নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০২

0
10

#নীল_কৃষ্ণচূড়া
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

২.

প্রত্যুষ চেয়ার টেনে বসলো।তেতো মুখ করে বলল——“তুই ঐ ছেলেকে দেখেছিস অনু?”

অনু ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।
——“ভালো হয়েছে দেখিসনি।খুবই বিশ্রী দেখতে।তোর সাথে তাকে কল্পনা করেই আমার মন খারাপ হচ্ছে।”

জয়া বিরক্ত হয়ে বলল——-“প্রত্যুষ তুমি থামবে?ভালো কাজ তো কিছু করতে পারো না।পারো কেবল সবকিছুতে ঝামেলা করতে।”

প্রত্যুষ অবিশ্বাসের সুরে বলল——“কি?আমি?আমি ঝামেলা করি?”

প্রজ্ঞা দুই কদম সামনে এসে দু’হাত বগলদাবা করে বলল—–“অবশ্যই।অনুর সিদ্ধান্ত অনুকে নিতে দাও।সে কাকে কি করবে,এ নিয়ে তোমার এতো মাথাব্যথা কেন?”

প্রত্যুষ ভ্রু কুঁচকে বলল——“অবশ্যই আমার মাথা ব্যথা।তুমি যেমন অনুর ভালো ভাবো,আমিও ভাবি।বেশি বকবক করো না।বিরক্ত লাগে।”

প্রত্যুষ আবারো সামনে তাকাল।সামান্য ঝুঁকে এসে পুরু স্বরে বলল——“অনু! তুই একটু খুলে বল তো আমাকে,তোর এমন কিসের ইমার্জেন্সি হচ্ছে?যে তুই লাফিয়ে লাফিয়ে বিয়ে করতে চাইছিস?”

অনু কলম চালায়।লিখে জানায়——-“বাবার সিদ্ধান্ত।কি করবো আমি?”

———“কি করবি মানে?বলবি যে তুই পড়বি।এটা একটা বিয়ের সময় হলো?বয়স কতো তোর?এখনো নাক টিপলে দুধ বের হয়।”

স্মৃতি বিরোধ করে বলল——-“এটা ভুল।নবজাতক শিশু বাদে কারো নাক টিপলে দুধ বের হয় না।”

——-“ধ্যাত! চুপ করো তো তুমি।এতো লজিক শুনতে চাই নি আমি।”

প্রত্যুষের মুখটা বিরক্তিতে ছোট হয়ে এলো।সে নাক সিটকে বলল——“অল্প বয়সে বিয়ে করলে জামাই মারে।সত্যি কথা।বাড়িয়ে বলছি না।আর পড়ালেখা করে বড়ো হয়ে বিয়ে করলে জামাই অনেক মেপে মেপে চলে।আদর করে,কিন্তু মারে না।”

জয়া বলল——-“এই ফালতু যুক্তি কি তুমি বানালে?”

——-“ফালতু না।একদম সলিড যুক্তি।মেরুদণ্ড শক্ত না হলে তেলাপোকাও লাথি মারবে।সুতরাং অনুর উচিত আগে পড়ালেখা শেষ করা এবং মেরুদন্ড শক্ত করা।”

কাবেরী ঘরে এসেই অনিমার খোঁজ করলেন।সে খাটের একপাশে সংকুচিত হয়ে বসেছিল।কাবেরী বললেন——-“চলো অনু।আসিফ তোমার সাথে একটু কথা বলবে।”

অনিমা নড়েচড়ে মায়ের দিকে তাকালো।দুইবার পলক ঝাপ্টে শিথিল হয়ে বসলো।প্রত্যুষ দুই চোখ সরু করে বলল——-“আসিফ কে?”

কাবেরী তাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন।গম্ভীর হয়ে কেবল বললেন——–“অনুর হবু বর।”

প্রত্যুষ গা দুলিয়ে হাসলো।দুই হাত এক করে বলল——-“ঐ ছুলা মুরগির নাম তাহলে আসিফ?”

