নীল কৃষ্ণচূড়া পর্ব-০৭

0
18

৭.

অনিমা মারা গেল না।তিন তালার ছাদ থেকে পা পিছলে নিচে পড়ার পরেও স্রষ্টা তাকে বাঁচিয়ে রাখলেন।তবে বেঁচে থাকা টা সুখকর ছিলো না।একশো এক টা যন্ত্রপাতি শরীরের সাথে যুক্ত করে বিবশ হয়ে পড়ে থাকা কে আর যাই হোক,বেঁচে থাকা বলে না।প্রত্যুষের সেটাকে কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক মনে হলো না।উল্টো তাকে দেখলে প্রত্যুষের দম বন্ধ হয়ে আসে,নিঃশ্বাস আটকে যায়।মনে হয় পৃথিবীতে হঠাৎই কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বেড়ে গেছে।যেই কার্বন ডাই অক্সাইড তার দম আটকে দেয় বার বার।

অনিমাকে শহরের একটা নাম করা হাসপাতালের আইসিইউতে শিফট করা হলো।গোলগাল মুখের শান্তশিষ্ট মেয়েটা নিথর হয়ে সে কেবিনে পড়ে থাকে দিনের পর দিন।সে নড়ে না,চড়ে না।কেবল বেঁচে থাকার নিদর্শন স্বরূপ শ্বাস ফেলে ঘন ঘন।

বাড়ি ভর্তি লোক রোজ রোজ তাকে দেখতে আসে।ঐ বক্স আকারের কাঁচের জানালাটার পরিসর খুব ছোট।সবকিছু দেখা যায় না স্পষ্ট।তবুও গুটি কয়েক লোক সেই জানালায় ভীড় করে।অনিমার ধুকতে থাকা শরীরটা ভেজা চোখে কয়েক পল দেখে।

কাবেরী পারভীন দিনে দিনে অসুস্থ হতে শুরু করলেন।নাজির সাহেবের অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়।তিনি কথা বলতে পারেন না ঠিক মতো।বলতে গেলেই কন্ঠ ভেঙে আসে।নাজির সাহেব বাচ্চাদের মতো কাঁদেন।প্রজ্ঞা কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে কি যেন পড়ে বিড়বিড় করে।মাঝে মাঝে সে বসে করিডোরের চেয়ারে।তার চোখের নিচে কালচে প্রলেপ।মেয়েটা ঘুমায় না কয়েক রাত ধরে।

আরেকটা মানুষ ছিলো।সে আসতো রোজ অনিমার কাছে।তার নাম আহসানুল হক প্রত্যুষ।সে আসতো দুপুরের পর।তারপর সারারাত পাথর হয়ে বসে থাকতো।কখনো বা তার দিন গড়াতো কেবিনের সামনের চেয়ারে বসে।

প্রত্যুষ কাঁদে নি।সে চোখ বড় বড় করে সব দেখেছে।অনুর জীবনে কতো কি ঘটে গেছে! প্রত্যুষ সুবোধ বালক হয়ে সব দেখেছে।জাভেদা আজকাল তাকে হাসপাতালে আসতে বাধা দেন।বলেন,প্রত্যুষ নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছে।দিন দিন নাকি সে পাগলের মতো আচরণ করছে।অথচ প্রত্যুষ জানে,এ কথা সত্যি না।সে পাগলের মতো আচরণ করে নি।সে উল্টা ভদ্র ছেলে হয়েছে দিন দিন।

প্রত্যুষ বসে করিডোরে বিছিয়ে রাখা চেয়ারে।
বেলা গড়ায়।
সন্ধ্যা নামে।
তারপর রাতের দিকে প্রজ্ঞাও আসে।এসে বলে——–“তুমি কিছু খাওনি প্রত্যুষ?কিছু আনবো আমি?”

প্রত্যুষ মাথা নাড়ে।মেয়েটা তবুও হাতে করে বিস্কুট অথবা স্যান্ডউইচের প্যাকেট নিয়ে আসে।প্রত্যুষ বিনাবাক্যে সেটা খায়।তারপর দু’জন চুপচাপ যার যার সিটে বসে থাকে।রাত নয়টায় প্রজ্ঞা বাড়ি চলে যায়।প্রত্যুষ যায় না।সে ওভাবেই বসে থাকে দীর্ঘসময়।

_____

কেমন করে যেন দুই মাস চলে গেল।
দুই মাস।ষাট দিন।
অনিমা নামের মেয়েটার আদুরে মিষ্টি চোখ দু’টো না দেখে প্রত্যুষ একটা আস্ত ঋতু পার করে দিলো।অথচ অনিমা চোখ খুলল না।সে তখনও গভীর নিচ্ছিদ্র ঘুমে আচ্ছন্ন।

