নীরবে নিভৃতে পর্ব-১৭

0
192

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_১৭
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বিনোদন হিসেবে যারা পড়তে চান পড়ুন। অবশ্যই মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত। )

রোশনের কথামতো সবাই ক্ষমা চাইলো মেহেকের বাবার কাছে। রোশন মুচকি হাসছে মেহেকের দিকে তাকিয়ে। মেহেক ভয়ে মায়ের পেছনে লুকিয়েছে।
এরমধ্যে লিমন আর শান্ত এলো কাজী সাহেবকে নিয়ে।
” বাবা বিশ্বাস করুন আপনার মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসি আমি। প্রমিজ কখনো অসম্মান করবোনা। আপনি দয়া করে রাজি হয়ে যান!”

এতগুলো ডাকাতের খপ্পরে পড়ে ভয়ে কাজী সাহেব কাঁপছে। বয়স উনার বাহান্ন কি তিপ্পান্ন হবে, চাপদাড়ি ভর্তি গাল, ছিমছাম গড়নের মানুষ। মিষ্টির মাথায় অন্য বুদ্ধি ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে সেটা রোশনকে বলবে? সিদ্দিক আহমেদ তবুও চুপ করে আছেন। গতবার লোভে পড়ে ইকবালের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে ভুল করেছিলেন। তাই আজ আর প্রাণের ভয় পেয়েও সেই ভুল করবেন না তিনি। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মেহেকের বাবা রোশনের উদ্দেশ্যে বলে,
” আমাকে মেরে ফেললেও আমি রাজি হবো না।”
রোশনের মেজাজ খারাপ লাগছে। ভেবেছিল ভালোবেসে, বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়েটা করবে। কিন্তু না! সেটা আর হচ্ছে না। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে আচমকা মিষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করলো রোশন। কিছু একটা ইশারা করছে মেয়েটা। রোশন কয়েক সেকেন্ড মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর মুচকি হেসে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে গুঁজে নিলো। কয়েক টান না দিলে মন মেজাজ ভালো হবে না আর। সিগারেটে সুখটান দিয়ে মিষ্টির দিকে এগোচ্ছে রোশন। মিষ্টির দিকে রোশনকে আসতে দেখে আনজুম ভয়ে কেঁপে উঠলেন। সিদ্দিক মেয়ের কাছে আসতে চাইলে ফয়সাল, শান্ত উনাকে ধরে ফেলেন। এসবকিছু দেখে মেহেক আর চুপ করে থাকতে পারে না। ধৈর্যের লিমিট ক্রস করে ফেলেছে এই ডাকাতেরা।
” এখনই এইখান থেকে চলে যা নয়তো পুলিশকে কল দিবো আমি। কী চাস? আমাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দে। আর খবরদার আমার বোনের দিকে এগোবি না।”

মেহেক রোশন আর মিষ্টির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে রাগে হিসিয়ে উঠে বললো। রোশন কিছু বললো না তবে একটু আহত হলো তুইতোকারি আচরণে। কিন্তু ব্যাপার না। তুই, তুমি, আপনি সবকিছুই চলবে রোশনের। তবুও মেহেককে চাই! রোশন মেহেককে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মিষ্টির হাত ধরে অন্য হাত দিয়ে সিগারেট মাটিতে ফেলে দিলো। মেহেক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সিদ্দিক আর আনজুম কাঁদছেন। এরমধ্যে আশেপাশের বাড়ির লোকজনও বিষয়টা টের পেয়ে গেছে। তবে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। যে যার জানালা দিয়ে কিংবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘটনা উপভোগ করছে। সত্যি বলতে কারো খারাপ লাগার বদলে ❝হাওলাদার বাড়ির কেচ্ছা আবার শুরু হয়েছে❞ বল হাসাহাসি করতেই বেশি ভালো লাগছে তাদের।

