নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-০৪

0
63

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-৪]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“মেয়ের জামাই না হয়েও জামাইয়ের অধিকার নিয়ে নিলাম। খারাপ না, ভালোই লেগেছে। যাহোক, আশা রাখি এরপর আর সাহস করবেন না কেসটা এগোনোর।”(তেজমাখা স্বরে)

নিশ্চুপ থমকে রইলো কল্যাণী। ওনার মনে হচ্ছে মা হিসেবে উনি ব্যর্থ। ওনার এই ব্যর্থতার কারণে আজ তার ফুলটাকে নির্মম অ-ত্যা-চারের শিকার হতে হয়েছে। নিজেকে কী ক্ষমা করতে পারবেন কল্যাণী? একজন অসহায় মানুষকে ন্যায় পাইয়ে দিতে গিয়ে নিজের ফুলটাকে ঝরিয়ে ফেললেন তিনি। মানতে কষ্ট হচ্ছে ওনার। এইতো মেয়েটা কালকে সুস্থ সবল ভাবে মামার বাড়িতে গেলো, আর আজকে! আজকে মেয়েটার এই অবস্থা। কল্যাণীর আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে ওপাশ থেকে আবারো বলে উঠলো,,

“প্রাণে বাঁচার মতো করে ছেড়ে দিয়েছি আপনার মেয়েকে, এরপর কেসটা বন্ধ না করলে জান নিয়ে নিব। নেয়ার আগে অবশ্য আবার মজা নেবো, এমন মৃ-ত্যু দিবো যে মেয়ের মৃ-তদেহ দেখলে আপনার রূহ কেঁপে উঠবে।”(কাঠ কাঠ স্বরে)

তীব্র ঘৃণা হলো কল্যাণীর অপর পাশের ব্যাক্তির উপরে। ব্যাক্তিস্বার্থে মানুষ এতটা নিচ হয় ভাবতেই গায়ে কাঁ-টা দিচ্ছে কল্যাণীর। আজ অব্দি এমন অনেক মেয়ে আছে যাদের রে’ই’প কেস লড়ে তাদেরকে ন্যায় পাইয়ে দিয়েছেন কল্যাণী। কিন্তু কোনোদিন ভাবেননি এই রে’ই’পের শিকার তার ফুলটাকেও হতে হবে, কোনোদিন ভাবেননি নিজের মেয়ের রে’ই’প কেস লড়তে হবে।
অজান্তেই হুট্ করে কল্যাণীর চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার মেয়ের সেই আত্মচিৎকার। সম্মান বাঁচানোর আকুতি মিনতি। চোয়াল শক্ত করে ফেললেন তিনি, একজন জনপ্রিয় উকিল তিনি। সবসময় ন্যায়ের পক্ষে থাকেন, এবং ভবিষৎ এও থাকবেন। চোয়াল শক্ত করে তীব্র ক্ষোভে তিনি বলে উঠলেন,,

“শুনে রাখ আমাকে কেউ দমাতে পারবেনা, সত্য এবং অসহায় মানুষের পাশে আমি সর্বদা থেকেছি এবং থাকবো। এতে করে নিজের পরিবারের ক্ষতি হলেও আমি দমে যাবোনা। বর্তমান এই কেসের জেরে তোমার বাবার ফাঁ-সি হত, এখন ৩৭৭ ধারা আইন ভঙ্গ করে একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে রে’ই’প করার জন্য তোমার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁ-সি হবে। রেডি থেকো তোমার পতন দেখার জন্য, নিঃশেষ করে দিবো তোমাকে এবং তোমার দম্ভকে। যেই পাপ করেছো, সেই পাপের জন্য তোমার শেষটা আমি দেখে ছাড়বো।”(কাঠ কাঠ স্বরে)

তীব্র ক্ষোভের সাথে কাঠ কাঠ স্বরে নিজের মন্তব্য পেশ করে অপর প্রান্তের ব্যাক্তির উত্তরের অপেক্ষা করলেন না তিনি। মোবাইলে সময় দেখলেন সবে সকাল দশটা বেজে সতেরো বেজেছে। মনকে শক্ত করলেন, যতটা শক্ত করলে দুনিয়ার সকল অন্যায়কে দাবানো যায়।
মোবাইলটা ব্যাগে ভরে, ডাক্তার শাফানের কেবিনে গেলেন। নক করে ভেতরে ঢুকলেন। ডাক্তার শাফান তখন চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল। তিনি ভেতরে প্রবেশ করেই বলে উঠলেন,,

“ডাক্তার শাফান, আপনার ভরসায় আমি আমার মেয়েটাকে রেখে গেলাম। আশা করি আপনি আমার মেয়ের নিঃশ্বাস বজায় রাখবেন।”