কাবেরী চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকালেন।প্রত্যুষের তাতে ভাবোদয় হলো না।সে আগের মতোই হেলেদুলে বলল———“আসলে ভেবে দেখলাম,দুনিয়াতে কেউ ই ভালো না।আমার মা আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছে বলে এতো অবজ্ঞা করে।আর অনু কথা বলতে পারে না দেখে তোমরাও তাকে অবজ্ঞা করো।এটা আসলে খুবই কষ্টের ব্যাপার।কষ্টের ব্যাপার হলেও আমার এতে হাসি পাচ্ছে।”

বলেই প্রত্যুষ শব্দ করে হাসল।কাবেরী কিছুক্ষণ স্থির নয়নে তাকে দেখলেন।অনিমার চোখ আর্দ্র হলো সহসা।সে কাগজটা হাতে নিয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো।প্রত্যুষকে এক প্রকার উপেক্ষা করেই সে কাবেরীর দিকে এগিয়ে গেল।কাবেরী মলিন হয়ে বললেন——–“তুমি কি মন খারাপ করেছো অনু?”

অনু শুধু মাথা নাড়ে।মন খারাপ কেন করবে?প্রত্যুষ ছেলেটা ওমনই।অনিমা তার কাছে খুব বেশি ভালো কিছুর প্রত্যাশাও রাখে না।

সে যেতেই প্রত্যুষ অবাক হয়ে বলল——-“যাহ্ শালা! পাত্তাই দিলো না আমার কথা।”

প্রজ্ঞা মুখ বাঁকা করে বলল——“এতো দিনে একটা কাজের কাজ করেছে অনু।”

প্রত্যুষ যেন বিরক্ত হলো ভীষণ।মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ করে সে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো।প্রজ্ঞা চোখ রাঙিয়ে বলল——–“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

——-“আর কোথায়?অনুর কাছে।”

——-“সেখানে তোমার কাজ কি?”

প্রত্যুষ ঘাড় ঘুরালো।মেজাজ করে বলল—-“আমি অনুর ট্রান্সলেটর।সে আমাকে ইশারায় বলবে।আর আমি আসিফ কে সেটা ট্রান্সলেট করে শোনাবো।”

——–“অনু তোমার কাছে সাহায্য চেয়েছে?”

——–“আমি ভালো ঘরের ছেলে।নিজ থেকেই সাহায্য করি।কারো চাইবার অপেক্ষা করি না।”

সে আগের মতোই ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।জয়া বিমুঢ় হয়ে বলল——“এই ছেলের মাথায় সমস্যা।”

প্রত্যুষের মাথায় সমস্যা,এ কথা অবশ্য প্রত্যুষ নিজেও কম বেশি বিশ্বাস করে।এই যেমন অনুকে বিয়ে করার কথা শুনতেই তার পুরো শরীর অপমানে ঝলসে গেল।আবার সেই অনুর অন্য জায়গায় বিয়ে হবে শুনেই তার মেজাজ বিগড়ে গেল।অনিমার বিয়ে।এটাও কি সম্ভব?অনিমার বিয়ে হলে কুঞ্জবিতানে আর কি ই বা অবশিষ্ট থাকবে?

____

অনিমা এবং আসিফকে কথা বলার জন্য দোতালার একটি ঘর দেওয়া হলো।অনিমা সেখানে গিয়েই সৌজন্য সূচক হাসল।আসিফ নিজেও সামান্য হাসল।বলল—–“কেমন আছো অনিমা?এসো বসো।”

অনিমা হাতে থাকা কাগজের দিকে তাকালো।ঠিক তখনই প্রত্যুষ হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো।না কোনো অনুমতি,না কোনো জিজ্ঞাসা,না কোনো শিষ্টাচার।সে এসেই বুক টান টান করে দাঁড়ালো।তাকে দেখতেই অনিমার মুখ চুপসে এলো,বিরক্তিতে ভাঁজ হলো কপাল।আসিফের প্রশ্নাত্মক চাহনি দেখতেই প্রত্যুষ নিখাঁদ স্বরে বলল———“আমি প্রত্যুষ।অনুর খালাতো ভাই।তার গার্ডিয়ান।”

আসিফ মাথা নাড়লো।উঠে দাঁড়িয়ে সামনে হাত বাড়িয়ে বলল——“ওহহহ নাইস টু মিট ইউ।”

প্রত্যুষ তার হাতের দিকে তাকালো।হাতে একটা সিলভার চেইনের ঘড়ি জ্বলজ্বল করছে।সে আর হাত মেলালো না।সোজা হেঁটে অনিমা থেকে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসে বলল——-“আসলে অনু নতুন মানুষের সাথে কথা বলতে ভয় পায়।আমি বলেছি,আসিফ সাহেব তো খুব ভালো।কোনো ভয় নেই।কিন্তু সে শুনলো না।অনেক জোর করল আমাকে আসার জন্য।তাই আমি আর না এসে পারলাম না।আপনি কিছু মনে করেন নি তো?”

