নীল সাঝেঁর উজান পর্ব-০৯

0
46

#নীল_সাঝেঁর_উজান
#পর্বঃ৯
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

সদ্য বিবাহিত সাঝঁ বিয়ের এক ঘন্টা পড়েই বিধবা হয়ে গেলো। অশুভ আর অপয়া তকমাটা তার নামের পাশে পাকাপোক্ত ভাবে লেগে গেলো। নিষ্প্রাণ শুন্য চোখে স্বামীর নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মাত্র কিছুক্ষণ হয়েছিলো সে তিন কবুল পড়ে মানুষটাকে নিজের স্বামী হিসেবে পেয়েছিলো। আর এখন সব শেষ। কত বারণ করার পরেও তাকে বিয়ে করার জন্য জেদ করেছিলো উজান। আত্নীয় স্বজনরা ক্ষিপ্ত চাহনিতে বলাবলি করছে এরকম অপয়া অশুভ মেয়েকে জন্মের সময়ই লবণ খাইয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে হতো। বিয়ের হওয়ার সাথে সাথেই স্বামীকে খেয়ে ফেললো পোড়ামুখী। সাঝেঁর মুখে কোন কথাতো নেই নেই কোন বিলাপ আর আহাজারি। পাথরের ন্যায় চোখের সামনে খাটিয়ায় রাখা স্বামীর নিশ্চল আর প্রাণহীন দেহের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে। সাঝেঁর বাবা-মাও যেন এখন মেয়ের জন্য তিক্ত এবং বিরক্ত। মা হয়ে মেয়েকে তিরস্কার করে বললেন

” তুই এতো অমঙ্গল কপাল নিয়ে দুনিয়াতে আসলি কেন? বিয়ের হইতে না হইতেই স্বামীরে দুনিয়া ছাড়া করলি। তোর ছায়া দেখাও পাপ। তোর চেহারা দেখলেই কারো না কারো ক্ষতি হবে। দূর হয়ে যা তুই চোখের সামনে থেকে”।

সাঝঁ মায়ের দিকে তাকিয়ে গগণবিদারী চিৎকার দিলো। কয়টা শোক একসাথে সামলাবে সে। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার শোক তারপর দূর্বল শরীর নিয়ে সবার তীক্ষ্ণ কথার শোক নাকি যে মানুষ তাকে এসব অপমান আর খোঁটা থেকে বাচাঁর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো তাকে হারানোর শোক। এইতো সব ঠিক ছিল। একটু আগেওতো সবার সাথে কথা বলছিলো। মুহুর্তের মধ্য মানুষটা আর নেই। এই মানুষটাকে সে একটু একটু করে পছন্দ করতে করতে ভালোবাসতে শুরু করেছিলো। কিন্তু উজান তার আবেগ অনুভূতিকে সায় দেয়নি আর যখন দিলো তখন তাকে দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন মুহুর্তের মধ্য ফেলে রেখে চলে গেলো। বিয়ে শেষ করে সবার সাথেই কথা বলছিলো সে। হঠাৎ করে বুকে ব্যাথা শুরু হলো তার। ডাক্তারকে ডাকতে ডাকতেই জ্ঞানশুন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তারপর তারপর আর কিছু নেই। সব শেষ। নিজের কালো ছায়া এভাবে একটা মানুষকে শেষ করে ফেললো। আত্নীয় স্বজনরা যেন আরও ক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। তারাও বলতে নেয়

” এরকম মেয়ে বাচাঁর কি দরকার। যেখানেই যাবে অনিষ্ট করে ছাড়বে”।

সাঝেঁর কিছু বলার নেই। কাকে বলবে কিইবা বলবে। খুব অভিমান হলো তার উজানের উপর। সেতো বারবার করে বলেছিলো তাকে ওর জীবনের সাথে না জড়াতে। উজানইতো জোর করে বিয়ে করলো তাকে। বুকে প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে। শ্বাস টেনে আসছে। মনে হচ্ছে তারও সময় শেষ। তাকেও যেতে হবে। উজানের সাথে সংসার করার শখ পূরন হলো না। তাকে ছুয়েঁ দেখা হলো না। তার আদর নেওয়া হলো না। কেন এমন হলো। মেশিনের ক্রমাগত বিপ বিপ আওয়াজে কেবিনের সবার ঘাম ছুটে গেলো। নার্স দ্রুত ডাক্তার ডাকতে গেলো। বাহিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। উজান সাঝেঁর পরিবারের সাথে কথা বলছিলো। হঠাৎ নার্সের ছোটাছুটি দেখে জিজ্ঞেস করলো

” কি হয়েছে সিস্টার? সাঝঁ কেমন আছে”?

