নৈঃশব্দ্যের প্রেমালাপ পর্ব-০৪

0
9

#নৈঃশব্দ্যের_প্রেমালাপ
#পর্ব৪
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
আদাভান দ্রুত গতিতে ছুটে গেলো,তৃধার মাথাটা তুলে ডাকলো কয়েকবার,গালে আলতো চাপ’ড় দিতেই আঁত’কে উঠলো জ্বর এ গা পু’ড়ে যাচ্ছে।
আদাভান দেরি করলো না কোলে তুলে নিলো তৃধা কে,বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পানির গ্লাস হাতে নিলো,বার কয়েক পানির ছিটা দিয়েও কোনো লাভ হলো না।
চিন্তায় পড়লো সে,যতই শত্রু”তা থাকুক মানুষ হিসেবেও তো তার একটা দায়িত্ব আছে,নিজের কিছুক্ষণ পূর্বে করা কাজের জন্য এখন বেশ আত্মগ্লানিতে ভুগছে,মেয়েটা যে এতো অসুস্থ বুঝতেই পারেনি,এতো দিন কেনো ভার্সিটি আসেনি তা জানার প্রয়োজন মনে করেনি, কে এই মেয়ে যার জন্য এতোটা উতলা হতে হবে?নিজের জে”দ বজায় রেখেছে আজও,নাম মাত্র বিয়ে হওয়া তে কেউ কারো আপন হয়ে যায় না, আর না তার সাথে অন্য কোনো ভালো সম্পর্ক কল্পনা করা যায়,তৃধার জায়গায় অন্য কেউ হলেও হয়তো একটা কথা ছিলো,কিন্তু এই মেয়ে প্রশ্নই উঠে না।

আদাভান মনে মনে চিন্তিত হলো, তৃধা কে এখানে কেউ এভাবে দেখলে কি ভাববে?ডাক্তার ডাকলেও তো সমস্যা, এনেছিলো সুস্থ এখন একদম অ”জ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মানুষ তাকেই দো’ষী ভাববে নিশ্চিত, মেয়েটা কে কি সাধে আপ”দ বলে,অসুস্থ শরীর নিয়ে বের হয়েছে কেনো?যত্তসব!
লম্বা শ্বাস টেনে বাথরুমে গেলো আদাভান,জলপট্টি দেওয়ার জন্য পানি আনলো,একটা চেয়ার পেতে বসলো তৃধার মাথার কাছে, না চাইতেও ছুঁয়ে দিতে হচ্ছে এই মেয়েকে, প্রথমেই মুখ মুছে দিলো কপালে পানিতে ভেজানো কাপড় টা রাখলো এর থেকে বেশি কিছু করা অসম্ভব ওর পক্ষে,এই বেয়া”দব টার জন্য যে এতটুকু করেছে এই অনেক!
———–
নাদিম তৃধার ফোন কে’টে দেওয়া তে তেমন কিছু মনে করেনি এই মেয়ে এমনই ফোন দিয়ে ত্যা’ড়ামি করে।
নাদিম মনোযোগ দিয়ে ফেইসবুক ঘাঁ’টছে এরই মধ্যে ফোন আসলো নোভার নাম্বার দেখে দ্রুতই রিসিভ করলো।

নাদিম ফোন কানে তুলে কিছু বলার আগেই নোভা বলে উঠলো–,,এই তৃধা কি তোর সাথে?এখনো রুমে আসেনি, ফোন দিচ্ছি এতো করে রিসিভ করছে না।

নাদিমের টন”ক নড়ে উঠলো,দুপুরেই তো ফোন করলো, কোনো বিপ”দে পড়ে দেয়নি তো আবার?নিজের গালেই চ”ড় দিতে মন চাইলো ওর।

নাদিম বলে উঠলো—,,দোস্ত ওর কিছু হয়নি তো আবার? আমার সাথে তো নেই,আমি হোস্টেলে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম বললো রিকশায় করে চলে যাবে,একাই তো গেলো তুই বলছিস এখনো যায়নি দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল হয়ে গেছে!

নোভা একটা ধ”মক দিয়ে বললো—,, নাদিমের বাচ্চা,বাকি সময় তো জোর করে আসতে পারিস আজকে ও অসুস্থ ছিলো একা কি করে ছাড়লি গ”রু।এবার কি হবে?

