নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-০৫

0
60

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-৫]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“জেঠিমণির রে’ই’প কেস হ্যান্ডেল করা শোভা পায় কী পায়না সেটা নিশ্চয়ই এতগুলা রে’ই’প কেসের জয় দেখে বুঝতে পেরেছেন। যেসব মেয়ের সাথে অন্যায় হয়েছে তারা প্রত্যেকেই ন্যায় পেয়েছে আর সেই ন্যায় পাইয়ে দিয়েছে আমার জেঠিমণি। সাংবাদিকতায় যদি সঠিক প্রশ্ন না করতে পারেন তাহলে নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখুন।'(কাঠ কাঠ স্বরে)

শেরহামের শক্তপোক্ত বাণীতে মুখ কালো করে ভিড়ের মধ্যে বিলীন হয়ে গেলো সেই রিপোর্টার। শেরহাম সতর্কতার সহিত কল্যাণীকে গাড়িতে উঠিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসলো। গন্তব্য কোর্ট, পুলিশের গাড়িও তাঁদের পেছনে আছে।
কোর্টের নির্দিষ্ট সময়েরও সাত মিনিট দেরি হয়ে গেলো তাদের কোর্টে প্রবেশ করতে।
শেরহাম এক পাশে দাঁড়ালো। কল্যাণী একবার তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। এইদিকে কল্যাণীকে কোর্টে উপস্থিত দেখে পুষণ ভৌমিক, তার বাবা ও তাদের সঙ্গী সাথীরা অবাকের সাথে সাথে প্রচুর রাগান্নিত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে পুষণ বলে উঠলো,,

“ভাঙবে তবে মচকাবে না। শা’লী’র মেয়েকে খে’য়ে আসলাম ভাবলাম কই মেয়েকে ধরে ম’রা কান্না কাঁদবে হসপিটালে পরে পরে কিন্তু নাহ শা’লী এতোই সত্যর পক্ষে যে নাচতে নাচতে কোর্টে চলে আসলো। তোকে তো দেখো নিবো আমি।”(রাগান্নিত স্বরে)

পুষণের বাবা নির্মল ভৌমিক ছেলের হাত চেপে বলে উঠলেন,,

“মাথা ঠান্ডা রাখ পুষণ, আমি একজন কমিশনার। যা পাপ করিনা কেনো কোনো প্রমাণ রাখিনা, দেখবি আজকে আমি বেকসুর প্রমাণিত হয়ে স্বসম্মানের সাথে বেরোব। এরপর নাহয় এঁকে ভাঙা যাবে।”

বাম দিকের বেঞ্চের কিনারে বসেছিল পুষণ ভৌমিক ও নির্মল ভৌমিক যার দরুন এগিয়ে যাওয়ার সময় পুরোটাই শুনলেন কল্যাণী। শক্ত চোয়ালে ও কঠোর চাহনি দিয়ে বিদ্রুপের হাসলেন তিনি, নজর সরিয়ে ডান দিকের বেঞ্চের দিকে তাকালেন। কয়েক জোড়া ভেজা ও এক রাশ আশা ভরা চক্ষু নজরে আসলেন ওনার। মাথা নাড়িয়ে অভয় দিলেন তিনি, যে করেই হোক সত্যর জয় করবেনই। মিষ্টি এক বাচ্চা মেয়ের মুখশ্রী কল্যাণীর নজরে আসলো। সেই সাথে নিজের মেয়ে স্নিগ্ধার মুখশ্রী ভেসে উঠলো চোখের সামনে। কল্যাণী ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।

“শুরুতেই আমি ক্ষমাপ্রার্থী আদালতের কাছে আমার দেরিতে আসার জন্য। মহামান্য আদালত আজকে এই কেসের শেষ দিন, এবং আমার সর্বশেষ প্রমাণ পেশেরও শেষ দিন। আমি আপনার নিকট এই কেসের সঠিক এবং শুদ্ধ প্রমাণ পেশ করছি। আমি আমার একজন সাক্ষীকে ডেকে নিতে চাই।”

মহামান্য আদালত থেকে অনুমতি পেতেই কল্যাণী একজনকে কাঠগোড়ায় এনে দাঁড় করালেন।
এদিকে কাঠগোড়ায় দাঁড়ানো ব্যাক্তিকে দেখে পুষণ, তার বাবা নির্মল ও তাদের লোকজনরা অবাক হলো। এই লোকটা তো তাদের বাড়ির কাজের লোক।
শেষ কিনা লোকটা যেই থালে খেলো সেই থালেই ফু’টো করলো!
পুষণ রাগে দাঁতে দাঁত পিষলো, এই মুহূর্তে পুষণের মন চাচ্ছে সবকিছু জ্বা-লিয়ে দিতে।

কল্যাণী কাঠগোড়ায় উপস্থিত আফতাব সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলেন,,

“আপনি নির্মল ভৌমিকের বাড়িতে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। আপনি নিশ্চয়ই এই খু’নের ব্যাপারে জানেন এবং এর জন্যই আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। আপনি আপনার মতামত রেখেছেন যে নির্মল ভৌমিক তার ছোটভাই সুরেশ ভৌমিককে খু’ন করেছেন। আপনার কাছে যা এভিডেন্স আছে আপনি পেশ করতে পারেন।”

