নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৩

0
36

#নীল_কৃষ্ণচূড়া
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

৩.

আমার বয়স যখন চার,তখন একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে আমি মাথা ফাটিয়ে ফেললাম।তারপর মাথার তালুতে ঠিক ছয়টা সেলাই লাগল।আমি তখন ব্যথায় জর্জরিত।হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে কাতরাতে কাতরাতে কোনোরকমে খাটে গিয়ে বসেছি।বড় বাবা,মেঝো বাবা,দি ভাইরা সবাই আমার সেবায় ব্যস্ত।কেউ যেন ফুলের টোকাও দেয় না আমায়।
ঠিক তখনই একটা ছেলে এসে আমার ব্যান্ডেজ খোঁচাতে খোঁচাতে কৌতূহলী হয়ে বলল——“দেখি দেখি! কয়টা সেলাই লাগলো তোর?আমার না সেলাই দেখতে খুব ভালো লাগে।”

সেই ছেলেটার নাম প্রত্যুষ।আমার মণি মার একমাত্র বাচ্চা।চঞ্চল,ডানপিটে,আবার ক্ষেত্রবিশেষে গম্ভীর।প্রত্যুষ কে আমি আজ পর্যন্ত জীবনের কোনো কিছু নিয়ে বিচলিত কিংবা ভাবুক হতে দেখিনি।খুব করুণ,ট্র্যাজিক মোমেন্টেও সে খিলখিল করে হাসে।তার এই স্বভাবটা আমার পছন্দ,আবার পছন্দ না।

একবার আমার মাম্পস হলো।সে কি গলা ব্যথা আমার! সে বিকেলে বাড়ি এলো মণি মার সাথে।এসেই আমাকে দেখে খিলখিল করে উঠে বলল——“কিরে?তোকে এমন ফটকা মাছের মতো দেখাচ্ছে কেন?ইসসসস! কি বিশ্রী!”
আমি তখন শুধু চোখের পানি ফেলি আর তার কথা শুনি।

এরপর যখন আমার এক্সিডেন্ট হলো,আমি প্রায় নয়দিন হাসপাতালে ছিলাম।প্রত্যুষ ভাইয়ার সাথে আমার তখন দেখা হয়নি।তার সাথে আমার দেখা হয়েছে বাড়িতে আসার পর।সে সময় আমার মানসিক অবস্থা একেবারে ভঙ্গুর।হুটহাট হু হু করে কেঁদে ফেলি।কতো চেষ্টা করি কথা বলার জন্য! কিন্তু কন্ঠনালি থেকে কোনো শব্দ আর বাইরে বেরিয়ে আসে না।
সেই বিপর্যস্ত অবস্থায় প্রত্যুষ ভাইয়া বাড়িতে এলো।এসে আমার ঘরে গিয়ে স্বান্তনা দিলো——–“শোন অনু!
সবকিছুরই ভালো খারাপ দিক আছে।তোর এক্সিডেন্টেরও ভালো খারাপ-দু’টো দিকই আছে।আসলে মানুষের মুখ হলো মানুষের অনেক বড় একটা শত্রু।মুখ দিয়েই আমরা অর্ধেকের বেশি পাপ করি।সেই জায়গায় মানুষটা যদি কথাই বলতে না পারে,তবে তার দ্বারা পাপ হওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম।সেই হিসেবে এটা ভালো।তুই আমাদের মধ্যে সবার আগে জান্নাতে যাবি।কারণ তোর পাপ হবে কম।”

তার এই যুক্তিতে আমার হৃদয় তৃপ্ত হলো না।উল্টো আমি আরেকদফা কেঁদে ভাসালাম।সে হো হো করে উঠে বলল———“কাঁদে না অনু।কেঁদে আর কি হবে বল?এর চেয়ে ভালো একটা আইসক্রিম খাই দু’জন মিলে।”
এরপর সে সত্যিই একটা আইসক্রিম এনে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়।

