#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
লেখনীতে: অক্ষরময়ী
[০১]
এবারের শীতকাল কতো দীর্ঘ হবে ধারণা করা যাচ্ছে না৷ জানুয়ারিকে বিদায় জানিয়ে ফেব্রুয়ারিকে বরণ করে নেওয়ার সপ্তাহ পেরিয়েছে। অথচ শীতের বিদায়বার্তা এখনো মিলছে না। দীর্ঘমেয়াদী শীতে সকলের অবস্থা ত্রাহিত্রাহি। কাঠের চেয়ারে পা তুলে বসে গায়ের চাদরটাকে আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে নিয়ে আরাম করে বসলো মোকাররম মজুমদার। টেবিলের উপর রাখা চায়ের ছোট কাঁচের গ্লাসটি তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। উষ্ণ তরল শরীরের অভ্যন্তরে পৌঁছে মুহুর্তেই নিবারণ করে দিল সমস্ত শীতলতা।
সেই উষ্ণতা বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারলো না মোকাররম। হিমেল হাওয়ার মতো হাজির হলো মাহিন।
কোনোরকম সম্ভাষণ ছাড়া টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটিতে আসন গ্রহণ করে তেঁতো মুখে মোকাররমকে সালাম জানালো।
– আসসালামু আলাইকুম চাচা।
চায়ের স্বাদ যেনো মুখে বিশ্রী ঠেকছে মোকাররমের। মুখে নেমেছে আষাঢ়িয়া মেঘ। এই ছেলের আগমনের কারন সম্পর্কে সে অবগত। ঠাস শব্দ করে চায়ের কাপটি নামিয়ে রেখে মোকাররম সালামের জবাব দিলো।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। এতো সকালে এদিকে কি মনে করে?
– আপনি তো খবর দিলেন না। বাধ্য হয়ে আমাকেই আসতে হলো। আপনার মেয়ে আমাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়ে আরেক ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে মাস্তিতে আছে। এদিকে আমাদের হয়েছে যতো ঝামেলা। কতো শখ করে বিয়ের আয়োজন করে নিজের বদনাম ডেকে আনলাম। এদিকে লোকে ছিঃ ছিঃ করছে, অন্যদিকে পাওনাদার হাত ধুয়ে পেছনে পরে আছে। গরুর টাকা দেওয়া বাকি, ফুলের দোকানে টাকা বাকি, মাইক্রোর ভাড়া, কেটরিং থেকে শুরু করে সবারই কমবেশি টাকা বাকি৷ দেখছি বলে আপনিও গা ঢাকা দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে আমাকেই আসতে হলো।
মোকাররমের মুখটা বিকৃত হলো সময় লাগলো না। সকালবেলা আড়ত খুলেছে মাত্র। এখনো দু পয়সার মুখ সে দেখেনি। এরমধ্যে ব্যয় এসে দুয়ারে হাজির। এভাবে লক্ষ্মী থাকবে ঘরে? বিরস মুখে জবাব দিলো,
– গা ঢাকা দিবো কেনো? ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত আছি। বাড়ির ঝামেলায় এই কয়েকটা দিন ব্যবসায় একদম মনোযোগ দিতে পারি নাই। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে মরা লাগবে। তুমি ভাইজানের সাথে কথা বলো নাই? উনি কি বলে?
– আব্বার সেই এক কথা। যেই বিয়ের কারনে উনার মান সম্মান নষ্ট হয়েছে সেই না হওয়া বিয়ের আয়োজনের পেছনে আর এক টাকাও সে ব্যয় করবে না।
– অনেক টাকার ব্যাপার। আমার ব্যবসাটা মন্দা যাচ্ছে। একদমই আয় রোজগার নাই। হাতে যা টাকা ছিলো, বিয়ের আয়োজনে চলে গেছে। তোমাকে কই থেকে টাকা দেই বলো? কে যে বলেছিলো তোমাদের এতো বড় আয়োজন করতে!
– আমাদের বাড়ির শেষ বিয়ে ছিলো। আম্মা অনেক শখ করে আয়োজন করছে৷ কে জানতো এই বিয়ে আমাদের কাল হয়ে দাঁড়াবে। বন্ধু বান্ধবের সামনে দাঁড়াইতে পারি না। ছিঃ! এমন মেয়ে মানুষ করছেন!