কল্যাণীর প্রশ্নের উত্তর দিলেন আফতাব সাহেব,,

“ওনাদের বাড়িতে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছি প্রায় বছর দুয়েকের মতো। এর মধ্যে ওনার অনেক পাপ কাজের কথা জেনেছি, মানুষ খু’ন করার মতো মানসিকতা ওনার আছে। কিন্তু কখনই ভাবিনি সম্পত্তির লোভে নিজের ছোটভাইকে খু’ন করবেন। সুরেশ ভাই আমার অনেক কাছের ছিলেন, কখনই আমি মুসলিম বলে বৈষম্য তৈরী করেননি, মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো স্নেহ করেছেন। কিন্তু ওনারা সর্বদা এই নিয়ে আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিল। আমার চোখের সামনেই উনি অর্থাৎ নির্মল ভৌমিক সুরেশ ভাইকে খু’ন করেছেন। আড়াল থেকে সেটা আমি আমার মোবাইলে রেকর্ড করেছি এবং ওই বাড়ির সিসি টিভি ফুটেজও সংগ্রহ করেছি। এইযে আমার মোবাইলের ভিডিওটা এবং সিসি টিভি ফুটেজ। আশা করি এতে প্রমাণ হবে উনিই খু’ন করেছেন সুরেশ ভাইকে।”

বলেই তিনি তার মোবাইল ও সিসি টিভি ফুটেজের পেনড্রাইব এগিয়ে দিলেন কল্যাণীর দিকে। কল্যাণী সেটা মহামান্য আদালতের কাছে পেশ করলেন।
কল্যাণীর অপর প্রান্তের উকিল হেরে যাচ্ছেন বুঝতে পেরে বলে উঠলেন,,

“মহামান্য আদালত এইসব বানোয়াট ভিডিও ও ফুটেজ। বানোয়াট ভিডিও পেশ করে আদালতের সময় ও এই কেসটা জেতার চেষ্টা করছেন কল্যাণী রায়। উনি জানেন উনি এই কেস হেরে যাবেন।”

কল্যাণী সামান্য হাসলেন অপর প্রান্তের উকিল আশরাফ সাহেবের কথায়। কল্যাণী ন্যায়ের বিচার পাওয়ার আশায় মহামান্য আদালতের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন,,

“সমস্ত প্রমাণের সত্যতা যাচাই করে আমি আমার রায় কিছুক্ষন পর জানাচ্ছি।”

বৈঠক উঠে গেলো। সবাই বাহিরে চলে গেলেও কল্যাণী, শেরহাম ও পুলিশ অফিসার এস কে আহাজীব ও দুইজন কনস্টেবল সাথে সুরেশ ভৌমিকের পক্ষের লোকজন ও পুষণ, তার বাবা ও তাদের সাথে থাকা লোকজন রয়ে গেলো।
পুষণ শক্ত মুখে এগিয়ে গেলো কল্যাণীর দিকে। এক হাত পরিমান ফাঁকা রেখে সাপের মতো ফুসতে ফুসতে তাকালো কল্যাণীর দিকে। পুষণের চেহারা নজরের সামনে আসতেই কল্যাণীর মনে তীব্র ঘৃণারা জানান দিলো তারা ঘৃণা করে পুষণ ভৌমিক ও তাদের পরিবারকে।

“বারণ করার পরেও আপনি কেনো এখানে আসলেন? মেয়ের মান ই’জ্জ’ত হারালেন, আপনার কী প্রাণের ভয় নেই?”(রাগান্নিত স্বরে)

“প্রাণের ভয় থাকলে নিশ্চয়ই তোমাদের মতো ন’ষ্ট চরিত্রের খু’নিদের বিরুদ্ধে কেস লড়তাম না।”(কঠোর স্বরে)

পুষণ আরও রাগলো, কল্যাণীর দিকে ঝুঁকে বলে উঠলো,,

“আপনার এতো বড় বড় কথা আজকে বের করে দিতাম, ইসস মজা নেয়ার ধান্দায় ভিডিও করতে ভুলে গেছিলাম। যদি করতাম তাহলে আপনার আজকে এতো বড় বড় কথা মুখ দিয়ে বের হতোনা।”(ব্যাঙ্গ করে)

কল্যাণীর ঘৃণার তেজ বৃদ্ধি পেলো। শেরহাম কল্যাণী ও পুষণের মাঝে এসে দাঁড়ালো, ডান হাত দিয়ে বেশ জোরেই পুষণকে ধাক্কা দিয়ে দু হাত পিছিয়ে দিলো। জোর গলায় বললো,,

“নোংরা মুখ ও নোংরা কথাবার্তা নিয়ে দূরেই থাক। পরবর্তীতে এমন করতে গেলে, মুখ ও নোংরা কথা বলার মতো আস্ত থাকবিনা।”(জোর গলায়)

পুষণ দু হাত পিছিয়ে গেলো, পরে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে তাকালো শেরহামের দিকে। কিছু বলতে নিলে নির্মল ভৌমিক পুষণের হাত চেপে নিষেধ করলেন ইশারা দিয়ে। নিজেই বললেন,,

