#নিঃসঙ্গতার_পরের_অধ্যায় (পর্ব ১)
নুসরাত জাহান লিজা
আলোকসজ্জায় ঝলমলে বিয়ে বাড়ি। হৈ হুল্লোড় চলছে পুরোদমে। মুহুর্মুহ “বর এসেছে, বর এসেছে” ধ্বনিত হয়ে সেই হুল্লোড় যেন বাড়তি মাত্রা পেল।
শৈলীর এখনো সাজ শেষ হয়নি। কনের সাথে থাকতে গিয়ে নিজের সাজ এমন আধখেঁচড়া হওয়ায় ভীষণ হতাশ সে। অথচ রিনি আপুর বিয়ে নিয়ে প্রায় মাসখানেক ধরে ও কত-শত প্ল্যান করেছে। ধূর, কোনো মানে হয়! শৈলী দেখেছে যখনই কিছু নিয়ে পরিকল্পনা করে সেটা ভেস্তে যায়-ই যায়।
শাড়ির আঁচল কোনোমতে সেফটিপিন আটকে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো। পেছন থেকে বড় চাচি চেঁচিয়ে বলছেন,
“আরে, শাড়ি পরে এভাবে দৌড়ালে পড়ে যাবি তো!”
কে শোনে কার কথা, শৈলীর এখন বরের গেট ধরতে হবে। এই প্ল্যান কিছুতেই ভেস্তে দেয়া যাবে না। সে যতক্ষণ বাড়ির সদর দরজার কাছে এলো, ততক্ষণে ওর পাঁজী কাজিনগুলো সব দল বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ে দর কষাকষি করছে। পাশে দাঁড়ানো শাওনকে বলল,
“আমাকে ছাড়া শুরু করেছিস কেন?”
শাওন মুখ ভেঙচে বলল, “তো কী করব? মহারানী কখন সেজেগুজে পায়ের ধূলো দেবেন, ততক্ষণে বর কবুল বলে রিনি আপুকে নিয়ে চলে যাবে।”
সেটা অবশ্য ঠিক। তবে এখন থেকে আর কিছু মিস করতে চায় না শৈলী। ওর বয়স উনিশ বছর, সামনের এপ্রিলে বিশে পড়বে। শাওন ওর সমবয়সী, বড়চাচার ছোট ছেলে, রিনি আপুর ভাই।
ধুন্ধুমার চাপাবাজী শেষে কাঙ্ক্ষিত অর্থের কাছাকাছি আসতেই এই দলটা সদয় হলো। বর মানে শাফিন ভাইয়াকে নির্ধারিত জায়গায় বসানো হলো।
রিনি আপু আর শাফিন ভাইয়া ইউনিভার্সিটি ফ্রেন্ড ছিল, একসময় নাকি তাদের মনে হয়েছে, সেই বন্ধুত্ব সারাজীবন ধরে রাখলে মন্দ হয় না। দুই বাসা থেকেই মেনে নেয়া হলো। অতঃপর বিয়ের আয়োজন।
বরকে ঘিরে হুল্লোড় চলছে, শাফিন ভাইয়ার বন্ধু আর কাজিনরা নানারকম দুষ্টুমি করছে, শৈলীরা তার কাউন্টার দিচ্ছে।
এরমধ্যে হঠাৎ ওর নজর পড়ল একজনের উপরে। এত সব হৈ হুল্লোড়ের ভীড়েও সে যেন এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ। উৎসবের মহাসমারোহেও অদ্ভুতভাবে ভীষণ একা। শৈলীর একটা উপমা মাথায় এলো ছেলেটার জন্য,
‘জনারণ্যে একলা যুবক।’
কিছুক্ষণ পরে দেখল, লোকটা উঠে সেখান থেকে চলে গেল। শৈলীর ভীষণ কৌতূহল হলো! তাই সে-ও পিছু নিল। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বাড়ির পেছন দিকটায় চলে গেল লোকটা।
শৈলীর মনে হলো, নির্জনতার খোঁজে এখানে এসেছে লোকটা। এমন কেন? এতই যদি নিরিবিলি থাকার ইচ্ছে, তবে বিয়েতে আসা কেন বাপু! হাতে মুঠোফোন তুলে নিতেই বুঝল, নির্ঘাৎ গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে এসেছে।
এসব সাত-পাঁচ ভাবছিল, ভাবতে ভাবতেই অবচেতনেই বলে বসল,
“একটা দিনের জন্য গার্লফ্রেন্ডকে ছুটি দিতে পারছেন না জীবন থেকে?”