একদিন প্রত্যুষ কুঞ্জবিতানে গেল।সবকিছু কেমন যে অসহ্য লাগে আজকাল।মনে হলো সেখানে গেলে একটু স্বস্তি মিলবে।

অনিমার ঘরটা আগের মতোই আছে।কোনো পরিবর্তন নেই।কাবেরী মেয়ের ঘর খুব সুন্দর গুছিয়ে রাখেন।অনিমা যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরবে,তখন এলোমেলো ঘর থেকে সে মন খারাপ করবে।কাবেরী প্রতিজ্ঞা করেছেন,তিনি আর তাকে মন খারাপ করতে দিবেন না।

সেদিন দরজা খুলে প্রত্যুষ কে দেখেই কাবেরী মলিন হাসলেন।দরজা ছেড়ে বললেন———“কি খাবে বাবা?তুমিও তো আজকাল কিছু খাওনা।”

প্রত্যুষ ভেতরে এলো।আস্তে করে বলল——–“আমি কিছু খাবো না খাম্মা।আমি একটু অনুর ঘরে গিয়ে বসবো।ঘর কি খোলা আছে?”

____

ঘর খোলাই ছিলো।প্রত্যুষ ঘরে গিয়ে একবার পুরো ঘরে চোখ বুলায়।অনিমার বুকশেল্ফ,তার ক্যানভাস সবকিছু একেবারে অমলিন,অক্ষয়।সাদা রঙের পর্দাটা দুলে দুলে ঘরে আলো বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলো।

প্রত্যুষ হেঁটে যায়।টেবিলের সামনে গিয়ে সবকিছু ছুঁয়ে ছঁয়ে দেখে।সে কাঁদে না।তার দম বন্ধ লাগে।এই ঘরটা কেমন যে অদ্ভুত দেখায়।

খাটের এক পাশে বসে অনিমা তুলি দিয়ে আঁকাআঁকি করতো।খাট আছে,তুলি আছে,কিন্তু অনু নেই।প্রত্যুষের একটা ঘটনা মনে পড়ল।অনিমা একটা ছবি এঁকেছিল একবার।একটা নীল রঙের সমুদ্রের পাড়।রাশি রাশি স্রোত সৈকতে এসে আছড়ে পড়ছে।তীরের কাছে দুইটা চেয়ার রাখা।তার একটাতে অনিমা,অন্যটাতে প্রত্যুষ।অনিমা খুব আগ্রহ ভরে ছবিটা প্রত্যুষ কে দেখালো।প্রত্যুষ সেটা দেখেই হাসি মুখে বলল———“আরেহ্! তুই তো দারুণ আঁকিস অনু!আমার সমুদ্র পছন্দ।আর তোকেও।সমুদ্রের পাড়ে বসে আমি তোকে একটা আজগুবি গল্প বলবো।আর তুই বসে বসে শুনবি।”

অনিমা তৎক্ষনাৎ লিখল———“তারপর আমরা সাগরের তীর ঘেঁষে হাঁটবো।”

প্রত্যুষ সে কথায় বাধা দিলো।বলল——-“ধুর না।তখন আমার বিয়ে হয়ে যাবে।তখন তোর সাথে হাঁটলে আমার বউ রাগ হবে।”

অনিমা আর কথা বাড়ায়নি।
আচ্ছা,অনিমা কি সেদিন কষ্ট পেয়েছিল এই কথা শুনে?

প্রত্যুষ বড় করে শ্বাস ফেলে।শরীরের তাপমাত্রা বেড়েছে কিছুটা।হঠাৎ তার চোখ গেল অনিমার কালো রঙের ব্যাগটার দিকে।এই ব্যাগটা সে সবসময় সাথে রাখে।এতে কাগজ থাকে,কলম থাকে,রং ক্যানভাস সবই থাকে।

প্রত্যুষ ব্যাগটা হাতে নেয়।নিশিথপুর যাওয়ার সময়ও সে ব্যাগটা সাথে রেখেছিল।তারপর রোকসানা সম্ভবত সেটা এনে তার ঘরে রেখেছে।প্রত্যুষ চেইন খুলে একে একে সবকিছু বের করল।এক টা কলম,একটা আর্টবুক,কয়েকটা কালার পেন,একটা হেয়ার ব্যান্ড।আর একটা কালো রঙের মোটা ডায়রি।