থামুন থামুন!
এইটুকু পড়ে আবার প্রত্যুষ কে জঘন্য, ইতর আর খারাপ ভাববেন না যেন।এটা হলো মুদ্রার এক পিঠের গল্প।এবার বলি মুদ্রার অন্য পিঠের কথা।যেখানে আহসানুল হক প্রত্যুষ একজন নিরেট ভদ্রলোক,গম্ভীর স্বভাবের মানুষ এবং আপনজনদের প্রতি দারুন যত্নশীল পুরুষ।

__আমার মাথায় যে’বার সেলাই লাগলো,প্রত্যুষ ভাইয়া তখন দুই তিনদিন মণি মার সাথে আমাদের বাড়িতেই ছিলো।আমার সব রকম যত্নে বাড়ির অন্যদের মতো সেও শামিল ছিলো।আম্মু কোনোদিন রাতে আমার পাশে না থাকতে পারলে সে এসে আমার ঘরের ইজি চেয়ারটায় বসতো।
__আমার যখন ব্যান্ডেজ খোলা হলো,তখন আমার চুল পরিষ্কার করতে আব্বু বেশ বেগ পেতো।কারণ আম্মু এসব ভয় পায়।তাই আব্বুর একা একা সব করতে হতো।সেসময় প্রত্যুষ আব্বুর সাথে থেকে আমার যত্ন নিতো।আমি রানীর মতো হেঁটে একটা চেয়ারে গিয়ে বসতাম।চুলগুলো পিঠ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে দিতাম পেছনের দিকে।আব্বু আর প্রত্যুষ তখন খুব যত্ন করে অতি সাবধানী কায়দায় সেখানে পানি ঢেলে আমার চুলে জমাট বাঁধা র’ক্ত পরিষ্কার করে দিতো।প্রত্যুষ কে তখন খুবই গম্ভীর আর শান্ত দেখাতো।সে কিন্তু এসব ব্যাপারে বরাবরই যত্নশীল।

__এরপর যখন আমার মাম্পস হলো,তখন প্রত্যুষ সারারাত ধরে আমার হোমওয়ার্ক করেছে।আমার আর করতে হয়নি কষ্ট করে।বেচারা না ঘুমিয়ে আমার কষ্ট লাঘব করেছে।আমি কিন্তু ঐ দায়িত্বশীল মানুষটাকে বাড়াবাড়ি রকম পছন্দ করি।

__এরপর আমি যখন দুর্ঘটনায় বাকশক্তি হারিয়ে ফেললাম,তখন আব্বু চাইছিলেন আমি যেন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শিখি।তারপর সেভাবেই ইশারায় তাদের সাথে কথা বলি।কিন্তু প্রত্যুষ সাহেবের এটা পছন্দ হলো না।সে বিরোধ করে বলল,”অনুর সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার কোনো দরকার নেই।”

আব্বু বলল—–“তাহলে সে কথা বলবে কিভাবে?”

——“লিখে লিখে।কাগজে লিখে সে সবকিছু বলবে।সে কি বোবা নাকি যে হাত পা নেড়ে কথা বলবে?”

শেষ পর্যন্ত আমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শিখলেও আর সেটা প্রয়োগ করা হয়নি তেমন।আমি লিখে লিখে মনের ভাব জানাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতাম।সবাই সেভাবেই আমার সাথে কথা বলতো।আমার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রত্যুষ ভাইয়ের কাছে বরাবরই বিরক্তিকর।সে আমায় প্রায়শই বোবা বোবা বলে ক্ষেপায়।অথচ আমি যখন সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করি যে আমি বোবা,তখন সেই প্রত্যুষই রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আমার কান টেনে ধরে বলে——-“এক থাপ্পড় দিবো বোবাদের মতো হাত নেড়ে নেড়ে ইশারা করলে।তুই কানে শুনিস না?যা বলবি লিখে লিখে বলবি।”

