নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-০৩

0
30

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ০৩
#জান্নাতুল_বিথী

ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা বাজে তুহার। বলা যায় সে ইচ্ছে করেই দেরি করে ফিরেছে৷ তুহা ড্রয়িংরুম পার হয়ে উপরে যাওয়ার সময় কিছু শব্দ ভেসে আসে তার কানে৷ তৎক্ষণাৎ সে থেমে যায়। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে শৈবালের ছোট বোন প্রিয় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ফিরতে দেখে ভ্রু কুচকে পুনরায় একই কথা আওড়ায়,

“তোমার আসতে এতো দেরি হলো কেনো? মম তোমার জন্য টেনশন করছে। ভাইয়াও বাড়িতে আছে। তুমি এখনো বাহিরে শুনে রেগে গিয়েছে৷”

শৈবালের কথা উঠতেই চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে তুহা। কঠিন স্বরে শুধায়,

“তোমার ভাইয়ার রাগকে আমি কেয়ার করি না। চুলোয় যাক তার রাগ।”

কথাটা বলে এক মিনিটও সেখানে দাড়ায় না সে। হনহন করে নিজ কামরায় চলে যায়। শৈবাল বাড়িতে মানে এখন রুমেই আছে হয়তো। তুহা নিজেকে যথেষ্ট শক্ত করার চেষ্টা করে। শৈবালের সামনে কান্না কাঁটি করলে সে তাকে আরো বেশি দুর্বল ভাবতে পারে। এতো সহজে সে সব কিছু মেনে নিবেনা। শৈবালের টর্চার তো আরো আগে না। তুহা রুমে ঢুকতেই শৈবালের ঝাঁঝালো কণ্ঠ কানে আসে,

“পৃথিবীর কোন মেয়েটাকে দেখেছো বিয়ের পরের দিন ঢ্যাং ঢ্যাং করে ভার্সিটি গিয়ে উঠতে?”

তুহা নির্বিকার চিত্তে উত্তর দেয়,

“আমাকে দিয়ে দেখে নিন। আমিই হয়তো সেই মেয়েটা৷”

তুহার উত্তরে আরো বেশি রেগে যায় শৈবাল। উঠে তার দিকে তেড়ে আসতে নিলে দুই পা পিছিয়ে যায় তুহা। রাগত স্বরে বলে,

“খবরদার আমার কাছে আসবেন না। যদি ভেবে থাকেন আমাকে বিয়ে করে আপনি আমার স্বাধীনতা কিনে নিয়েছেন তাহলে ভুল ভাবছেন। আমি পড়াশোনা করবো এবং আমার মতো করে চলবো। সেখানে আপনি কিছু বলার কেউ না।”

তুহার কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে উঠে শৈবাল। তুহা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালে শৈবাল এগিয়ে আসে তুহার দিকে। তুহার কোমড়ে হাত রেখে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ফু দিয়ে কপালের বেবি হেয়ার গুলো সরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে আওড়ায়,

“আমি তোমার কেউনা কথাটা কিভাবে বলতে পারলে জান? আমি তোমার হাজবেন্ড এবং বিয়ের পর মেয়েরা হাজবেন্ডের কথা শুনেই চলে।”

তুহা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে শৈবাল আরো শক্ত করে চেপে ধরে তাকে৷ সে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে সব রাগ কথার মাঝে ঝেড়ে দিয়ে বলে,

“আর হাজবেন্ড যদি জালিম টাইপের হয় তাহলে কি করা উচিত?”

