পদ্ম ফুলের অভিমান পর্ব-১৫

0
308

#পদ্ম_ফুলের_অভিমান(পর্ব:15)
#লেখনীতে_নাফিসা_আনজুম

সকালে আজানের আগেই ঘুম ভেঙে গেলো, নিলয় ভাইয়া এক হাত দিয়ে আমায় জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে, আমি আসতে করে হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে আসলাম, গোছল করে নামাজ পরে নিচে আসলাম। আজ রান্না করতে মন চাচ্ছে, আমি বিয়ের পর একদিনো রান্না করি নি, তাই ভাবলাম আজ রান্না করে ফেলি। আগে সবার জন্য নাস্তা বানাতে হবে, চুলোয় গরম পানি বসিয়ে সবজি কেটে নিলাম আমার কাটা শেষ না হতেই ফুপি উঠে আসলো,
-একি তুই কেনো এসব করছিস মা,

-আমি হেসেঁ বললাম,কেন আমি করতে পারবো না নাকি মা,

-না , তুই তো রান্না পারিস না,

-আমি ইউটিউব এ দেখে দেখে অনেক রান্না শিখেছি,

-আমার মেয়েটা কত্তো বড় হয়ে গেছে, সেদিনি আসলি এই বাড়িতে তখন তো একদম পিচ্চি ছিলি, এই তিন বছরে যতোটা না বড় হয়েছিস আমার মনে হয় তার থেকে বেশি এই একমাসে হয়েছিস বলে হেসেঁ উঠলো,,

-মনে মনে ভাবলাম সত্যি হয়তো, বিয়ের পর এই একমাসে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসে গেছে।

ফুপির সাথে গল্প করতে করতে সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে ফেললাম,তারপর কফি বানিয়ে রুমে আসলাম,
এসে দেখি নিলয় ভাইয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাঁসছে,ওনার ঘারে টাওয়াল ঝুলছে,মনে হয় মাত্র শাওয়ার নিয়েছে,

-উহুমম উহুমম, কি ব্যাপার ভুতে ধরেছে নাকি, একা একা হাসছেন যে

-হুমম একটা কিউট মেয়ে ভুত সারাক্ষণ মাথায়,মনে,চোখেঁ ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে

-কিইহহ, কার এতো বড় সাহস আমার স্বামীর আশেপাশে ঘোরে

উনি আমার দুই ঘার হাত রেখে অসহায় ফেস করে বলে, জানো আজ রাতে কি হয়েছে

আমি মাথা ঝাকিয়ে বুঝালাম, না জানি না

উনি ঘার থেকে টাওয়াল সরিয়ে,আমাকে ঘারের নিচে কয়েকটা নখের আচড় দেখালেন, আর বললেন রাতে অধিক ভালোবাসতে গিয়ে এমন করে দিয়েছে,

বুঝতে একটু সময় লাগলেও বুঝলাম উনি কি বলতেছে, ইশশ এখন আবার লজ্জায় পরে গেলাম,লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম, কি একটা বিশ্রি অবস্থা,

উনি এক হাত দিয়ে মাথাটা উচু করে বললেন,আমার সামনে এসে এতো লজ্জা পেয়ো না বউ,বুকে একটা হাত রেখে বললেন, খু*ন হতে দেরী লাগবেনা আমার, তখন কিন্তু তোমাকেই সামলাতে হবে।

ওনার ঠোঁটে দুষ্টুমি হাসিঁ দেখে বললাম,

এই নিন আপনার কফি, আমি নিচে গেলাম

এক হাত টেনে ধরে অন্য হাতে কফি নিয়ে বললেন, ছাড়লে তো যাবা,

ছাড়ুন আমার কাজ আছে,

বাড়িতে কি কাজের মানুষ কম পরেছে নাকি,,

ফুপিইইই,,

ফুপিকে ডাকার সাথে সাথে উনি হাত ছেড়ে দিয়েছে, আমাকে আর পায় কে, এক দৌড়ে নিচে এসেছি,