আমি সেই এক ধমকেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ভূত ছাড়িয়ে হাতে কলম তুলে নিলাম।আমি লিখার পাশাপাশি টুকটাক আঁকতাম।প্রত্যুষ ভাইয়া বাড়িতে এসে মনোযোগী হয়ে সেসব দেখতো।আমার নিরব,নিভৃত,বাকহীন জীবনে সে সর্বদাই আমার বিশ্বস্ত সহচরী।আর ঠিক একারণেই আহসানুল হক প্রত্যুষ আমার অত্যাধিক পছন্দের মানুষদের একজন।সে আমাকে খোঁচা মেরে কথা বললেও আমি গায়ে মাখি না।আমি চুপ করে সুবোধ বালিকার ন্যায় অপেক্ষা করি।যখন সে অসহায় মুখে আমার কাছে ফিরে আসে,আর আমার খাটে হাত পা ছড়িয়ে নিগুঢ় স্বরে বলে———“অনু! অনু রে! আমি ভেবে দেখলাম,তুই আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজিন।আমার মন চায় তোকে সারাদিন গাল টিপে আদর দিতে।তুই আমার বিয়ের আগের প্রথম বাচ্চা।”

এই হলো এক নজরে আহসানুল হক প্রত্যুষ।তাকে নিয়ে আরো অনেক লিখেছি।সামনেও লিখবো।কারণ সে হলো আমার সবচেয়ে কাছের মানুষদের একজন।আমার জন্য আলাদীনের জ্বলজ্বলে স্বর্ণের চেরাগ।আব্বু,বড় বাবা,মেঝো বাবার পর আমি সবচেয়ে বেশি বায়না ধরেছি তার কাছে।এবং সে প্রত্যেকবারই নাক ছিটকে আমরা বায়না ফিরিয়ে দিয়েছে।কিন্তু বললাম না,সব মুদ্রারই তো অন্য পিঠ থাকে।সে যতোই মুখে মুখে আমার সমস্ত আবদারে প্রত্যাখ্যানের সুর তুলুক না কেন,দিন শেষে সে ঠিকই আমাকে আমার পছন্দের জিনিস এনে দিয়েছে।এটাই প্রত্যুষ।এটাই তার স্বরূপ।মানতে পারলে ভালো,না পারলেও কোনো সমস্যা নেই।সে চিরকাল এমনই থাকবে।

আমার সাথে তার সখ্যতা ভালোই গভীর।তার কারণ মণি মা প্রায়ই ছুটির দিনে আমাদের বাড়ি আসতো।সেই থেকে তার সাথে আমার বন্ধুত্ব।বন্ধুত্বই বলছি।কারণ সে সত্যিই আমার বন্ধুর মতো।তার আর আমার বয়সের ব্যবধান সাড়ে ছয়।কিন্তু বহু বছরের চেনা জানায় তাকে আর আমার সেরকম বড় ভাই বড় ভাই মনে হয় না।মনে হয় সে আমার নিরালা,অলস,আর ক্লান্ত দুপুরের একমাত্র সঙ্গী।আমার এলোমেলো আঁকিবুঁকির মনোযোগী দর্শক।আমার নিস্তব্ধ শব্দের গম্ভীর শ্রোতা,আমার শূন্য জীবনের দ্বীপ্তিমান আলোকবাতি।আমি যদি বলি,দিনশেষে আমি তার প্রতি কম বেশি দুর্বল,তবে কি অত্যুক্তি কিংবা বাড়াবাড়ি কিছু হবে?নিজের খুব কাছের মানুষকে নিয়ে কেউ কি দুর্বল হতে পারে না?

অনিমা আহমেদ
১৪ জুলাই,২০১৮
___
অনিমা লিখা শেষে বলপয়েন্টের ক্যাপ বন্ধ করে একমনে লিখাটার দিকে তাকালো।আজ শনিবার।আষাঢ়ের ত্রিশ তারিখ,১৪২৫ বঙ্গাব্দ।

আজকের দিনের কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই।আব্বু সকালে অফিসে চলে গেছে।মা নিচে আমেনা খালার সাথে কাজ করছে।প্রজ্ঞার আজ থেকে সেমিস্টার ফাইনাল শুরু।
জয়া দিভাই গেছে বন্ধুর বাসায়।স্মৃতির সাথে অবশ্য দুই দিন যাবত কথা হচ্ছে না।