মোকাররমের মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রইলো। সেই বিয়ের কথা উঠলে মাহিনের মেজাজটা বিগড়ে যায়। বন্ধুরা সামনে এলেই ইনিয়েবিনিয়ে হাসি তামাশা করে৷ বিয়ের আসর থেকে বউ পালিয়ে গিয়ে আদ্রতা মাহিনকে চরম অপমান করেছে। মাহিনের ইচ্ছে করে এর কঠিন প্রতিশোধ নিতে৷ কিন্তু কীভাবে নিবে? আদ্রতা নিখোঁজ আজ অনেক দিন। সে গোপনে নিজের লোকজন লাগিয়েও কোনো খোঁজ করতে পারেনি। বিরক্তি এতোটাই মাথায় জেঁকে বসলো যে স্থির হয়ে বসে থাকা সম্ভব হলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– যাই হোক, পুরনো কথা বাদ দেন। টাকাটা দিয়ে দেন। চলে যাই।
গায়ের চাদরটা ঠিকঠাকভাবে জড়িয়ে নিয়ে মোকাররম বললো,
– হাতে এখন কোনো টাকা নাই। পাওনাদারদের বলো কিছুদিন অপেক্ষা করতে।
মোকাররমের কথা শুনে মাহিন ভীষণ ক্ষেপে গেলো। কন্ঠস্বর উঁচু করে বললো,
– কী আশ্চর্য! বাহানা বাদ দেন। বিয়ের আয়োজন করতে গিয়ে এতো খরচা হয়েছে। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আপনার মেয়ে সব আয়োজনে পানি ঢেলে দিয়েছে, আমাদের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। লোকজন থু থু করতেছে, বাড়িতে আব্বা আমারে বকাবকি করতেছে৷ আমার পকেট খরচটা পর্যন্ত বন্ধ করে রাখছে৷ এদিকে আপনি বিয়ের আয়োজনের বাকি টাকা পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন তালবাহানা করতেছেন। ফাজলামি নাকি! আপনার মেয়ের জন্য এতোকিছু হলো, আপনি ক্ষতিপূরণ দিবেন না?
– তোমাদের যতোটা ক্ষতি হয়েছে, আমাদেরও ততোটাই হয়েছে। মানুষজন আমাকে কম কথা শোনাচ্ছে না। রইলো টাকার কথা, দিবো যখন বলেছি, অবশ্যই দিবো। এখন হাতে টাকা নাই, ব্যবসা বন্ধ। কই থেকে এতো টাকা ম্যানেজ করবো? এক টাকা, দু টাকা তো না। লাখ টাকার প্রশ্ন।
মাহিন কিছু না বলে রাগে ফোস ফোস করতে করতে কিছুক্ষণ পায়েচারি করলো। ভাবতে ভাবতে বিড়বিড় করে বললো,
– পাওনাদারদের আজকেই টাকা দিতে হবে। আর সময় দিবে না। এক কাজ করেন, নার্সারির কিছু গাছ বিক্রি করে দেন।
মোকাররম বিরস মুখে বললো,
– নার্সারিতে আর কয়েকটা গাছ আছে! বিক্রি করলে কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আজকের মধ্যে এতো চারা কে নিবে? পাইকারী দরে বিক্রি করলে খুব একটা লাভও হবে না। আপাতত কারও থেকে ধার নিয়ে পাওনা পরিশোধ করো। এই মাসের শেষে চালের ট্রাক যাবে একটা। তখন হাতে কিছু টাকা আসবে।
– ধার দেওয়ার মতো কেউ নাই। বন্ধু বান্ধবের কাছে আমি যাবো না। ওদের সামনে যাওয়া মানেই বিয়ে নিয়ে আবারও হাসি তামাশা। আপনার মেয়ে আমাকে কীসের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আপনি ভাবতেও পারবেন না।
– ভাইজানের কাছে চাও। অনুরোধ করো।
– উহু, দিবে না। সে এক কথার মানুষ। আচ্ছা, এক কাজ করেন। আপনার বাড়ির ছাদে কয়েকটা বনসাই আছে, না? ওগুলা বিক্রি করলে কয়েক লাখ টাকা পাওয়া যাবে। খদ্দের আমি ম্যানেজ করতেছি।
মোকাররম একবার বলতে চাইলো, ওগুলো আদ্রিকার গাছে। কিন্তু কিছু বললো না। আজকে তার এই সংকটের জন্য তার নিজের মেয়ে-ই দায়ী। যারা বাবার সম্মানের কথা ভাবে না, তাদের কথা মোকাররম কেনো ভাববে? মোকাররমের এখন টাকা দরকার। ওই গাছগুলো বিক্রি করে যদি টাকার ঘাটতি পূরণ হয়, তবে সে তাই করবে। মেয়ের ভালোমন্দ ভাবার দিন ফুরিয়েছে। ওগুলোকে যে এখনো বাড়িতে থাকতে দিয়েছে, তাই অনেক।
মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো মাহিন। পাওনাদার বারবার কল দিচ্ছে। দ্রুত ক্রেতা সংগ্রহ করতে হবে।
মোজাম্মেলের কাছে চাইলে সে অবশ্য টাকা দিয়ে দিতো। কিন্তু মাহিন নিজেই মোজাম্মেলকে না করে দিয়েছে। যে বিয়ের কারনে তার সম্মানহানি হয়েছে সে বিয়ের খরচ তার পরিবার কেনো বহন করবে? প্রতিটি পয়সা সে মোকাররমের থেকে আদায় করে ছাড়বে।
