নীরবে নিভৃতে পর্ব-০৪

0
129

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

“যাই করো কোনো প্রমাণ যাতে বাইরে না যায় সেদিকে শুধু খেয়াল করবে। যাইহোক, এসো এখন তুমি। আজকে দুপুর হতেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসে হামলে পড়েছে আমার। একটু ঘুমোতে হবে রোশন। ”
বাবার কথায় হাসি পাচ্ছে রোশনের। সবুর হোসেন যে কতটা ঘুমকাতুরে সেটা এখানকার সবাই জানে। দিন নেই রাত নেই যেকোনো সময় ঘুমিয়ে পড়তে পারার বিশেষ গুণ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি৷
” ওকে ঘুমাও তুমি। এমনিতেই ঘুম ছাড়া তোমার জীবনে আর কী বা আছে সবুর হোসেন? ”

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সিগারেটে আগুন ধরাতে ধরাতে বললো রোশন। ছেলের রসিকতায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন সবুর। ছেলেটা ভীষণ বেহায়া, বেশরম। বাবাকেও ছাড়ে না!
” এসো তুমি। ”
” ইয়েস যাচ্ছিই!”

তিনটে দিন কীভাবে কেটেছে মেহেক সেই নিয়ে মেহেক ভাবছে। পরনে বাটিকের একটা নীল রঙের থ্রিপিস ওর। চুলগুলো খোঁপা করা। চেহারা কেমন শুকিয়ে গেছে এই ক’দিনে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশে রূপোর থালার মতো চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। ঘরের একপাশে একটা স্টিলের বাটিতে একটা মোমবাতি রাখা। সেই মোমবাতিই ঘরের একমাত্র আলোর উৎস এখন। বাড়ির সবাইকে খুব মিস করছে। এখান থেকে কি কখনো ফিরতে পারবে? শতশত ভাবনার ছেদ ঘটে পরিচিত কোনো কণ্ঠস্বরে। মেহেক চমকে উঠে। জানালার পাশ থেকে সরে দ্রুত পা চালিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাইরে উঁকি মারে মেহেকে।
” পল্লব তুই আগামীকাল সকালে আরেকবার আসবি। ”
” কেনো বস?”
” দরকার আছে। ওই এলাকার বিষয় কথা আছে। তাছাড়া কিছু নতুন অস্ত্র লাগবে আমাদের। ”
” ওকে বস৷ এখন তাহলে আসছি।”
” হুম। সাবধানে! ”
” অবশ্যই। ”
লম্বাচওড়া সুদর্শন যুবক পল্লব রোশনের সাথে কথা বলা শেষ করে জঙ্গল থেকে বেরোনোর পথের দিকে এগোলো। কিন্তু পল্লবকে এখানে দেখে মেহেক বিস্ময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এই ডাকাতদের সাথে ওর কীসের সখ্যতা? তাহলে কি পল্লবও এসবের সাথে জড়িত! হিসাব মিলছে না মেহেকের। রোশন ঘাড় কাত করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মেহেক তড়িঘড়ি করে ঘরের দরজা আঁটকে আবারো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে। ডাকাতের বাচ্চা আবার না এখন ঘরে এসে অসভ্যতা শুরু করে! এসব ভেবে রাগে, বিরক্তিতে আবারো নিজের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো মেহেক। এটা আসলে মেহেকের একটা বাজে অভ্যাসও বলা চলে। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মেহেক। পল্লব মেহেকদের গ্রামের ছেলে। ওর বাবা স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পল্লব মাস্টার্স শেষ করেছে কেবল। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই মেহেকের সাথে ভাব জমাতে চাইত পল্লব। মেহেকও একটু-আধটু পছন্দ করতো বইকি। মাঝে মধ্যে কথা হতো দুজনের কলেজ যাওয়ার পথে। কিন্তু মেহেক নিজের অবস্থানের কথা ভেবে কখনো নিজের সীমা অতিক্রম করতোনা। মেহেক ফের চোখ বন্ধ করেছে। স্মৃতির পাতায় পল্লবের সাথে কাটানো কিছু মুহুর্ত জ্বলজ্বল করে উঠলো!

