#নুন_ঝালের_সংসার
(৮ম পর্ব)
তাপসীর শাশুড়ি পরের দিনই চলে গেলেন। কিন্তু তাপসীর সংসারে জ্বলতে লাগলো তুষের আগুন। সুমন সহজে কারো উপরে রাগ করে না। কটূ কথাও ওর মুখ থেকে খুব কম বের হয়। তাপসী সুমনকে ভালো করেই চেনে। কিন্তু সুমন সেদিন তাপসী সংসার ছাড়া আর কোন কাজ করে না – এটা বললো তার মানে হঠাৎ রাগের মাথায় বলা কোন কথা না। বরং এই ক্ষোভ দীর্ঘদিন সুমনের মনে ছিলো, একটা রাগের মুহূর্তে সেটা বের হয়ে গেছে।
তাপসী কয়েক রাত ধরে ভাবতে থাকে। সুমনের একা সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যায় সন্দেহ নেই। এদিকে পরপর হওয়া দুই বাচ্চা নিয়ে তাপসীরও জীবন তালগোল পাকানো। জীবনের কিছু অর্জনের প্রমাণ হিসেবে কতগুলো কাগজের সার্টিফিকেট আলমিরার কোন এক ফাইলে পড়ে আছে। আজ সুমন হালকাভাবে বলেছে,বাচ্চারা আরো বড় হলে ওদের স্কুলে দিলে খরচ যখন আরো বাড়বে তখন দিনের মধ্যে কয়েকবার তাপসীর এই কিছু করে না – কথাটা বলতে পারে, অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাপসীর বান্ধবীদের মধ্যেই তো আর কেউ বসে নেই। তাপসী ওর বন্ধু বান্ধবীদের সাথেও যোগাযোগ রাখে না মানে রাখতে পারে না। ভাবছিলো বাচ্চারা আরেকটু বড় হলে কিছু করা যায় কিনা। কিন্তু ততোদিনে তাপসীর বয়স যেমন বসে থাকবে না, আবার পড়াশোনার মধ্যে না থাকলে জব পাওয়া কঠিন। সেই জব করা আরো কঠিন।
বান্ধবী তামান্নাকে ফোন দেয়। বেসরকারি সেক্টরে চাকরি করে। স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত চটপটে মেয়ে। মিশুক এবং পরোপকারী। তাপসী ওর কথা সব খুলে বলে। তামান্না তাপসীর সব শুনে চুপ করে থাকে।
– সরকারি চাকরি পাওয়ার বয়স তোর প্রায় শেষের দিকে। যা দুই এক বছর আছে তাতে তোর প্রস্তুতিতেই চলে যাবে। লম্বা একটা গ্যাপ পড়ে গেছে। এখন আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আবার সাকুর্লার সময় মতো হবে কিনা গ্যারান্টি নেই। বেসরকারি চাকরিতে ফ্রেসার খোঁজে। সদ্য পাশ করে বের হয়েছে এমন। আর তোর বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে যে অবস্থা তাতে তুই কোনভাবেই এখন এসব সেক্টরে পারবি না। আমার মনে হয় তোর যা সিচুয়েশন তাতে বাসায় বসেই কিছু করা যেতে পারে।
– বান্ধবী আর যাই হোক উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলিস না। একে আমার পুঁজি নাই তার উপরে এতো হ্যাপা আমি নিতে পারবো না।
– তুই এক কাজ কর কিছু অনলাইনে কোর্স করে ফেল। এই যেমন গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েবসাইট মেকিং, লোগো ডিজাইন – এই টাইপের কিছু। তুই বিবিএর স্টুডেন্ট, ব্রাইট স্টুডেন্ড। আত্মবিশ্বাস হারাবি না। আমি তোকে ভালো কিছু অনলাইন কোর্সের লিংক দিচ্ছি। এগুলো করে বাসায় বসেই কাজ করার চেষ্টা কর। প্রথমেই কিছু হবে না তবে লেগে থাকলে হবে। আর তোর তো প্রেজেন্টেশন ভালো ছিলো। সেই গুণ কাজে লাগাবি। তবে সব কিছুর আগে অবশ্যই সুমন ভায়ের সাথে কথা বলে নিবি। হাজবেন্ড ওয়াইফের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকা উচিৎ। এসব পরে ফ্লাস হলে জামাইরা নিতে পারে না।
তাপসী চুপ করে শোনে। এই বুদ্ধিটা ভালোই কিন্তু সুমন কি বলবে তাপসী জানে না। এসব কাজে খুব ভালো মানের ল্যাপটপ লাগে। সুমন কি কিনে দেবে? না দিলে এতো টাকা তাপসী কীভাবে জোগাড় করবে?