রুমে থাকা আভা,নিশি ও চিন্তায় পড়লো।নাদিম অপরা”ধীর ন্যায় বললো—,,আবার ও আমাকে ফোন করেছিলো, ভাব নিয়ে কি চাই জিজ্ঞেস করেছিলাম ও তো রেগে কল কে’টে দিলো আমি ভাবছি এমনি হয়তো।

নোভা রেগে বললো–,,তুই ম’র হারা”মি,আমি বের হচ্ছি ওকে খুঁজতে।

নাদিম বলে উঠলো –,,আমার কথাটা শোন একটু আমিও তো যাবো।

নোভা তো বের হয়ে যাচ্ছে সাথে আভা, নিশি ও গেলো।
ওদের জানা মতে যে যে জায়গা আছে সব গুলো তে গিয়ে খুঁজলো,এরই মধ্যে নাদিম ও আসলো।সে ক্লান্ত হয়ে বেঞ্চে বসে বললো–,,কোথাও পাইনি, বিশ্বাস কর আমার অনেক চিন্তা হচ্ছে ওর যদি কিছু হয় সত্যি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না আমি।

নোভা ও ধপ করে বসে পড়লো,ঘড়ির কাঁটায় রাত নয়টা চার বন্ধু মিলে বসে আছে ভার্সিটির বাহিরে রাস্তায়।

আভার ফোনটা কেঁপে উঠে জানান দিলো কেউ কল করেছে,নাম্বার টি দেখে আভা এবার কান্না করে দিলো মেয়েটি বরাবরই ইমোশনাল এতোক্ষণ যে শান্ত ছিলো এই অনেক।
স্ক্রিনে ঝলঝল করছে তৃধার আম্মু নামটি,নাদিম বলে উঠলো –,, খবর”দার বড় আম্মু কে কিছু বলবি না,এই নোভা আভা সেজে কথা বল।

নোভা মোবাইল কানে তুললো–,,এই আভা তৃধা কোথায় রে?কল দিচ্ছি ধরছেই না, মেয়েটা এতো অভিমানি মায়ের উপর রাগ করে বসে আছে, ফোন টা দে তো ওর কাছে, আজ সারাদিন ওর কথা এতো মনে পড়েছে কি বলবো, মন টাও কেমন অস্থির হয়ে উঠছে!

নোভার মিথ্যা বলতে কি যে খারা’প লাগছে বলাই বাহুল্য।
মায়ের মন হয়তো সত্যি ঠিক টের পেয়ে গেছে।
নোভা কাঁপা কন্ঠে বললো–,,আন্টি তুমি ও না বেশি ভাবছো তোমার মেয়ে তোমাকে বেশি ভালোবাসে তো তাই রাগ করেছে,দুইদিন পর দেখবে আবার ঠিক ও হয়ে যাবে।

রাজিয়া বেগম অধৈর্য হয়ে বললো–,,দে না মোবাইলটা ওর কাছে বল শুধু দু মিনিট কথা বলবো!

নোভা নাদিমের দিকে তাকালো,নাদিম নোভা কে শান্ত থাকতে বললো,নোভা ঠোঁট কাম’ড়ে নিজেকে আটকালো বলে উঠলো–,,ও তো ঘুমাচ্ছে, আর বলো না জ্বর বাঁধিয়েছে তোমার মেয়ে,ঔষধ খেয়ে মাত্ররোই ঘুমালো এখন ডেকে তুলবো?

রাজিয়া বেগম বলে উঠলো–,,ডাকিস না ঘুমাক,জ্বর এসেছে আমাকে একবার বলবে না?একবার হাতের কাছে পাই আচ্ছা করে কয়েকটা লাগাবো আমি,উঠলে আমাকে আগে ফোন করতে বলবি কেমন?

নোভা ঠিক আছে বলে ফোন কা’টলো।এরই মধ্যে আভা বলে উঠলো –,,এই ও আবার বা’রে চলে যায় নি তো?

