নীল সাঝেঁর উজান পর্ব-১১+১২

0
49

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১১
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

“শুনেছি ছেলেটার আগের বিয়ে টিকেনি। বউকে তালাক দিয়ে দিয়েছিলো। আবার ছেলেরও কি জানি সমস্যা আছে। বাবা হতে পারবে না। এমন আধকুঁড়ে ছেলেটার সাথে ওমন সুন্দর মেয়ের বিয়ে দিলেন একবারও ভাবলেন না? একবারও মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলেন না? বিয়ে ভেঙেছেতো কি হয়েছে? দুনিয়াতে কি ছেলের অভাব? আপনাকেতো প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমার বড় ভাইয়ের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ের কথা নিয়ে। আপনি নাকোচ করে দিলেন। বলেছিলেন ছেলের বয়স বেশি। এখনতো ঠিকই বেশি বয়সের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন। মেয়ের সম্মান কি কমলো নাকি বাড়লো ভাই? সারাজীবন এমন ছেলের ঘর সংসার করবে কি করে যেখানে স্বামী বউকে সন্তানের মা হওয়ার সুখ দিতে পারবে না”?

এতোক্ষণ ধরে একটানা গলায় ঝাঁঝ নিয়ে গম্ভীর স্বরে কথাগুলো বলছিলেন সাঁঝের বড় চাচী। সাঁঝের বাবা রমজান সাহেব মনোযোগ সহকারে শুধু শুনে গেলেন। পাশেই তার বড় ভাই দাড়াঁনো। তারা ঢাকা শহরে থাকেন না। তার বড় ভাইয়ের নিজস্ব ব্যবসা আছে পরিবার সহ চট্রগ্রাম থাকেন। ব্যবসার কাজের জন্য বিয়ের দিনে আসতে পারেননি কিন্তু স্ত্রী সন্তান আগেই এসেছিলেন। তারপরতো যা হলো সবারই জানা। স্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার পর তার বড় ভাই মুখ খুললেন। তিনি বললেন

” ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলি ভালোমতো? কি করে বংশ কেমন? বয়সতো সাঁঝের চেয়ে বেশি। শুনলাম বাবা-মা কেউ বেচেঁ নেই। সাঁঝের মত ছিলো নাকি জোর করে বিয়ে দিলি”?

রমজান সাহেব ভাইয়ের দিকে সরল চোখে এক পলক তাকান। বাবা-মা বেচেঁ নেই সে বহু বছর হয়ে গেলো। তারপর থেকে এই ভাইটাই তাদের অভিভাবক হিসেবে সবসময় পাশে থাকে। তার থেকে বছর পাচেঁক এর বড় তার ভাই। আর ভাইবোনের মধ্য সবার বড়। কথা গম্ভীর হয়ে বললেও ন্যায্য কথাই বলেন। তাই তার কথা সবাই এক বাক্যে মেনে চলে। সাঁঝের বাবা একটা লম্বা শ্বাস নিলেন তারপর বললেন