প্রত্যুষ ডায়েরিটা হাতে নিল।অনুর ডায়রি লিখার স্বভাব আছে।মাঝে মাঝে সে গভীর রাতে উঠে ডায়রি লিখতো।

প্রত্যুষ মলাট উল্টায়।প্রথম পাতায় লাল কালি দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা——-“মানুষের ডায়েরি কোনো পড়ার জিনিস না।যেখান থেকে নিয়েছেন,সেখানেই রাখুন।অন্যথায় আমি টের পেলে কিন্তু ভীষণ রাগ হবো।”

প্রত্যুষ লিখাটা পড়েই হেসে ফেলল।হাসিটা অদ্ভুত।হাসতে হাসতেই দুই চোখ ভিজে উঠল হুট করে।প্রত্যুষ লিখার উপর হাত বুলায়।পাতা উল্টে পরের পৃষ্ঠায় যায়।

___

আসসালামু আলাইকুম!
আমার নাম অনিমা আহমেদ।
ডায়েরিতে কেউ এভাবে নিজের পরিচয় দেয় নাকি জানি না।কিন্তু আমি দিচ্ছি।
My life,my rules.

ডায়েরিটা আব্বু আমাকে গিফট করেছে।বলেছে,’অনু মা!যখনই তোমার মন খারাপ হবে।তখনই তুমি এতে লিখবে।এখন আমার মন খারাপ হয় নি।তবুও আমি লিখছি।নতুন একটা ডায়েরি পেয়ে সেটাকে খালি রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে না একদমই।

উঁহু।আমার পুরো পরিচয় এখনো দেওয়া হয় নি।আমার বাবার নাম নাজির আহমেদ।আমি তার একমাত্র বাচ্চা অনিমা আহমেদ।আর আমার মায়ের নাম কাবেরী পারভীন।এই হলো আমাদের ছোট্ট পরিবার।একটু বেশিই ছোট তাই না?
তাই আমি কিছুদিন আগে আব্বুকে দিয়ে অনেকগুলো পাখি আর খরগোশ আনিয়েছি।তারা শব্দ করলে বাড়িটা একটু সরব মনে হয়।নয়তো এই বাড়িতে কথা বলার মতো আছে কে?

ওহহ! আরেকটা কথা জানানো হয়নি।আমি কথা বলতে পারি না।ছোটবেলায় একটা এক্সিডেন্টের পর আমার ভোকালকর্ড পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।সেখান থেকে আর শব্দ আসে।
কেউ আবার ভাববেন না যে এই নিয়ে আমি খুব দুঃখিত।আমি মোটেও দুঃখিত নই।আমি সবকিছু মেনে জীবনের পথ চলতে আগ্রহী।আমি হারানো জিনিসকে ভেবে কাঁদি না।বরং যা আমার আছে,আমি তা নিয়েই বাঁচি।

*
আমার এই ডায়েরির সম্ভাব্য পরিণতি তিনটা।

প্রথম,
ডায়রিটা আমি এক সময় পুড়িয়ে দিবো।যা যা লিখেছি সব আগুনের শিখায় জ্বলে ভস্ম হয়ে যাবে।আমার এই ছোটখাটো স্মৃতি গুলো অজানা থেকে সবশেষে ছাই হয়ে উড়ে যাবে।

দ্বিতীয়,
ডায়রিটা শত বর্ষ পরে কোনো এক আগন্তুকের হাতে উঠবে।হয়তো স্টোর রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে সে এটা খুঁজে পাবে।সে অনিমাকে চিনবে না।অনিমা তাকে চিনবে না।অথচ সে একশো বছর আগে বেঁচে থাকা একটা বোকাসোকা মেয়ের পুরো জীবন জেনে যাবে।
আগস্তক! তোমাকে ভালোবাসা।অনিমাকে জেনে তাকে বিচার বিশ্লেষণ করতে বসো না যেন।সবারই তো আলাদা আলাদা গল্প থাকে বলো!