” ভালো কথায় যখন কাজ হলোনা তখন খারাপ টাই বলি! হয় সুন্দরী তুমি চুপচাপ আমাকে বিয়ে করবে নয়তো আমি মিষ্টিকে সাথে নিয়ে যাবো আর তোমার বাবা-মাকে সোজা ওপরে….”
রোশন ঘাড় কাত করে দাঁত বের করে হাসছে। মেহেকের ঘৃণায় শরীর ঘিনঘিন করছে রোশনের এমন রূপ দেখে। ছিহ! একটা মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে।
” খবরদার! ডাকাতের বাচ্চা, শয়তান একটা তুই। আমার বোনকে ছাড় নয়তো আমি তোকে শেষ করে ফেলবো। আমার বাবাকেও ছাড়তে বল।”
” তোমার হাত দাও তাহলে আর মিষ্টির হাত ধরে রাখবো না। তুমি চাইলেই এখানকার সবাই ভালো থাকবে। এখন বলো কী করবে? সবাইকে কষ্ট দিবে নাকি বিয়ে করবে?”

আনজুম এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। ঠিক নিজের মেয়েকে বাঁচাতে সৎ মেয়েকে অনুরোধ করতে লাগলো বিয়েটা করে নিতে। কিন্তু মেহেকের বাবা রেগে গেলেন তাতে।
” কী বলছো আনজুম? আজ যদি দু’টো মেয়েই তোমার নিজের হতো তাহলে এক মেয়ের জন্য অন্য মেয়ের জীবন শেষ করতে বলতে পারতে?”

স্বামীর কথায় চুপ করে রইলেন আনজুম বেগম।
মেহেকের ভীষণ অসহায় লাগছে। তবে মায়ের প্রতি কোনো ক্ষোভ কিংবা রাগ হচ্ছে না। নিজের মায়ের মতো পৃথিবীতে আর কেউ হয় না, হবেও না। বাবাকে আর বোনকে মুক্ত করতে অবশেষে নিজেকে ধ্বংসের নামে লিখে দিতে প্রস্তুত হলো সে।

” আমি বিয়ে করবো।”

থমথমে গলায় বললো মেহেক। সবাই একসাথে হেসে উঠলো ওঁরা। মিষ্টিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো গোপনে। কিছু সময়ের ব্যবধানে কাজী সাহেব বিয়ে সম্পন্ন করলো রোশন ও মেহেকের। যেমন ছিলো সেই অবস্থায়ই বিয়ে হলো মেয়েটার। রোশন ভীষণ খুশি আজ। মেহেক একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। কবুল বলা ব্যতীত আর কোনো কথা বলেনি। মিষ্টির একটু হলেও বোনের জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু তবুও কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভালোবাসা পাবে মেহেক। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র!

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা। রাতের খাওয়াদাওয়া করেননি সবুর হোসেন। ছেলেটাকে নিয়ে ভীষণ ঝামেলায় পড়েছেন উনি। সত্যি সত্যি আজ বিয়ে করতে চলে যাবে সেটা তো ভাবতেও পারেননি সবুর। শুধু যাওয়ার আগে বলে গেছে,
❞ বাবা আমি তোমার জন্য পুত্রবধূ আনতে যাচ্ছি! ❞
ব্যাস! গত কয়েকদিন ধরে তো এই বিয়ে করা নিয়েই ঝামেলা চলছিল দু’জনের মধ্যে। তবুও! তবুও সেই বিয়ে করতে গেলো ছেলেটা। ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না সবুর, ডাকাতদের ডেরায় মেয়েমানুষ থাকতে পারে না। তা-ও কারো বউ হয়ে! মেয়ে মানুষকে বিশ্বাস করেন না আর সবুর। পরপুরুষের সংস্পর্শে আসলে এরা খারাপ হয়ে যায়। অন্য পুরুষের ছোঁয়া পেয়ে নিজস্ব পুরুষকে ঠকায়। এসব ভাবতেই সবুর হোসেনের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। পুরনো স্মৃতি, যন্ত্রণা সব, সবকিছু হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।

” ভাই, ভাবিকে নিয়ে এসে গেছে……. হুররেএ…. ”