*****
সকালের মিঠা রোদ জানালা পেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে। বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আদ্রিকা। গায়ের উপর একটি লেপ ছড়ানো। লেপের সাদা কভারের উপর সোনা রোদ চিকচিক করছে৷ ত্রস্ত পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো নীহার। আলমারিতে লুকিয়ে রাখা সয়াবিন তেলের বোতলটি থেকে একটুখানি তেল ঢেলে নিলো হাতে ধরে রাখা কাচের ছোট শিশিতে। বাড়িতে বাজার সদাই আসে না অনেকদিন তো হয়ে গেলো। নীহারের জমিয়ে রাখা সম্পদ শেষ হতে চললো। আর কতোদিন চলবে কে জানে! তেলের শিশি হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে আদ্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ভাত হয়েছে। খেতে আয়।
মেয়েটা ঘুম থেকে উঠেছে সেই ভোরে৷ নীহার গিয়েছিলো বাসন মাজতে। এরমাঝে আদ্রিকা ঘরদোর ঝাড়ু দিয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে খাবারের অপেক্ষা করতে করতে আবার এসে শুয়ে পরেছে বিছানায়। আদ্রতা চলে যাওয়ার পর সে একদিন কলেজে গিয়েছিলো। ফিরে এলো অসুস্থ শরীর নিয়ে৷ তারপর থেকে আর কলেজে যায় না। সারাদিন ঘরের ভেতর বসে থাকে আর কি যেনো ভাবে! না ঘরের বাইরে বের হয়, না কারো সাথে কথা বলে। নীহার কিছু বললেও জবার দেয় না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। নীহার অবশ্য জোরাজুরি করে না। ওকে ওর মতো থাকতে দেয়। এভাবে আদ্রতার চলে যাওয়ায় আদ্রিকা মানসিকভাবে কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা মা হিসেবে নীহার ভালোভাবে বুঝতে পারে।
মায়ের ডাকে আস্তেধীরে বিছানা ছেড়ে বাইরে এলো আদ্রিকা। আদ্রতা চলে যাওয়ার পরে মোকাররম ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল রান্নাঘরে। গ্যাসের চুলা, সিলিন্ডার, থালা বাসন কোনোকিছু অবশিষ্ট নেই।
চ্যাপ্টা লাগা একটি পাতিল, কান ছাড়া কড়াইকে সম্বল করে চলছে নীহারের রান্নাবান্না। বাড়ির বাইরে আঙ্গিনার এক কোণে ইট দিয়ে সাময়িক চুলা তৈরি করা হয়েছিল। দুদিন রান্না করার পর সেখানেই মাটি দিয়ে চুলা বানিয়েছে নীহার। এখন সেখানেই রান্না হয়।
রান্না শেষ করে নীহার সব গুছিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে আসছিলো। আদ্রিকাও মায়ের সাথে ভাতের হাড়িটা রান্নাঘরে নিয়ে এলো। দুটো প্লেটে খাবার পরিবেশন করে ওরা খেতে বসলো ড্রয়িংরুমের টেবিলে। খাবার বলতে গরম ভাত আর আলু ভর্তা। শুকনো মরিচ পুড়িয়ে আলু মাখানো হয়েছে। সেই ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে টুকটুকে লাল ভাত নির্বিকারে মুখে পুড়ে নিচ্ছে আদ্রিকা।
খাবার ফাঁকে নীহার একবার তাকিয়ে দেখলো আদ্রিকার দিকে। সকালে ভাত দেখলে মেয়েটা ভীষণ রেগে যেতো। নাস্তা ছাড়া একদিনও চলবে না। শখ করে ওরা কোনোদিন ভাত নিয়ে বসলেও আদ্রতা নিজে হাতে আলাদা করে নাস্তা তৈরি করে রাখতো আদ্রিকার জন্য। এখন আদ্রতাও নেই, আদ্রিকার আবদারও নেই। নীহার অবশ্য ভেবেছিলো মেয়েটার জন্য কিছু নাস্তার আয়োজন করবে কিন্তু ঘরে ময়দা নেই। কিনে আনার মতো টাকাও নেই হাতে।
বাড়ির পেছনের দিকে কয়েক সারি আলু আবাদ করেছিলো বলে সেগুলো খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারছে। প্রতিদিন সকালে গরম ভাত, আলু ভর্তা৷ সবজি বাগানের লাউ, চালকুমড়া, শিম, বরবটি, মূলা, ফুলকপি, বাধাকপি ইত্যাদি সবজি রান্না করা হয় দুপুর বেলা। যা খেতে হয় দুপুর এবং রাতে। গত কয়েকদিন ধরে এভাবেই চলছে দিনকাল।
আদ্রতার বিয়ের দিন থেকে মোকাররম বাড়িতে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করেছে। বাজারের হোটেলে তিনবেলা খায়। তাই বাড়িতে কোনো বাজার সদাই পাঠায় না। রাতে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে শুয়ে পরে, আবার সকালে চালের আড়তে চলে যায়। বাড়িতে দুটো মানুষ কি খেয়ে বেঁচে আছে সে খবর রাখে না।
খাবার খেতে খেতে নীহার বললো,
– তোর কলেজে ক্লাস হচ্ছে না?