——-“জ্বী না।আমি কিছু মনে করি নি।ভালোই হলো আপনি এলেন।”

অনিমা কটমট করে একবার প্রত্যুষের দিকে তাকালো।তাড়াতাড়ি কলমের ক্যাপ খুলে কাগজে লিখলো—–

“মিথ্যা কথা।সে মিথ্যা বলছে।আমি তাকে আসতে বলিনি।সে নিজে এসেছে।ও অনেক মিথ্যা কথা বলে।ওর কথা বিশ্বাস করবেন না।”

সে কাগজটা আসিফ কে দেখানোর আগেই প্রত্যুষ সেটা ছোঁ মেরে নিজের হাতে নিল।তারপর অনিমাকে দেখে আদুরে গলায় বলল——-“না না অনু।এভাবে বলতে নেই।সবাই তো মানুষ।আল্লাহই তো বানায় সবাইকে।”

অনিমা হতবুদ্ধি হয়ে পিটপিট করে তার দিকে তাকালো।তার ফ্যালফ্যাল চাহনি তে প্রত্যুষ নিজেই সামান্য হেসে ফেলল।আসিফ কাচুমাচু হয়ে বলল——“কি বলেছে অনিমা?”

প্রত্যুষের ঠোঁটে কুটিল হাসি।অনিমা তার হাত খাঁমচে ধরে চোখ পাকালো।প্রত্যুষ সেই হাত এক ঝাড়ায় ছাড়িয়ে নিল।কাগজটা খুলে রিডিং পড়ার মতো করে বলল—–“অনু লিখেছে-
প্রত্যুষ ভাই! এই লোকটাকে আমার একদমই পছন্দ হয়নি।এমন ধলা মুরগির মতো গায়ের রং,আর ছুলা মুরগির মতো চেহারার লোককে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।তুমি প্লিজ তাকে না করে দাও।”

প্রত্যুষ পড়া শেষ করে কাগজটা একহাতে মুচড়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারল।ঈষৎ হেসে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে বলল——-“নেভার মাইন্ড আসিফ।বাচ্চা মানুষ তো।বুঝে নাই।”

আসিফ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।সে যেমন করে বসেছিল,সেভাবেই বসে থাকলো।শুধু অনিমার ঠোঁট ভেঙে কান্না এসে গেল।সে জোরে জোরে ডানে বায়ে মাথা নাড়ল।হাত নেড়ে বুঝালো সে এমন কিছুই করে নি।প্রত্যুষ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল——-“আহা অনু! ভয় পায় না।আসিফ সাহেব খুব ভালো মানুষ।সে খাম্মা আর খালুকে এসব কিছুই বলবে না।তুই এতো ভয় পাস নে।”

অনিমা এবার সত্যিই ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।আসিফ কথা না বাড়িয়ে সোফা থেকে উঠে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।সে যেতেই অনিমা এক থাবায় প্রত্যুষের মাথায় চুল খাবলে ধরল।দুই হাতে তার চুল টেনে সে আক্ষরিক অর্থেই বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে উঠল।

প্রত্যুষ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।খিলখিলিয়ে খাটের উপর গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল——–“একটা কথা আছে না?বোবার কোনো শত্রু নাই।কথাটা আসলে ঠিক না।আমার মতো পালিত খালাতো ভাই থাকলে বোবারও শত্রু থাকে।”
সে আরো কতোক্ষণ হেসে কুটি কুটি হলো।অনিমা হাতের আঙুলে ইশারা করে বলল——–“তোমার মতো লোকের জীবনেও বিয়ে হবে না।”

——“হেহেহে।আমি চাইও না আমার বিয়ে হোক।তোর মতো অল্প বয়সে বিয়ের শখ আমার নাই।”

অনিমা হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।প্রত্যুষ আরো কিছু সময় খাটের উপর শুয়ে থাকল।শুয়ে থাকতে থাকতেই সে কেমন যে অন্যমনস্ক হয়ে উঠল।মনে হলো কিছু একটা যেন তার নেই।খুব দূরে,অনন্ত মহাকাশে প্রত্যুষ কিছু একটা হারিয়ে এসেছে।যার নাগাল সে অনেক চেষ্টার পরেও পায়নি।

