#নীল_প্রহর
আফরা নূর
১১.
তখন রাত বারোটা৷ অভ্র কলিং বেল চাপল না৷ নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়েই প্রবেশ করল। দেখল মা জেগে আছে এখনও। অভ্র ভেবেছিল সবাই ঘুমিয়ে আছে। তাই ডিস্টার্ব করে নি।
-“তুমি ঘুমাও নি এখনও?”
-“এত দেরি করলি কেন?”
উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন মা।
-“আসিফর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তাই দেরি হয়েছে।”
-“খেয়ে এসেছিস নাকি খাবি?”
-“খেয়ে এসেছি।”
আয়শা আহসান শরবত দিলেন অভ্রকে। অভ্র শরবত খানা শেষ করে রুমে গেল। আয়শা আহসান ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজকের ঘটনা আসিফ তাকে সবটাই বলেছে। আর এটাও বলেছে অভ্র এতক্ষণ তার সাথে ছিল না। আজকে ছেলেকে তিনি কিছু বলেন নি। থাক একটু নিজের মতন।
অভ্র রুমে এসে দেখল পুরো বিছানা দখল করে শুয়ে আছে পিহু। অভ্র ফ্রেশ হতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোসল করে বেরিয়ে আসল সে। পিহু এখনো সেভাবেই ঘুমিয়ে আছে।
-“এই, উঠ।”
বেশ কর্কশ গলায় ডাকল অভ্র। তবে পিহু উঠল না। কুম্ভকর্ণের একমাত্র উত্তরসূরী কিনা!
-“যেভাবে ঘুমাচ্ছে মনে হচ্ছে খাট সে বাপের বাড়ি থেকে যৌতুক নিয়ে এসেছে। যত্তসব।”
বিরবির করে কথাখানা বলল অভ্র। তারপর পিহুকে ঢেলে সরিয়ে নিজের জন্য একটু জায়গা করল। কালকেই বড় খাটের অর্ডার দিতে হবে। এভাবে এতটুকু জায়গায় থাকা যায়? লিলিপুট শরীরে এত জায়গা যদি লাগে তাহলে অভ্রর হাতির মতন শরীরে কতটুকু জায়গা লাগবে? একটু কমনসেন্সও নেই যেন। মনে মনে পিহুকে আচ্চা ধোলায় করল অভ্র।
তখন মাঝরাত। ধপাশ করে নিচে পড়ে গেল অভ্র। কোমড়ের ব্যথায় শব্দ করে “আহ” বলে উঠল। শব্দটা পিহুর কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র লাফিয়ে উঠল সে। ভয় পেয়ে। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল অভ্র ভাই মেঝেতে বসে কোমড়ে মালিশ করছে।
-“এমন করে নিচে বসে আছো কেন অভ্র ভাই?”
অবাক হয়ে জানতে চাইল পিহু।
-“জাহান্নামী! জাহান্নামেও জায়গা হবে না তোর পাপী।”
পিহু ভাবল প্রেমিকার শোকে ছেলেটা বুঝি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আবল তাবল বকছে। আহারে বেচারা! অভ্র ভাইয়ের জন্য মনে মনে কষ্ট পেল পিহু।
-“তুমি পাগল হয়ে গেছ মনে হয়।”
-“তুই পাগল। তোর চৌদ্দ গুষ্টি পাগল। বেয়াদব মেয়ে মানুষ কোথাকার।”
পিহুর এবার আর সন্দেহ রইল না। ছেলেটা আসলেই পাগল হয়ে গেছে। পিহু মনে মনে আতঁকে উঠল। তার স্বামী একটা পাগল। তাকে সারাটা জীবন একটা পাগলের সাথে কাটাতে হবে। পিহু শুনেছে পাগলেরা মানুষ পিটায়। তার মনে কী অভ্র ভাই তাকেও মারবে? আগে তো শুধু ধমক টমক দিত। পিহু ভয়ে পিছিয়ে এল। পিহুর এরূপ আচরণে অভ্র ভ্রুকুটি করে বলল,
-“এমন আচরণ করছিস কেন?”