” খারাপ পরিস্থিতিতে সবার আসল রুপ চেনা যায় ভাই। যে আত্নীয় স্বজনদের দাওয়াত করে বিয়েতে আমন্ত্রন জানিয়েছিলাম যাদের জন্য সেরা সেরা ফল মিষ্টি খাবারের আয়োজন করতে কোন দ্বিধা বা টাকার চিন্তা করিনি তারাই কালকের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য আমার মেয়ের বেচেঁ থাকা মুশকিল করে দিয়েছিলো। আমার মেয়েকে ডাক্তার বাচাঁতে পারলেও মনে হয় না তাদের তীক্ষ্ণ কথা তাকে বাচঁতে দিতো। এই মানুষরাই আমার মেয়েকে কাল অশুভ, অপয়া আর অছ্যুৎ বলে দূরছাই করেছিলো যেনো মেয়েটা দুনিয়ার সবচেয়ে অমঙ্গল কোন ছায়া। সেই সময় উপরওয়ালার এক রহমত হয়ে এসেছে এই ছেলে। এই ছেলে বলছি কেন এখন সে আমার মেয়ে জামাই। এমন ছেলে লাখে একটা মেলে। কাল যখন আমরা পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম এই ছেলেই কোন দায় বা সম্পর্ক ছাড়াই পরের বাড়ির ছেলে হয়ে নিজের ছেলের মতো সামলেছে সব। ঘরবাড়ি রেখে নিজের সুস্থতা ফেলে সারাদিনরাত হসপিটালে থেকেছে। মানুষের এই সব খারাপ কথা শোনার পর তাদের জবাব দেওয়ার জন্য সাঁঝের হাত ধরেছে এইটা প্রমাণ করতে যে আমার মেয়ে আর তার বউ কোন অশুভ অপয়া মানুষ না। বিয়েটা সাঁঝের মত নিয়েই হয়েছে। সাঁঝ জেনেশুনেই বিয়ে করেছে উজানকে। উজান কোন লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করেনি। স্বামী -স্ত্রীর মধ্য কোন লুকোচুরি থাকাটা শোভনীয় নয়। আর রইলো বাকি বয়স হ্যা ছেলের বয়স বেশি মেয়ের তুলনায় কিন্তু আমার মেয়ের সাথে তার জোড়া ছিলো তাই হয়তো ঘুরে ফিরে এই ছেলের সাথেই বিয়ে হয়েছে”। ছেলে ভালো সরকারি চাকুরী করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর পদে আছে। মা-বাবা কেউ বেচেঁ নাই। আমরা এখন যে বাসায় থাকি সে আমাদেরও বহু আগে থেকে ওই বিল্ডিং এ থাকে নিজেরই বাড়ি তার”।

সব শুনে তার বড় ভাই স্থির হলেন তবুও মন থেকে এই বিয়ে নিয়ে শান্তি পেলেন না। একেতো মেয়েটার বয়স কম তার উপর ছেলের এতো বড় সমস্যা। সব কিছু বাদ দিলেও এইটাতো মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাদের মেয়েরতো কোন সমস্যা নেই। তিনি বললেন

” ছেলের এতো বড় সমস্যা আছে মেয়ে পারবে মানিয়ে নিতে”?

রমজান সাহেবও যে এই বিষয় নিয়ে ভাবেননি তা নয়। এই কথাটা তাকেও ভাবিয়েছে অনেক। চিন্তা ভাবনা থেকে ছুটে গিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন। মেয়ে উত্তর করেছে

” উজানের জায়গায় যদি আমার সমস্যা হতো আর সেটা বিয়ের আগে জানা যেতো তখন কি কেউ সেধেঁ এসে বিয়ে করতে চাইতো? সমস্যা রোগ বালাইতো মানুষেরই হয়। এগুলো বালা মসিবত উপরওয়ালার পক্ষ থেকেই আসে। তিনি যদি চান তার রহমত হিসেবে কোন না কোনদিন এই দুঃসময় চলে যাবে। দুনিয়ায়তো কত আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটে। কত মানুষের জীবনে কত সমস্যা তবুও তারা বেচেঁ থাকে। আমারতো বাচ্চা আছেই। দুইটা বাচ্চার মা আমি আগে থেকেই। ওদেরকেই নিজের সন্তান হিসেবে মানুষ করবো। নিজের সন্তান পেটে ধরার ভাগ্য নাইবা হলো কিন্তু একজন ভালো মানুষকেতো জীবনে পাওয়া যাবে”।

মেয়ের কথায় রমজান সাহেব অনেক খুশি হয়ে যান। এইতো একজন মানুষের মতো মানুষের কথা। এক জীবনে সব সুখ পেতে হবে তার কোন মানে নেই। কিছু কিছু অপূর্নতা জীবনকে আরও বেশি বুঝতে শেখায়। এই ভাবনা থেকে বের হয়ে এসে বললেন

” এইটা ছেলেমেয়েরাই নিজেদের মধ্য বোঝাপড়া করে নেবে। এক জীবনে সব কিছু পেয়ে গেলেতো কারও কোন আপত্তি থাকতো না বেচেঁ থাকা নিয়ে। আমার বড় মেয়েটাকেতো সুখ হবে ভেবে বিত্তবান পরিবারেই বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাহিরটা দেখে কি আর ভেতরটা বুঝা যায়? বাহিরে বিত্তবান হলেও ভেতর থেকে ছিলো জাত ছোটলোক। তবুও মুখ বুজে আটটা বছর মেয়ে আমার সংসার করে গেছে কোন অভিযোগ ছাড়া। কপালে যদি সুখ থাকে এরই মধ্যেই খুজেঁ পাবে “।