তুহার কথায় আবার হাসে শৈবাল। তার সুন্দর হাসি টাকেও এখন সবচাইতে কুৎসিত লাগছে তার নিকট। মুখ ফিরিয়ে নেয় তুহা। শৈবাল তুহার উ*ন্মুক্ত উদরে দুই আঙুল দিয়ে স্লা*ইড করতে করতে বলে,

“হাজবেন্ডকে এসব কথা বলতে নেই জান। সে তো তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে না। তোমাকে পড়ালেখা ছেড়ে দিতেও বলছে না। জাস্ট বলেছে দুইদিন পর ভার্সিটি যাও।”

শৈবালের প্রতিটা স্পর্শে শিউরে ওঠে তুহা৷ নিজেকে ধরে রাখতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার। শরীর ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। তারপরো শক্ত কন্ঠে বলে,

“আপনার সব কথা মানতে বাধ্য নই আমি। বিয়ে তো আপনিও করেছেন৷ আপনি যেহেতু বিয়ের পরের দিন নিজ পেশার তাগিদে বের হতে পেরেছেন সেহেতু আমিও আমার পড়ালেখার জন্য ভার্সিটি যেতে পারবো। আফটার অল দুজনেই তো বিয়ে করেছি।”

তুহার যুক্তিতে শৈবালের হাত কিছুটা শিথিল হয়। কিন্তু তার জেদ বজায় রাখতে আওড়ায়,

“আমি যা বলবো তাই করবে তুমি। আগামী দুইদিন তুমি কোথাও যাচ্ছো না।”

তুহাও নিজের জেদে অটল থেকে বলে,

“আমি যাবোই যাবো। আপনি কি করবেন দেখবো।”

শৈবাল কিছু না বলে তুহার ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দেয়। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে তুহা৷ শৈবালের দিকে রাগী লুকে তাকাতেই সে পৈচাশিক হেসে আওড়ায়,

“আমি আরো কি কি করতে পারি সেটার প্রমাণ তো গতকাল রাতে পাওয়ার কথা৷ আর যেটুকু বাকী তা নাহয় তুলেই রাখলাম।”

“পারেনই তো শুধু কাপুরুষদের মতো নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে। এছাড়া আপনার দ্বারা কোনো কাজ সম্ভব বলে আমার মনে হয় না!”

তুহার কথা বেশ গায়ে লাগে শৈবালের। রাগে কপালের রগ ফুলে উঠে। তুহাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়৷ যাওয়ার সময় শব্দ করে দরজা লাগিয়ে নিজের রাগ সম্পর্কে তুহাকে অবগত করতে চায়৷ পুরো সময়টাতেই তুহা ছিলো নির্বিকার। শৈবালের সাথে এই ধরনের ব্যবহার করতে তার নিজেরও খারাপ লাগে। কিন্তু তার অহঙ্কারী সত্তার কথা মনে পড়লেই সব রাগ কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায়৷ শৈবালের সাথে সে কখনো সংসার করতে পারবে কি না জানা নেই৷ কিন্তু সে চেষ্টা করবে। তার আগে শৈবালের অহঙ্কার কে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে আছে।
.
শান্ত একমনে বাহিরে তাকিয়ে আছি, তার দৃষ্টি শূন্যে। বাহিরে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে ছেলেটা। তার অবস্থা দেখে ভয় পায় রাতুল আর হিমেল। দুজনেই তাকে হাজারবার থামানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু সফল কেউই হয় না। শান্তর মনে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা এসবের ধারে কাছেও নেই৷ এক সময় শান্তই নিরবতার জাল ছিন্ন করে আওড়ায়,

“আমি কি তাকে কম ভালোবেসেছিলাম? তাহলে পাইনি কেন তাকে? সেই প্রথম দিন থেকে আমি তাকে ভালোবাসি। না সে আমার ভালোবাসা বুঝেছে না আমি তাকে পেয়েছি৷ কেনো এমনটা হলো? কেনো? আমার সারাজীবনের বিনিময়ে হলেও আমি তুহাকে চাই। আমার তুহাকে এনে দে প্লিজ। তুহা ভালো নেই৷ আমার তুহার আমাকে প্রয়োজন। এনে দে না তাকে প্লিজ। আমি তোদের পায়ে ধরি।”

বলতে বলতে চিৎকার করে কেঁদে উঠে শান্ত। শান্তর কান্না দেখে বুক ফেটে যায় রাতুল আর হিমেলের। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলেটা যখন যেটা ছেয়েছে সেটাই তার বাবা তাকে এনে দিয়েছে। আজ তাদের আদরের ছেলে নিজের ভালোবাসা হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। অথচ তার ভালোবাসাকে এনে দেওয়ার শক্তি তাদের কারো নেই। হিমেল শান্তর পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

“ব্রো শান্ত হ প্লিজ। তুই কান্নাকাটি করলে তুহা তোর হয়ে যাবেনা! নিজেকে কেনো কষ্ট দিচ্ছিস?”