অনিমা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে বাইরে তাকালো।বাড়ির সামনের জারুল গাছ ভর্তি গাঢ় বেগুনি ফুলের ছড়াছড়ি।কখনো বা বাতাসের মৃদু দোলায় জমিনে এসে পড়ছে।অনিমা কেশগুচ্ছ কানের পেছনে গুজে নিয়ে আকাশ দেখে।বর্ষার মেঘলা আকাশ।সকালে মেঘ ডাকছিল।আপাতত সব নিরব।শহরের আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি চলছে মাঝামাঝি বেগে।বাড়ির সামনের জায়গায় আরো নানারকম ফুলের গাছ।

অনিমার ধ্যান ভাঙলো মাহাদের কর্কশ ডাকে।সে ঘরে এসেই খ্যাট খ্যাটে গলায় বলল——-“অনু! শুনছিস?তাড়াতাড়ি রেডি হ।”

অনিমা চকিত চোখে তার দিকে তাকায়।আঙুল তুলে ইশারায় প্রশ্ন ছুড়ে।মাহাদ তার মামাতো ভাই।বনানীর ওদিকে থাকে।মামানি অবসর হলে মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে।

অনিমা খাতায় লিখলো——-“তুমি একাই এলে?দিবা কোথায়?”

——–“দিবা নিচে।ফুপ্পি আর মণির সাথে কথা বলে।”

——-“মণি মা এসেছে?”

মাহাদ লিখাটা পড়ে মাথা নেড়ে বলল——–“হ্যাঁ।দুই মিনিট আগে।”

——–“আচ্ছা।কিন্তু তোমরা যাবে কোথায়?”

মাহাদ কলার টেনে আমোদ করে বলল——-“শপিংয়ে বনু।দিবার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শেষ।তাই আজ আমরা গাড়ি দিয়ে পুরো শহর ঘুরবো।”

অনিমা হাঁফ ছেড়ে লিখলো——–“কিন্তু আমার তো টায়ার্ড লাগছে।”

———“আরে চল না।ভালো লাগবে।”

মাহাদ কোমরে হাত রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়াল।মুখজুড়ে বিরক্তির ছড়াছড়ি।অনিমা চোখ বাঁকা করে তার দিকে তাকাতেই সে রাগ হয়ে বলল——“তুই পুরাই একটা নিরামিষ অনু।”

তখনই ঠক ঠক শব্দ করে কেউ ঘরে এসে দাঁড়ালো।অনিমা আড়চোখে সেদিকে তাকালো।যা ভেবেছিল,তাই।প্রত্যুষ এসেছে।মুখে সেই আগের মতো ছন্নছাড়া ভাব।এসেই অনিমার পড়ার টেবিলে হেলান দিয়ে বলল——–“এ্যাই অনু! মুভি দেখতে যাবি?”

অনিমা দুই দিকে মাথা নাড়ল।প্রত্যুষ চোখ পাকিয়ে বলল——-“সে কি! কেন?”

——-“কারণ অনুর নাকি আজ টায়ার্ড লাগছে।”
উত্তরটা মাহাদই দিলো।

প্রত্যুষ মুখ কুঁচকে বলল——“না গেলে নাই।খুব হাইপে থাকা মুভি।আমি দেখবো।”

অনিমা কাগজে লিখলো——–“আমি মাহাদ দের সাথে শপিংয়ে যাবো।”

প্রত্যুষ লিখাটা পড়ে চুপ মেরে গেল।পড়ার টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে গিয়ে বলল——-“আচ্ছা যা।”

মাহাদ বলল——-“তুমিও চলো না।”

——–“আমার শখ নাই।তোরা যা।”

——-“তোমার মুভির কি হলো?

——–“পরের সপ্তাহে দেখবো।”

প্রত্যুষ গম্ভীর হয়ে এদিক সেদিক তাকালো।অন্যমনস্ক আর এলোমেলো চাহনি।অনিমার সাথে চোখাচোখি হতেই সে চোখ সরিয়ে নিল।অনিমা কলম খুলে লিখল——-“তুমি যাবে না কেন?চলো যাই।”

——–“তুই যা।আমার ইচ্ছে নেই।তুই গিয়ে মাহাদ আর দিবা কে ধরে নাচ কিছুক্ষণ।”