এই কথার পর আর আসলেই কারো কিছু বলার থাকে না। দুই ভাইয়ের কথোপকথন এতোক্ষণ দূর থেকে উজান শুনছিলো। আড়ি পেতে নয়। সে মূলত বাড়ি গিয়েছিলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে। সাঁঝ জেদ ধরে আছে যতক্ষণ পর্যন্ত বউকে জড়িয়ে ধরার অনুমতি না পায় ততক্ষণ যেন তার সাথে দেখা না করে যেহেতু বউয়ের মাথায় হাত বুলাতে হলেও দেন মোহর পরিশোধ করতে হবে। তাই বাড়ি গিয়েছিলো চেক স্বাক্ষর করে আনতে। এখন যদি বউয়ের মুখ দেখতে দেয় বউ নিজে। বাড়ি গিয়ে সবার আগে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে মিনিট দশেক শুয়ে ছিলো। ভাবতেই অবাক লাগছে তার এক দিনের ব্যবধানে ছয় বছরের একাকী জীবন তার ঘুচে গেছে। একেই বলে সময়ের কারসাজি। সাঁঝকে তার ভালোলাগে কিন্তু সেতো এমন অনুভূতি সায় দেয়নি কখনো। কিন্তু এখন দিতে হবে। বউ হয় তার। আরতো হেলা ফেলা করা যাবে না। পাচঁ লক্ষ টাকা বিয়ের দেনমোহর তাদের। এতো টাকা একসাথে মোবাইল ব্যাংকিং এ লেনদেন হবে না। উজান দুইটা ভাগে ভাগ করলো। কিছু টাকা নগদ পরিশোধ করবে আর কিছুটা গয়না দিয়ে। নগদ অর্থ যেটা সেটা চেক হিসেবে সাঁঝকে দিবে আর মায়ের রুলি বালাজোড়া আর একটা সোনার হার গয়না হিসেবে সাঁঝকে দিবে। আবার অসুস্থ বউয়ের জন্য হালকা খাবারও বানিয়ে নিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। সাঁঝের কেবিনের সামনে আসতেই সাঁঝের বাবা আর জ্যাঠার কথা কানে আসলে দূর থেকেই শুনছিলো সে। মনেতো সংশয় তার নিজেরও আছে। ইতিহাস কি পরিবর্তন হবে নাকি পুনরাবৃত্তি হবে এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এসব ভাবতে ভাবতে তাদের সামনে গিয়ে পড়ে উজান। বড়দের সালাম দেয়। কুশল বিনিময় করে। পরিচিত হয়। ছেলের অমায়িক আচরণ দেখে সাঁঝের বড় চাচা বলে

” ছেলেকেতো বেশ ভালোই মনে হলো। দেখা যাক সামনে কি হয়”।

ভাইয়ের কথায় খুশি হয় রমজান সাহেব। জামাই তার নিজেরও পছন্দ হয়েছে। এখন বেলা বাজে এগারোটা। উজান কেবিনে ঢুকে দেখে সাঁঝ বাচ্চাদের সাথে কথা বলছে। ছোটটাকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছে। কেউ বলবে এই মেয়েটা কাল কি পাগলামো করেছিলো। আজকে নিজের ডিউটিতে লেগে গেছে। উজান যে এসেছে এটা বুঝতে পেরেছে সাঁঝ কিন্তু মাথা তোলেনি। অভিমান করে আছে। উজান বুঝতে পেরে টিপ্পনী দিয়ে বললো

” কচি মেয়ে বিয়ে করার এই এক কষ্ট কথায় কথায় রাগ করে। কিন্তু কি নিয়ে রাগ অভিমান করে এটা বুঝা আরেক কষ্ট। একদিনেই এই রাগ অভিমান বুঝতে বুঝতে আমার দুই কেজি ওজন কমে গেছে। সাতদিন যেতে যেতে না হাড্ডিসাড় হয়ে যাই “।