বাইরে থেকে লিমনের কণ্ঠস্বর শুনে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সবুর। তিন-চার জন ছেলেদের সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোশন, মেহেক পাশে দাঁড়ানো। সবুর হোসেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে একেবারে বিধস্ত, ভেঙেচুরে গেছে ভেতর থেকে। কেমন বিরসতায় ভরপুর মুখাবয়ব।

” বাবা! বিয়ে করেছি আমি হে হে। প্যা প্যা… প্যা প্যা… ”
রোশন বাবার চারপাশে ঘুরে এরকম বলতে লাগলো। প্রথম প্রথম একটু বিরক্ত হয়ে রাগ দেখাতে লাগলেন সবুর কিন্তু রোশনের পাগলামিতে আর না হেসে পারলো না।

” থাম এবার। ওকে ঘরে নিয়ে যা। দেখে মনে হচ্ছে সারা রাস্তায় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসেছিস।”
” কী বলো বাবা? বউ আমার, কোলে তুলে নিয়ে এসেছি। টেনেহিঁচড়ে? ছিহ!”

সবুর রোশনের কানমলা দিয়ে অন্য দিকে এগিয়ে শান্তকে ইশারা করে কাছে ডেকে কথা বলতে লাগলো। শান্ত কথা বলে কয়েকজন ছেলে নিয়ে অন্য দিকে এগোলো। মেহেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আকস্মিক ঘটনায় একটু বেসামাল হয়ে গেছে। নিজেকে সামলে নিতে একটু সময় লাগছে ওর। এরমধ্যে মীরা আপু এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। রোশনও মীরার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
” মীরা ওকে বিয়ের শাড়ি পরিয়ে দাও তো। আর অল্পস্বল্প সাজুগুজু করাও তবে লিপস্টিক একেবারে হালকা দিবে। ওসব খাওয়া অস্বাস্থ্যকর। ”
মীরা প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। রোশন চলে গেলো অন্য দিকে। মেহেক লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। আর ভয় পাবে না কাউকে। নিজের মতো চলবে, খামখেয়ালি করবে। তাতে মরে গেলে যাবে,গুলি খেলেও খাবে! এসব ভেবে নিজেকে শান্ত করছে মেয়েটা। মীরা মেহেকের হাত ধরে বলে,
” চলো সাজিয়ে দিবো।”
” হ্যাঁ জানাজা হবে তো। ঠিকমতো কাফনের কাপড় পরিয়ে, গোলাপজল দিয়ে দিও।”
মীরা চুপ করে রইলো। মেহেক নিজেই হাঁটতে লাগলো আগেভাগে। মীরার ঘর ভালো করেই চেনে মেহেক।

বাড়ির উঠোনে মাটিতে লুটিয়ে বসে আছে সিদ্দিক আহমেদ। মেয়েটাকে শেষমেশ এভাবে জীবনটা বরবাদ করতে হলো! আনজুম দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, মিষ্টি নিজের ঘরে। এরমধ্যেই আশেপাশের বাড়ির লোকজন মিষ্টিদের উঠোনে এসে জড়ো হয়ে গেছে। সবাই নানান কথা বলাবলি করছে। কেউ কেউ বলছে মেহেকের পরিবারের জন্য এ গ্রামে ডাকাতদের আনাগোনা লেগেই আছে। তাই ওদেরকে গ্রামে থাকতে দেওয়া যাবে না। আবার কেউ কেউ বলছে,
❝বাপের জন্মেও শোনেনি ডাকাত কাউকে বিয়ে করে নিয়ে যায়! এই বাড়ির মেয়েগুলো অদ্ভুত জাদু টোনা জানে। নইলে এমন ডাকাতেরকেও বশ করলো কীভাবে? ❞

সিদ্দিক কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। মিষ্টির মা এসে একপ্রকার জোরাজোরি করে উনাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়ে দরজা আঁটকে দেন। গ্রামের লোকজন রাত গভীর হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে কথাকথি করে নিজেদের বাড়ি চলে যায়।

চলবে,