ডাক্তার শাফান চোখ তুলে তাকালো কল্যাণীর দিকে, দেখতে পেল নারীটির চক্ষুতে অনল দাউ দাউ করে জ্ব-লছে। এই নারীটির বেশ সুনাম শুনেছিল সে। সত্যর পক্ষে ছিলেন সবসময় তিনি এবং ভবিষৎ এও থাকবেন তা নারীটির মুখশ্রীতেই পরিলক্ষিত। ডাক্তার শাফানের কী হলো কে জানে, বলে উঠলো,,

“নিশ্চিন্তে থাকুন, আমার সর্বোচ্চটা দিবো আপনার মেয়েকে সুস্থ করাতে। ভরসা রাখুন।”

কল্যাণী মাথা নাড়ালেন, নীরবে শক্ত পায়ে প্রস্থান করলেন। আইসিইউ এর সামনে আসলেন, মিতালি, ননদ ও ননস ও তাদের স্বামীকে দেখতে পেলেন। সবাই যে শোকের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করছে তা তাদের চেহারাতে পরিলক্ষিত।
শক্ত রইলেন তিনি, তবুও মনের মধ্যে খচখচ করছে। আজকে যদি এই পরিস্থিতিতে নিজের স্বামী, ছেলেকে পাশে পেতেন তাহলে হয়তো আরও শক্ত হতে পারতেন। কিন্তু তা হওয়ার নয়, তার স্বামী আর ছেলে কোনোদিনও তার কাছে বা রায় বাড়িতে আসবেন না হয়তো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন কল্যাণী, আইসিইউ এর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। শেরহামকে অসহায় ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন, সারু শেরহামের বাহুতে মুখ ঠেকিয়ে ডুকরে কান্না করছে।
গলাটা ভারী হয়ে আসলো ওনার, অনুভব করলেন গলায় পাথর বিঁধে গেছে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। ধীর স্বরে বলে উঠলেন,,

“বয়ান নিয়েছেন অফিসার?”

পুলিশ অফিসার এস কে আহাজীব, ঘুরে তাকালেন। মাথা নাড়লেন, বুঝালেন হ্যা নিয়েছেন মাত্রই। ঢোক গিলে কল্যাণী আবারো বলে উঠলেন,,

“সুরেশ ভৌমিকের কেসটার আজকে শেষ দিন, সব প্রমাণ আজকে পেশ করা হবে। আশা রাখছি ঐই শক্ত পোক্ত প্রমাণে উনি ন্যায় পাবেন। কোর্টের কার্যক্রম শুরু হওয়ার সময় হয়ে এসেছে, চলুন।”

এস কে আহাজীব উঠে দাঁড়ালেন, নিচু স্বরে বলে উঠলেন,,

“আপনি যার বিরুদ্ধে এই কেসটা লড়ছেন তার ছেলেই আজকে এতো বড় অন্যায় করলো আপনার মেয়ের সাথে। আপনার মেয়ে কোনোমতে বয়ান দিয়ে আর রেসপন্স করছেনা।”(নিচু স্বরে)

কল্যানি নিশ্চুপ। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছেনা আর ওনার। তবুও কষ্ট করে বললেন,,

“আমার মেয়ে রেসপন্স করবে, ও সুস্থ হবে আবার আগের মতো প্রাণবন্ত হবে। আর কিছুক্ষন আগেই পুষণ ভৌমিক কল দিয়েছিলো আমাকে। ‘ও’ই যে এই অন্যায়টা করেছে তা নিজ মুখে স্বীকার করেছে। আজকে ওর বাবাকে ফাঁ-সিতে ঝোলানোর ব্যবস্থা করবো এরপর ‘ও’র ব্যবস্থা করবো। ওর শেষটা আমি দেখে ছাড়বো।”

শেরহাম এতক্ষন বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু কল্যাণীর কথা শুনে থমকে গেলো। শেরহামের চোখ ক্রমশ লাল হতে থাকলো, শিরা ফুলে উঠছে তার। ক্রোধান্নিত স্বরে বলে উঠলো,,

“ওর এতো সহজ মৃ-ত্যু আমি কিছুতেই মানবোনা জেঠিমণি। আমার ফুল, নিষ্পাপ বোনটার সাথে এতো বড় অন্যায় কাজ করার জন্য ওর তো যন্ত্রনাদায়ক মৃ-ত্যু হওয়া দরকার। ওর এতো সহজ মৃ-ত্যু ওর বা আমাদের কারোরই প্রাপ্য নয়।”(রাগান্নিত স্বরে)