সাঁঝ আর মাথা না তুলে থাকতে পারলো না বড্ড হাসি পাচ্ছে তার স্বামীর কথা শুনে। একদিনেই দুই কেজি ওজন নাকি কমে গেছে তার। সাঁঝকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে উজান বললো

” এখন যে আহ্লাদ দেখাচ্ছো বাচ্চাদের কালতো স্বার্থপরের মতো ঠিকই তাদের একা করে দিয়ে পাগলামো করেছো। তখন মাথায় ছিলো না যে ওরা তোমাকে ছাড়া কি করে থাকবে? তুমি ছাড়া ওদের আর কে আছে দুনিয়ায়? আছে কিন্তু তারা থেকেও নেই “।

সাঁঝের চোখ পানিতে ভরে যায়। আসলেইতো কেমন স্বার্থপর মা সে। বাচ্চাদের কথা একটুও ভাবেনি। দুজনকে দুহাতে টেনে অজস্র আদর করে। উজান এগিয়ে এসে ছোটটাকে কোলে নেয়। মেয়ে বাচ্চা এতো আদুরে হয় উজান প্রথম অনুভব করতে পেরেছে এই বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার পরেই। সাঁঝ উজানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বরকে এখন দুনিয়ার সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ মানুষ লাগছে। অনুমতির কথা মাথায় আসতেই সাঁঝ বলে

” বউকে ছুয়েঁ দেখার অনুমতির সনদ নিয়ে এসেছেন”?

উজান সাঁঝের দিকে তাকায়। একটা স্থির হাসি দেয় সে। তারপর একটা ব্যাগ এগিয়ে দেয় আর সাথে একটা খাম। সাঁঝ দেখে বলে

“কি আছে এতে”?

উজান মুখে কিছু বলে না। একটু একটু করে আগায় সাঁঝের দিকে। সাঁঝ ওমনই আছে। বউকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে আদর দিয়ে বলে

” সারাজীবন বউকে সকাল বিকাল আর রাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে রাখার অনুমতি পত্র আছে এখানে “।

চলবে………

#নীল_সাঁঝের_উজান
#পর্বঃ১২
#লেখনীতে_তানিয়া_রহমান

বিচ্ছেদের প্রায় ছয় বছর পর প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে দেখা উজানের। যেখানে তারা থামিয়ে দিয়েছিলো দুজনের পথচলা সেখান থেকে দুজনের বয়স ছয়টা বছর বেড়ে গেছে। গত ছয় বছরে উজান যেমন হারিয়েছে তার মাথার উপর থাকা একমাত্র অভিভাবক মা কে সেই সাথে স্থবির হয়েছিলো তার জীবন। সবদিক থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো সে। কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলতো না। বাসা থেকে অফিস আবার সেই অফিস থেকে বাসা ছিলো তার গন্তব্য। আত্নীয় স্বজন সবার কাছ থেকে এখনো সে একরকম লুকিয়ে থাকে। ডিভোর্স এর পর কম ভোগান্তিতো পোহাতে হয়নি তাকে। মানুষের হাজার রকমের প্রশ্ন ঘিরে ধরেছিলো থাকে যদিও অনেক দিন অবধি সে খোলাসা করে কাউকে কিছুই জানতে দেয়নি। স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া ধোঁকার কথা এখনো অনেকেরই অজানা। তবে মায়ের প্রয়াণ এর আগে এই কঠিন সত্যিটা উজান তার মাকে জানিয়েছিলো। তার মা ছেলের জন্য বিদায় বেলায় খুব আফসোস করে গেছেন। নিজের কৃতকর্মের জন্য ছেলের কাছে অনেক লজ্জিত হয়েছেন। উজান শুধু তার মাকে বলেছিলো

” সন্তান হিসেবে আমার অনেক অপারগতা ছিলো। আমিও অনেক ভুল ত্রুটি করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। মাফ করে দিও মা “।