নাদিম চকিত নয়নে তাকালো,নোভা বলে উঠলো–,, কোনো দিন একা গিয়েছে ও?এখন তো এসব ছেড়েই দিয়েছে প্রায়।

আভা বললো–,, পাগ’ল টা আংকেলের উপর রাগ উঠলেই তো যায়,ওফ মেয়েটা পাগ’ল করে ছাড়বে একেবারে।
নাদিম বলে উঠলো –,,আয় তোদের হোস্টেলে দিয়ে আসি,রাত হয়েছে বাহিরে থাকা সেইফ না। আমি আর রাদিফ মিলে ওকে খুঁজছি।

নিশি বলে উঠলো–,,রাদিফ টা আবার কে?

আভা বললো–,, আমাদেরই ক্লাসমেইট,এখন এসব বাদ দে এই নোভা তৃধা কে আবার কল কর তো শেষ চেষ্টা করে দেখি।

নোভা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো, কল করতেই রিসিভ হলো ওদের চোখে মুখে খুশির ঝলক দেখা গেলো।
নোভার কন্ঠনালি কাঁপছে অধৈর্য হয়ে বললো–,,তৃধা কোথায় তুই?কখন থেকে খুঁজছি তোকে ঠিক আছিস তো?

আদাভান শান্ত কন্ঠে উত্তর করলো–,, আমি তৃধা নই,আদাভান!

নাদিম সহ বাকিরাও অবাক হলো,আদাভান নিজ থেকেই বললো-,,আসলে তৃধা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো দুপুরে তাই আর ফিরতে পারেনি,আমার কাছে তোমাদের কারো নাম্বার না থাকায় কল করতে পারিনি,তোমরা চিন্তা করো না সকালে আমি নিজে পৌঁছে দিয়ে আসবো!

নিশি মুখ বাঁকালো, এদিকে ওরা চিন্তায় ম’রে যাচ্ছে উনি এসে বলছে চিন্তা করো না।
কথা বলা শেষ হতেই নাদিম বললো-,,তোরা কি বলিস?

নোভা বলে উঠলো –,,কাছেই তো আয় যাই,ওকে না দেখে গেলে আমার ঘুম হবে না ভাই।

আভা বললো–,,স্যার হোক বা দুলাভাই তৃধা উনাকে পছন্দ করে না,এতোক্ষণ ওখানে থাকতে রাজি হলো কেনো বুঝতেছি না আমার মনে হয় অন্য ঘটনা!

নাদিম উঠে দাঁড়িয়ে বললো–,,আয় এখনই যাবো।

পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠলো–,,এই নোভা না রাতে এখানে কি করছিস?

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে নাদিম পিছু ফিরলো আদিব কে দেখেই বলে উঠলো–,,ভাইয়া!

নাদিম গিয়ে ভাই কে জড়িয়ে ধরলো,কতোদিন পর দেখছে মানুষ টা রাগ করে ওই যে বাড়ি ছাড়লো আর গেলোই না!

আদিব আবার জিজ্ঞেস করলো–,, কি করছিস এখানে আগে বল।

নাদিম প্রথম থেকে সব খুলে বললো, তৃধার বিয়ের খবর পেয়েছিলো আগেই তবে মেয়েটা যে ঢাকা তে এসেছে তা জানতো না।আদিবের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো।

নিজের বন্ধুদের বিদেয় জানিয়ে ওদের সাথে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

————
আদাভান বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে এখনো,মেয়েটা অজ্ঞা’ন হয়েছে ভালো কথা, জ্বরের ঘোরে ওর হাত কেনো ধরে রেখেছে কে জানে।
সেই সন্ধ্যা থেকে এই মেয়ে ওর হাত চেপে ধরে আছে,তৃধা গভীর ঘুমে জ্বর আর ক্লান্তিই এই ঘুমের আসল কারন।আদাভান ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে যাক অন্তত হুঁ’শে তো এসেছে।
আদাভান যতই নিজের হাত ছাড়াতে চেয়েছে ততোই গভীর ভাবে হাত জড়িয়ে ঘুমিয়েছে তৃধা।
কপাল চাপড়ালো আদাভান, কোন দুঃখে যে এটাকে দুপুরে বাসায় আনতে গেলো,একবার যদি ওর দাদুর কাছে খবর যায় আর ভাবতে পারলো না আদাভান এই বুড়ো তো তাকে বনবাস দিতে দুবার ও ভাববে না!