বর্ষার প্রথম দিন, পহেলা আষাঢ়। যদিও কদিন ধরে এমনিতেই আকাশ ভীষণ মেঘলা ছিলো। আজ তাই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মেঘের গর্জনে মুখরিত হচ্ছে ধরণী। দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম ক্লাস ছিলো আজ মেহেকের। বান্ধবীদের সাথে বাড়ি ফিরছে সে। তিনটে ছাতায় চারজন এগিয়ে চলছে গ্রামের পাকা রাস্তা দিয়ে। কিছুটা পথ এগোতে থামলো মেহেকসহ সবাই । এমনিতেই সবাই এখন অন্য রাস্তায় চলে যাবে। ছাতা ছাড়াই রওনা দিতে হবে মেহেককে। গত মাসে ওর ছাতাটা নষ্ট হয়ে গেছে। বার দুয়েক বাবাকে বলেছিল অবশ্য ছাতার কথা। কিন্তু লাভ যে হয়নি তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এখান থেকে মেহেকের বাড়ির দূরত্ব দশ-পনেরো মিনিটের রাস্তা। একটু দূরে গাছের নিচে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই নড়েচড়ে দাঁড়ায়। এই বৃষ্টির মধ্যে কে দাঁড়িয়ে আছে দেখার জন্য ভালো করে তাকায় মেহেক। গাছের নিচে ছাতা হাতে পল্লবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর বান্ধবীরা মজা করে অনেক কিছু বলতে শুরু করে ।
” ওই যে পল্লব ভাই দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য। যা যা কথা বল। আমরা তো এমনিতেই এখন চলে যাবো।”
” আমার জন্য দাঁড়ায়নি। হয়তো অন্য কোনো কাজে এসেছে তানিয়া।”
তানিয়া মুচকি হাসলো। সাথে বাকিরাও। সাদিয়া বললো,
” ঠিক আছে। আমরা তাহলে গেলাম। তোর ছাতার সমস্যা হবে না এখন।”
মেহেক চুপ করে রইলো। সবাই যার যার পথে এগোতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মাথায় ওড়না দিয়ে সামনের দিকে পা চালাতে লাগলো মেহেক। সবাইকে চলে যেতে দেখে পল্লব এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই মেহেকের মাথার উপর ছাতা ধরে মুচকি হেসে পল্লব বললো,
” গতকালও বললাম ছাতাটা নিয়ে নাও। কথা শুনলে কী হয়?”
” আমিও বলেছি নিতে পারবো না। ”
পল্লবের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে মেহেক শান্তভাবে হাঁটছে। পল্লব বেশি কথা বলে ওর চেয়ে।
” জেদ ছাড়ো মেহেক গ্রহণ করো। আমাকে এবং আমার অসহায় ছাতাকে।”
” সম্ভব না। আমার পরিস্থিতি আপনি জানেন পল্লব ভাই। ”
” মেহেক কতবার বলেছি তোমাকে? আমরা দরকার হলে এখানে থাকবো না। ঢাকা চলে যাবো। লেখাপড়া শেষ যখন একটা না একটা চাকরি ঠিক পেয়ে যাবো।”
” এসব পাগলামি ছাড়ুন। ”
” যতক্ষণ না পাচ্ছি ততক্ষণ ছাড়বোনা। ”
” পেলে ছেড়ে দিবেন?”
বৃষ্টির তোপ বেড়েছে। মেহেক দাঁড়াল একটু। পল্লবের চোখে চোখ রেখে শুধালো উক্ত কথাটি। দু’জোড়া চোখ একে অন্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
” কথার ভুল মিনিং বের করবে না মেহেক। তাড়াতাড়ি চলো। ভিজে যাচ্ছ তুমি। ছাতাটা রেখে দিলে আমি চলে যেতাম। তা-ও নিবে না। ছাতার নিচে হাঁটছ ঠিক কিন্তু এতটা দূরে দূরে হাঁটলে হয়? ”