ছুটির দিন। সকাল বেলায় তাপসী খিচুড়ি গরুর মাংস রান্না করে। সুমন বেশ মজা করে খায়। এরপর তাপসী এক কাপ চা দেয়।
– আমি ভাবছি বাসায় বসেই কিছু একটা করবো।
– সেই কিছু একটা কি?
– অনলাইনে কাজ করা, আজকাল অনেকেই করছে। অবশ্য কিছু কোর্স করতে হবে।
– দেখো তোমার যা ভালো মনে হয়।
সুমন আর কথা বাড়ায় না। জিজ্ঞাসাও করে না, কিভাবে কি শুরু করবে বা তাপসীর কোন টাকা লাগবে কিনা। সুমন আসলে ভাবে ক্ষণিকের খেয়াল। আবার পরেই ঠিক হয়ে যাবে! বাচ্চা কাচ্চাই সামলাতে পারে না, তার আবার অন্য কাজ!
তাপসী দমে যায় না, মানসিক শক্তি বাড়ায়। কিছু একটা করতেই হবে। নিজের আর্থিক সক্ষমতা না থাকলে বাচ্চা কাচ্চাও দুই দিন পরে দাম দেয় না। নিজের কিছু শখ আহ্লাদ থাকে। আর বাবা মায়ের হাতেও যদি কিছু দিতে পারে, নিজের জীবন, ঐ ড্রয়ারে পড়ে থাকা সার্টিফিকেট এগুলো ধন্য হবে। সুমনের উপরেও চাপ কমলে ওর একটু স্বাভাবিক হবে, এভাবে সব সময় দৌড়ের উপরে থেকে মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
তাপসীর সামান্য কিছু টাকা ছিলো। সেখান থেকেই টাকা নিয়ে অনলাইন কোর্সে ভর্তি হয়। দুই মাস, তিন মাসের কোর্স করতে থাকে। একইসাথে বাচ্চাদের একটা রুটিনের মধ্যে আনার চেষ্টা করে। রাতে আগেই ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস করানো, নির্দিষ্ট সময়েই খাবার দেয়া, বাসায় অহেতুক বিশৃঙ্খলা না করা। লাস্টের বিষয়টা বেশ কঠিন। কিন্তু তাপসী লেগে আছে, ওদের সাথে খেলা করে গল্প করে নিজের আয়ত্বে আনার।
সমস্যা হয়ে গেছে অন্য জায়গায় – ল্যাপটপ কেনা খুব দরকার। কিন্তু টাকা কোথায় পাবে? সুমন এতো টাকা দেবে কী না তাপসী বুঝতে পারে না। চাকরিতে ঢোকার জন্য মানুষ আট, দশ লাখ টাকা খরচ করতে পিছপা হয় না। কারণ ঢুকলেই মাস শেষে টাকা। আর এসব কাজে আয় অনির্দিষ্ট। হতে পারে আবার নাও হতে পারে। লেগে থাকতে হয়। আবার অনেকের লাক ক্লিক করে ভালো কোন ডিল পেয়ে যায়। তাপসীর ভাগ্যে কি আছে তাপসী বোঝে না।
(চলবে)