নীরবে নিভৃতে পর্ব-৩০+৩১

0
104

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৩০
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে আশপাশ থেকে। নতুন এক সকালের আগমন মানেই আবারো কাজকর্মের শুরু। মেহেকেরও কাজ শুরু হয়ে গেছে। ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ বাইরে হাঁটাহাঁটি করেছে। তারপর বাসি থালাবাসন ধুয়েমুছে, ঘর ঝাড়ু দিয়েছে। বৃষ্টির ঋতু বলে উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার বালাই নেই। বাইরে একটু-আধটু কাঁদা থাকে সবসময়। আজ বিকেলে মেলায় যাবে ওঁরা সবাই। আহনাফকে দুপুরেই খেতে আসতে বলেছেন আনজুম বেগম। খাওয়াদাওয়া শেষে একসাথেই চারজন মেলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।

” কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ”
মেহেককে ঘরে ঢুকতে দেখে ঘুম ঘুম চোখে শুধালো রোশন। মেহেক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়ে পরিপাটি করতে ব্যস্ত।
” ঘরের কাজ করেছি। আপনি উঠবেন এখন? তাহলে ভাত দেবো। ”
রোশন হাই তুলে বিছানা থেকে উঠে বসলো। সেন্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরনে ওর। রাতে বৃষ্টি হলে কম্বল মুড়ি দিয়ে ফ্যান চালিয়ে ঘুমানো রোশনের অভ্যাস। কিন্তু তাতে আবার মিষ্টির ঝামেলা হয়। অসময়ে কম্বল মুড়ি দেওয়া ভালো লাগে না ওর। আর বৃষ্টি হলে ঠান্ডা লাগে, ফ্যান চললে তো ঠান্ডা আরো বেশি লাগে!
” যা লাগবে তাই দাও। ভাত খেতে তো আসিনি শ্বশুরবাড়ি। ”
রোশন ইতিমধ্যে খাট থেকে নেমে মেহেকের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হালকা গোলাপি রঙের থ্রিপিস পরনে মেহেকের। এতক্ষণ ধরে চুলগুলো খোঁপা করেছে কেবল। রোশন হুট করেই সেই খোঁপা খুলে দিয়ে কোলে তুলে নিলো ওকে। চমকাল মেহেক।
” এই কী করছেন সকালবেলা! ”
” কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছি। ”
” আমি এখন শোবো না। সাতটা বাজে, একটু পরই মা,বোন খেতে চাইবে। ”
রোশন মিষ্টির কোনো আপত্তি শোনে না। আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও মেহেকের পাশে শুয়ে কম্বল মুড়ি দেয়।
” আটটার আগে কেউ খাবার খায় না। আর উনারা নিজেরাও তো খাবার খেতে পারেন! তোমাকে সব সময় দিতে হবে কেনো? এটা তোমার বাবার বাড়ি তবুও এতো কাজকর্ম কেন করো! মেলা থেকে ফিরেই বাড়ি চলে যাবো। মিষ্টির বিয়েতে অনেক দেরি। তখন আবার আসবো আমরা। ”
রোশনের কথায় কিছু বলে না মেহেক। অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসব কাজের সাথে। তাই আনজুম বেগম এখন কাজ করতে বারণ করলেও শোনে না।

” কী ভাবছো?”
” উম…কিছু না। ”
রোশন মেহেককে জড়িয়ে ধরে দুষ্টমি করে চোখ টিপ্পনী কেটে বলে,
” কিছু ভাবতেও হবে না। ”
” মানে….”
মেহেক কথা শেষ করতে পারলো না। রোশন তার আগেই মেহেকের ঠোঁটগুলি নিজের দখলে নিয়ে নিলো। আকস্মিক ঘটনায় চমকাল, থমকাল মেয়েটা। হাত দিয়ে সরাতে চাইলেও রোশন ছাড়লো না। সময় নিয়ে প্রেয়সীর ওষ্ঠের মোহে মোহাবিষ্ট হতে লাগলো। কিয়ৎক্ষণ বাদে রোশন থামলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে মেহেক। রোশন প্রিয়তমার বক্ষে মাথা রেখে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।
” এতটুকুই সহ্য করতে পারো না! কীভাবে বাকিটা সইবে সুন্দরী? ”
মেহেক রোশনকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে দিলো। দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,
” ভালো হোন। ভালো হতে পয়সা লাগে না। ”
” আদর লাগে.. বউদের আদর…..”
মেহেক আর ছুটি পেলো না আজ। রোশনের ডাকে সাড়া না দিয়ে কী আর উপায় থাকে!