কলিং বেল বেজে উঠলো, আদাভান জোরে টানলো নিজের হাত,হাত সরাতেই চোখের পাতা নড়ে উঠলো তৃধার।পিট পিট করে তাকালো আশেপাশে আদাভান কে দেখে তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো,একবার নিজের দিকে তাকালো না সব ঠিকই তো আছে, এখানে কি করে আসলো?প্রথমে মনে করতে অসুবিধে হলো, মনে পড়তেই বিছানা থেকে নেমে গেলো ও,শরীর দুর্বল থাকায় আবার বসে পড়লো বিছানায়,মাথা চেপে ধরলো নিজের।

কলিং বেল পুনরায় বাজায় আদাভান বললো-,,এই মেয়ে একদম নড়াচড়া করবে না, খে”য়ে ফেলবো না আমি তোমায়, চুপচাপ বসে থাকো!

আদাভান দরজা খুলতে দেরি,হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকতে দেরি হলো না সবার।

বসার ঘর পেরিয়ে সবাই গিয়ে হাজির শয়নকক্ষে।তৃধা মাথা চেপে ধরে বসে আছে।
নোভা ডেকে উঠলো–,,তৃধা!
তৃধা সবাই কে দেখে খুশি হলো,সে তো আরো ভাবছিলো কি করে এখান থেকে যাবে। রাত যে হয়ে গেছে এটা অব্দি জানে না এখনো।

নাদিমের পেছন থেকে আদিব বেরিয়ে আসলো,তৃধা তাকে দেখে আর দেরি করলো না, অসুস্থ শরীর নিয়েই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।

আদাভানের মনে হয় একদম ক’লিজায় গিয়ে লাগলো,
কেনো একটা ছেলেকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে হবে?আদাভান অবাক হলো পর মুহুর্তেই, ধরতেই পারে তাতে তার কি!

তৃধা কান্নারত কন্ঠে বললো–,,ভাইয়া তুমি এতোদিন পর এসেছো?তোমার তৃধা তোমাকে কতো মিস করে তুমি জানো না?

আদিব হেসে তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো–,,পা”গলি কি করেছিস নিজের অবস্থা? তোকে কতোবার বুঝিয়েছি বল তো অন্যের জন্য কখনো নিজের কোনো ক্ষ’তি করবি না, কথা শুনিস না কেনো আমার?

তৃধা অভিমানী সুরে বললো–,,তুমি ছাড়া আমার কথা কেউ ভাবে না ভাইয়া।কেউ একটুও ভালোবাসে না আমায়,সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত!

নাদিম বলে উঠলো–, হ ভাই কেউ তোমারে ভালোবাসে না,সেই বিকেল থেকে খুঁজে খুঁজে হয়রা’ন হয়ে গেছি তার পর ও মানুষের মন পেলাম না।

তৃধা কে বসালো সোফায়,আদিব তৃধার হাত দেখেই ধ”মক দিয়ে বললো–,,আবার হাত কে”টেছিস তুই?কি একটা অবস্থা আল্লাহ তৃধু কবে বুঝ হবে তোর,ইশঁ!অনেক ব্যাথা হচ্ছে নিশ্চয়ই?

নোভা বলে উঠলো –,,ভাইয়া আর বলো না,শুধু কাট’লে কথা ছিলো, এই একই হাতের উপর তোমার বোন বার বার অত্যা’চার করেছে গরম পানি ফেলে দিয়েছে ওই দিন,তাও কিনা একটা ফা”লতু মেয়ের উপর রাগ দেখিয়ে!

আদাভানের গা পি”ত্তি জ্ব’লে যাচ্ছে যেনো,সে শুধু ভাবছে কতোটা ক্লোজ বসেছে তৃধার হাত ধরেছে, কতোটা ভালোবাসা দেখাচ্ছে,এতো এতো কেয়ার কেনো করবে অন্য কেউ?
আদাভান আবার নিজের কাজে বিরক্ত হলো,ওর কি যা খুশি হোক!

