নীরবে নিভৃতে পর্ব-০৫

0
144

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

” তোমার এই ঢং কিন্তু আমার আর ভালো লাগে না সানভির বাবা। ”
দুপুরের খাওয়াদাওয়া করছে হাওলাদার বাড়ির সবার। টেবিলের একপাশে বসা সানভি ও সিদ্দিক আহমেদ অন্য দিকে মিষ্টি আর আনজুম বেগম। মেহেকের কথা উঠতেই রাগে ফোঁস করে উঠে উপরোক্ত কথাটি বললেন আনজুম। সিদ্দিকও আজ থেমে থাকবে না। রাগে হুংকার দিয়ে বললেন,
” ভালো না লাগলে বাড়ির দরজা খোলা আছে। তোমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাও।”
মিষ্টি হকচকিয়ে গেল বাবার এমন কথায়। ছোটো থেকে কখনো বাবা এমন আচরণ করেনি মায়ের সাথে। আনজুম ক্ষেপে গেলেন মিষ্টির বিষয় কথা বলায়। বেচারা সানভি চুপ করে খেয়ে যাচ্ছে। সত্যি বলতে বড়ো বোনের জন্য যে তারও মন পোড়ে। কিন্তু মায়ের জন্য তা প্রকাশ করতে পারে না।
” খবরদার! আমার মেয়েকে নিয়ে এরকম তুমি বলবে না। তাছাড়া তুমি কথা দিয়েছিলে কখনো আমার মেয়েকে অবহেলা করবে না।”
” কথা কি কেবল আমি দিয়েছিলাম আনজুম? তুমি দাওনি? আজ তোমার জন্য আমার মেয়েটা ঘরছাড়া। বেঁচে থাকলেও কী অবস্থায় আছে জানি না। তাই তোমার মেয়েকেও মাথায় উঠিয়ে রাখতে পারছি না আর। আমার ভুল হয়েছে খুব। আগে যদি মেরুদণ্ড সোজা করতাম তবে আজ এই দিনটাই আসতো না।”
মিষ্টি ভাতের প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে গেছে। এই অপমান সহ্য করতে পারবে না সে। সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের ঘরের দিকে হনহনিয়ে চলে গেছে সে। আনজুম আহত দৃষ্টিতে মেয়ের গমনপথের দিকে তাকিয়ে আছেন।
” তোমার কোনো দোষ নেই? তুমি নিজেই তো মেয়ের থেকে বিশ বছরের এক বুড়োর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলে। ”
” তাতেও যে তোমার ইন্ধন ছিলো সেটা মনে হয় তুমি ভুলে যাওনি আনজুম। আমি জানি না মেহেককে কখনো ফিরে পাবো কি-না, কিন্তু তোমাকে কখনো ক্ষমা করবোনা। ”
আনজুম কিছু বলার আগেই সিদ্দিকও খাওয়া বাদ দিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়। সানভিও হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। খাওয়ার জন্য একটা পরিবেশ দরকার। যা এই মুহুর্তে এ বাড়িতে নেই।

সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো পল্লবের আসার নাম নেই। তাহলে কি আসবে না? না এসে কীভাবে পারবে? রসুনের বাচ্চা যখন আসতে বলেছে আসতে তো হবেই! দরজা খোলার শব্দে মেহেকের জল্পনাকল্পনা ভেস্তে গেলো। বিছানায় বসে ছিলো মেয়েটা। মীরাকে দেখে উঠে বসলো।
” খেয়ে নিও। ”
” দাঁড়াও মীরা আপু।”
মেহেকের কথায় দাঁড়াল মীরা। মেরুন রঙের একটা শাড়ি পরে আছে মীরা। চুলগুলো বিনুনি করা। কানে ছোটো দুল, গলা খালি। চেহারায় কোনো কৃত্রিম প্রসাধনী নেই। অবশ্য এখানে সেসব আসবে কোথা থেকে।
” বলো।”
” তুমি সব সময় এমন চুপচাপ থাকো কেনো? ”
” এমনি।”
” আচ্ছা শোনো, এখান থেকে কি আমরা একসাথে পালাতে পারিনা?”
মেহেকের কথায় চমকাল মীরা। শুকনো ঢোক গিলে বললো,
” সেটা সম্ভব না মেহেক।”
” কিন্তু কেনো? চেষ্টা তো করতে পারি?”
” আমি করেছিলাম একবার। বদলে কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছিল। ওরা যে কতটা খারাপ জানো না তুমি। ”
” কী করেছিল?”
” আমাকে উল্টো করে বেঁধে রেখেছিল অনেকক্ষণ। যখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা তখন ছেড়ে দিয়েছিল।”
মীরার কথায় কষ্ট হচ্ছে মেহেকের। মেয়েটা কতো কষ্টে এখানে আছে।
” সরি আপু। ওসব মনে করানোর জন্য। ”
” না না ঠিক আছে। ”
” তাহলে অন্য একটা হেল্প করো প্লিজ।”
” একটা ছোটো ছুরি লাগবে আমার। ”
” কী করবে?”
” আত্মরক্ষার জন্য। ”
মীরা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,
” নিজেকে শেষ করা ছাড়া এদের কিছু করতে পারবে না তুমি। আর মরে গেলে তো হেরে গেলে। তারচে লড়াই করে বাঁচতে হবে তাই না? ”
” হ্যাঁ আমিও তাই করবো। নিজে মরবো না।”
” ঠিক আছে। আমি রাতের খাবারের সাথে নিয়ে আসবো সেটা।”