দুপুরের কড়া রোদে হাসফাস লাগছে সবার। সবুর হোসেন খাওয়াদাওয়া শেষে বাইরে চেয়ার পেতে বসেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই রোদের মধ্যেও হুটহাট ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আগমন ঘটছে। বর্ষাকাল সবুর হোসেনের জন্য বেদনাদায়ক। এই বর্ষায় এসেছিল কেউ তার জীবনে আবার এই বর্ষায়ই! সবুর হোসেন দূর আকাশে দৃষ্টিপাত করতেই সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল…

ঝুৃম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বন্ধুদের সাথে নৌকায় ঘুরতে বের হয়েছে রোজী। পলাশ, রোজী আর পায়েল ওঁরা তিনজন। সবাই অনার্স শেষ করেছে কেবল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করা ওদের স্বভাব। সবাই রাজশাহীতে থাকে।
” ভাইয়া এই ছোটো নদীর ভেতরের রাস্তাটা কোথায় যায়? ”
পলাশের প্রশ্নে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো মাঝি কালাম। কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন,
” ওইদিকে কেউ যায় না সচারাচর। শোনা যায় ওই জঙ্গলে ডাকাতদের বসবাস। ”
ডাকাতের কথা শুনে ওরা তিনজন একসাথে হেসে উঠলো। রোজী কিছুটা হেসেই বললো,
” তাহলে চলুন তো, দেখি কেমন ডাকাতদের আস্তানা ওখানে! এই ছোটো জঙ্গলে আবার ডাকাত! ”
কালাম প্রথম প্রথম রাজি না হলেও পরে মোটা টাকার কথা শুনে রাজি হয়ে যায়। বড়ো নদীর পথ রেখে সরু নদীর পথ ধরে মাঝি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা জঙ্গলে ঘেরা খালের মতো একটা জায়গায় এসে পৌঁছে। আচমকা গুলির আওয়াজে নড়েচড়ে ওঠে সবাই। কালাম কিছু না বলেই দ্রুত পানিতে ঝাপ দেয়। ওরা তিনজন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে নৌকার ছাউনির নিচে বসে থাকে।
______________
” বস! বস!”
হঠাৎ শান্তর কণ্ঠস্বর শুনে নড়েচড়ে উঠেন সবুর হোসেন। কল্পনার জগতে হারিয়ে ছিলেন ভেবে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি কথা বলতে লাগলেন।
” হ্যাঁ বল। ”
” শুনলাম রোশন ভাই নাকি বিকেলে আশেপাশের কোনো গ্রামে মেলায় যাবে। ”
” মেলা! কিন্তু যদি কোনো ঝামেলা হয়?”
” সেটাই তো ভাবছি।”
রোশনের বাবা একটু ভেবে শান্তকে বললেন,
” রোশন যখন যাবে ভেবেছে নিজের সেফটি বজায় রেখেই যাবে। তবুও লিমনকে নিয়ে তুইও চলে যাস না হয়। মেলাও দেখলি আর কোনো ঝামেলা হলেও সামলে নিবি।”
শান্ত মৃদু হেসে রাজি হলো সবুরের কথায়।