তৃধা এবার আদাভানের দিকে তাকালো যে কিনা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে,তৃধার মনে পড়লো দুপুরের কথা, অপমা’নের কথা মনে পড়তেই বলে উঠলো–,,ভাইয়া আমাকে নিয়ে চলো এখান থেকে,আমার এখানে দ’ম বন্ধ লাগছে!কিছু কিছু মানুষ কে দেখলেই আমার নিজেকেই কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করে।

রাগে কাঁপছে তৃধা,আদিব বুঝার চেষ্টা করবো বিষয় টা,তৃধা যে তীব্র ঘৃ”ণা করে সামনে থাকা ব্যক্তি কে বুঝতে বেশি সময় লাগলো না ওর।

আদাভান আগ বাড়িয়ে বললো–,,তোমরা এখানেই থেকে যাও আজ,রাত তো অনেক হলো না যাওয়াই ভালো।

তৃধা রেগে বললো–,,তোমরা কি যাবে আমার সাথে?নাকি আমি একাই চলে যাবো?

আদিব মুচকি হাসলো,আদাভানের দিক তাকিয়ে বললো–,,প্রফেসর আমরা আজ আসি,আমার বোন কে সাহায্যে করার জন্য ধন্যবাদ!

আদিব কে এর আগে দেখেনি আদাভান,তবে এতটুকু জানে তৃধার আপন কোনো ভাই নেই,চাচাতো ভাই আছে!

তৃধা রাগে কট”মট করে একবার আদাভানের দিক তাকালো পরেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

আদিব সবাই কে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে গেলো,কিন্তু সেখানে ঘটলো আরেক বিপত্তি রাত নয়টার পর ঢুকতে দেওয়া হবে না,এখন প্রায় রাত সারে দশটা।
কপালে ভাঁজ পড়লো আদিবের,হোস্টেলের দারোয়ান কে রিকুয়েষ্ট করেও কাজ হলো না।ছেলে হলে তো কোনো সমস্যাই হতো না,ওরা চার জনই মেয়ে।

তৃধা বলে উঠলো—,,নাদিম ভাই আমার আগে একটু পানি এনে খাওয়া, দুপুরে ওই অভ”দ্র লোকটা মুখের সামনে থেকে পানি কে”ড়ে নিয়েছিলো কোনো দিন ভুলবো না আমি,এতোটা নির্দ”য় মানুষ, রাস্তার কুকু’রের সাথেও মানুষ এমন ব্যবহার করে না, যেমন টা উনি আমার সাথে করেছেন।

রাস্তায় বসে আছে ছয় জন,রাত বাড়ছে সাথে চিন্তা ও কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা গাড়ি এসে থামলো সেখানে
নাদিম নিজের মামা কে দেখে চিনতে ভুল করলো না।

আদিব বললো–,,থ্যাং গড মামু তুমি এসেছো।

সজল হাসি মুখে বললো–,,মামা ভাগিনা যেখানে আপ’দ নেই সেখানে।

আদিব সবাই কে বললো–,,সব গুলোতে গিয়ে বস গাড়িতে।
আদিব গিয়ে বসলো সামনে,নাদিম, আভা,নিশি পেছনে।
তৃধা, নোভা মাঝে।
তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে বললো-,,ভাইয়া তুমি কি এখন আমাদের কে ওই আজাদ তালুকদারের কচু মার্কা বাড়িতে নিয়ে যাবে?

আদিব হাসলো –,, রাগ করিস না বনু,এ ছাড়া উপায় নেই মামার বাড়ি যেতে পারতাম,তবে বাড্ডা এখান থেকে কম দূরে না রাত হয়েছে এখন বড় আব্বুর বাসায় থাকাই ভালো,কেয়ারটেকার কে বলে দিয়েছি উনি সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন!

নিশি বলে উঠলো–,,তোদের এখানে বাড়ি আছে?তার পর ও হোস্টেলে কেনো থাকিস?

আভা বললো–,,তা তোকে পরে বুঝিয়ে বলবো,লম্বা কাহিনি।
———-
বাড়ি এসেই খেয়ে দেয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছে সবাই,তৃধার বাবার করা দু তলা আলিশান ভবন,কাজের সূত্রে এসে তিনি এখানেই থাকেন,তৃধার দাদু ভাই গ্রামে থাকতেই পছন্দ করতেন,সেই সুবাধেই মফস্বলে থাকতো তারা,দাদু ভাই গত হলেন কিন্তু আর আসা হয়ে উঠলো না শহরে!