“স্যরি?”
তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে শৈলীর দিকে তাকাল ছেলেটা, গলায় কিঞ্চিৎ ক্ষোভের আভাস। সে খানিকটা ভড়কে গেলেও দ্রুত সামলে নিল। ওকে ভড়কে দেয়া এত সোজা না৷
“শুনতে পাননি?”
“দেখুন, আমি যাই করি, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। আপনি অযথা নাক গলাচ্ছেন কেন?”
শৈলীর মুখ ম্লান হলো সহসা, সত্যিই তো, অনধিকার চর্চা কেন করল সে। ভীষণ ভুল হয়ে গেছে।
“স্যরি। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আপনি খুব ডিস্টার্বড। সেজন্য ফলো করে এখানে চলে এসেছি। আপনার বোধহয় প্রাইভেসি দরকার। আসি।”
বলেই ঘুরে দাঁড়াল, এক পা বাড়াতেই শুনতে পেল,
“স্যরি। আমি ওভাররিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। আমি সত্যিই খানিকটা ডিস্টার্বড। আমার মাকে আমিই দেখি আসলে। উনি দুই বছর ধরে প্যারালাইজড। শাফিন আমার মেজো খালামনির ছেলে। বেস্ট ফ্রেন্ডও। ওই ধরে বেঁধে নিয়ে এলো। মা-ও জোর করল। তাই আজ সকালেই এলাম। রাতে ফিরতে পারব কি-না নিশ্চিত না। তাই টেনশন হচ্ছে।”
কাউকে সহানুভূতি কী করে জানাতে হয়, শৈলী জানে না। তবুও বলতে চেষ্টা করল,
“স্যরি, স্যরি, স্যরি। আমি একদম বুঝতে পারিনি। আন্টির সাথে যারা আছেন, তারা নিশ্চয়ই খেয়াল রাখবেন। আপনি চিন্তা করবেন না।”
“আমি ছাড়া মায়ের আর কেউ নেই। দেখাশোনার জন্য মানুষ আছে। কিন্তু তারা পুরো একটা রাত কতটা দেখতে পারবে সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান। আসলে মা অসুস্থ হবার পরে আমি কখনো রাতে বাইরে থাকিনি। দিনে অফিসের জন্য বেরুতে হয়, রাতে আমিই থাকি।”
শৈলী কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “আমি শৈলী। রিনি আপুর কাজিন।”
“আমি মিফতা।”
“এই বাড়িতে আপনার কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন। আমি এখানেই আছি।”
বিষণ্ণ হেসে মিফতা বলল, “ঠিক আছে শৈলী।”
কারো হাসিতে যে এতটা বিষন্নতা মিশে থাকে আজকের আগে কোনোদিন দেখেনি শৈলী। ওর মায়া হলো সদ্য পরিচিত মা অন্তঃপ্রাণ মিফতার জন্য, প্রগাঢ় মায়া।
***
মিফতা সেদিন রাতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঘর-অফিস-ঘর এই গণ্ডিতে ওর জীবনটা বাঁধা পড়ে গেছে। ফিরে আসার মাসখানেক পড়ে ওর মা মারা গেলেন।
মিফতার একান্ত নিজের বলতে আর কেউ রইল না এই বিশাল পৃথিবীতে। অনেক আত্মীয়স্বজনের সাথে শাফিন আর রিনিও এসেছিল। ওর মা জীবিত থাকতে কেবল মেজো খালামনির সাথেই হৃদ্যতা ছিল মায়ের। আর কারোর সাথে না।