হিমেলের কথা মানতে নারাজ শান্ত। দুইপাশে ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলে উঠে,

“না না আমি এতো সহজেে সব কিছু মেনে নিবো না। আমার তুহাকে আমি আমার করবোই। তুহা কেবল আমার। আমার সখের নারীকে কোনো অপরিচিত ছেলেকে নিতে দিবো না।”

শান্তর পাগলামী দেখে ফোস করে নিশ্বাস ফেলে রাতুল৷ শান্তকে বুঝানোর মতো করে বলে,

“আমাদের মাঝে সবচাইতে বুদ্ধিমান ছেলেটা তুই শান্ত। মনকে প্রাধান্য না দিয়ে একটু মাথা খাটিয়ে ভেবে দেখ তোর এসব পাগলামীর কথা শুনলে তুহা কি করবে। এমন তো নয় যে তোদের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিলো৷ তোকে এটা মেনে নিতে হবে পুরোটাই তোর এক তরফা ছিলো। তুই কখনো তুহাকে ভালোবাসার কথা বলিস নি৷ এখন সে বিবাহিত, অন্য কারো বউ। এই নির্মম সত্যি টা তোকে মেনে নিতে হবে৷”

রাতুলের কথা শুনে উদাস চোখর বাহিরে তাকায় শান্ত। মিনিট পাঁচেক চুপ থেকে ওদের দুইজনের উদ্দেশ্যে বলে,

“তোরা চলে যা আমি ঠিকাছি। আমাকে একটু একা থাকতে দে আমি ঠিক সামলে নিবো নিজেকে।”

রাতুল আর হিমেল একে অপরের দিকে তাকিয়ে উঠে বেলকনি থেকে অন্য একটা রুমে চলে যায়। কেউই নিজের বাসায় যাবেনা আজ। শান্তকে বিশ্বাস নাই কখন কি করে বসে৷ ওরা দুইজনে যেতেই শান্ত বিরবির করে বলে,

“তবে কি আমি সত্যি তুহাকে হারিয়ে ফেলেছি? আমার সখের নারী। আমার তুহা, আমার ভালোবাসা!”

বলতে বলতে আবারো কেঁদে ফেলে শান্ত। নিজেকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছে না। তার সখের নারী অন্য কারো বুকে দিব্যি ঘুমায়। নিজের বিবেক জিনিসটা মেনে নিলেও বেহায়া মনকে মানাতে পারছে না৷ কে বলেছে পুরুষ মানুষ কাঁদতে জানে না? পুরুষেরা কাঁদে, নিজের ভালোবাসা হারিয়ে কাঁদে। নিজ আপন সত্তা হারিয়ে কাঁদে তারা। কাউকে নিজের ব্যাথা বলতে পারেনা। এ ব্যাথা যে কোনো ঔষধেই সারে না। এতোটা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে যখন তাকে পায়নি তাহলে কি সেই মেয়েটাকে তার থেকেও বেশি কেউ ছেয়ে নিয়েছে? না চাইতেও পেয়ে যাওয়া তার সখের নারীর কদর করতে পারবে তো ওই ডাক্তার সাহেব? এসব ভেবেই নির্ঘুম রাত্রি কাঁটে শান্তর। ফজরের আজান যখন দেয় তখনো তার চোখে পানি টলমল করে। সারা রাত ছেলেটা কেঁদেছে।

চলবে,,,,,,,,