আদাভানের ঘুম আসছে না কিছুতেই, কিছু তো একটা আছে,অজানা এক অনুভূতি মনের ভিতরে এসে হা’না দিচ্ছে, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে,কিন্তু সেটা কি?কিছু কি নেই ওর জীবনে?মেয়েটা জীবনে আসার পর থেকেই এতোটা পরিবর্তন হচ্ছে আদাভানের ভিতরে কই আগে তো এমন হয়নি কখনো!আদাভান রাগে দুঃখে মাথা ব্যাথার ম”লম বেশি করে লাগালো কপালে, আজ ঘুম না এসে কই যায় সে ও দেখবে,এই মেয়েকে মাথা থেকে বের করতে হবে যেভাবেই হোক!
————–
ভোর বেলাতেই রওনা দিয়ে সাতটার সময় হোস্টেলে গেলো সবাই,আজ ক্লাস টেস্ট আছে।
পাঁচ জনের মধ্যে একজনেরও প্রস্তুতি ভালো না আগে যা পড়েছিলো তাই,আবার আজকে ফিজি’ক্যাল ফার্মেসির ক্লাস আছে।

ক্লাস রুমে ঢুকতেই ধাক্কা লাগলো সোহার সাথে,বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকালো তৃধা,শয়তা’নের নাম না নিতেই এসে হাজির,আজকের দিন টাই খারা’প যাবে।
পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লো ওরা,প্রথম ক্লাস এই শিক্ষক কে কে করাতে দিয়েছে?

কিছুসময় পরই ক্লাসে শিক্ষক আসলো,সবাই ভয়ে আছে আদাভান পড়ানো তে ভালো হলেও তার মনে বিন্দু মাত্র সহানুভূতি নেই সবাই বুঝে গেছে ইতিমধ্যে, এতোবার করে বুঝিয়েছে এখন ফেই’ল মার’লে কথা শুনানো টা আহামরি কিছু না।

তবে তৃধা জানেই না তার জন্য কি বিপ’দ আজ অপেক্ষা করছে।সোহা,রূপা,নিপা দাঁত কেলিয়ে হেসে পরীক্ষা দেওয়া শুরু করলো,তারা আজ তৃধাদের পাশাপাশি বসেছে, পরীক্ষা শুরু হওয়ার দশ মিনিট পরই সোহা চেঁচিয়ে উঠে বললো–,,স্যার ওই বেঞ্চের ওই মেয়েটা ক্লাসে নক”ল নিয়ে এসেছে!

তৃধার হাত থেমে গেলো বাকিদের ও একই অবস্থা, মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একে অন্যের।

আদাভান গম্ভীর কন্ঠে বললো–,,কে?ক্লাসে এরকম অসভ্য’তা করার সাহস কে দেখিয়েছে?

রূপা বলে উঠলো–,,কে আবার স্যার,প্রথম দিন থেকেই কাহিনি শুরু করেছে যে মেয়েটা,একটুও ডিসিপ্লিনে থাকে না ও,প্রথম দিন দেরি করে এসেছে সবার সাথে খারা’প ব্যবহার করেছে,মেয়েটা এতো অহং’কারী! তার উপর আমাদের তো বলেছে কিভাবে যে বলি স্যার?

আদাভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃধার দিকে,রূপা কে বলে উঠলো–,,তুমি বলো কি বলেছে?

রূপা নিজের চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললো–,, আপনার সাথে নাকি বা’সর করার ক্ষমতা ও ওর আছে!

তৃধা চোখ বড় বড় করে তাকালো মেয়েটা এতো নিচে নেমে যাবে একবারও ভাবেনি তৃধা এমন কথা কখন বললো ওদের সামনে?

তৃধার রাগে দুঃখে লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করলো,এতো গুলো মানুষের সামনে এতো বড় অপমান!

