#নীড়ের_খোজে♥
পর্বঃ১৮
#জান্নাতুল_বিথী
সেই ঘটনার তিনমাস পর,
এই তিন মাসে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে,বদলে যায় অনেক কিছু!তারপর থেকে আমি নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নেই,অনেকটা ডিপ্রেশনে চলে যাই!যার কারনে আমার পাবলিক ভার্সিটিতে নাম আসে নাই,আব্বু আমাকে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেয়!এতে আমি আরো হ’তাশ হয়ে পড়ি,আমার মতো অ’পয়া অ’ভাগাকে দিয়ে কিছু হবে না এমন একটা কথাই মাথায় ঢুকে যায়!সবাই আমাকে অনেক ভাবে সামলানোর চেষ্টা করলেও আমি আরো বেশি গুটিয়ে নেই নিজেকে।আমার অবস্থা দেখে শৈবাল ভীষন রে’গে যায় আমার উপর,তার কথা হচ্ছে,
‘হা’র জী’ত নিয়েই মানুষের জীবন তুমি যদি জী’বনে হে’রে যাওয়ার স্বাদ না পাও তাহলে জীবনের মূল্য তুমি বুঝবে না।পাবলিকে সান্স না পেলেই যে তোমার দ্বারা কিছু হবে না এমন কথা কোথাও লেখা নেই।তাছাড়া তোমার উপর দিয়ে যেসব ঝ’ড় যাচ্ছে তুমি তা সামলাতেই হিম’শীম খাচ্ছো সেখানো পড়ালেখা সামলানো আরো কঠিন,তাই বলে যে এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিবে এটা কেমন কথা?’
আমি তখন কোনো কথা না বলে চুপচাপ কথা গুলো শুনে যাই,এসব কোনো কথাই আমার উপর প্রভাব পড়ছে না!বিয়েতে যাওয়ার কারনেই আমার এ অবস্থা বলে মনে করছে সবাই,ইতোপূর্বে শৈবালের মাস্টার্স লাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হয়েছে!বড় আব্বু শৈবাল কে বলছে এখন থেকে হায়ার এ্যাডুকেশনের জন্য অ্যাবরোড যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।কিন্তু সে নাচক করে দিয়েছে তার কথা হচ্ছে আমি এখন থেকে বাবার ব্যবসা দেখবো কোথাও যেতে চাই না আমি!ইতোমধ্যে সে বড় আব্বুর অফিসে যাওয়াও শুরু করে দিয়েছে।
সন্ধ্যার পর হালকা নাস্তা করে এসে বারান্দায় বসে আছি উদাষ মুখে,হালকা ঠোঁট কামড়ে ভাবছি শৈবালের সাথে সব কিছু ঠিক করে নিবো।মানুষ টার সাথে এই কয়েক মাসে অদৃশ্য একটা দেয়ালের মতো সৃষ্টি হয়েছে,একাকী থাকতেই ভালো লাগছে।তাই তার সাথেও তেমন কথা হয়না
‘তুহা রুমে আসো!’
শৈবালের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে আমার একটা দী’র্ঘশ্বাস ফেলে রুমে আসি,ডিভানে হেলান দিয়ে বসে আছে সে।তার ক্লান্ত মুখখানা দেখে আমার অনেক মায়া লাগে প্রচুর,তার পাশে গিয়ে চুলের ভাজে হাত ঢুকিয়ে হালকা টেনে দিতে দিতে বললাম,
‘কি হয়েছে খুব ক্লান্ত লাগছে?’
শৈবাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়,সে হয়তো আমার এতো স্বা’ভাবিক ব্যবহার হ’জ’ম করতে পারছে।না পারাটাই স্বাভাবিক যার সাথে এতোদিন যো’জন যো’জন দূরত্ব গুলো যে শেষ করলাম তাতেই অ’বাক হয়তো সে।আমার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে বললো,
‘জানো তুহা আমার জীবনে একটা প’রী আছে যে ম্যাজিকের মতো আমার জীবনের ক্লান্তি,সকল সমস্যা সমাধার করে দেয়!’
আমি তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি,অতঃপর তার কথার মর্মার্থ বুজতেই চোখ বুজে ফেলি আমি।তার ছোট্ট ছোট্ট কথা গুলো মনে অদ্ভুত শিহরন জ্বা’গিয়ে তোলে,আমি নীচের ঠোঁট কামড়ে রেখে বললাম,
‘আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি আপনার জন্য কফি নিয়ে আসছি।’
কথাটা বলে তার উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে আসি বাহিরে।
.