_______

সেদিন পাত্রপক্ষ থেকে নেতিবাচক কোনো কথাই অনিমার কানে আসে নি।তারা রাতে খেয়ে খুব হাসিমুখে বিদায় নিল।নাজির সাহেব মোটামুটি ধরেই নিলেন যে বিয়েটা হচ্ছে।বাড়িতেও একটা হইহই অবস্থা।শুধু প্রত্যুষ মুখটা এতোটুকু করে বসে থাকলো।আসিফ নামের লোকটা এখনো বিয়ে ভাঙেনি কেন?এমন তো হওয়ার কথা না।

জাভেদা তার সামনে এসে তাড়া দিয়ে বললেন——-“এভাবে বসে কি ভাবছো?চলো বাড়ি যাবে।”

——“তুমি কি আমার ভাবনাও নিয়ন্ত্রণ করবে নাকি?রাস্তা থেকে ধরে এনেছো বলে কি আমার ভাবার স্বাধীনতাও নেই?”

জাভেদা হাল ছাড়ার ভঙ্গিতে বললেন——–“তুমি আর আমাকে কতো জ্বালাবে প্রত্যুষ?”

——-“বাহ্! তোমার সাথে দেখি কোনো কথাও বলা যাবে না।ঠিক আছে মিসেস জাভেদা।বলবো না কোনো কথা।”

সে গরজ দেখিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।জাভেদা পেছনের সিটে বসতেই সে জেদ করে বলল——“এ্যাই আম্মু! একটা কথা শুনো।”

——-“কি কথা?”

——-“অনুর ঐ বরটাকে আমার ভালো লাগে নাই।তুমি খাম্মা কে মানা করো প্লিজ।”

জাভেদা আশ্চর্য হয়ে বললেন——“কি অদ্ভুত! কেন?”

——–“কারণ ঐ লোককে আমার ভালো লাগে না।”

——-“তোমার ভালো লাগার কি দরকার?ঘর করবে অনু।তার ভালো লাগলেই তো হলো।”

প্রত্যুষ আবারো চুপ মেরে গেল।কিছুক্ষণ ভেবে তারপর মুখ গোমড়া করে বলল——–“আজ যদি তোমার পালা ছেলে না হয়ে আসল ছেলে হতাম,তাহলে তুমি ঠিকই আমার কথা শুনতে।”

জাভেদা উত্তর দিতে গিয়েও আটকে গেলেন।কি যেন একটা গলার কাছে এসে আটকে গেল।তাকে দীর্ঘ সময় নিরব থাকতে দেখে প্রত্যুষ ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকালো।
জাভেদার শূন্য মলিন দৃষ্টি।প্রত্যুষ নিজেও কেমন হকচকিয়ে গেল।তৎক্ষনাৎ সিট ছেড়ে সে জাভেদার একটা হাত লুফে নিল।তাড়াহুড়ো করে বলল——“আম্মু! তুমি কষ্ট পেলে?সরি।প্লিজ আম্মু।কান্না করে না প্লিজ।”

জাভেদা এবার সত্যিই কান্না করলেন।কতোদিনের জমানো কষ্ট! প্রত্যুষ যন্ত্রের মতো নির্বিকার হয়ে তার কান্না দেখে।জাভেদা বললেন———“একটা বাচ্চা…..একটা বাচ্চা কে ছোট থেকে পালতে পালতে এই পর্যন্ত বড়ো করার পর যখন সে এমন আচরণ করে,তখন একটা মায়ের কেমন লাগে,তুমি সেটা বুঝবে না প্রত্যুষ।সেটুকু বুঝলে তুমি কোনোদিন আমাকে এভাবে আঘাত করতে না বার বার।”

প্রত্যুষ নির্নিমেষ চোখে তার কথা শুনে।জাভেদা কিছুটা ধাতস্থ হতেই সে আচমকা সবেগে ছিটকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।সুস্থির,জোড়ালো,আর নিবিড় আলিঙ্গন।জাভেদা পারভীন নিজেই তার আচরণে ভড়কে গেলেন।প্রত্যুষ অস্পষ্ট গলায় বলল——-“এ্যাই আম্মু প্লিজ।আর গভীরে যেও না।আমার ভুল হয়েছে।সরি।”

চলবে-