অভিভাবকহীন উজানের দিনগুলো চলে গেছে। কথায় আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। দিনের পর দিন এমনিতেই চলে যায়। কাজের ব্যস্ততা বাড়িয়ে দেয় উজান। প্রথম প্রথম যখন অফিস থেকে ঘরে ফিরতো ভুলে যে কতবার ডোরবেল দিয়েছে। পাচঁ মিনিট ডোরবেল বাজানোর পর তার মনে হয়েছে তাকে দরজা খুলে দেওয়ার কেউ নেই। জ্বরে কাহিল হয়ে বেহুশ হয়ে গেছে কতবার। তবু এক গ্লাস পানি তাকে নিজে নিয়েই খেতে হয়েছে। প্রায়ই অফিস কলিগদের দেখে কি সুন্দর হাসি খুশি পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে গেছে। তাদের দেখে বুকের ভেতর হাহাকার ঠেলে আসতো তার। বুক থেকে বের হয়ে আসতো চাপা দ্বীর্ঘশ্বাস। এমন একটা পরিবার তার থাকতে পারতো। কিন্তু তার নেই কিছুই নেই সে একা ভীষণ একা। আজ হঠাৎ এতো বছর পর ইশাকে দেখে তার পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। ইশারও বয়স বেড়েছে কিন্তু তার গড়ন দেখে তা বুঝার উপায় নেই। আগের চেয়ে মোটা হয়ে গেছে কিছুটা কিন্তু সুন্দর হয়ে গেছে বেশ। সেও বোধহয় শপিং করতে এসেছে। সাথে স্বামী সন্তান আছে নিশ্চয়ই। মেয়েদের ড্রেসের সেকশনে এখন সে। সাঁঝের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে এসেছে। নতুন বউ নতুন পরিবার হয়েছে এখন। স্বামীর বাড়িতে গিয়ে সে কি পরবে তাই কিছু কাপড়চোপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে এসেছে। এখানে এসেই তার ইশার সাথে দেখা। একদম তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এখন সে অন্য কারো বউ। ডাকাটা শোভনীয় হবে কি হবে না এই দ্বিধায় যখন সে চুপ হয়ে আছে ঠিক তখনই তার নাম ধরে কেউ ডাকলো। কাপড় থেকে চোখ সরিয়ে সেই ডাক অনুসরণ করে তাকালো সে

“উজান”

ইশা নিজে থেকেই ডেকেছে তাকে। যাক বাচাঁ গেলো তাকে আর মনের সাথে দ্বিধায় জড়াতে হবে না। অবাক হওয়ার রেশ নিয়ে উজান স্মিত হেসে জবাব দিলো

” ইশা তুমি?

ইশার চোখে মুখে এক ধরনের জড়তা আর সাথে অনুতাপে মোড়ানো দ্বিধা। এই মানুষটাকে সে সোজাভাবে ছেড়ে দিতে পারতো। কিন্তু যে ছলের আশ্রয় সে নিয়েছে এটা তাকে আজীবন পোড়াচ্ছে। ভেতর থেকে খোকলা বানিয়ে দিচ্ছে। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সে করেছে উজান এর বিশ্বাস ভেঙে। সেই ভুলের মাশুলও তাকে দিতে হয়েছে অনেক বাজে ভাবেই। ইশা হালকা হেসে জবাব দিলো

” হ্যাঁ আমি। কতদিন পর তোমার সাথে দেখা। এখনো আগের মতোই আছো”।

উজান হেসে বললো

” কোথায় আগের মতো আছি? বয়স বেড়েছে। আজকে আয়নাতে দেখলাম চুল দু একটা পেকে গেছে। দেখো পেটের মেদটাও বেড়ে সামনে গিয়েছে। কিন্তু তুমি আগের মতোই আছো। তবে আগের চেয়ে সুন্দর হয়ে গেছো। তা একাই এসেছো শপিং করতে”?

ইশা বললো

” না একা আসিনি। আমার ছেলে আর স্বামীও এসেছে সাথে। ছেলে জেদ ধরেছে খেলনা কিনবে। তাই বাবা ছেলে সেই দোকানেই গেছে “।

উজানের বুকের মধ্য একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। যদিও এটা শোভনীয় নয় বেমানান দেখায়। তবুও ইশাতো তার এক সময় স্ত্রী ছিলো। চারবছর একসাথে সংসার করেছে। কিন্তু কপালে ছিলো না তাই টিকেনি। এখন তার কত সুন্দর সংসার আছে। স্বামী সন্তান নিয়ে একটা সুখী পরিবার তার। উজান এর একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে। ইশা কি তাকেই বেছে বিয়েছে যার সাথে সে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো? কিন্তু প্রশ্নটা করা ঠিক হবে না হয়তো তাই চুপ করে রইলো। প্রসঙ্গ পালটে বললো

” ছেলের বয়স কত?

