#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ০৬
#জান্নাতুল_বিথী
জিহাদদের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল সাতটা বাজে৷ রাস্তায় জ্যাম আর গ্রামের রাস্তা হওয়াতে তাদের জায়গা চিনতে অসুবিধা হয়। শৈবাল গাড়ি থেকে নেমে দাড়াতেই জিহাদের ক্লান্ত মুখশ্রী নজরে আসে। ছেলে টা বিয়ে বাড়িতে সকল কাজ নিয়ে বিজি, এখন আবার বন্ধুদের রিসিভ করতে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। শৈবাল বন্ধুর দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। তুহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কাণ্ড দেখছে। দু’জনে কথা বলায় ব্যস্ত। হঠাৎ জিহাদ তুহার দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“আসসালামুআলাইকুম ভাবি। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছি ভাইয়া!”
টুকটাক কথা হয় তাঁদের মাঝে। কথা বলতে বলতে তারা ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। একটা পাকা দোতলা বাড়ি। দেখে মনে হয় পুরোনো দিনের করা বাড়ি। তুহা চারদিকে তাকায়। এটাই প্রথম সে সরাসরি গ্রাম দেখছে। আসেপাশে যেনো সতেজতায় মোড়ানো সব কিছু। বাড়িতে ঢুকে দেখে সব দিকে মানুষ গিজগিজ করছে। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা তাদের দিকে এগিয়ে আসলে শৈবাল তাকে সালাম দিয়ে সুন্দর করে কথা বলে। কথায় এতোটুকু বুঝা যায় উনি জিহাদের মা৷
শৈবালের ভদ্র সভ্য আচরণ দেখে মুখ বাঁকায় তুহা। দেখে যেনো মনে হয় ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেনা। তাদের কথা বলার মাঝে ভদ্র মহিলার নজর তার দিকে পড়লে তিনি আওড়ায়,
“মাশাল্লাহ্ এই পরীটা কে শৈবাল?”
তুহা খুব করে বলতে চায় ছেলেটা তার কাজিন হয়। কিন্তু তার আগেই শৈবাল তড়িঘড়ি করে উত্তর দেয়,
“আমার বউ, তুহা শাহরিয়ার!”
তুহা এক পলক রাগি চোখে তাকায়। ছেলেটাকে পইপই করে বলে দিয়েছে যেনো বউয়ের পরিচয় না দেয়৷ সেখানে সে সবার আগে এটাই বলেছে। তুহা জিহাদের মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে রুমে চলে যায়৷ শৈবাল অনেক আগেই রুমে গিয়েছে। সে গিয়ে দেখে শৈবাল ফ্রেশ হয়েছে মাত্র। রেগে মেগে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“আপনাকে আমি বলে দিয়েছি না আমাকে বউয়ের পরিচয় দিবেন না? তারপরো আপনি সেই একই কাজ কেন করলেন?”
শৈবাল নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেয়,
“আমার জীবন চলবে আমার রুলসে। তুমি সেখানে কথা বলার কে?”
খুব করে হাসে তুহা। একটু আগেই বউ পরিচয় দিয়ে এখন আবার বলছে তুমি কথা বলার কে? ব্যাপারটা হাস্যকর। চোখ ঝাপটে তাকিয়ে থাকে শৈবাল তুহার দিকে৷ মেয়েটার হাসি সুন্দর। কিন্তু তার সামনে খুব একটা হাসে না। শৈবাল এগিয়ে গিয়ে এক হাতে তুহার গালে স্পর্শ করে কিছু বলতে নিলে তুহা পুনরায় বলে,
“সব কিছু ভুলে গিয়ে চলো আমরা দু’জনে সুখের সংসার করি। আগের সব ভুলে যাও না তুহা৷ এরকম কিছুই বলবেন?”
“বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই এসব বলার। আশা করো নাকি এসব কথা?”
“ছেলে মানুষ তো, তাদের দ্বারা সবই সম্ভব!”
শৈবাল তুহার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“শৈবাল শাহরিয়ার মেয়েদের মনে প্রাণে ঘৃণা করে মিসেস।”
“সেকথা আমাকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলার কি দরকার?”
“মানুষটা তুমি তাই বলতে হয়। ভুল করে যদি পড়ে যাও৷”
“কোথায় পড়বো?”
“শৈবাল শাহরিয়ারের প্রেমে!”
শৈবালের কথায় ফিক করে হেসে ফেলে তুহা। দারুণ মজা পেয়েছে সে। মুচকি হাসি ঠোঁটে রেখে শক্ত কণ্ঠে বলে,
“আপনার মতো অমানুষের প্রেমে কোনো সুস্থ মানুষ পড়বে না।”
“তো আমি কখন বলেছি তুমি ভালো?”
রাগে শৈবালের সামনের চুল গুলো খামছে ধরে তুহা। ব্যাথা পেয়েও শব্দ করেনা শৈবাল। মেয়েটা বেশ জব্দ হয়েছে। এমনিও হয়তো মেয়েটা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তার আগে নাহয় ভালো করে জব্দ করা যাক। ভেবেই আবারো হাসে সে। তুহার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায় রুমের বাহিরে।
.
শৈবালদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত। অনেক কষ্টে ঠিকানা মেনেজ করতে হয়েছে। টলমলে চোখে একবার বাড়ির দিকে তাকায়। মেয়েটাকে না জানিয়ে চলে এসেছে এক নজর দেখার জন্য। দেখা দিবে মেয়েটা? এক পা এগিয়ে যায় তো দশ পা পিছিয়ে যায়।
শান্তকে অনেকক্ষণ যাবত এখানে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দারোয়ান এগিয়ে আসে। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
“কারে খোজেন আপনে? এইহানে খাড়াইয়া আছেন ক্যান?”
একটা ঢোক গিলে শান্ত আওড়ায়,
“তুহা আছে বাড়িতে? আমি আসলে তার বন্ধু। তার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“ওও আমগো বউমনি? হে তো বেড়াইবার লাইগা গেছে আমগো ভাইজানের লগে।”
কথাটা শুনে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে শান্তর। এতো দ্রুত তুহা সব কিছু মেনে নিয়ে সংসারে মন দিয়েছে? তার সাথে এখন ঘুরতে যায়? এতো প্রেম কখন হলো? যার জন্য সে কষ্ট পায় সে তো দিব্যি আছে।
.
এক দল বন্ধুদের ভীড়ে বসে আছে শৈবাল। সবাই স্বার্থের পাগল। এখানের সবাই তার বন্ধু মহলের হলেও কারো সাথেই খুব বেশি মিশেনা শৈবাল। যখন সমুদ্রের এক্সিডেন্টের পরেও কেউ এগিয়ে আসেনি তখনই সে সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। তার প্রাণ প্রিয় বন্ধু মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছিলো তখন কেউ এগিয়ে আসেনি। জিহাদ আর সে না থাকলে এতোদিনে সমুদ্রের লা**শ পঁচে গলে যেতো। সব ভেবে ভেতরটা তিক্ততায় ভরে যায় তার। তাদের মধ্যে নিরবতা ভেঙে ফাহিম শুধালো,
“শৈবাল, সমুদ্র এখন কেমন আছে? পাপিয়াকে খুঁজে পেয়েছিস?”
চোখ মুখ শক্ত করে নেয় শৈবাল। সমুদ্র কে নিয়ে উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে নাই তার। সবাই তার অমানুষিক ভাব দেখে। অথচ তার সামনে কতোগুলো মানুষ রুপি পশু বসে আছে তাদের দিকে কারো খেয়াল নেই,
“সমুদ্র ম*রে গেছে৷ তাকে নিয়ে তোদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না!”
সেখানে উপস্থিত সবার মুখ ছোট হয়ে আসে। জিহাদ ঠোঁট কামড়ে হাসে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে টপিক চেঞ্জ করতে। শৈবাল চুপচাপ মোবাইলে মনোনিবেশ করে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে আরেকজন বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার রে শৈবাল? এমনিতেই তো চুপচাপ ছিলি। বিয়ে করার পর আরো চুপচাপ। তোর সুন্দরী হ*ট বউ দেখে মুখে খৈ ফোঁটার কথা!”
রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে শৈবালের। তুহাকে নিয়ে খারাপ কথা মেনে নিতে পারছে না। তার উপর এরা খুব স্বা*র্থপর। এদের কাছে কাউকে নিয়েই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় সে।
“তুহা আমার বউ হয়, তাকে নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য আমি শুনতে চাই না। আমার বউ কেমন আমি জানি। কারো থেকে জানতে চাইনি!”
পর পর শৈবালের থেকে দুইটা শক্ত কথা শুনে ওদের মুখ চুপসে যায়। শৈবাল সেখান থেকে উঠে চলে যায়। জিহাদ হাসতে হাসতে বলে,
“আগেই বলেছিলাম ওকে বেশি ঘাঁটাবি না। তারপরো একই কাজ করছিস তোরা। এখন মজা বুঝ!”
.
জিহাদের কাজিনরা সবাই মেহেদি দিতে ব্যস্ত। ছেলে পক্ষে বিয়ে হলেও কনে পক্ষের বাড়ির মতো মেহেদি মেওয়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে সবার মাঝে। এই সব কিছুর মাঝে তুহা চুপচাপ বসে আছে। কাউকে চিনেনা, কারো সাথে কথা বলেনা। একা নিজেকে অন্য গ্রহের মানুষ মনে হচ্ছে।
এর মাঝেই হুট করে কোত্থেকে শৈবাল এসে তার পাশে বসে পড়ে। তার হাতে একটা মেহেদি উঁকি দিচ্ছে। তুহা তার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকাতেই শৈবাল একগাল হেসে তুহার বাম হাতটা এগিয়ে নেয়। তুহা হাত ছাড়াতে চাইলে রাগি লুকে তার দিকে তাকায়। আর কিছু বলেনা তুহা। নিরবে তার কার্য দেখে যায়। শৈবাল তার হাতে গুটিগুটি অক্ষরে লিখে দিয়েছে ‘শৈবালের বউ’।
শৈবালের কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে যায় তুহা। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। ছেলেটাকে নিষেধ করার পর থেকে যেনো আরো উঠে পড়ে লেগেছে তার পরিচয় দেওয়াতে। শৈবাল বিশ্ব জয় করার মতো হেসে বলে,
“আশা করছি এরপর থেকে আমার বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার আগে একবার ভাববে। তুমি আমাকে যা করতে বলবে আমি তা কখনো করবো না জান!”
চলবে,,,,,,,,,