আর উনি পেছন থেকে বলছে,আমাকে বোকা বানানো শিখে গেছো তো,,দেখো আজ রাতে কি করি তোমার।

,,

এর মধ্যে কেটে গেছে আরো পাঁচটা দিন, কালকে সন্ধ্যায় ওনার ফ্লাইট, আমি বেলকোনিতে একা একা দাড়িয়ে দাড়িয়ে এই ভাবছি মানুষের জীবন বড়ই অদ্ভুত,কার জীবনে কখন কি থেকে কি হয়ে যায় বলাই যায় না, আমি তিনটা বছর যে ভালোবাসার জন্য দূরে থেকেও কষ্ট পেয়েছি আজ সেই মানুষটা আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে, কারন আমি সেদিন অভ্র ভাইয়ার চোখেঁ কষ্ট দেখেছি, আমি যখন নিলয় ভাইয়াকে খাইয়ে দিচ্ছিলাম তখন অভ্র ভাইয়া আড়াল থেকে সবটা লক্ষ্য করেছিলো,আর আজকের পর থেকে হয়তো আরো কষ্ট অপেক্ষা করছে ওনার জন্য,, আর আমাকে যে দূরে থেকে ভালোবেসেছে সে আমাকে পেয়েছে, আর যাই হোক আমি নিলয় ভাইয়াকে ঠকাবো না, আমার খুব মনে পরছে এই পাঁচদিনের কথা, এই পাঁচদিন উনি প্রয়োজন ছাড়া একবারো আমার পেছন ছাড়ে নি। সবসময় আমার সাথে ছিলো, সারাক্ষণ একটার পর একটা দুষ্টুমি করে গেছে, আমি রাগ করে বলতাম, এমন ভাব করলে মানুষ বউ পাগ*ল বলবে,
উনি অভিমান করে বলতো, আর কয়েকটা দিন এ তোমার সাথে আছি, তারপর তো চলেই যাবো তখন চাইলেও আর তোমাকে কাছে পাবো না তাই তো এমন করতেছি,
এরকম কথার পর আর কোনো কিছু বলার থাকে না তাই সবকিছু সহ্য করেছি। আমার যে খারাপ লেগেছে এমনটাও না, ভালোই লাগতো কিন্তু ওনার উত্তর শোনার জন্য জিজ্ঞেস করতাম। আজ সবকিছু কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে,আজকে রাতের পর আর কাছে পাবো না। কবে আসবে তার ও ঠিক নেই, চোখঁ দুটৌ যেনো আর বাঁধা মানছে না, এরকম একটা মানুষকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।

ঘারে স্পর্শ পেয়ে চোখঁদুটো মুছে পেছনে তাকালাম। নিলয় ভাইয়া কখন এসেছে খেয়াল করি নি,

-মন খারাপ কেনো

-এমনি

-আমি চলে যাবো জন্য

আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললাম,চোখঁ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে,

উনি আমার হাত ধরে বললো, অভ্র তোমাকে কেনো ফোন দিয়েছিলো,

নিলয় ভাইয়ার কথায় আমি যেনো অবাক হয়ে গেলাম,নিলয় ভাইয়া কিভাবে জানলো, অভ্র ভাইয়া আমাকে ফোন করেছিলো সরি বলার জন্য, আমার ফোন নম্বর হয়তো ওনার কাছে ছিলো কিন্তু আমি তা জানতাম না জানলে এই সিম ডিলেট করে দিতাম,আজ হটাৎ ফোন দিয়ে বললো,

পদ্ম আমি অভ্র,

আমি ওনার কন্ঠ শুনে প্রথমবার কেটে দিয়েছি, পরেরবার রিসিভ করেই বলেছি,
আমাকে কখনো ফোন দেবেন না, তখন অভ্র ভাই বলে শুধু এক মিনিট কথা বলবো,

কি বলবেন তারাতারি বলেন,

আমি সরি পদ্ম, আমি ভুল করেছি আর সেই ভুলের শাস্তি ও পেয়েছি,এখন কিছুদিন আগে চাকরিটাও চলে গিয়েছে, কিছুতেই আটকাতে পারলাম না। শশুরের কালো বাজারি ব্যাবসা ছিলো সেসবের মধ্যে আমার নাম ও জরিতো ছিলো, কিন্তু আমি এসবের কিছুই জানতাম না। আমি বাড়িতে চাকরি চলে যাওয়ার কথা বলি নি,কিছুদিন থেকে পুলিশ আমাকে হন্য হয়ে খুজছে,আমি ফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম, এখন খুলেই তোকে কল করলাম, হয়তো পুলিশ এতোক্ষনে আমার লোকেশন জেনে আমাকে ধরার জন্য আসতেছে,এই কয়দিন পালিয়ে বেড়ানোর পর মনে হয়েছে জীবন খুব কঠিন, এভাবে পালিয়ে বাঁচা যায় না, তার থেকে পুলিশের কাছে ধরা দেওয়া ভালো।

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না, এতো বড় শাস্তি আমি চাই নি, অবনির জন্য মন খারাপ হচ্ছে, বাবা মায়ের কারনে বাচ্চাটাকে না এসবের জন্য কথা শুনতে হয়।

কিন্তু নিলয় ভাইয়া কিভাবে জানলো যে অভ্র ভাইয়া আমাকে ফোন করেছিলো। আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
আপনি জানেন,

হুমম,অভ্র আমাকেও ফোন দিয়েছিলো

আমি অবাক হয়ে চোখঁ মুছে ওনার মুখের দিকে তাকালাম,অভ্র ভাইয়া কেনো ফোন দিয়েছিলো

ক্ষমা চাইতে, ও আমাদের বিয়ের দিন আমাকে বলেছিলো তুমি নাকি আমার সাথে কখনই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না, কিন্তু সেদিন দেখা হওয়ার পর ওর ধারনা ভুল হয়ে গেছে,আর কিসব ঝামেলায় নাকি পরেছে, তোমাকে কল দিয়েছিলো সেটাও বললো।