মেহেক কিছু বলতেই যাবে এমন সময় ফয়সাল এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
” কী নিয়ে আসবি মীরা?”
মীরা ও মেহেক দু’জন ভয়ে আঁতকে উঠল ফয়সালের উপস্থিততে। সবকিছু কি শুনে ফেললো? মীরা থতমত খেয়ে বললো,
” আসলে ও কয়েকটা চুড়ি চাচ্ছিল। ”
” চুড়ি? ”
মেহেক মীরার কথায় স্বায় দিয়ে বলে,
” হ্যাঁ চুড়ি। ”
” আমি শুনলাম ছুরি!”
” চুড়ি আর ছুরি তো প্রায় একরকম শোনায় সেজন্য হয়তো। ”
মেহেক স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই বলে। ফয়সাল ঘরের মধ্যে ঢুকতেই মীরা তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এই ছেলেটার নজর মোটেও সুবিধার ঠেকছে না মেহেকের। একজন অসভ্যতা করে তা-ও সহ্য করে নিচ্ছে কিন্তু!
” কী ভাবছো? কেনো এতো ঝামেলা করছো বলো তো! তুমিও মজা নাও আর আমাকেও কিছু মজা দাও। সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিবো তোমাকে। ”
ফয়সাল ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে মেহেকের দিকে। মেহেকও একপা একপা করে পেছনে এগোচ্ছে। ভয় লাগছে ভীষণ।
” দেখুন ভালো হবে না বলছি। আমার কাছে আসলে কিন্তু শেষ করে ফেলবো।”
” বিশ্বাস করো খুব ভালো হবে। তোমার ওই গোলাপি ঠোঁট যখন আমার ঠোঁটের দখলে আসবে আমি এমনি শেষ হয়ে যাবো। তারপর তোমার সেক্সি বডি! উফফ…..”
পেছনে এগোতে এগোতে মেহেক বিছানায় বসে পড়তেই ফয়সাল বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে মেহেকের। ওরা তো বলেছিল জোরজারি করবে না কিন্তু এখন!

” ফয়সাল! ”
আচমকা রোশনের আওয়াজে চমকে উঠে ফয়সাল। মেহেক কী ভেবে যেনো বসা থেকে উঠে দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে রোশনের পেছনে লুকাল। ফয়সাল চোরের মতো কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে মিনমিন করে বলতে লাগলো,
” আসলে ভাই আমি মানে একটু দেখছিলাম ও রাজি হয় কি-না। ”
” এখান থেকে যা এখন।”
” ভাই… ”
” চুপ। যেতে বলেছি তোকে।”
ফয়সাল আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত ওদেরকে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মেহেক হাঁপ ছেড়ে বাঁচল তাতে।
” পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে নাকি সুন্দরী? ”
রোশনের অসভ্য কথায় মেহেক চোখের পলকে পেছন থেকে সরে ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো।
” এমন খারাপ দিন আমার কখনো আসবেনা যে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে হবে। ”
রোশন ঘরে ঢুকে খাটে বসে পা দুলিয়ে বলে,
” কখন কী দিন আসে বলা তো যায় না সুন্দরী। আজকের পর থেকে এই ঘরে আমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ ঢুকবে না। নিশ্চিত থাকো।”
” তাতে নিশ্চিতের কী আছে? আপনি কি মহাপুরুষ? উল্টো আপনি একটা লুচ্চা নম্বর ওয়ান।”
রাগে মেজাজ খারাপ লাগছে মেহেকের। কতক্ষণ নিজেকে দমিয়ে রাখা যায়?
” ওয়াও! নাইস! বিউটিফুল! কতো সুন্দর প্রশংসা করলে।”
মেহেক চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এর সাথে কথা বললে আরো কথা বাড়ে। তবে একটা বিষয় হচ্ছে চুপ করে থাকলেই সবাই পেয়ে বসে। মরতে যদি হয় এভাবেই বলেকয়ে মরবে বলে ঠিক করে নিয়েছে মেহেক।