ইশা উত্তর দিলো

” চার বছর চলছে “। তুমি এখানে শপিং করতে এসেছো বুঝতে পারছি। কিছু পছন্দ হলো? কার জন্য কিনতে এসেছো তোমার মার জন্য”?

উজান সহজ গলায় বললো

” মা বেচেঁ নেই দুবছর হলো ইশা। ডায়বেটিকস ছিলো সেটাতো তুমি জানতেই। একদিম সেটা নীল হয়ে গিয়ে মা দুনিয়া আর আমাকে ছেড়ে চলে গেছে “।

ইশার মুখটা মুহুর্তের মধ্যই ছোট হিয়ে এলো বিষাদে। কি বলছে উজান তার মা বেচেঁ নেই। ছেলেটার দুনিয়াতে আপন বলতে আর কেউ নেই। তাহলে কার জন্য কেনাকাটা করছে সে? সে কি এখনো একা নাকি বিয়ে করেছে আবার। ইশা ইতস্তত হয়ে বললো

” আমি দুঃখিত। আমি জানতাম না মা আর বেচেঁ নেই। তুমি কি আবার বিয়ে করেছো উজান”?

উজান যে প্রশ্নটার ভয় পাচ্ছিলো ইশা সেই প্রশ্নটাই করেছে তাকে। কিন্তু আবার ভাবলো এতে ভয়ের কি আছে। বিয়েইতো করেছে। সবার মতো তারও ভালো থাকার অধিকার আছে। উজান হেসে বললো

” হ্যাঁ গতকাল রাতে বিয়ে করেছি। ভেবেছিলাম করবো না। পরে ভেবে দেখলাম এক জীবন এভাবে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব না। দিনশেষে ঘরে ফিরে দুটো কথা বলার জন্য কাউকে পাশে দরকার। তাই বিয়েটা করেই ফেললাম। হঠাৎ মেয়ে দেখে পছন্দ হয়ে গেলো তাই বিয়ে করে ফেলেছি। সত্যিটা জানিয়েই বিয়ে করেছি। নতুন বউ বাড়িতে যাবে কিন্তু তার প্রয়োজনীয় কিছুই নেই স্বামীর ঘরে। তাই এসেছি কিছু দরকারি কেনাকাটা করতে “।

ইশা চুপ করে শুনে গেলো। কি অবলীলায় জীবনের কঠিন অথচ সুন্দর একটা মুহুর্ত বলে গেলো উজান। উজান বরাবরই এমন। ভনিতা করা পছন্দ করেনা। সোজাসাপ্টা বলে দেয় যা মনের মধ্য চলে। ইশা স্মিত হেসে জবাব দিলো

” অভিনন্দন তোমাকে নতুন জীবনের জন্য। আগামী দিনগুলো সুন্দর হোক। জীবনে সবারই ভালো থাকার অধিকার আছে। তোমারও আছে। আসলেই একা জীবন কাটানো সহজ ব্যাপার না। জীবনে চলার জন্য পাশে বন্ধুর মতো কাউকে দরকার”।

ঠিক এই মুহুর্তে আম্নু বলে একটা বাচ্চা ডেকে উঠলো। পেছন থেকে এসে ইশার আচঁল ধরে দাড়াঁলো। ইশা হেসে ছেলেকে কোলে নিয়ে বললো

” খেলনা কেনা হয়েছে আব্বু? পছন্দ হয়েছে কিছু”?