আবারো হাঁটতে লাগলো দু’জন। বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে প্রায়।
” এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবোনা আমি। ধন্যবাদ। আসছি।”
মেহেক পল্লবকে আরকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একা একা হাঁটতে লাগলো। ছেলেটার সাথে বেশিক্ষণ কথা বললেই বিপদ। কথা বললে মায়া বাড়ে আর মায়া বড্ড ভয়ানক। বিষের থেকেও বিষাক্ত এর বিষ। মস্তিষ্কে একবার ছেয়ে গেলে আর নিস্তার নেই।

” সুন্দরী দরজা খোলো। ”
রোশনের বাজখাঁই আওয়াজে হকচকিয়ে গেল মেহেক। সমস্ত জল্পনাকল্পনা থেকে বেরিয়ে বাস্তবে ফিরে এসেছে সে। উফ ডাকাতের বাচ্চা এসেছে কেন?
” সুন্দরী! ঘরে আছো? দরজা খোলো নয়তো ভেঙে ঢুকছি। দরজা ভাঙলে কিন্তু রাতেও খোলা রেখেই ঘুমাতে হবে। তারপর যদি….. ”
মেহেক আর দাঁড়াল না। সোজা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। তা-ও দরজা আঁটকে ঘুমালে একটু শান্তি লাগে। রোশন ঘরে ঢুকে সবদিকে নজর বুলিয়ে নিচ্ছে। মেহেক কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। ঘর চেক করা শেষ হলে মেহেকের দিকে দৃষ্টিপাত করলো রোশন। মেয়েটা আসলেই আগুন সুন্দরী! কিন্তু এই সৌন্দর্যই যে মেয়েদের জন্য কখনোসখনো অভিষাপ হয়ে দাঁড়ায়।
” মেহেক শব্দের অর্থ জানো তুমি সুন্দরী? ”
” না।”
মেহেকের কাঠখোট্টা স্বরে মুচকি হাসে রোশন। কী তেজ এখনো! এতগুলো ডাকাতদের মধ্যে থেকেও এতো সাহস। রোশন খাটে বসে ইশারায় মেহেককেও পাশে বসতে বলে। মেহেক পাশে বসে না কিন্তু খাটের একপাশে এসে দাঁড়ায়।
” মেহেক শব্দের অর্থ সুগন্ধ মনে হয়। আমি শিওর না যদিও। তা-ও হিন্দিতে মেহেক মানে সুগন্ধ বলেছি।”
” তোর হিন্দির বংশ নির্বংশ হোক শয়তান ডাকাদের বাচ্চা। চরিত্রহীন, কুকুর, লুচ্চা মার্কা লোক।”