একটা মেরুন রঙের শাড়ি পরে হালকা একটু সেজে হাতে লাল রঙের চুড়ি পরে নেই,নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই ছিনতে পারছি না।বাহবা দিচ্ছি নিজেকে নিজে,ভেবেই একটু মুচকি হাসলাম!আমার এতো খুশি থাকার অবশ্যই কারন আছে।শৈবাল বলেছে আজ নাকি আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে তাই এতো সাজগোজ, অবশ্যই সে নিজেই শাড়ি সিলেক্ট করে দিয়ে গেছে সকালে অফিসে যাওয়ার সময়।আজ কি কোনো স্পেশাল ডে?মনে পড়ছে না আমার।হঠাৎ ফোনে টুংটাং আওয়াজ পেতেই ফোন হাতে নিয়ে দেখি শৈবালের ম্যাসেজ!সে নিচে অপেক্ষা করছে আমার।ম্যাসেজ টা দেখে নিজেকে আবার আয়নায় পরোখ করে নিয়ে একহাতে শাড়ির কুচি গুলো উচু করে বের হই রুম থেকে।ছোট মায়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে বললো,
‘ইশশ রে তুহা তোকে একেবারে নতুন বউয়ের মতো লাগছে,সত্যি করে বলতো আজ তোর বিয়ে নাকি কারো সাথে?’
ছোট মায়ের কথা শুনে আমি থতমত খেয়ে তার দিকে পিটপিট করে তাকাতেই আম্মু সহ বাকী সবাই হেসে উঠে,একটু পর ছোটমা নিজেও হেসে উঠে।
‘নিচে যা তোর জন্য অপেক্ষা করছে ছেলেটা।’
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে ফেলি,তারপর আম্মুকে বলে বেরিয়ে পড়ি।ঘর থেকে বের হয়ে দেখি আসে পাশে কোথাও শৈবাল নাই,গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে তানিম ভাইয়া দাড়িয়ে!আমি তানিম ভাইয়ার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করি,
‘আপনার বন্ধু কোথায় ভাইয়া?’
‘শৈবাল তোমাকে নিয়ে যেতে বলছে,ও ওইখানেই আছে গাড়িতে উঠো!’
গাড়িতে উঠতে উঠতে শৈবালকে ম্যাসেজ দিতেই সেও একই কথা বললো।
.
২ ঘন্টা গাড়ি চলার পরে একটা একতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামে,আমি তানিম ভাইয়ার দিকে তাকাতেই সে বললো,
‘তুমি ভেতরে যাও আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি!’
জানিনা হঠাৎ কেনো জানি মনের মাঝে একরাশ ভয় এসে হানা দিয়েছে,শৈবালকে যতো ম্যাসেজ করি নো রিপ্লে।ফোন করার পরও সে ফোন তুলছে না,এ মুহূর্তে আমার কা’ন্না পাচ্ছে প্রচুর।নিজেকে কোনো মতে দমিয়ে রেখে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাই,একটা খুব পুরোনো বাড়ি মনে হচ্ছে!চারদিকে তেমন কোনো বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে না,আমি ভ’য়ে ভ’য়ে বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই আমার মুখটা হা হয়ে যায়!অবাক দৃষ্টিতে চারদিকটা দেখছি,চারদিকে কি সুন্দর লাল,নীল,সাদা মরিচ বাতি জ্ব’লছে।বাড়িটা বাহির থেকে যতোটা পুরাতন মনে হইছে ভেতরে ঢুকতেই তার ঠিক উল্টো ধারনা টা মাথায় আসলো।পুরো বাড়িটা কি সুন্দর করে সাজানো,চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে আমার।চোখ বন্ধ করে এই সৌন্দর্য উপভোগ করছি,হঠাৎ মনে হলো পেছনে কিছুর শব্দ শুনতে পাচ্ছি।পেছনে ঘুরতেই দেখি আমার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে আছে,তার হাতে একটা ডায়মন্ডের রিং।আমাকে তার দিকে তাকাতে দেখে সে বললো,
‘আমি একটা সহজ-সরল মেয়েকে মন দিয়েছি আরো দুই বছর আগেই,সদ্য এসএসসি দেওয়া একটা মেয়েকে!সেদিন ছোট মামার সাথে কেন্দ্রে গিয়েছিলাম একটা কাজে সেখানে প্রথম প্রেয়সী কে দেখেছিলাম।তার মাঝেই আমি মন হারিয়েছি।তার পর কাকে আর কখনো দেখিনি,সেদিনই ছিলো তার শেষ পরীক্ষা।আজকের এই দিনেই আমার তাকে প্রথম দেখেছিল।মাঝখানে ২ বছর কেটে গেলো।আমার মনে সে ছিলো কারনেই তোমাকে বিয়ে করতে আপত্তি করেছিলাম,কিন্তু যখন আমার কাজিনের জায়গায় নিজের প্রেয়সী কে দেখি তখন সকল দ্বিধা কেটে যায়!মনে একরাশ মুগ্ধতা আর বিস্ময় কাজ করছিলো,আমার প্রেয়সী কে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ।আমি তাকে সময় দিয়েছিলাম আমাকে মেনে নেওয়া বা আমার সাথে মানিয়ে নেয়ার,আমার মনে হচ্ছে এই কয়েকটা মাসই যথেষ্ট তার আমার সাথে মানিয়ে নেয়ার।’
একটু থেমে নিশ্বাস নেয় শৈবাল,এই দিকে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি।শৈবাল আমাকে আগে থেকেই ছিনে এটা কখনো বুঝতেই পারিনি আমি,অথচ আজ কতো গুলো মাস তার সাথে ছিলাম।তার মনের কথা গুলো একদমই টের পাইনি,মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছি আমি।এদিকে শৈবাল আবারো বলা শুরু করছে,
‘আল্লাহ্ কে সাক্ষী রেখে ইসলাম অনুযায়ী আমি তোমাকে আমার সাথে সারা জীবনের জন্য বাধতে চাইছি।তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি তুহা,উইল ইউ ম্যারি মি মাই সুইটহার্ট?’
