নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-১৪

0
35

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ ১৪
#জান্নাতুল_বিথী

বিকেল বেলা, পাখিরা সব আপন নীড়ের খোঁজে উড়ে বেড়ায়। নীল আকাশের ভুবনে তারা হারিয়ে যায়। আবার ফিরে এসে দল বেঁধে ছুটে বেড়ায়। তুহা শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সবাই সবার আপন নীড়ের ফিরে যায়। অথচ পথ হারা রমণী নীড়ের খোঁজে হাতরে বেড়ায়। মনের পুরুষের জন্য মন পুড়ে। কিন্তু ইগোকে সাইডে রেখে তাঁর সাথে কথা বলতে পারে না।

তুহার ভাবনার মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় দিশারা৷ তুহাকে বেশ সন্দেহ হয় তার। মেয়েটা বলেছে শৈবালের সাথে নাকি তাঁর সব কিছু ঠিক আছে। অথচ আজ পর্যন্ত একদিনও ছেলেটার সাথে কথা বলতে দেখেনি। শুধু দেখেছে নিরবে কাঁদতে। তুহা মা হচ্ছে, এখন শৈবালের সাথে আরো বেশি যোগাযোগ করা উচিত। প্রথম সন্তান নিয়ে তাঁদের আবেগ, অনুভূতি শেয়ার করা উচিত। অথচ তাঁর চোখে কিছুই পড়ে না। দিশারা এগিয়ে গিয়ে শব্দ করে তুহার পাশে বসে। মেয়েটা শব্দের উৎসে চমকে উঠে তাকায়। দিশারাকে দেখে মলিন হাসে। দিশারা কিছু না বলে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

“কি হয়েছে তোর তুহা? আমার থেকে কি লুকাস তুই?”

তুহার যেনো এসব প্রশ্নে কিছু যায় আসে না। সে আরো বেশি ভাবশূণ্য ভাবে উত্তর দেয়,

“আমি তোর থেকে কি লুকাবো? এমন কিছু ঘটেনি যা তোর থেকে লুকাবো।”

“তুই ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করিস না কেনো?”

পিলে চমকে উঠে তুহা। এ কথাটা কারো জানার কথা না। দিশারা কিভাবে জানে? নাকি আপন ভাবনা থেকে বলেছে? তুহা নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে শুধায়,

“তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ হবে না কেনো? কথা হয় তো!”

“আমার বিশ্বাস হয় না, তুই আমার সামনে ভাইয়াকে ফোন করে কথা বল!”

“কেনো ভাই? তাছাড়া উনি এখন ব্যস্ত আছে!”

“তুই তাঁর বউ তুহা, হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও তোর ফোন তুলবে ভাইয়া!”

আনমনা হয় তুহা, শৈবালের জীবনে তাঁর তো কোনো মূল্যই নাই। সে শুধুমাত্র তাঁর লাইফের একটা দায়িত্ব। দায়িত্বে অবহেলা হয়তো উনি করেন না। বিচলিত হয়ে বলল,

“যার লাইফে তুহা নামক রমণীর কোনো মূল্য নেই তাঁর সাথে আমি কি কথা বলবো বলতে পারবি?”

অন্ধকারে ঢিল ছুড়েছে দিশারা, আর নিশানাও সঠিক হয়েছে। সে কিছুটা নড়েচড়ে বসে বলে,

“কি হয়েছে আমাকে বল। নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস কেনো শুধু শুধু?”

“আমি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি না দিশা, তুই কি সেখানে থাকতে পারবি যেখানে তুই দিনের পর দিন অবহেলা পাবি?”

“কিন্তু সেই মানুষটা তোকে অবহেলা করেছে কেনো?”

“আমি কিভাবে জানবো? কথায কথায় বলবে তোমার আর অন্য মেয়েদের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। আমার থেকে বেটার অপশন পেলে তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তোকে যখন তোর হাজবেন্ড এধরণের কথা বলবে তখন তোর কাছে কেমন লাগবে বল!”

দিশারা কি বলবে ভেবে পায় না। নিজেকে অসহায মনে হয় নিজের কাছে। দু’জনে ছোট কালে এক সাথে বেড়ে উঠেছে। মূলত তুহা তাঁর জীবনের প্রথম বন্ধু। এভাবে ঘটা করে তাঁর দুঃখ শুনতে হবে কখনো ভাবেনি। দিশারা তুহার কাছে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। কাঁদে না তুহা। নিজেকে শক্ত রেখে দিশারাকে কিছু কথা বলে। সব শুনে দিশারা বলে,