নার্স বললো

” পেশেন্ট৷ নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা থেকে খারাপ কিছু কল্পনা করেছে এবং সেটা সে নিতে পারেনি। প্রচন্ড খিচুনি উঠেছে তার। শ্বাস টেনে আসছে । অক্সিজেন লেভেল কমে আসছে। ব্লাড প্রেসার হাই হয়ে গেছে।

মুহুর্তের মধ্য দুজন ডাক্তার কেবিনে ঢুকলো। এইতো মেয়েটা ঘুমিয়ে গিয়েছিলো বিয়ে পড়ানোর পরে। মাথা থেকে নিশ্চয়ই সেসব আজেবাজে কথা যায়নি। তাই ব্রেইনে চাপ পড়েছে। সবার চোখ মুখ থমথমে। সাঝেঁর বাবা রমজান সাহেব তার নতুন মেয়ে জামাই উজানের হাত ধরে বললেন

” বাবা আমার মেয়েটা বাচঁবেতো”?

উজান তার হাতটা শক্ত ধরে বললো

” উপরওয়ালার উপর বিশ্বাস রাখুন বাবা। কিছুই হবে না আপনার মেয়ের। ও ফিরবে। কাটিয়ে উঠবে এই কঠিন সময়। আপনাদের মেয়ের এখনো আমার সাথে এক জনম সংসার করা বাকি। এভাবে সে আমাকে ফাকিঁ দিতে পারে না”।

এইদিকে সাঝেঁর অবস্থা বেগতিক। কোনভাবেই খিচুনি কমছে না। সাঝঁ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। অক্সিজেন লেভেল এবং ব্লাড প্রেসার দ্রুত ওঠানামা করছে। নিয়ন্ত্রণে না আসলে কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে। প্রায় পনেরো মিনিট চেষ্টার পরে ডাক্তাররা সাঝঁকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। শক থেকেই এমন অবস্থা হয়েছিলো। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে সাঝঁ। এখন অবস্থা স্থিতিশীল। ডাক্তার তাকে আবারও ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলো। কিছুক্ষণ ঘুমালে স্বাভাবিক হবে। ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে বললো

” পেশেন্ট এর একটু আগে বিয়ে হলো। উনার স্বামী কোথায়”?

উজান ধরফরিয়ে উঠে ডাক্তারের দিকে এগিয়ে গেলো

” আপনার স্ত্রী আপনার কথা ভেবে ভেবে নিজের ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে ফেলেছিলো। অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় খিচুনি উঠেছিলো। তার ব্রেইনে আপনাকে নিয়ে এমন কোন কিছু চিন্তা ঢুকেছে যেটা তাকে অস্থির করে তুলছে। বারবার আপনার নামই নিচ্ছিলো। এমন অদ্ভুতভাবে বিয়ে করেছেন যে বিয়ের প্রথম রাত বউ হসপিটালে অসুস্থ হয়ে আছে।

উজান বললো

” এখন কেমন আছে আমার স্ত্রী”?

কথাটা বলতেই উজানের হঠাৎ করে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সাঝঁ আজ থেকে তার স্ত্রী। জীবনে আবারও সে কাউকে জায়গা দিলো। সে কি ভুল করলো? তারতো বাবা না হওয়ার অক্ষমতা রয়েছে। সাঝঁ তার সাথে সংসার করবেতো? মেয়েটাকে বাচাঁতে গিয়ে কোন ক্ষতি করলো নাতো আবার? এই সংসারের ভবিষ্যৎ কি? যদি একসময় সে হাপিঁয়ে যায়? কোন মেয়ে না চায় সন্তানের মা হতে? সাঝঁকে সে সবকিছু দিতে পারলেও সন্তান সুখ দিতে পারবে না। এইটা যদি তাকে স্বামী সংসার বিমুখ করে তখন? এতোদিনতো সে একা ছিলো। ইশার সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে এসবের সাথে জড়াতে চায়নি। তার মা অনেক চেষ্টা করে গেছে ছেলেকে সংসারে ফেরানোর। কতবার বিয়ের জন্য বলেছে। উজান রাজি হয়নি। এখন কোন ঘোর থেকে কি পেয়ে বসলো তাকে। কি যে মাথায় জেদ চাপলো যে সোজা বিয়ে করে ফেললো। উজানকে অন্যমনস্ক দেখে ডাক্তার তার কাধেঁ আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো

” কি ভাবছেন? কোথায় হারালেন”?

উজান বললো

” সাঝেঁর সাথে দেখা করা যাবে”?