মনে মনে রোশনকে এরকমই আরো কিছু গালিগালাজ করলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা। এমনিতেই পল্লবের বিষয়টা নিয়ে মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে ওর। তার উপর এভাবে এখানে থাকতে মরণ যন্ত্রণা ভুগতে হচ্ছে। প্রতিটা মুহুর্তে মানসম্মান হারানোর ভয় নিয়ে কি বাঁচা যায়?
” ওওও।”
মেহেকের সংক্ষিপ্ত উত্তর। রোশন ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে মেহেককে। এতো সুন্দর মেয়েটাকেও তো মেরে ফেলতে হবে ওকে। বিষয়টা কেনো জানি ভালো লাগছে না। অবশ্য না মেরে উপায় নেই। অতীতে এখানে যেসব মেয়েরা এসেছে তারা কিছু না কিছু তথ্য ওদের সম্পর্কে জেনে ফেলেছে। তাই সেসব মেয়েদের ফিরে যেতে দিলে ঝামেলা হতো ওদের জন্য। একবার একটা মেয়ে ওদের কিছু গোপন তথ্য পুলিশের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিল। ফলে ডাকাতি করতে গিয়ে দু’জন ডাকাত ধরা পড়েছিল প্রশাসনের হাতে। এই ঘটনার পর থেকে আর কাউকে জীবিত ছেড়ে দেয় না ডাকাতরা।
” মীরাকে এতো প্রশ্ন কেনো করো তুমি? সে কম কথা বলে। আর তুমি একটার পর একটা কথা বলেই যাও তার সাথে। ”
” আমার দরকার তাই প্রশ্ন করি।”
” শোনো মেয়ে, মীরা নিজেও তোমার মতো একজন। মাসখানেক হলো এখানে এসেছে। আসেনি আরকি আনা হয়েছে। নিজেদের হাতের পোড়া রান্না খেতে আর ভালো লাগে না। তবে মীরাকে কেউ অসম্মান করে না। ও কেবল আমাদের মুখে ভালো ভালো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য আছে। তাই ওর সাথে কথা বলে তোমার কোনো বিশেষ লাভ নেই। বুঝলে?”
” হ্যাঁ। ”
” গুড। আমি একটা সিন্ধান্ত নিয়েছি।”
রোশন ঘাড় কাত করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সাথে মেহেককেও টান দিয়ে পাশে শোয়াল। খোঁপা করা চুলগুলো খুলে এলোমেলো করে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো লোকটা। মেহেক চোখমুখ শক্ত করে আছে। কথা বলতেও ইচ্ছে করে না।
” জিজ্ঞেস করো,কী সিন্ধান্ত। ”
কোমরে শক্ত করে হাত রেখে থুতনিতে আঙুল ছুঁইয়ে বললো রোশন। ভয়ে তরতর করে ঠোঁট কাঁপছে মেহেকের।
” কী সিন্ধান্ত? ”
” আমার সাথেই বেড শেয়ার করবে তুমি শুধু। আর কেউ তোমার কাছে আসবেনা। এখন বলো রাজি? আমি দেখতে যথেষ্ট হট। তাই না?”

থুতনি থেকে আঙুল সরিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়াতে ব্যথায় চোখ বন্ধ করে ফেললো মেহেক। বিষয়টা বুঝতে সময় লাগলো না রোশনের। এতটা উন্মাদ কেন যে হয় নিজেই জানে না।
” আচ্ছা কিছু বলতে হবে না তোমাকে। ”
মেহেক চুপ করেই আছে। রোশন ঠোঁট থেকে আঙুল সরিয়ে গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। তীব্র ঘৃণায় নিজেকেই ক্ষতবিক্ষত করতে ইচ্ছে করছে মেহেকের। এই দুশ্চরিত্র লোকটা এভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে! রোশন মেহেককে ওভাবে শুইয়ে রেখেই উঠে বসে। কী একটা মনে করে মেহেকও বসে রোশনকে বলে,
” আপনার সাথে তখন কে কথা বলছিল?”
রোশন পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করেছে। ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে আগুন ধরিয়ে মেহেকের প্রশ্নের উত্তর দিলো।
” পল্লবের সাথে। ”
” আচ্ছা। ”
রোশন আরকিছু বললো না। দরজার দিকে এগোতে লাগলো। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেনো মেহেক। কিন্তু দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল রোশন। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললো,
” পল্লবের সামনে যাবে না তুমি। ভুলেও না। মনে রেখো কথাটা। দরজা আঁটকে দাও। মীরা এসে খাবার দিয়ে যাবে।”
রোশন দ্রুত পায়ে চলে গেলো। মেহেক দরজা আঁটকে দিয়ে আবারো ভাবতে লাগলো পল্লবের কথা। রোশন কেনো মানা করলো? পল্লব ওর গ্রামের বলে? না-কি অন্য কিছু? আচ্ছা পল্লব কি কোনোভাবে এখানে মেহেককে নিতে এসেছে? কোনো প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে না মেয়েটা। এতো অশান্তি আগে কখনো লাগেনি। এখন আগামীকালের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই। পল্লবের সাথে যে করে হোক কথা বলতে হবে।

চলবে,