বিকেলের ম্লান রোদে মেহেক, রোশন, আহনাফ, মিষ্টি অটোরিকশায় করে মেলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। উদ্দেশ্য সন্ধ্যার পরপর মেলায় ঢোকা। কারণ তখন আর কোনো দলের লোক কিংবা প্রশাসনের লোক রোশনকে খেয়াল করতে পারবে না। ড্রাইভারের সাথে বসেছে আহনাফ আর মিষ্টি, মেহেক আর রোশন পেছনের সিটে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া মিষ্টিদের সাথে করেছিল আহনাফ। সত্যি বলতে এতবছর পর যে কাউকে বিয়ে করবে কখনো ভাবতেও পারেনি আহনাফ। কিন্তু সেই কাজটাই এখন করবে সে। এসব ভেবে একা একা মুচকি হাসছে সে।
” কী ব্যাপার আমাদের মিষ্টির আহনাফ স্যার? মুচকি মুচকি হাসছেন! তা-ও একা একা?”
রোশন হেসে হেসে বললো কথাটা। সামনের আয়নায় আহনাফের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
” না মানে এমনি…”
মেহেক আর রোশন দু’জনেই আহনাফের অবস্থা দেখে হাসছে। মিষ্টিও লজ্জা পাচ্ছে। মাথা নিচু করে আছে সে।
” হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি তো। সবই এ..ম..নি!”
রোশন লম্বা করে টেনে টেনে বললো শেষ কথাটা। এরমধ্যে গাড়ি থেমে গেলো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে মেহেক বললো,
” আমরা এসে গেছি।”
সবাই একে একে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। আহনাফ খুব করে চাইলেও রোশনই ভাড়া দিলো। মাগরিবের আজান হচ্ছে। মেলার গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপু, এতগুলো বছর পর আবারো মেলায় এসেছি! ”
মিষ্টির চোখেমুখে বিস্ময়ের ছিটে। আহনাফ আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
” হ্যাঁ বোন। চল ভেতরে যাই। ”
” হ্যাঁ চলো। ”

চারজনে একসাথে মেলার ভেতর প্রবেশ করে। হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট ফুঁকছে রোশন। আহনাফ আর মিষ্টি নিজেদের মধ্যে মেলার প্রসঙ্গে টুকটাক কথা বলছে। রোশন মেহেকের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুযোগ বুঝে মেহেকের ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলো। মেহেক একবার ছাড়াতে চাইলেও ছাড়াতে পারছেনা।
” কী করছেন? ওরা আছে তো সাথে। ”
” তাতে কী! আমার বউয়ের হাত আমি ধরেছি। তাছাড়া ওঁরা তো তোমার মতো আনরোমান্টিক না।”
রোশন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললো কথাটা। মেহেক চোখ পাকিয়ে তাকাতেই সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটুকু মাটিতে ফেলে দিয়ে মিটিমিটি হেসে আবারো বলে রোশন,
” অমনি না তাকিয়ে বললেই তো হয়, আমার হট এন্ড হ্যান্ডসাম বর সিগারেট খেও না। ”
” আপনি আপনার মুখটা বন্ধ করুন এবার। ”
রোশন ঠোঁটে আঙুল চেপে হাঁটতে লাগলো। মেহেক ওর কাজকর্ম দেখে ফিক করে হেসে উঠতেই রোশনও হেসে উঠলো।

মেলায় ঢুকতেই মিষ্টি আর মেহেকের নজর পড়লো কাঁচের রঙবেরঙে চুড়ির দিকে। মিষ্টি একপ্রকার দৌড়ে গেলো দোকানের সামনে। আসলে একসাথে এতো চুড়ি এমনি বাজারের দোকানে দেখেনি কখনো।
” আপু এদিকে এসো। দেখো কী সুন্দর চুড়ি! ”
মিষ্টির হাসি হাসি মুখখানার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহনাফ। মেয়েটা কতটা প্রাণচঞ্চল। অথচ মাঝে মধ্যে আনমনে কীসব ভাবে। হয়তো পুরনো ক্ষত মনে পড়ে যায়! মেহেকও মিষ্টির পাশে গিয়ে বসলো। মাটিতেই হোগলা জাতীয় কিছুতে চুড়ি গুলো সাজিয়ে রাখা। দু’জনে চুড়ি দেখছে।