ডাক্তার স্মিত হেসে বললো

” এখন ঘুমাচ্ছে। হ্যাঁ ঘন্টা দুই অপেক্ষা করেন জেগে যাবে। জেগে উঠলে আপনাকে তার প্রয়োজন হতে পারে। এখন শুধু আপনাকেই মেয়েটার প্রয়োজন। মেয়েটাকেতো লোকলজ্জা থেকে সমাজের তীক্ষ্ণ কথার বাণ থেকে বাচিঁয়েছেন। এখন তার সারাজীবনের সফর সঙ্গী হয়ে তার পাশে থাকেন। কেবিনে কিন্তু আলাদা একটা বেড আছেই। আপনি চাইলে স্ত্রীর কাছে থাকতেই পারেন”।

উজান মনোযোগ দিয়ে ডাক্তারের কথা শুনলো। এই মুহুর্তে আসলেই সাঝেঁর কাছে তার থাকাটা প্রয়োজন। যদি আবার দুশ্চিন্তা করে শরীর খারাপ করে ফেলে? তার চেয়ে ভালো সে না হয় আরেকটা অদ্ভুত অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা অর্জন করুক। বিয়ের প্রথম রাতটা বউয়ের সাথে হসপিটালেই থেকে যাক। তার জামা কাপড়ে রক্তের দাগ লেগে খারাপ হয়ে আছে। বাড়ি গিয়ে কাপড় পরিবর্তন করে আসবে সেটাও বা কি করে করবে বুঝতে পারছেনা। সাঝেঁর ভাই বললো

“ভাইয়া আপনার কাপড়টাতো পরিবর্তন করা দরকার। দাগ লেগে গেছে। আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। আমি আসতেছি “।

কিছুক্ষণ পর সাঝেঁর ভাই এসে খাবার আর ড্রেস দিয়ে গেলো। এতো কম সময়ের মধ্য ছেলেটা দোকান থেকে নতুন কাপড় কিনে নিয়ে এসেছে। কাপড় পালটে রাতের খাবার খেয়ে সাঝেঁর কেবিনে ছোট্ট একটা বেড আছে সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়লো। নার্স যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো যেকোন প্রয়োজন হলে ইমারজেন্সি বেল দিতে। আর রোগী জেগে গিয়ে যেন উত্তেজিত না হয়ে পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে। উজান কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করে বললো

” আচ্ছা নার্স ওর যখন খিচুনি উঠেছিলো তখন কি ও স্পষ্ট করে আমার নামটাই নিয়েছিলো”?

নার্স বললো

” জি স্পষ্ট করে আপনার নামটাই নিচ্ছিলো। বারবার বলছিলো উজান এভাবে চলে যেতে পারে না তাকে ছেড়ে। উজানকে এনে দিতে তার কাছে”।

উজান কিছুটা বিব্রতবোধ বোধ করে। লজ্জায় চোখ ছোট হয়ে আসে তার। উজান বললো

” আচ্ছা নার্স আমি খেয়াল রাখবো যাতে ও উত্তেজিত না হয়ে যায় “।

নার্স হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে স্মিত হেসে কেবিনের বাহিরে চলে যায়। উজান ধীরে ধীরে উজানের বেড এর দিকে আগায়। সাঝঁকে এই মুহুর্তে দেখতে যেন তার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে মায়াবী কোন নারী লাগছে। এই নারী তার স্থবির হওয়া জীবনটাতে আবারও ঝড় তুললো। বিগত দিনে সে যা কিছুর মুখোমুখি হয়ে আসছে সে কি পারবে নতুন করে আবার কাউকে ভালোবাসতে বিশ্বাস করতে? বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব সাতপাচঁ ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শ্রান্ত চোখ আর খুলে রাখা সম্ভব হলো না। ঘুমিয়ে গেলো সে। হঠাৎ করে কারো অস্পষ্ট ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো উজানের। বিছানায় স্থিতু হয়ে বসতেই ডাকটা আরও স্পষ্ট হলো। সাঝঁ ঘুমের মধ্য ধীরে ধীরে তার নাম ডাকছে। মানে তার ঘুমের রেশ ছেড়ে যাচ্ছে। উজান ধীরে ধীরে তার দিকেভেগিয়ে যায়। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে

” আমি এখানেই আছি সাঝঁ। আমার কিছুই হয়নি। চোখ খুলে দেখো আমি তোমার সামনেই আছি”।

সাঝঁ চোখ মেলে তাকায়। উজান স্পষ্ট তার সামনে আছে। সুস্থ আছে সে। তার মানে সে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলো। সে অপয়া অশুভ নয়। তার স্বামীর কিছু হয়নি। সাঝঁ অস্পষ্ট স্বরে বলে

“আপনি এখানে আমার সাথে”?

উজান বললো

” কি করবো আর বলো। তুমি যে পাগলামো করলে নয়তো এতক্ষণ ফাইভ স্টার কোন রিসর্টে বাসর রাত হতে পারতো আমাদের। কি আর করা যাবে বউ অসুস্থ হয়ে হসপিটালে তাই আমাকেও বউ এর সাথে এখানেই থাকতে হবে। বউ ছাড়াতো আর আলাদা থাকা সম্ভব না। কি কপাল!!!”

চলবে………