তার হাতের রিংটা আমার দিকে বাড়িয়ে সে প্রশ্ন করে আমাকে,আমি কোনো মতে মাথাটা নাড়িয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেই।সে মুচকি হেসে আমার অনামিকায় রিংটা পরিয়ে দিয়ে ভালোবাসার প’রশ একে দেয় হাতে।চারদিক থেকে করতালির জোয়ার ভেসে আসছে,এতক্ষন পুরো ঘরের লাইট সব বন্ধ ছিলো।এখন কেউ একজন হয়তো লাইট গুলো জ্বা’লিয়ে দিয়েছে,আমি চারদিকে ন’জ’র বুলিয়ে দেখলাম ১০-১২ জন ছেলে মেয়ে আমাদের ঘিরে দাড়িয়ে আছি।
তারপরের সব কিছু আরো তাড়াতাড়ি ঘটে,কাজী ডেকে আমার আর শৈবালের বিয়ে হয়!সবাই ডিনার করে আড্ডা দিতে দিতে ১২ টা বেজে গেছে,ছোট্ট এই একতলা বিশিষ্ট বাড়িটায় তিনটা বেডরুম একটা কিচেন।ঘুমানোর জন্য ছেলেরা এক রুমে আর মেয়েরা এক রুমে চলে যায়।আমার আর শৈবালের জন্য আলাদা একটা রুম,আমাকে একটা মেয়ে এসে রুমটাতে নিয়ে যায়,শৈবাল তখনো তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো।আপুটা আমাকে রুমে দরজার সামনে রেখে বললো,
‘চেঞ্জ করবে না ফ্রেশ হয়ে নাও একটু শুধু।’
আমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে রুমে ঢুকি,দ্বিতীয় বারের মতো চমকে যাই রুমে ঢুকে!সারা রুমে ছোট ছোট ক্যান্ডেল জ্ব’লছে, আর পুরো রুমটা তাজা ফুলের গন্ধে মো মো করছে!রুমে এতো এতো আয়োজন আমাকে কি জানি বলছে,লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নেই আমি।বেডে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে S+T লেখা।এটা দেখে লজ্জায় আরো কুকড়ে যাই আমি।তড়িগড়ি করে ফ্রেশ হয়ে এসে বেলকনিতে দাড়াই,বাহিরে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে করে ভাবতে থাকি আমার জীবন টা কতো সুন্দর!আমার এই ছোট্ট জীবনে অপ্রাপ্তির ছেয়ে প্রাপ্তির পরিমান বেশি,এই যে এতো সুন্দর একটা পরিবার পেলাম,দুজন শ্বাশুড় শ্বাশুড়ি ফেলাম,সবটাই আমার ভাগ্য!সব চাইতে বড় ভাগ্য হলো আমার আম্মু কে আমি আবারো ফিরে পেয়েছি,আব্বুর মতো একজন পিতা পেয়েছি!হিমেলের মতো একটা ছোট ভাই আরশৈবালের মতো একজন স্বামী পেয়েছি!আমার এই ছোট্ট জীবনে আর কি চাই।হঠাৎ কোমড়ে ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠি আমি,কয়েক সেকেন্ডই বুঝে যাই এই স্পর্শ কার।আমি কোনো কথা না বলে চোখ বন্ধ করে তার স্পর্শ অনুভব করছি,ক্ষনে ক্ষনে তার স্পর্শ গভীর হচ্ছে।সে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
‘আজকের রাতটা শুধু আমার জন্য তুহা,অন্য কিছু ভাবার জন্য না!ওই যে চাঁদ টাকে দেখছো তুমি তাকেও আমার হিংসে হয়,তুমি শুধু আমাকে দেখবে।আমার মাঝে হারিয়ে যাবে।আমার কোনো আপত্তি থাকবে না!’
কানো আলতো কামড় দিয়ে শৈবাল আমাকে কোলে তুলে নেয়,হঠাৎ আক্রমনে থতমত খেয়ে গিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘কি করছেন শৈবাল?’
‘বললাম না তোমার আজকের রাতটা শুধু আমার জন্য,এখন আমার যা ইচ্ছে করবে তাই করবো,আদর করতে ইচ্ছে করলে আদর করবো আর..’
‘চুপ অ’স’ভ্য।’
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মৃদু ধ’মক দিয়ে উঠে তার বুকে মুখ লুকাই আমি,আমার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে দেয় শৈবাল।রাতটা দুজনারই কাটে স্বপ্নের মতো,আজ নিজেকে পরিপূর্ণ সুখের মনের হচ্ছে!শেষ রাতে শৈবাল ফিসফিস করে বললো,
‘আজ থেকে তুমি সম্পুর্ন শৈবালের হলে বউ,এখন শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে জা’ন।’
চলবে,,,,