আমি অভ্র ভাইয়ার সব কথা নিলয় ভাইয়াকে খুলে বললাম,
উনি আমার দুই গালে হাত রেখে বললো,পদ্ম ফুল,আমি জানি একসময় তুমি ওকে ভালোবেসেছিলে কিন্তু সেটা তোমার ভালোলাগা থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তুমি যে বয়সে ওকে ভালোবেসেছো সেই বয়সটা চোখেঁ রঙ্গিন চশমা দেওয়া থাকে, চোখেঁ যাকে ভালোলাগে তখন মনে হয় একে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব, কিন্তু সেটা ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা হলো মন থেকে হয় , কারো সাথে কিছুদিন চলাফেরা করে তার মন পর্যন্ত যদি পৌছানো যায়, তার সাথে সুখ-দুঃখ, হাসিঁ-কা*ন্না সবকিছু ভাগ করে নেওয়া যায় সেটাকে বলে ভালোবাসা। তোমার তরফ থেকে তুমি ভালোবাসতে চেয়েছিলে কিন্তু সেটা ছিলো এক তরফা, অভ্র তোমাকে ভালোবাসে নি।

আমি কিছু না বলে রুমে চলে আসলাম, নিলয় ভাইয়া একদম ঠিক বলেছে অভ্র ভাইয়া আমাকে কখনোই ভালোবাসে নি, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।
,,
পরেরদিন সকালে উঠেই নামাজ পরে নিলাম। আজ মনের সাথে সাথে বাহিরের আকাশটাও কেমন যেনো থমথমে হয়ে আছে, যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে, আজ সন্ধ্যায় নিলয় ভাইয়া চলে যাবে।দেখতে দেখতে সকাল গরিয়ে দুপুর পার হয়ে গেলো নিলয় ভাইয়া সেই যে সকালে নাস্তা করে বের হয়েছে, এখনো ফেরে নি, ফোন করেও পাচ্ছি না।

বেশ অনেক্ষন অপেক্ষা করে আমি নিজের রুমে চলে আসলাম, রুমে আসতেই ফোন বেজে উঠলো, এস এম এস এসেছে,চেক করতেই দেখলাম নিলয় ভাইয়ার নাম্বার থেকে,

এস এম এস টা ছিলো এরকম,
আমি চলে যাচ্ছি পদ্ম আমাদের আর দেখা হবে না। জানি না কবে বাড়ি ফিরবো কিন্তু এই পাঁচদিনের কথা কখনোই ভুলতে পারবো না, আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমার মুখ থেকে একবার শোনার যে নিলয় ভাইয়া তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না, কিন্তু তুমি একবারো আমাকে বলোনি, তুমি যদি একবার বলতে যতো কিছুই হোক না কেনো আমি থেকে যেতাম। কিন্তু আফসোস তুমি একবারো বলো নি। আমার ভালোবাসা কখনো কমবে না পদ্ম ফুলের জন্য, আমি যেমন ভালোবাসি সারাজীবন এভাবেই ভালোবাসবো।
তোমার থেকে ঘটা করে বিদায় নিয়ে আসতে গেলে তোমার মুখটা দেখলে আমি আসতেই পারতাম না,তাই কাউকে কিছু না বলে আগেই চলে এসেছি যাতে নিজেকে আটকাতে পারি।আমার সব দুর্বলতা তুমি জানো কিন্তু তবুও একবারো থাকতে বললে না আমাকে। যাই হোক, ভালো থেকো তুমি। আর আম্মুকে বলে দিও তার এই পা*গ*ল ছেলেটাকে যেনো ক্ষমা করে দেয়।

এস এম এস টা পরার পর কি করবো মাথা কাজ করছে না,অনবরত কল করে যাচ্ছি নিলয় ভাইয়া র নম্বরে কিন্তু ফোন বন্ধ, কেঁদে কেঁদে ফুপির রুমে চলে আসলাম,আমাকে কাঁদতে দেখে ফুপি জিজ্ঞেস করলো,

-কি হয়েছে পদ্ম মা কাঁদছিস কেনো,

-মা , মা নিলয় , কান্নার জন্য আর কিছু বলতেও পারছি না

-কি হয়েছে আমার নিলয়ের, এই পদ্ম বল না কি হয়েছে নিলয়ের, আমার নিলয় ঠিক আছে তো কোথায় আছে ও

ফুপিও কেঁদে দিয়েছে, আমি শুধু বললাম নিলয় ভাইয়া চলে গিয়েছে মা, আমাদেরকে সন্ধ্যার কথা বলে আগেই চলে গিয়েছে,সব আমার দোষ,আমি বলি নি থাকতে, মা তোমার ছেলে কেনো বুঝলো না মা আমি তো চেয়েছিলাম উনি যাতে সারাজীবন আমার সাথে থাকে কিন্তু উনি কেনো আমাকে বুঝলো না। আমি না হয় বলি নি কিন্তু উনি তো বলতে পারতো পদ্ম আমি যাবো না তোমাকে ছেড়ে, উনিও তো একবারো বলে নি আমাকে,,

চলবে,,