নিপা বললো –,,হ্যাঁ স্যার, আবার আজ নক”ল ও নিয়ে এসেছে,এ ও বলেছে ওকে ধরার সাধ্য কারো নেই।
এসব ওর বা হাতের খেল!আসল কথা স্যার ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে এখন কিছু পারে না তাই এগুলা ওর নাটক।

নাদিম, নোভা,আভা,নিশি তৃধার দিকে তাকিয়ে এখনো কিছু বলছে না কেনো?

নাদিম বলে উঠলো–,,এগুলো সব মিথ্যা কথা স্যার।

রূপা বলে উঠলো–,,মিথ্যা না সত্যি তা তো প্রমান হয়ে যাবে এখনই,ওর চেয়ারের ওখানে দেখুন স্যার কাগজের টুকরো স্পষ্ট নজরে আসছে,তৃধা ছাড়া সবাই নিচু হয়ে দেখলো কি আছে।নোভা হাতে করে উঠিয়ে বলে উঠলো –,,সত্যিই তো কাগজ,কিন্তু কে রাখলো?

আদাভানের মন বি”ষিয়ে উঠলো,আগের ক্ষো’ভ রাগ তাকে অন্ধ করে দিলো ভেবেই নিলো এটা তৃধারই কাজ,তৃধা ছাড়া উশৃ’ঙ্খল একটাও নেই ক্লাসে।
তৃধা বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে,আদাভানের প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায়।

তৃধা কে শান্ত দেখে নাদিম ভয় পাচ্ছে,রূপার জীবনে যে এবার কি কি হবে অভাবনীয়।

আদাভান গম্ভীর কন্ঠে বললো–,,কোনো বেয়া’দবের জায়গা এই ক্লাস রুমে হবে না।

তৃধা মৃদু কন্ঠে বললো–,,এক পক্ষের কথা শুনে বিচার করাটা বোকাদের কাজ প্রফেসর!

আদাভান কঠিন কন্ঠে বললো–,, তোমার থেকে শিখতে হবে না আমাকে কোনটা ভুল কোনটা সঠিক।

তৃধার ধারা’লো জবাব–,,ওয়েল!যেমন আপনার ইচ্ছে,একটা কথা আছে না মানুষ একবার ভুল করা শুরু করলে পদে পদেই ভুল করে।আজ ক্লাসে কিছু মানুষ ওটা করেছে,তাদের কে তো আমি দেখে নিবো!

রূপা নাকি সুরে বললো–, দেখেছেন স্যার আপনার সামনেই থ্রে’ট দিচ্ছে!

আদাভান ধম”ক দিয়ে বললো–,,ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও বলছি,এর পর থেকে আমার ক্লাসে যেনো তোমাকে না দেখি,শিক্ষকদের নিয়ে কূট ক্তি করতে মুখে বাঁধে না যার তার ক্লাস করার কোনো অধিকার নেই,বেয়া”দব দের আদাভান পড়ায় না!

তৃধা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসলো,আদাভানের সামনে এসে দাঁড়ালো দাঁতে দাঁত চেপে বললো–,,কিছু কিছু ভুলের কোনো দিন ক্ষমা হয় না প্রফেসর!শিক্ষক হতে হলেও যোগ্যতা লাগে যা বুঝলাম তা আপনার নেই।

তৃধা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো আদাভান রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো।
পর পর খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেলো নাদিম,নোভা, আভা।নিশি উঠার সাহস করতে পারলো,এর আগে এরকম দুঃসাহস করার কথা ভাবতেও পারেনি,সে যা পারছে লিখছে।

ওরা বেরিয়ে যেতেই,ক্লাসে নিরবতা এসে ভর করলো,পরীক্ষা চললো আপন গতিতে!
———–
নাদিম রেগে বললো–,,বাড়িতে তো রাগ দেখিয়ে উল্টাইয়া ফেলিস ওই মেয়েটা কে কিছু বলতে পারলি না, আমার কিন্তু একদমই সহ্য হচ্ছে না তোর নিরবতা।

তৃধা গুন গুন করে গান গাইছে–,,
হাসতে দেখো গাইতে দেখো,
অনেক কথায় মুখোর আমায় দেখো,
দেখো না তো হাসির শেষের,,
নিরবতা…!