প্রত্যুষ আশা করেছিল অনিমা শেষ পর্যন্ত মাহাদদের সাথে ঘুরতে যাবে না।কিন্তু তার সমস্ত ভাবনা কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনিমা বেশ সাগ্রহে মাহাদদের সাথে তাদের গাড়িতে করে বেরিয়ে গেল।প্রত্যুষ নির্নিমেষ চোখে বাড়ির রাস্তা ছেড়ে তাদের গাড়ির প্রস্থান দেখে।তারপর দায়সারা হয়ে অনিমার খাটের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ে।সে ভেবে নিয়েছে,জাভেদা যতোক্ষণ বাড়িতে থাকবে,ততক্ষণ সে এই ঘরে আরাম করে ঘুমাবে।

_____

অনিমারা সেদিন ভালোই ঘুরাঘুরি করল।প্রথমে বসুন্ধরায় কেনাকাটা,তারপর একটা সুন্দর গোছানো রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া।

দিবার মন আজ ভীষণ ভালো।একে তো পরীক্ষা শেষ হওয়ার আনন্দ,অন্যদিকে সবাইকে নিয়ে শহর ভ্রমণ।সে পোর্সিলিনের বাটি থেকে কাঁটা চামচের সাহায্যে সামান্য পাস্তা তুলে নিয়ে বলল——-“আজ আমরা ধানমন্ডি লেকও যাবো কেমন?”

মাহাদ খেতে খেতে বলল——-“সমস্যা নেই।যাওয়া যায়।”

কেবল অনিমা দুই দিকে মাথা নাড়ল।রোকসানা হোসেন মোলায়েম কন্ঠে বললেন———“তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে অনু?”

অনিমা আবার ডানে বায়ে মাথা নাড়ল।ঝটপট লিখে জানাল,তার সমস্যা হচ্ছে না।কিন্তু সে ধানমন্ডি লেক যেতে চায় না।কারণ তার মাথা ব্যথা হচ্ছে।

রোকসানা তার মামানি।বড় মামার বউ।অনিমার খুব প্রিয় মানুষদের তালিকায় রোকসানা একজন।রোকসানা প্রায়ই মাহাদ আর দিবার সাথে তাকে সহ নিয়ে ঘুরতে বের হন।তিনি সহজাত মিষ্টি এবং কোমল স্বভাবের।
তার কথা শুনেই রোকসানা দ্বিধায় পড়ে বললেন——–“সেকি! খারাপ লাগছে?এখনি বাসায় যাবে।”

অনিমা দ্রুত দুই পাশে মাথা নাড়ে।মাহাদ হঠাৎ খাবার থামিয়ে বলল——–“আরে ঐটা প্রত্যুষ ভাই না?”

টেবিলভর্তি মানুষ তার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকালো।প্রত্যুষ সবে লিফট থেকে বেরিয়ে টেনথ ফ্লোরে পা রেখেছে।তার চোখে থাকা রোদ চশমাটির অবস্থান আপাতত তার শার্টের বোতামের কাছাকাছি।অনিমাদের দেখতেই সে গোমড়া মুখে এগিয়ে এলো।

মাহাদ বলল——-“এসো এসো।বসো।”

প্রত্যুষ বসলো না।উল্টা রাগ হয়ে বলল——“বসতে আসি নাই আমি।”

——-“তাহলে?”

——-“আমি কাল রাঙামাটি যাচ্ছি।আব্বুর একটা প্রজেক্টের কাজে।তোদের কে বিদায় জানাতে এলাম।”

দিবা আশ্চর্য হয়ে বলল——-“আগে তো কোনোদিন জানাও নি।”

প্রত্যুষ আচানক খেঁকিয়ে উঠল——–“আগে জানাই নি।আজ জানিয়েছি।তোর কোনো সমস্যা?”