তৃতীয়,
এই সম্ভাবনা টা নিয়ে আমি বেশি ভয়ে আছি।আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কেন যে বার বার বলে,এটাই হবে।অথচ আমি ভয়ে তটস্থ থাকি,এটা যেন কখনোই না হয়।আমার মনে হচ্ছে জনাব আহসানুল হক প্রত্যুষ একদিন আমার অনুপস্থিতিতে এই ডায়রিটা হাতে নিবে।আর কেউ আমার ব্যাপারে আগ্রহ না দেখালেও সে ঠিকই আগ্রহ দেখাবে।সে দুম করে ডায়রিটা খুলে পড়তে শুরু করবে।

এ্যাই প্রত্যুষ! ধমক দিয়ে বলছি।আমার ডায়রিটা রেখে সুন্দর মতো ঘর থেকে বের হয়ে যাও।এটা আমার পার্সোনাল জিনিস।

আমি জানি এসব লিখেও কোনো কাজ হবে না।কারণ আমার যে কিছু ব্যক্তিগত থাকতে পারে,এটা সে বিশ্বাস করে না।আমার সবকিছু সে ঘেটে ঘেটে দেখে।আমি কোনোদিন তাকে বাধা দেই নি।কারণ সে আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজিন।হুহ! এই সত্য আমি তাকে জানাইনি।তাকে জ্বালাতে ভালো লাগে আমার।তবুও সে পৃথিবীর যেদিকেই থাকুক না কেন,সে জেনে রাখুক,অনু তার সব বিশেষ দিনগুলোতে তাকে পাশে চেয়েছে।জন্মদিনের কোনো কেক অনিমা তার অনুপস্থিতিতে কাটে নি।জনাব প্রত্যুষ একথা জেনে খুশি থাকুক যে প্রিয় কাজিন হওয়ার তালিকায় সে সর্বদাই এক নম্বর ছিলো।মাহাদ,দিবা,প্রজ্ঞা কিংবা স্মৃতি-কেউ কোনোদিন সেই লিস্টে প্রত্যুষের ধারে কাছেও যেতে পারে নি।প্রত্যুষ ভাই চিরকালই আমার হৃদয়ের সবচেয়ে নাজুক এবং গভীর স্থানে থাকবে।তার তুলনা সে নিজেই।

*

একটি সত্য আমি রোজ লুকাই।মানুষ থেকে লুকাই,সমাজ থেকে লুকাই,কখনো বা নিজের থেকে লুকাই।নিজেকে ভুলভাল বুঝ দেই।কিন্তু দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে পরাজয় মেনে নেই।

আজ প্রত্যুষ ভাই বিকেলের দিকে বাড়ি এলেন।এসেই সাহেব রোজকার মতো আমার ঘরে এসে আমার ক্যানভাস হাতে নিলেন।আমি সমুদ্র তীরের একটা দৃশ্য এঁকেছিলাম।প্রত্যুষ ভাইয়া সেটা দেখল।কথায় কথায় সে বলল,তার বিয়ের পর সে আর আমার সাথে ঘুরতে পারবে না।তখন তার বউ কে সময় দিতে হবে।আমার যে তখন কি অভিমান হলো!
সে সত্যিই বিয়ে করবে?তারপর অন্য একটা সুন্দর মেয়ে নিয়ে সংসার করবে?আমি কিছু বলিনি।কিন্তু ভেতরটা কেমন মুচড়ে গেল।

আজ রাতে আমি আবার উপলব্ধি করলাম,আমি তাকে পছন্দ করি।সেটাও বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ।আমি যখন মনে মনে আমার একটা ভবিষ্যৎ কল্পনা করি,আমি যখন কল্পনায় নিজের একটা ছোট্ট কুটির আঁকি,তখন আমি সেই কুটিরে প্রত্যুষ ভাইকে দেখি।

আমি দেখি প্রত্যুষ ভাই কাকভেজা হয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরেছেন।আমি তখন একটা সুতির শাড়ি পরে তার হাত থেকে সবকিছু নিজের হাতে নিবো।তারপর আমি স্টোভ জ্বালাবো।প্রত্যুষ ভাই পেছন থেকে ধমক দিয়ে বলবে——“এতো পাকামো করতে হবে না তোর।যা ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাক।”

আমি তবুও পাকামো করবো।আমাদের একটা ছোট ঘর হবে।কানামাছি সংসার আমাদের।সেখানে দিবানিশি জোৎসনা চলবে।প্রত্যুষ ভাইয়ের রাগী বিরক্ত আর বিক্ষিপ্ত মেজাজের সাথে আমার ঠান্ডা,শান্ত আর প্রফুল্ল মেজাজ মিলেমিশে একাকার হবে।
বর্ষা আসবে।
শ্রাবণ নামবে।
উঠোনে অনেক পানি জমবে।
প্রত্যুষ ভাই ঘরের সামনের খোলা বারান্দায় সে দাঁড়াবেন।আমরা গাইবো—-

“আগে কতো বৃষ্টি যে
দেখেছি শ্রাবণে।
জাগেনি তো এতো আশা।
ভালোবাসা এ বুকে!”

চলবে-