পারবে না। যদি ইউভান একবার বলে দুষ্টুমি করে
“জারা ইউ আর ডিলিসিয়াস।”
ভাবতে ভাবতেই বলা শেষ। আর জারা? কুশন ছুড়ে দিলো ইউভানের দিকে।
” এই কারণে ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন?”
ইউভান হাসলো।
.
শহরের ব্যস্ত রাস্তা থমকেগেছে যেন। গাড়ির ভেতরে নেমে এসেছিল এক টুকরো শান্তি। ইউভানের কালো বুগাট্টি…. চলছে শশুর বাড়ির দিকে। সেখানে একটা ছোট দাওয়াত আছে। একারণেই বিনা দ্বিধায় একটু আগে ইহানকে রেখে এলো হেলিকপ্টারে।

জ্যামে আঁটকে জারা ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে হেলে পড়ে ইউভানের কাঁধে, যেন সেই চেনা আশ্রয়ে কিছু সময়ের জন্য ভুলে যেতে চায় সবকিছু।
তার খোলা চুল ছড়িয়ে ছিল ইউভানের কোলজুড়ে। বাতাসের হালকা ছোঁয়ায় ওরা দু’জনেই যেন হারিয়ে গিয়েছিল এক পুরনো, অমলিন গল্পের পাতায়। ইউভান নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে জারার শান্ত মুখের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়,সময় যেন স্থির হয়ে গেছে কেবল তাদের জন্য।
হঠাৎ আস্তে করে নিজের টাই খুলে নেয় ইউভান। অপূর্ব কোমলতায়, যেন ভেঙে যাবে এই মুহূর্ত, ছুঁয়ে ছুঁয়ে গুছিয়ে দেয় জারার এলোমেলো চুলগুলো। এমন স্নেহ, এমন মায়া কেবল সেই ভালোবাসায় জন্মায়, যা কথায় প্রকাশ পায় না।শুধু অনুভবে বাজে।
জারা তখনও গভীর ঘুমে নিশ্চিন্ত। ইউভান তার মাথার ওজন নিজের কাঁধে অনুভব করে, বুকের ভেতর প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে সামনের পথে। ভালোবাসার মানুষ এভাবেই পাশে থাকুক পাগল প্রেমিকের কাঁধে মাথা রেখে। পূর্ণতা পাক পৃথিবীর সব ভালোবাসা।
.
রাতের নিস্তব্ধতা আজ ছুঁতে পারেনি জাহানারার বাড়ি। ঘরে ঘরে ছোটাছুটি, হাসাহাসির ধ্বনি।
আজ একটা ছোট্ট পারিবারিক আড্ডা। মেয়েরা, আর মেয়েতুল্য কিছু বোন-ননদের মেয়ে-জামাইদের নিয়ে ছোটখাটো আনন্দ, আয়োজন।
উপমা এসেছে আজ, কোলে তার ছোট্ট শ্যাম পরী আয়রা। ড্রয়িংরুমের সোফার সামনে কালো পাঞ্জাবিতে ইহান বুকের ওপর হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে ছিল, বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে।
হঠাৎই উপমাকে দেখে তার চোখ আটকে যায়।
আর কোলে ঘুমন্ত আয়রাকে দেখে যেন দুনিয়াই থমকে যায় ছোট ইহানের জন্য!
একটানা তাকিয়ে থাকে সে।
বুকে টনটন শব্দ হয়। যেন ছোট্ট ঢোল বাজছে।
চোখে-মুখে অপলক মুগ্ধতা।এদিকে আয়রা ঘুম থেকে জেগে পিটপিট করে চোখ মেলে। আধো ঘুমে মায়ের কাঁধে মাথা রেখেই তাকায় সামনে।
দৃষ্টি এসে আটকে যায় ইহানের চোখে।
অবাক হয়ে ছোট্ট আয়রা ফিসফিস করে ডাকে
“ইআন ভাইয়া…”
ইহানের মুখ ভার হয়ে যায় সাথে সাথে।
বেশ রাগী ভঙ্গিতে দৌড়ে গিয়ে টানতে টানতে আয়রাকে কোলে নেয়, যেন কেউ তার প্রিয় জিনিস ছিনিয়ে নেবে।
তারপর ঝটপট এনে বসিয়ে দেয় সোফার কোণে।
চারপাশের বড়রা তখন ব্যস্ত নিজেদের কাজে।
এই সুযোগে ইহান আয়রার ছোট্ট মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে
“আমি ভাইয়া না। আমি তোমার বেবি বয়। তুমি আমার বেবি গার্ল। বুঝলে?”
আয়রা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে মাথা দুলিয়ে বলল,
“হু।”
ইহান সঙ্গে সঙ্গে আরও আগ্রহ নিয়ে বলে —
“আমি বড় হয়ে তোমাকে বউ করবো। ওক্কে?”
আয়রা হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, তার ছোট্ট গলা কাঁপে,
“নাআআআআ! বউ হবো না। আমি ডাক্তার হবো!”
ইহান একটুও দমে না। মুখ ফুলিয়ে, হাত কোমরে রেখে ঘোষণা দেয়
“না, তুই বউ হবি। ইহানের বউ! তোর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকে টুপটাপ করে ব্যাথা করেছে। জানিস? তাই তোকে আমার বউ হতেই হবে।”
আয়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
পরে আবার আধো ঘুমে হেসে ফেলে।
আর ইহান তার পাশে বসে গম্ভীর মুখে ঠিক যেন সত্যিকারের কোনো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সারাজীবনের জন্য।

সমাপ্ত

[ বেচারা কি প্রমাণ করলো? সে ইউভান কা বেডা, আমাদ কা ভাতিজা। আবারও প্রেমের পুনরাবৃত্তি। শ্যামলা চোখের প্রেমে আমারও ইহান। আর বাবার মতো জেদি মনোভাব। ]
[ যাই হোক, আমি জানি গল্পে টুকটাক অনেক ভুল করেছি। বানান ভুল তো আছেই। আশা করি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আল্লাহ হাফেজ। ভালো থাকুন। আর একটা ছোট মন্তব্য করতে ভুলবেন না। প্রিয় চরিত্র কে ছিল বলে যাবেন।]