দিবা থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেল।প্রত্যুষ চোখ মুখ শক্ত করে পুরো টেবিলের দিকে তাকালো।ঐ যে টেবিলের এক দিকে বসা মেয়েটা! গায়ে মেরুন কুর্তি।মাথায় শিফনের ওড়না।সে ই তো।তাকে দেখলেই প্রত্যুষের রাগ উঠে।সে আর কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।

নিচের পার্কিং লটে তার বাইক রাখা।রাস্তার এক ধারে সারি সারি হুন্ডা।সে বহুতল ভবন থেকে বেরিয়ে পকেট থেকে বাইকের চাবি বের করল।মেজাজটা হঠাৎ খিটখিটে হয়ে গেছে।অকারণে মন খারাপ হওয়া একটা বাজে বিষয়।মানুষ তখন মন ভালো করার উপায় খুঁজে পায় না।

সে বিষন্ন হয়ে বাইকে বসতেই পেছন থেকে কারো পায়ের শব্দ পেল।আপনাআপনি ঘাড়টা পেছনের দিকে ঘুরে গেল তার।দেখল অনিমা নিরীহ ভঙ্গিতে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।মুখে কোনো হাবভাব নেই।প্রত্যুষের সাথে চোখাচোখি হতেই ইশারায় কিছু একটা বলল।

প্রত্যুষের ভ্রুদ্বয় শিথিল হয়ে এলো।শান্ত হলো মস্তিষ্ক।তবুও কেন যে অনুর উপর অহেতুক রাগ দেখাতে ইচ্ছে হলো।সে বাইক স্টার্ট দিতে দিতে গরজ দেখিয়ে বলল——–“নিবো না তোকে আমার সাথে।তুই দাঁড়িয়ে থাক।মাহাদ আর দিবাকে বল তোকে কোলে করে নিয়ে যেতে।”

সে সত্যিই ভুঁ ভুঁ করে বাইক ছুটিয়ে নিয়ে গেল।যেতে যেতে একবার ফিরেও তাকালো না।অনিমা হতাশ ভঙ্গিতে সামনের রাস্তার দিকে তাকালো।মাথার উপর কড়া রোদ একটু একটু করে তার শক্তি টেনে নিচ্ছে।তবুও সে নড়ল না।অবিচল হয়ে ঠিক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল।

দুই।হাতে গুনে ঠিক দুই মিনিট বাদে আগের মতো শব্দ করে কালো রঙের বাইকটা তার সামনে এসে থামল।প্রত্যুষ হেলমেট খুলে থমথমে মুখে তার দিকে তাকালো।অনিমা তাকে দেখে অবাক হলো না।সে জানতো,প্রত্যুষ আসবে।এইরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে।তাকে দেখালো আগের মতোই নির্বিকার,ভাবলেশহীন।

প্রত্যুষ গাঢ় স্বরে বলল——–“এমন এতিমের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস।তাই করুণা করে সাথে নিচ্ছি।এদিকে আয়।হেলমেট পরাবো।”

অনিমা শম্বুক গতিতে এগিয়ে এলো।প্রত্যুষ হেলমেট পরাতে পরাতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল——-“তুই একটা আস্ত বেয়াদব।তোকে আমি মুভির কথা বললাম।তুই শুনলি না।আর মাহাদ রেস্টুরেন্টের কথা বলল।ওমনি তুই রাজি হয়ে গেলি।
দেখবো আমি।তোর জ্বর হলে কে তোর মাথায় পানি ঢালে,আমি দেখবো।”

অনিমা মুচকি হাসল।বাধ্য মেয়ের মতো বাইকের পেছনে উঠে বসলো।দুই হাতে খাঁমচে ধরল প্রত্যুষের পিঠের কাছে শার্টের অংশ।
প্রত্যুষ পুনরায় বাইক স্টার্ট দিয়ে মূল সড়কের দিকে এগিয়ে গেল।অনিমা জড়োসড়ো হয়ে তার গা ঘেঁষে বসে থাকলো।একবার অবশ্য কাত হয়ে প্রত্যুষের বিরক্ত বিরক্ত মুখটাও দেখল।অনিমার মনে হলো,এই ছেলেটার একটা অদ্ভুত অলৌকিক ক্ষমতা আছে।
সে আশেপাশে থাকলেই অনুর মন ভালো হয়ে যায়।এই যে সে অনুকে বকা দিলো।কিন্তু অনু মন খারাপ করল না।উল্টো সে যে রেস্টুরেন্টে এলো,এতেই তার মন ভালো হয়ে গেছে।অনু কি কোনোদিন তাকে এই কথা বলে দেখবে?বললে কি সে অনুকে খারাপ ভাববে?কে জানে! হয়তো বা।

চলবে-