” ভাই পল্লব এসেছে। ”
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে লিমন উচ্চস্বরে বললো। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কারণেই যে লিমন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছে মেহেক। যাক তা-ও ভালো একটার অসভ্যতা সহ্য করতে হচ্ছে।
” আসছি।”
রোশন বসা থেকে উঠে ঘাড় কাত করে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে মেহেককে বললো,
” রাতে কথা হবে। ”
মেহেক অন্য দিকে ফিরে রইলো। এমন করে বললো যেনো কথা বলার জন্য মুখিয়ে আছি! আসুক রাতে ছুরি দিয়ে ভুঁড়ি ফুটো করে দিবো। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে মনোযোগ দিলো। কপাল একটু হলেও ভালো। তাই এখান থেকে পল্লব আর রোশনের কথাবার্তা শোনা ও দেখা যায়। পল্লব একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। রোশনও ওর সামনাসামনি অন্য একটা চেয়ারে বসেছে। কোনো একটা এলাকায় গুপ্তচর পাঠানোর বিষয় আলোচনা করছে রোশন। পল্লব শুধু এলাকার বিষয় তথ্য দিতে এসেছে।
” ঠিক আছে তাহলে তুই দু’জন লোক পাঠিয়ে দে। আর অস্ত্রগুলো ঠিকমতো সরবরাহ করার জন্য থ্যাংকস। ”
রোশন সিগারেটে সুখটান দিয়ে বললো। পল্লব মুচকি হাসলো।
” ব্যাপার না। বেশ তাহলে আমি যাচ্ছি এখন। ”
” যাবি? খাওয়াদাওয়া করে যা?”
” না বস। খেয়ে এসেছি আমি। ”
” ওকে। পরে দেখা হবে তাহলে। ”
” ওকে বস। আসছি।”
পল্লব উঠার আগেই রোশন উঠে অন্য দিকে গেলো। পল্লবের সাথে কীভাবে কথা বলবে সেই নিয়ে ভাবছে মেহেক। কিন্তু ও তো চলে যাচ্ছে! কী করবে ভাবতে ভাবতে ঘরের মধ্যে কোথাও কিছু আছে কিনা দেখতে লাগলো মেহেক। ছোটো ছোটো কিছু পাথর নজরে এলো। সেখান থেকে কয়েকটা পাথর নিয়ে দৌড়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল। পল্লব চলে যাচ্ছে। বের হওয়ার রাস্তা ঘর থেকে উল্টো পথে। মেহেক আর দেরি না করে পরপর দু’টো পাথর নিক্ষেপ করলো। প্রথমটা পল্লবের আশেপাশে পড়লেও দ্বিতীয়টা একেবারে পিঠে গিয়ে পড়লো। ফলশ্রুতিতে দাঁড়িয়ে গেলো সে। মেহেক থামলো না। আরেকটা পাথর ছুঁড়ে ফেললো পল্লবের সামনে। আশেপাশে তাকিয়ে এই পাথর কে ছুঁড়ছে খুঁজছে পল্লব। মেহেক জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে হাত নেড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পল্লবের দৃষ্টি মেহেকের দিকে পড়তেই চমকাল পল্লব। মেহেক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করতে লাগলো পল্লবের। ছেলেটা ঝড়ের গতিতে হেঁটে এলো জানালার কাছে।
” মেহেক! তুমি এখনো আছো এখানে? আমি তো ভেবেছিলাম ওরা তোমাকে মেরে ফেলেছে। আমি তোমার জন্য এখানে এসেছি।”
” পল্লব ভাই আমি ঠিক আছি। প্লিজ আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে চলুন। আমি আর এভাবে বাঁচতে পারবোনা। ”
পল্লব মেহেকের দিকে তাকিয়ে আছে। কী সুন্দর মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। মেহেক ছলছল নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। পল্লব আশেপাশে নজর বুলিয়ে নিলো একবার। তারপর বললো,
” আমি যতটা দ্রুত সম্ভব তোমাকে নিয়ে যাবো এখান থেকে। তুমি তৈরি থেকো শুধু। আর হ্যাঁ একদম ভয় পাবে না। আমি আছি।”
মেহেক নিজের হাত জানালা দিয়ে বের করে পল্লবের দিকে এগিয়ে দিলো। পল্লবও মেহেকের হাতটা শক্ত করে ধরেছে।
” আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। ”
” আমি আসবো মেহেক। ততক্ষণ নিজের খেয়াল রেখো। আসছি এখন। কেউ দেখে ফেললে বিপদ। ”
” হ্যাঁ এসো।”
মেহেক পল্লবের হাত ছেড়ে দেয়। পল্লব মুচকি হেসে অন্য দিকে এগিয়ে যায়। এতদিনে একটু শান্তি লাগছে মেহেকের। ইশ এই মানুষটার হাত যদি আগেই ধরতো তবে আজ এখানে থাকতে হতোনা। তবে দেরিতে হলেও পল্লবকে বেছে নিয়েছে মেহেক। মনে মনে ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে মেয়েটা। এখান থেকে বেরিয়ে বিয়ে করে নিবে ওকে। আর কষ্ট দেবে না ছেলেটাকে। এসব ভেবে বিছানায় বসে দুপুরের জন্য বরাদ্দকৃত খাবারগুলো খেতে লাগলো মেহেক।

চলবে,