তৃধা মু্চকি একটা হাসি দিয়ে বললো–,,কথাটা খুবই জ”ঘন্য হলেও সত্যি আজকে না চাইতেও আমাকে আজাদ সাহেবের ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে,বুঝতে পারলাম আসলে টাকা আর ক্ষমতা দিয়ে দিন কে রাত, আর রাত কে সকাল বানানো যায়!

কপাল চাপড়ালো তিন জন,এমন বন্ধু পেয়েছে বেশি চিল্লায় নয়তো একদম চুপ থাকে আরে ভাই প্ল্যান টা তো অন্তত বল!

ক্লাস শেষ হতেই বেরিয়ে আসলো নিশি,হাঁপাতে হাঁপাতে বললো–,,তোরা সবাই বের হয়ে গেলি কেনো পরীক্ষা না দিয়ে?

আভা সহজ সরল মেয়েটাও আজ কঠোর হয়ে বললো–,,এটাই আমাদের ফ্রেন্ডশিপ রুলস!

আদাভান কানে ফোন গুঁজে তৃধার দিকে এগিয়ে আসলো,মোবাইল টা বাড়িয়ে দিয়ে বললো–,,কথা বলো!

তৃধা মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখলো দাদু লেখা তাই বেশি ঘাটলো না কথা বলে ফোন ফেরত দিয়ে দিলো।

আদাভান গম্ভীর কন্ঠে বললো–,,এরকম বেয়া”দবি করতে যেনো আর না দেখি,ভুলে যাবে না আমি তোমার শিক্ষক এগুলা কেমন কথা বলে বেড়াও তুমি?

তৃধা বলে উঠলো –,,আপনি বলার সময় শুনেছেন? দেখেছেন?তাহলে জোর গলায় কিভাবে বলছেন।একটা সত্যি কথা বলি, আপনাকে আমি নূন্যতম হলেও ভালো মনে করতাম,আজকের পর থেকে ওইটাও আর করবো না, আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো সাধারণ স্টুডেন্টদের কে ও একই পাল্লায় মাপেন তবে আমার ধারনা টা আসলে ভুল।আপনি আজকে প্রমান করে দিলেন যাদের মামা,খালু সভাপতির চেয়ারে বসে থাকে তারাই স্টুডেন্ট বাকিরা তো খেলনা তাদের যা খুশি বলা যায়।সমাজের সমস্যা একটাই স্যার সাধারণদের পায়ের তলায় রেখে পিষে ফেলে অনায়াসে, আর বড়লোকরা খারা’প কাজ করেও বুক ফুলিয়ে হাঁটে, ভালো থাকতে চাইলাম ওরা দিলো না।
আপনি যদি চাকরি বাঁচানোর জন্য ওদের হয়ে কথা বলতে পারেন তবে এটাও ভালো করে শুনে রাখেন,আপনার মতো থা’র্ড ক্লাস শিক্ষকদের সম্মান দেওয়া তো দূর তাদের ছায়া ও তৃধা তালুকদার মারা’য় না।আমি বেয়া”দব অহং”কারী যাই হই না কেনো আপনার মতো অসৎ না।আমি ভুলে যাই নি আমি আপনার ছাত্রী কিন্তু আপনি ব্যক্তিগত আ’ক্রোশের ফলে ভুলে গেছেন আপনি একজন শিক্ষক রূপা যেমন আপনার স্টুডেন্ট ঠিক তেমনই আমি,ওর কথার উপর বিশ্বাস করে ঠিক ভুল বিচার পর্যন্ত করার প্রয়োজন মনে করলেন না!
স্যার দোষা”রোপ করা সহজ, সত্যি টা বের করা কঠিন।

ওদের যদি মামা সভাপতি হয় তবে আমার বাপ ও এই ভার্সিটির হেড,আমিও দেখবো এরকম স্টুডেন্ট এখানে কিভাবে টিকে থাকে।
ভালোমানুষির দাম পাইনি তো এবার আস”ল রূপটাই না হয় দেখালাম।আপনার চাকরি হয়তো বা বেঁচে যাবে আফটার অল আপনি তার প্রিয় ছোট মেয়ের জামাই!

তৃধা আদাভান কে কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে সেখান থেকে বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো!
চলবে…