-“আমার ভয় করছে।”
এ্যাহ্ তার ভয় করছে এখন। লাথি দেওয়ার আগে ভয় ডর কাজ করে নি?
-“কেন?”
-“তুমি কী আমায় ধরে মারবে অভ্র ভাই?”
-“হে তোর ঠ্যাং দুটো ভাঙ্গব আমি। যাতে লাথি দিতে না পারিস। মুখের সাথে সাথে দেখি পাটাও ভালোই চলে তোর। পার্ট টাইম ফুটবলার নাকি রে তুই?”
মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বলল অভ্র। কোমড়ে লেগেছে বেশ। দেখতে লিকপিকে হলে কী হবে গায়ে শক্তি আছে মেয়ের। অপরদিকে পিহু অভ্রর দিকে ভেবলার মতন তাকিয়ে আছে। অভ্র আবারো পিহুকে ‘হোপলেস’ বলে আখ্যায়িত করল। তারপর বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল।
-“আর যদি আমার গায়ে পা দিয়েছিস তবে দেখিস কী করি। বেয়াদব মেয়ে। স্বামীকে লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দেয়। এই জন্যই পরীক্ষায় পাশ করতে পারিস না। আর জীবনেও পাশ করতে পারবি না। বদদোয়া দিলাম তোকে। তোর ছেলে মেয়ে তোকে আদু আম্মা বলে ডাকবে।”
পিহু তখনও অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্র ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে বকবক করতে করতে। পিহুর মস্তিষ্ক সচল হতেই সে বুঝল এবারের অঘটনটা সে ঘটিয়েছে। পিহু এবার অভ্রর থেকে একটু দূরত্ব রেখে শুলো। মাঝখানে কোলবালিশ দিতে ভুলল না। না জানি আমার কখন লাথি দিয়ে বসে। এবার লাথি দিতে অভ্র ভাই যে তাকে আস্ত রাখবে না তা পিহু ভালো মতই জানে।
****
অন্ধকার একটা ঘর। কোথাও আলোর ছিটেফোঁটা নেই। খাটে মাথা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে আলিজা। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অবহেলায়, অযত্নে। অভ্র তাকে ধোঁকা দিয়েছে কথাটা আলিজা মানতে পারছে না। অভ্র কেন তাকে ধোঁকা দেবে? এভাবে খেলা উল্টে যেতে পারে না। কিছুতেই না। আলিজার সবচেয়ে বেশি রাগ লাগছে অভ্রর মায়ের উপর। আলিজা নিশ্চিত মহিলা অভ্রকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বিয়ে করিয়েছে। তা না হলে অভ্র কখনই অন্য মেয়ে কে বিয়ে করত না। অভ্র কোন দিন সে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকায় অবদি নি। আজকে যেমন তাকায় নি তার দিকে।
নটিফিকেশনের টুংটাং শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হলো আলিজার। সে এভাবে থেকেই ফোন হাতে নিল। সে অভ্রর বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্য তখনই লোক লাগিয়েছিল। সেও দেখতে চায় অভ্র কাকে বিয়ে করেছে। সেই লোকেরই ম্যাসেজ। ছবি পাঠিয়েছে। হয়ত অভ্রর বউয়ের ছবি।
আলিজা সময় নিয়ে ওয়াটস্এ্যাপে ঢুকল। দুটো লম্বা শ্বাস টেনে ছবিটা ওপন করল। সাথে সাথে আলিজার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক পরিচিত, বিরক্তিকর মুখ। পিহু! অভ্র পিহুকে বিয়ে করেছে। রাগে আলিজার কপালের শিরা গুলো নীল হয়ে ফুলে উঠল। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে ফোন ছুঁড়ে মারল অজানায়। শব্দ করে ফোনখানা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। এবার আর আলিজার কোন সন্দেহ রইল না যে খেলটা এবার অভ্রর মা খেলেছে।
