নুন ঝালের সংসার পর্ব-০৪

0
28

#নুন_ঝালের_সংসার

(৪র্থ পর্ব)

তাপসীর ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। রাতে ঘুম এসেছে অনেক পরে। ঘুম থেকে উঠে দেখলো সুমন অফিসে চলে গেছে। মন খারাপ হলো তাপসীর। ঝগড়াঝাটি যাই হোক সকালের নাস্তা না খাইয়ে সুমনকে ছাড়ে না। আজ কেন যে ঘুম ভাঙলো না বুঝতে পারে না!

তাপসীর ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছিলো। বাচ্চা দুটোও উঠে খেতে চাইবে। তাপসী দ্রুত হাতে খিচুড়ি চাপিয়ে দিলো। বাচ্চা দুইটার জন্য একটু নরম নরম করে ডিম ভাজি করলো। নিজে আর ডিম খেলো না, কেন যেন সুমনের জন্য খুব খারাপ লাগছিলো। আজ তো দুপুরের লাঞ্চও বাইরে করবে, নাহ এতোটা রাগ না করলেও পারতো। মনে মনে নানান কথা উঠা নামা করলো তাপসীর। এরই মধ্যে ছেলেটাকে স্কুলে দিয়ে আসলো, মেয়েটাকে কোলে ঝুলাতে ঝুলাতে নিয়ে গেলো। ফিরে আসার পথেই মেয়েটা ডায়াপারে পটি করে দিলো।

মেয়েটার দোষ না। রাস্তায় এতো জ্যাম যে সে আর আটকে রাখতে পারে নি। বাচ্চা দুইটার জন্য কেন যেন হঠাৎ মায়া এসে ভর করলো। মনে পড়লো গাযায় মারা যাওয়া বাচ্চাদের কথা। আহা, ওরই বাচ্চাদের বয়সী। কিভাবে আম্মি আম্মি বলে উচ্চস্বরে কাঁদে। খাবারের অভাবে ঘাস পাতা পর্যন্ত খায়! তাপসীর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো। রিকশায় বাচ্চা দুটোকে মা পাখি যেভাবে তার সন্তানদের আগলে রাখে, সেভাবে আগলে রাখলো। যেন এখুনি কেউ ওদের বাচ্চাকে ছিনিয়ে নেবে৷

বাসায় ফিরে মেয়েকে পরিস্কার করে ছেলেটাকে গোসল করিয়ে একটু নাস্তা দিলো। টিভিতে কার্টুন ছেড়ে দিলো। ওরা টিভি দেখতে দেখতে রান্না সেরে ফেলবে। আল্লাহ বাঁচিয়েছে আজ বুয়া এসেছে। বুয়া মুখ চালাতে চালাতে ঘর পরিস্কার করছে। ওর স্বামী ঠিকমতো কাজ করে না আবার বুয়ার টাকা নিয়ে ওকেই কথায় কথায় পিটায়। তাপসী বুয়ার কথার উত্তর দেয় না। উত্তর দিলেই আরো অনেক ক্যাঁচাল শুরু করবে। ওরা স্বামীর মাইর খায় আবার সেই স্বামীকে কেউ কিছু বললে বাঁচে না। মাইর খাওয়া ভাত খাওয়ার মতোই নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে গেছে।

রান্নাবান্না শেষ করে বাচ্চাদের খাইয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে প্রায় চারটা বেজে গেলো। প্লেটে ভাত নিয়ে খেতে বসেও মুখে ভাত তুলতে পারলো না তাপসী৷ সুমন কি খেয়েছে?

সব মান অভিমান ভুলে তাপসী ফোন করলো। ওপাশ থেকে রিং বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। নাহ, তাপসী আর মন খারাপ করলো না। মন খারাপ করে লাভ নাই। ব্যস্ততা থাকতেই পারে।

ঘুম থেকে বাচ্চারা উঠেই জিদ করে – বাইরে যাবে। বাসার পাশেই একটা ছোট্ট পার্ক মতো আছে। ভাবছে যাবে কিনা। দুইটা নিয়ে সামলানো কষ্ট। সুমন আসলে ভালো হতো। পাঁচটার বেশি বাজে। আরেকটু পরেই হয়তো আসবে। এমন সময় তাপসীর হোয়াটসঅ্যাপে অপরিচিত নাম্বার থেকে দুইটা ছবি আসলো। তাপসী ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। বাচ্চাদের চিৎকার কান্নাকাটি কোন কিছুই তার কানে যাচ্ছে না যেন!

শীলা ম্যাডাম সুমনের হাতে যে ফাইলটা ধরিয়ে দিয়েছেন সেটা বেশ জটিল। এতো জটিলতা হতো না, কিন্তু শীলা ম্যাডাম নিজে করতে যেয়ে বেশ গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছেন। সুমনের নিজেরও কিছু কাজ ছিলো। সেগুলো শেষ করে, শীলা ম্যাডামের কাজ শেষ করতে চারটা বেজে গেলো। সুমনের এখন বাড়ি ফেরার তাড়া। ব্যাগের মধ্যে তাপসীর জন্য কেনা স্পেশাল গিফট অলরেডি ঢুকিয়ে ফেলেছে। মেয়েটার অনেক দিনের ইচ্ছে – একটা ডায়মন্ডের আংটির। মুখ ফুটে বলে না। কিন্তু সুমন দেখেছে ফেসবুকে প্রায় এসব কালেকশনের ছবি দেখে। তাপসীর একটা পুরনো আংটি নিয়ে মাপ দিয়ে কিনেছে। এজন্য অনেকদিন ধরেই টাকা জমিয়ে তবেই স্বপ্ন পূরণ হলো।

ফাইলটা শীলা ম্যাডামের হাতে দিয়েই সুমন চলে আসতে চাচ্ছিলো। কিন্তু শীলা ম্যাডাম আটকে দিলেন।

– ওহ নো ডিয়ার। আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার সাথে লাঞ্চ করবে। সেটা না করলে আমার মনে কষ্ট লাগবে।

– ম্যাডাম, আরেকদিন করি। আজ আমার একটু আগে বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে যাবো।

– তার মানে তুমি আমাকে ইগ্নোর করার চেষ্টা করছো সুমন? বাচ্চাদের নিয়ে ছুটির দিনেও বাইরে যেতে পারবে। এটা কি আমাকে এড়ানোর চেষ্টা? অ্যাম আই এ ব্যাড ওম্যান?

ক্ষোভ ঝরে পড়লো শীলা ম্যাডামের কন্ঠে। উনাকে রাগালে এই অফিসে চাকরি করা কঠিন। এই মহিলার এতো মুড সুইং হয় বলার না। দেখা গেলো আগামীকালই সুমনের এমন জায়গায় পোস্টিং হয়ে যাবে যে কান্নাকাটি করার মতো অবস্থা হবে! নাহ, উনাকে রাগানো যাবে না!

মুখ ভার করে সুমন উনার সাথে চললো। বেশ নামকরা দামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো। শীলা কি সব বক বক করছিলো, সুমনের মাথায় ঢুকছিলো না। তাপসী আর বাচ্চাদের জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে। নামী রেস্তোরাঁয় সুস্বাদু খাবারও সুমনের কাছে বিস্বাদ লাগছিলো।

সুমন তখনো জানে না, কি দু:সময় তার সামনে। কেউ একজন তার নির্দোষ খাওয়ার ছবি তুলে পাঠাচ্ছে অন্য কোথাও।

(চলবে)