সারু মুখ তুলে তাকালো শেরহামের দিকে। এই প্রথম শেরহামকে এতটা রাগতে দেখেছে সে। যতবার সে উল্টাপাল্টা কাজ করেছে কোনোবারই শেরহামকে সে রাগতো দেখেনি, ঠান্ডা মাথায় তাকে শাস্তি দিয়েছে। যে মানুষ ঠান্ডা মাথায় ভালোই শাস্তি দিতে পারে সে মানুষ রাগের মাথায় ঠিক কী কী করতে পারে বোধগম্য হচ্ছে সারুর। ভেজা চোখে সারু কল্যাণীকে দেখলো। মানুষটা যতই নিজেকে শক্ত দেখাক, যতই শক্ত ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হোকনা কেনো সব শেষে সবচে বড় সত্য হচ্ছেন তিনি একজন মা। মায়েরা কখনো সন্তানের এমন দশা সহ্য করতে পারেন না। সারু বুঝতে পারছে কল্যাণীর মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু তিনি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছেন স্বভাবগত।

শেরহামের কথা শুনে অফিসার এস কে আহাজীব শেরহামের চোখের দিকে তাকালেন। কিয়ক্ষন নিরবতা পালন করে বলে উঠলেন,,

“তা ঠিক বলেছেন, কিন্তু আইন নামক একটা শব্দ প্রচলিত আমাদের সমাজে। এই আইনের উর্ধে আমরা যেতে পারিনা। যদি যাই তাহলে এর ভুক্তভোগী আমরাও হই। মানুষ খু’ন করার শাস্তি হয় আজীবন কারাদণ্ড নয় ফাঁ-সি। এর বাহিরেও কেউ যদি লুকিয়ে এমন রে’পি’স্ট দের নিঃশেষ করে দেয় সমাজ থেকে তাহলে তাকে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে থাকতে হবে অন্যথায় ধরা পরে গেলে তাকেও ভুগতে হবে।”

অফিসার এস কে আহাজীবের কথায় কীসের যেন একটা ইঙ্গিত খুঁজে পেলো শেরহাম। রাগের মাত্র আরও বৃদ্ধি পেলো শেরহামের। সারুর দিকে এক নজর তাকিয়ে কল্যাণীর দিকে তাকালো শেরহাম। শক্ত স্বরে বলে উঠলো,,

“জেঠিমণি তোমার বর্তমান কেসের শেষ দিন আজকে। সব প্রমাণ সঠিক সময়ে পেশ করতে হবে। আর মাত্র আধা ঘন্টার মতো সময় আছে। ওই জা’নো’য়া’রের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, এরপর ওর ছেলের।”

কল্যাণী শেরহামের কথায় নিজেকে আরও শক্ত করলেন। সারুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,,

“শেরহাম আমার সাথে কোর্টে যাচ্ছে, স্নিগ্ধা মায়ের পাশে থেকো। তোমার শশুর আসলে, তোমার শাশুড়ি, পিসি শাশুড়ি ও তাদের স্বামীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিও। তুমি আর তোমার শশুর এখানে থেকে যেও, বিজয় নিয়ে কোর্ট থেকে আমি সোজা এখানেই আসবো।”

বলেই তিনি আর দেরি করলেন না বের হয়ে গেলেন। ওনার সাথে সাথে পুলিশ অফিসাররাও। স্নিগ্ধার করুন, ফ্যাকাসে মুখশ্রীর দিকে নজর পরতেই সারু মুখে হাত দিয়ে নীরবে কেঁদে উঠলো। শেরহাম তাকালো সারুর দিকে, এক হাতে সারুকে জড়িয়ে সারুর কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,,

“নিজের ও ফুলের খেয়াল রেখো।”

বলে শেরহাম নিজেও বের হয়ে গেলো। আইসিইউ থেকে বেরোতে মায়ের করুন মুখশ্রীর মুখোমুখি হতেই গম্ভীর হয়ে উঠলো শেরহাম। মনের মধ্যে তার র’ক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে, লাভা উতলে উঠছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে শেরহাম। সবাইকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলো হসপিটালের বাহিরের দিকে, যাওয়ার সময় হসপিটালের প্রতিটা মানুষকে তার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকতে দেখলো।
হসপিটালের বাহিরে আসতেই দেখলো আশেপাশে প্রেস মিডিয়ার লোকজন এসে ভিড় করেছে। তাজা খবর নামকরা উকিল কল্যাণী রায়ের মেয়েকে রে’ই’প করা হয়েছে, টিভি চ্যানেলের হেডলাইন।
শেরহাম তার জেঠিমণির পেছনে ছিল, পাশে পুলিশ অফিসাররা লোকজনকে সরিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কল্যাণী দ্রুত পদে হাঁটতে গিয়ে এক রিপোর্টারের প্রশ্নে থমকে গেলো,

“যেখানে নামকরা উকিল হয়েও নিজের মেয়েকে রে’ই’পের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেননি সেখানে সাধারণ আম জনতার মেয়েদের রে’ই’প কেস হ্যান্ডেল করা কী শোভা পায় আপনার ?”

চলবে,,?