আলিজার মস্তিষ্ক অশান্ত হয়ে উঠল। অভ্র কী করে পিহুকে বিয়ে করতে পারে? পিহুর প্রতি আলিজার পুরোনো রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল যেন। চোখের সামনে ভেসে উঠল এক আপত্তিকর, অসম্মানজনক ঘটনা।
এই তো তিন মাস আগের ঘটনা মাত্র। সেদিন ছিল অভ্র আর আলিজার প্রেমের দুই বছরের পদার্পণ। আলিজা অনেক পরিকল্পনা করেছিল সেই দিনটা নিয়ে। অভ্রর জন্য সারপ্রাইজও রেডি করেছিল মেয়েটা। সে অনেক এক্সাইটেড ছিল দিনটার জন্য। একটা নিঃস্তব্ধ সন্ধ্যা, অভ্র আর সে সাথে এক কাপ কফি! ব্যস তার পরই তো হত খেলা শেষ! কিন্তু এই পিহু, পিহু সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল। এত দিনের পরিশ্রম এক নিমিষে শেষ করে দিল। অভ্র আর তার কোয়ালিটি টাইমে বিনা নোটিসে ঢুকে গেল সে।
-“আরে আরে অভ্র ভাই…!”
পরিচিত কারো কন্ঠ শুনে থতমত খেল অভ্র। তাকিয়ে দেখল পিহু দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র তরাক করে উঠে দাঁড়াল। পিহুকে দেখে আমতা আমতা করল সে। পিহু মজা পেল বেশ। অভ্রকে দেখে মনে হচ্ছে, বেড়াল মাছ চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে।
-“তুই এখানে কী করিস?”
-“ভগ্যিস এসেছিলাম। তা না হলে এত কিছু মিস করে যেতাম যে।”
ঠোঁট টিপে হাসল পিহু। অভ্র নিজের সাফাই দিতে চাইল তার আগেই আসিফের কল চলে এল। অভ্র আসিফের কল এটেন্ড করতে বাইরে গিয়েছিল একটু। তারপর যা হল তা তার অজানা।
আলিজা ওইদিন পিহুকে অনেক ভালোমন্দ কথা বলেছিল। এক পর্যায়ে এটাও বলেছিল অভ্রর দিকে পিহুর বাজে নজর। পিহুর চরিত্র নিয়েও দুয়েকটা কথা বলেছিল। পিহু কী করল? রেস্টুরেন্টে ভরতি মানুষের সামনে আলিজার গালে সপাটে এক চড় মেরে দিল। ওই দিন আলিজা পিহুকে ছেড়ে ছিল ঠিক। কিন্তু প্রতিশোধের আগুন তার মনে জ্বলছিল তখনও। অপমানের বদলা তো নিতেই হত।
আলিজা চোখ বন্ধ করে দুটো লম্বা শ্বাস নিল। পিহু অভ্রর বউ মানতে কষ্ট হচ্ছে। প্রথমে সে ভেবেছিল পিহুকে কঠিন শাস্তি দেবে। যেভাবে তাকে অপমানিত করেছে সেভাবে পিহুকেও ভরা মজলিশে অপমানিত করবে। এবার আলিজা নিজের প্ল্যান চেইঞ্জ করল। দুনিয়াতে পিহুর সময় ফুরিয়ে এল বলে। এবার সে এক ঢিলে দুই পাখি মারবে। ভালোই হল। তার খাটনি কমল। পিহুর আগে অভ্রর মায়ের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। উনি অক্ষত থাকলে একটা একটা ভেজাল উনি করবেনই। এটা আলিজা ভালোই বুঝেছে। আলিজা নিজের ফোনটা হাতে নিল। ভেঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। আলিজা বিরক্ত হয়ে ড্রয়ার থেকে নতুন একটা ফোন বের করল। সিল কার্ড ঢুকিয়ে কাউকে ফোন করল। অভ্র আহসান এবার কয়দিক সামলাবে? কাকে বাঁচাবে? কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার জন্য, মা? নাকি বউ?
চলবে……