মা তার পছন্দের মানুষকে পরিবারের অমতে বিয়ে করায় রীতিমতো ব্রাত্য ছিলেন নিজের পরিবারে। সংসারটাও অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলেন, বিয়ের ছয় বছরের মাথায় তিনি একটা এক্সিডেন্টে সমস্ত জাগতিক মায়া কাটিয়ে চলে যান।
সেই থেকে সন্তানকে নিয়ে তার একলা পথ চলা। তার চলে যাওয়ার পরে সেই পথ চলা আজ সাঙ্গ হলো।
মিফতা এই শূন্যতায় কিছুতেই অভ্যস্ত হতে পারছিল না। আরও একমাস পরে শাফিন আর মেজো খালামনি রীতিমতো জোর করে ওকে নিয়ে গেলেন। কিছুদিন অন্তত থাকুক মানুষজনের মাঝে। হয়তো কিছুটা সামলে উঠতে পারবে।
***
শৈলী রিনির কাছে মিফতার মাতৃ বিয়োগের খবর শুনেছে। ওর ভীষণ খারাপ লেগেছে। বিয়েতে আর কথা হয়নি ওদের।
খবরটা শুনেই ওর চোখে মিফতার সেদিনের চিন্তাগ্রস্ত বিষাদী মুখটা ভেসে উঠেছে। মা ছাড়া যার কেউ নেই, সে কেমন আছে এখন!
শৈলী তো মা’কে ছাড়া কল্পনাও করতে পারে না! মাকে নিয়ে এমন ভাবনা মাথায় আসরেই বুকটা হুহু করে উঠল।
এরপর জীবনের স্রোতে ভেসে গেল শৈলী। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে সে। ছুটিতে এসে রিনির শ্বশুরবাড়ি গেল সে, রিনি আপুর সাথে দেখা করতে।
সদর দরজায় একজন স্বল্প পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়ে গেল ওর। তাকে এখানে দেখবে সেটা একদমই আশা করেনি শৈলী।
প্রথম দেখার পরিপাটি ধোপদুরস্ত পোশাকের বিষণ্ণ মিফতার সাথে আজকের উস্কোখুস্কো মিফতাকে মেলানোই দুস্কর। সেদিনের সেই গভীর চোখ দুটোর নিচে কালি জমেছে। সেদিনের সেই দ্যুতিও অনুপস্থিত। ভীষণ ম্লান মুখটা যেন মানুষটার একাকীত্বের সাক্ষ্য বহন করছে।
সহসা শৈলীর মনে হলো, এই নিঃসঙ্গ ছেলেটার হাত ধরতে, সারা জীবনের জন্য। নিঃসঙ্গ দ্বীপের পাশে কলকল ঝর্ণার মতো প্রবাহিত হয়ে তার সমস্ত বিষাদ ভাসিয়ে নিয়ে যেতে, বহুদূরে।
পরক্ষণেই লাগাম টানল নিজের। যদি মিফতা অন্য কারো হাত ধরতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে কিংবা বয়সের দোহাই দিয়ে ওকে প্রত্যাখ্যান করে! সে প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবে না।
“কেমন আছ শৈলী?”
এমনভাবে বলল যেন কতদিনের চেনা কেউ। স্পষ্ট ওর নাম উচ্চারণ করল। একবারের দেখায় এতদিন পরে এত আন্তরিকতা মিশিয়ে নাম ধরে কে ডাকে! কী যেন একটা ছলাৎ করে উঠল বুকে।
“আমার নাম মনে আছে আপনার?”
“আমি কারো সাথে একবার কথা বললে তার নাম সহজে ভুলি না।”
ভেতরে যে আশা জোয়ার তুলতে যাচ্ছিল, তাতে সহসা ভাটার টান পড়ল। বিশেষ কেউ হিসেবে মনে রাখেনি তবে! সবাইকেই সে মনে রাখে, শৈলী বিশেষ কেউ নয়। এই ভাবনায় এত কষ্ট হচ্ছে কেন!
সদ্য জন্মানো অনুভূতি এতটা পোড়ায়! সে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেল। এই ছেলেটার সামনে সে আর এক মুহূর্ত থাকতে চায় না।
……..
চলবে।