চলবে,

#নীরবে_নিভৃতে
#পর্ব_৩১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” কী হলো? দুই বোন কি চুড়ি শুধু দেখেই যাবে? না-কি কিনবেও!”
রোশনের কথায় মেহেক ভেংচি কাটলো। মিষ্টি হেসে বললো,
” হ্যাঁ কিনবো তো ভাইয়া। আপু তুমি এই লাল চুড়ি গুলো নাও না? ”
” লাল? ”
মেহেক ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো। রোশন মাঝখানে বলে উঠে,
” হ্যাঁ লাল। এখন লাল রেশমি চুড়ি পরে আমার সাথে ঘুরবে মেলায়।”
আহনাফ রোশনের কথায় ঠোঁট টিপে হাসছে। লোকটা কতটা ঠোঁটকাটা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মেহেক। কথা বাড়ালে হয়তো আরো বেফাঁস কথাবার্তা শুরু করবে রোশন, সেসব ভেবে মেহেক চুপচাপ এক ডজন লাল চুড়ি হাতে নিলো।

” এক ডজন নিবেন আফা?”
দোকানদার মাঝবয়েসী, তবে হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। হেসে হেসে কথা বলছেন। মেহেক কিছু বলার আগেই মিষ্টি বলে,
” চার ডজন দিন চাচা। আমার জন্য গোলাপি, সাদা আর আপুর জন্য লাল আর নীল রঙের। ”
মেহেকের প্রিয় রঙ নীল সেটা ভালো করেই জানে মিষ্টি।
” আচ্ছা আফা।”
দোকানদার চুড়ি প্যাকেট করে দিলেন। আহনাফ টাকা দিতে চাইলেও রোশন দিতে দিলো না। বয়সে ছোটো হলেও সম্পর্কে বড়ো হওয়ায় রোশনের জোড়াজুড়ির সাথে আহনাফ ঠিক পেরে উঠছে না। চুড়ির দোকান থেকে বেরিয়ে ওরা সামনে এগোচ্ছে। আহনাফ আর মিষ্টি আগের মতোই মেলা সংক্রান্ত কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেছে। মেহেকও আশেপাশে দেখতে দেখতে হাঁটছে। হঠাৎ রোশন মেহেকের হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেলো।
” কী হলো?”
” দাঁড়াও একটু।”
রোশন মেহেকের ওড়না আরেকটু প্রসারিত পকেট থেকে একটা সেফটিপিন বের করে কাঁধে আঁটকে দিলো। জরজেট থ্রিপিস বলে বারবার ওড়না পড়ে যাচ্ছিল। মেহেক চুপচাপ লোকটার কান্ড দেখলো। এতো কেয়ার করে কেন লোকটা? মেহেক মৃদু হেসে শুধালো,
” এখন যাই?”
” না, আরেকটু… ”
চুড়ির প্যাকেট থেকে লাল রঙের চুড়ি ডজন বের করে সেগুলো মেহেকের হাতে পরিয়ে দিলো। সবুজ আর লাল রঙের থ্রিপিস পরনে মেহেকের, সাথে সবুজ রঙের হিজাব।
” এখন ঠিক আছে। চলো সুন্দরী। ”
” চলুন ডাকাত সাহেব…উঁহু হট বয়!”
মেহেক ফিক করে হেসে উঠলো কথাটা শেষ করে। বউয়ের মুখে হট বয় কথাটা শুনে রোশন তো বেজায় খুশি। মুহুর্তেই কোমরে হাত দিয়ে মেহেককে বুকের সাথে টেনে নিয়ে বললো,
” মুড হচ্ছে নাকি? চলো বাড়ি যাই…”
মেহেক রোশনকে সরিয়ে দিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে।
” আপনি একটা পাগল। এটা মেলা! চলুন..”