“শোন তুহা, একটা মুদ্রার দুই পিঠ থাকে। এক পিঠ দেখে মানুষ জাজ করাটা ঠিক না। তুই হয়তো ভাইয়ার উপরের অংশটা দেখেছিস। কিন্তু তাঁর ভেতরে সুপ্ত কষ্ট টুকুর খোঁজ করেছিস তুই? সে কেনো তোর সাথে এভাবে কথা বলেছে, কেনো অন্য সব মেয়েদের সাথে তোকে তুলনা করে একবারো সেই দিক বিবেচনা করে দেখেছিস? শুধু দূরত্ব বাড়িয়ে সব কিছুর সমাধান হয না। কোনো কোনো সময় কাছে থেকে ভালোবেসে সমস্যা গুলোর সমাধান করতে হয়৷”
.
শৈবাল ছাদের সিঁড়িতে বসে আছে। উসকোখুসকো চুলে তাকে চেনা বড় দায়। তুহাকে ছাড়া দিন গুলো কিভাবে কাটায় সেটা যদি পাষণ্ড নারীকে দেখানো যেতো তাহলে কি সেই নারীর মন নরম হোতো? সেদিন তুহার বাবা বলেছিলো তুহা জাপানে আছে। সঠিক ঠিকানাও দিয়েছে শৈবালকে। সে সব কিছু গুছিয়ে সমুদ্রের কাছে গিয়েছে। ছেলেটার অবস্থা দেখে তাঁর সাথে কিছু সময় কাঁটায়। নিজের ব্যস্ত জীবনের জন্য সমুদ্র কে সে সময় দিতে পারেনা। অথচ ছেলেটার মেন্টাল সাপোর্ট খুব বেশি দরকার।

তুহা যে পড়ালেখা করতে গিয়েছে, কোথায় উঠেছে সেকথাও বলেছে নুরুল পাটোয়ারী। সেদিনের পর আজ দুই মাস ছয় দিন চলে। শৈবালের ফ্লাইট বিকেল বেলা। মনের রাণীকে ছাড়া সাত মাসের উপরে কাটিয়ে ফেলেছে শৈবাল। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। তুহার কাছে যাবে এই একটা খুশি ছাড়াও অন্য একটা ভয় জেঁকে ধরে তাকে। তাঁর তুহা চেঞ্জ হয়ে যায় নি তো? সে কি শৈবালকে মেনে নিবে? যদি তাকে অবহেলা করে তবে কি সে মেনে নিতে পারবে?

শৈবাল সবচাইতে বেশি ভয় পায় যেটাতে তা হলো তুহা যদি নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলে? কি করে বাঁচবে এই পাষণ্ড নারীকে ছাড়া? এসব চিন্তায় দুচোখে ঘুম নাই শৈবালের।
সাড়ে তিনটার দিকে শৈবাল সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়। ওই দেশে দিশারার সাথে যোগাযোগ হয়েছে তাঁর। সে হয়তো এয়ারপোর্টে আসবে শৈবালকে রিসিভ করতে। শৈবাল পইপই করে নিষেধ করে দিয়েছে তাঁর যাওয়ার সম্পর্কে যেনো তুহা কিছু না জানে। তাও বলেছে কি না জানা নেই শৈবালের।
.
তুহা ভারী পেট নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে তাঁর। বাসায় ফুপি বা দিশারা কেউ নেই। তুহা সাবধানে উঠে ফ্রিজের কাছে গিয়ে খাবার নেয়। ওভেনে গরম করে কেবল খেতে বসে। সেই সময় কলিং বেল বাজে। তুহা ভাবে হয়তো দিশারা বা ফুপি এসেছে। তাই ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। বেশ সময় লাগে তাঁর দোর পর্যন্ত পৌঁছাতে। কিন্তু অপর পাশের মানুষটা যে অধৈর্য। একের পর বেল বাজিয়েই যাচ্ছে। বেশ রাগ হয় তাঁর। দোর খুলে রাগত স্বরে কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই থমকে যায় সে। পায়ের নিচে মাটি যেনো সরে যায়। শেষ কোন দিন এতো অবাক হয়েছে তার জানা নেই। শৈবাল এখানে কি করছে এটা মাথায় ঢুকে না তাঁর। আশে পাশে কেউ নেই। শুধু শৈবাল দাঁড়িয়ে আছে।

তুহা আসে পাশে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে দোর বন্ধ করে দিতে গেলে শৈবাল তুহার হাত ধরে ফেলে। তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজে ভেতরে ঢুকে পড়ে। পর পর এতো গুলা কাজে হতভম্ব হয়ে যায় তুহা। কি করবে ভেবে পায় না। শৈবালের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। নাছোড়বান্দা শৈবাল ছাড়লে তো। সে তুহার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

“তুমি প্রেগনেন্ট তুহা?”

কিছু বলে না তুহা। নিজের চোখে যখন দেখতেই পায় তবে জিজ্ঞাসা করার কি দরকার? বরং সে কিছুটা রাগত্ব স্বরেই বললো,

“আপনি এখানে কি করেন? অপরিচিত কারো বাসায় অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করেন কিভাবে?”

শৈবাল কি বলবে ভেবে পায় না। তুহাকে সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গিয়েছে। নিজের হতভম্বতা ভাব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মাঝেই তুহার প্রশ্নের কবলে পড়েছে। এভাবে তাকে না চেনার ভান করে কেনো এই মেয়ে? শৈবালের বুকের ভেতরটা যে জ্বলে যায় সেদিকে নজর দিতে পারে না? নিজেকে সামলাতে পারে না শৈবাল। চোখ ছলছল করে উঠে টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পাষণ্ড নারীর গালে হাত গলিয়ে ভেজা গলায় আওড়ায়,

“এতোটা পাষাণ কেনো তুমি মিসেস? আমি বাবা হবো এই খুশির খবরটা পর্যন্ত তুমি আমাকে দিতে পারোনি। কিসের এতো রাগ তোমার? যা ভুল করেছি আমার হাজবেন্ড সত্তা করেছে। বাবা হিসেবে আমি কি ভুল করেছি? আমাকে কেনো বাবা হওয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করতে ছেয়েছো তুমি মিসেস?”

চলবে,,,,,,,,,,