বাচ্চাটা বললো

” না কিছুই পছন্দ হয়নি। সব আগের খেলনা গুলোই”।

তখন একজন পুরুষ মানুষ বললো

” ইশা তোমার ছেলে যা বিচ্চু আর চালাক। এইটুকু বয়সেই সে নতুন পুরাতন চেনে। দোকানে গিয়ে কোন খেলনাই তার পছন্দ হয় না। যেটাই দোকানদার দেখায় সেটাই পুরাতন বলে। শেষে কিছুই নিলো না”।

উজান বুঝলো এটাই ইশার স্বামী। কিন্তু চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছে। একটু ভালো করে দেখে মনে করার চেষ্টা করলো সে। মনে পড়লো তার। আরে হ্যাঁ এইটাতো ইশার ফুপুর ছেলে। তার মানে ওই ছেলেটার সাথে ইশার বিয়ে হয়নি। কিন্তু এই ছেলেতো বিবাহিত ছিলো। তাদের বিয়েরও অনেক আগে বিয়ে হয়েছিলো। একটা বাচ্চাও ছিলো তাদের। উজানকে চুপ করে থাকতে দেখে সেই পুরুষ মানুষটি বললো

” আরে উজান ভাইয়া আপনি এখানে? কত বছর পর দেখা। কেমন আছেন?

উজান হেসে বললো

“ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? ইশা প্রায় আপনার কথা বলে “।

উজান ইতস্তত বোধ করলো। বর্তমান স্বামীর কাছে প্রাক্তন স্বামীর গল্প করা কেমন বিচ্ছিরি ব্যাপার মনে হলো তার। যতই হোক এক সময় তারা বেশ ভালো দাম্পত্য জীবন পার করেছে। উজানকে একটু বিব্রত হতে দেখে ছেলেটি ইশাকে বললো

” ইশা বাবুর জন্য কিছু ড্রেস কিনেছি। আর তোমার জন্যও। কাউন্টারে রাখা আছে। বিল করছে। তুমি একটু এগিয়ে দেখো। কাপড়গুলো বাবুর সাইজ মতো গায়ে হবে কিনা”।

ইশা হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়িয়ে সেদিকে আগায়। উজানকেও যেতে হবে। আরও কিছু কিনতে হবে। সময় বেশি নেই। উজানও তাড়া দেখিয়ে বিদায় নিয়ে সামনে এগোতে নিলেই ইশার স্বামী বললো

” ইশাকে সেই ছেলে ঠকিয়েছে উজান ভাই। আপনার সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর ইশা বাড়িতে সেই ছেলের কথা জানায়। বলে বিয়ে করবে দুজন। প্রস্তুত তারা। বিয়ের কথা পাকাপোক্তও করে। বিয়ের পর ব্যবসা শুরু করবে এই কথা বলে ইশার বাবার কাছ থেকে ছেলেটা পাচঁ লাখ টাকা নেয়। সরল মনে তারা দেয়। বিয়ের তারিখ পাকাপোক্ত হয়। কিন্তু যেদিন বিয়ে সেদিন সেই ছেলেটি আর আসেনি। তার এক বন্ধু মারফত ইশা জানতে পারে বিয়ের দিনই সেই ছেলে বিদেশ চলে গেছে। এই ব্যাপারে তার পরিবারের সাথে কথা বললে বলে তারাও কিছু জানে না। তারাও এই কথা বিয়ের দিনেই জেনেছে। এর মধ্য বাপের বাড়ি থেকে আসার সময় একটা রোড এক্সিডেন্টে আমার স্ত্রী আর মেয়ে দুজনেই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে আমাদের বিয়ে হয়। ইশা এখনো মনে করে আপনাকে ঠকানোর জন্যই সেও এইভাবে ঠকে গেছে। এখনো সে আপনার কথা বলে প্রায়ই আফসোস করে। আপনি ওরে ক্ষমা করে দিয়েন”।

ইশার স্বামীর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় উজান। আসলে এমনটা যে হবে আশংকা করেছিলো সে শুরুতেই। এজন্য সাবধানও করেছিলো ইশাকে। দুজন পুরুষ মানুষ নিজেদের মধ্য আরও কথা বলে কাউন্টারে বিল মিটিয়ে বের হয়ে আসতে নেয় উজান। আসার আগে সে ইশা কে বলে

” যে জীবন তুমি আবার উপহার পেয়েছো তাকে আনন্দে বিমোহিত হয়ে উপভোগ করো। কোন পিছুটান রেখোনা ঠিক যেমন আমার নেই। ভালো থেকো এটাই চেয়েছিলাম এখনো চাই। কোন অভিযোগ নেই এখানে “।

চলবে……….