মেহেক হাঁটতে শুরু করেছে। রোশন জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বউয়ের প্রেমে স্থানকালের জ্ঞানও লোপ পেয়েছে তার। সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো সে,
” সরি সুন্দরী। আসলে তোমার মুখে এতোদিনে নিজের এতো সুন্দর প্রশংসা শুনে না মনটা নেচে উঠেছিল।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছে। চলুন এখন। ওরা অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে। ”
” ওকে!”
দু’জনে এগোলো সামনে। রাত দশটা পর্যন্ত মেলায় ঘুরাঘুরি করলো চারজন। এরমধ্যে বেশকিছু জিনিসপত্র কিনেছে। যেমন – রেশমি চুড়ি, মাটির জিনিসপত্র, শাড়ি, পাঞ্জাবি, আরো টুকটাক কিছু। তারপর বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে এসেছে। মিষ্টির তো এরমধ্যেই চোখে ঘুম নেমেছে। মেহেকের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে বেচারি। পুরো মেলায় থাকাকালীন সময় লিমন আর শান্ত দূর থেকে ওদের উপর নজর রেখেছিল। কিন্তু সেটা রোশন নিজেও টের পায়নি।
” মেহেক মিষ্টি কি সত্যি ঘুমিয়ে গেছে? ”
সামনের সিট থেকে পেছনে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে আহনাফ। মেহেক মিষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করে নিশ্চিত হয়ে বলে,
” হ্যাঁ ভাইয়া। ”
” মাথা ব্যথা করেছিল বললো তখন। সেজন্য হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। ”
” চিন্তা নেই। বাড়ি গিয়ে ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। ”
” তা ঠিক। তা রোশন কোনো সমস্যা হলে বলবে কিন্তু। ”
আহনাফের কথার মানে রোশন বুঝতে পেরেছে।
” ভাবছি কালকে চলে যাবো। রিস্ক নিয়ে থাকা ঠিক হবে না। তাছাড়া তোমাদের বিয়ের তো অনেক দেরি! ”
আহনাফের মুখটা শুকিয়ে গেলো। বিয়েটা এতোদিন পর কেনো?
” হ্যাঁ। যা ভালো হয় করো। কিন্তু আমি ভাবছি এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কি জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়? মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতেও পারো না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোশন। সত্যি বলতে এই কয়মাসে ও নিজেও এসব ভেবেছে। এরকম জীবন আর চায় না রোশন। মেহেককে নিয়ে সুন্দর, স্বাভাবিক একটা জীবন চায়। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব হবে বুঝতে পারছে না। সবকিছু ছেড়ে দিলেও প্রশাসন তো ছাড়বে না! গাড়ি থেমে যাওয়াতে প্রসঙ্গ বদলে যায়। আহনাফের বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে। ও এখান থেকে নেমে যাবে। মিষ্টির দিকে একঝলক তাকিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে এগোলো আহনাফ। এখান থেকে মিনিট সাতেক পরে মিষ্টিদের বাড়ির সামনে পৌঁছুবে।

” এসেছিস আহনাফ? এদিকে আয় তো।”
বাবার ডাকে বসার ঘরেই দাঁড়িয়ে গেলো আহনাফ। আহনাফের চাচা,চাচিও বসে আছেন। আহনাফ অন্য একটা সোফায় বসলো।
” হ্যাঁ বাবা। ফ্রেশ হয়ে এসে শুনি?”
” তেমন কোনো কথা নেই। শুধু একটা মতামত নেওয়ার জন্য। ”
” হ্যাঁ বলো তাহলে।”
আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে আছে। কথা শেষ হতেই গোসল করতে ছুটবে। গরমে অসহ্য লাগছে।
” তোর চাচা, চাচি বলছিল বিয়েটা এই মাসের মধ্যে দিয়ে দিতে। মাস দুয়েক পরে ওরা ঢাকা চলে যাবে। ”
আহনাফ চমকাল একটু। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
” তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো। আমার কোনো সমস্যা নেই। এখন আসছি। বাকি কথা খেতে খেতে হবে। ছোটো মা খাবার রেডি করো।”
আহনাফ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে। আহনাফের চাচি মুচকি হেসে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলেন।