“আমার মতে দুইটা জিনিস করা উচিৎ না মানুষের। এক, আপন মানুষের বিরুদ্ধে যাওয়া। দুই, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যাওয়া। গেলেই এর ফল অনেক ভারী হয়। আজকে যদি আমি দোষী প্রমাণিতও হয়ে যাই, আমার ছেলে আছে। অগ্রিম বলে দিলাম, সাবধানে থাকবেন।”

শেরহাম হাসল, কল্যাণী কিছু বলার আগেই শেরহাম হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

“এসব কথা আপনার মুখে শোভা পায়না কমিশনার সাহেব উড়ফে নিজের আপন ভাইয়ের খু’নি। প্রথমত আপনি দোষী, তা শুধু আজকে আয়োজন করে প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয়ত আপনি নিজেই আপন মানুষের বিরুদ্ধে গিয়েছেন, নিজের ভাইকে খু’ন করেছেন। একটা বাচ্চা মেয়ের মাথার উপর থেকে বাবা নামক বটবৃক্ষ কেড়ে নিয়েছেন। এতো সহজে তো পার পেয়ে যাবেন না, আশা রাখি আজকে সত্যটাই প্রমাণিত হবে। প্রথমে আপনার ফাঁ-সি হবে এরপর আপনার ছেলের। ঐযে কী জানি একটা বললেন? রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যেতে নেই? তা ঠিক বলেছেন তবে কুকুরদের বিরুদ্ধে গেলে সমস্যা কোথায় কমিশনার সাহেব?”

পুষণ লাভার মতো উতলে উঠলো,

“এই কুকুর কাকে বললি? মুখ সামলে কথা বল নয়তো এমন অবস্থা করবো পায়ে দাঁড়ানোর মতো সাহসটুকু কুলাবেনা।”

“এখন আয়না কোথায় পাবো ভাই? ইসস আয়না থাকলে তোকে কয়েক জোড়া কুকুর দেখাতে পারতাম। শুন, সময়ের কাজ সময়ে করতে আমি অনেক ভালোবাসি। তাড়াহুড়ো আমার ভালো লাগেনা। সময় আসুক, এরপর দেখা যাবে কে পায়ে দাঁড়াবে আর কে বিছানায় পরে কাতরাবে ।”(হাই তুলে)

কল্যাণী শেরহামর হাত ধরলেন, সুরেশ ভৌমিকের স্ত্রী ও ওনার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছোট করে শ্বাস ছাড়লেন। শেরহামকে টেনে বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু পুষণের এক কথায় থেমে গেলো শেরহাম।

“শুনলাম ভাইয়ের নাকি বিয়ের অনেক দিন হচ্ছে তবুও নাকি ভাই বাবা হতে পারছেন না। তা ফ্রি তে একটা উপদেশ দেই, বাবা হতে চাইলে আপনার বউকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েন। ভালোই খাতির যত্ন করবো, দেখবেন বাবা ডাক শুনতে পারবেন।”

শেরহাম এতক্ষন নিজের যে রাগটাকে লুকিয়ে রেখেছিলো সেই রাগ আর লুকাতে পারলোনা। তেড়ে এসে পুষণের কলার ধরে নাক বরাবর পরপর দুইটা ঘুষি মা’রলো। মুহূর্তেই পুষণের নাক দিয়ে ঝরঝর করে র’ক্ত পরতে লাগলো।

“জানে মে’রে ফেলবো একদম। মুখ সামলে কথা বল, নয়তো আইনের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করবোনা। নিজেই তোর এই মুখ ভেঙে দিবো। মাইন্ড ইট।”(রাগান্নিত স্বরে)

বলেই পুষণকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো শেরহাম। পুষণের মাথা ঘোরানোর কারণে পুষণ নিজেকে সামলাতে পারলোনা। নিজের বাবার পায়ের উপর গিয়ে পরলো। নির্মল ভৌমিক দ্রুত ছেলেকে উঠিয়ে রাগান্নিত স্বরে অফিসার এস কে আহাজীবকে বলে উঠলেন,,

“আপনি উপস্থিত থাকতে এই অভদ্র ছেলে আমার ছেলেকে কোন সাহসে আ’ঘা’ত করে?”(রাগান্নিত স্বরে)

অফিসার এস কে আহাজীব হাসলেন, দারুন ভাবে হাসলেন। বললেন,

“ঠিকই বলেছেন, আমি থাকতে আপনি কমিশনার হয়েও কিভাবে খুন করতে পারেন? আপনার ছেলে কিভাবে একটা মেয়েকে আইন ভঙ্গ করে রে’ই’প করতে পারে? প্রমাণ কিন্তু আমাদের হাতে আছে শক্তপোক্ত। সময় আসুক বাপ, বেটা দুইজনেই ফাঁ-সির দড়িতে ঝু’লবেন।”

কল্যাণী শেরহামকে টেনে বাহিরে নিয়ে গেলেন। অফিসার এস কে আহাজীব ও সাথে গেলেন।

চলবে,,?