মেলা থেকে কিনে আনা জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখছে মেহেক। রোশন শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে। একটা ইংরেজি আর্টিকেল পড়তে পড়তে সেদিকে খেয়াল চলে গেছে। মাঝে মধ্যে রোশনের অবাক লাগে। কীভাবে এই কঠিন ইংরেজি পড়তে পারে ও? লেখাপড়া করার কোনো চিত্র ওর মানসপটে ভেসে ওঠে না কখনো।
” কী দেখছেন ফোনে? এদিকে আসুন একবার। ”
মেহেকের ডাকে নড়েচড়ে উঠলো রোশন। পাশে তাকিয়ে দেখলো হাতে পাঞ্জাবি নিয়ে ডাকছে মেহেক। ড্রেসিং টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে আছে মেহেক।
” বাসর করতে চাইছো সুন্দরী? পাঞ্জাবি পরে আরেকবার বাসররাত কাটাতে কোনো আপত্তি নেই আমার। ”
মেহেকের সামনে ঝুঁকে হাসছে রোশন। মেহেক নিজেও হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবিটা রোশনের গায়ে জড়িয়ে ধরে দেখে বললো,
” সুন্দর লাগছে। পাঞ্জাবি পরেন না কেনো?”
” এমনিতেই। জঙ্গলে থাকি, করি ডাকাতি! পাঞ্জাবি পরে কী করবো সুন্দরী? ”
” এখন থেকে পরবেন।”
” যো হুকুম মেরি বিবিজান। এখন পরতে হবে? ”
মেহেক মাথা নেড়ে হু বললো। রোশন হেসে পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে বললো,
” আমি পাঞ্জাবি পরলে তোমাকেও শাড়ি পরতে হবে। আর একটা কথা.. ”
কোমরে হাত দিয়ে মেহেককে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলে বললো রোশন। মেহেক কণ্ঠ খাদে নামিয়ে শুধালো,
” কী?”
” সুন্দরী বউকে শাড়ি পরা দেখে যদি দুষ্ট বর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আমার কিন্তু কোনো দোষ নেই। ”
” আপনি একটা বজ্জাত লোক।”
বউয়ের নাকের ডগায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে জোরে হেসে উঠলো রোশন।
” হ্যাঁ তা ঠিক। তুমি এখানেই শাড়ি পরে নাও। আমি একটু পর আসছি।”
হাতে পাঞ্জাবি নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে উদ্যত হলো রোশন।
” আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
” আসছি একটু পর। এতো টেনশন করো না সুন্দরী, প্রেমে পড়ে যাবে আমার। ”
চোখ টিপ্পনী কেটে বললো রোশন। মেহেক ভেংচি কাটলো।
” হ্যাঁ আমার ঠেকা পড়ছে। ”
রোশন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মেহেক একা একা হাসতে লাগলো। ভালোই লাগে লোকটার দুষ্টমি।

❝ কেনো মেঘ আসে
হৃদয় আকাশে
মোহমেঘে তোমারে
দেখিতে দেয় না।❞

স্মৃতির পাতায় গানটা খুব স্পষ্ট সবুরের। এখন রাত আড়াইটার কাছাকাছি। রোজীর কথা ভীষণ মনে পড়ছে আজ। একটা মানুষকে তীব্রভাবে ভালোবেসে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না সে কি ভীষণ যন্ত্রণা তা প্রতিদিন টের পায় সবুর। ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার তীব্র বাসনা আজীবন একরকম থাকে। হোক সেটা যৌবনে কিংবা বৃদ্ধ কালে। রোজীর উপর কোনো রাগ অভিমান নেই উনার। শুধু আছে ভালোবাসা…..

চলবে,