পানি দিয়ে মুখের ভাতটুকু গিলে ফেলে নরম গলায় আদ্রিকা বললো,
– হচ্ছে।
– ক্লাস করতেছিস না কেনো?
– যাবো।
– কবে?
– দেখি।
– কালকে থেকে কলেজে যাবি।
– আচ্ছা।
আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না নীহার। চেয়ে দেখলো তার উচ্ছ্বসিত মেয়েটার মলিন মুখ। ফর্সা মুখখানিতে নেমেছে কালো মেঘের ছায়া। চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে। অথচ দিনরাত বিছানায় পরে থাকে। নীহার এতোদিন ভাবতো তার পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে নিদ্রা দেশে পাড়ি দেয় তার মেয়ে। কিন্তু তার চোখের নিচের কালি বলে দিচ্ছে, নীহারের মতোই আদ্রিকার রাত কাটে নির্ঘুম।
কলেজে না গেলেও পড়াশোনার ব্যাপারে নীহার আজ ছাড় দিলো না। বেলা গড়াতে শুরু করলে সবজি বাগান থেকে কিছু পালং শাক তুলে নিয়ে এলো। ঘরে কয়েকটা শুটকি আছে। শুটকি দিয়ে পালংশাক রাধবে আজকে। মাছ দিয়ে পালংশাক আদ্রিকার ভীষণ পছন্দের। মাছ নেই তো কি হয়েছে! শুটকি দিয়ে না হয় রেধে দিবে। শুটকিও তো এক প্রকার মাছ।
বাইরের বারান্দায় পালংশাক বাছতে বসে আদ্রিকাকে ডাক দিলো।
– বই নিয়ে এখানে পড়তে বস। কী সুন্দর রোদ উঠেছে।
আদ্রিকা কিছুক্ষণ মায়ের দিকে নিশ্চল চোখে চেয়ে থেকে ঘরে চলে গেলো। ফিরে এলো বই হাতে। মায়ের পাশে বসে বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে গেলো।
দুপুরের খাবারের পর বিছানায় গড়াগড়ি দেওয়ার পর মা-মেয়ে চলে গেলো সবজি বাগানে। গাছে পানি দিলো, মাটি আলগা করে দিলো, যেখানে মাটি সরে
গিয়েছে সেখানে মাটি তুলে দিলো, কিছু ঝিঙেও তুলে নিলো আঁচলে।
ওরা ফিরে এসে দেখলো বাড়ির আঙ্গিনায় একটি লরি এসে দাঁড়িয়ে আছে। নীহার এগিয়ে এসে ড্রাইভারকে প্রশ্ন করলো,
– কাকে চাই?
ভদ্রগোছের বৃদ্ধ মানুষটি জবাব দিলো,
– গাছ নিতে এসেছি।
– নার্সারি বাইরের দিকে। আপনি বাড়ির ভেতরে চলে এসেছেন।
– আমাকে যে বাড়ির ভেতরের আঙ্গিনায় গাড়ি দাড় করতে বলেছে। ছাদ থেকে নাকি গাছ নামাতে হবে।
নীহার ভ্রু কুচকে তাকালো আদ্রিকার দিকে। সেও কিছু জানে না। মাকে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো।
– কে বলেছে?
– মাহিন নামের একজন। ফেসবুকে কথা হয়েছিল। কিছু গাছের সেল পোস্ট দিয়েছিলেন। আমার ম্যাডাম উনাকে পেমেন্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমাকে পাঠালেন গাছ নিতে যেতে৷
আদ্রিকা এগিয়ে এলো লোকটির দিকে। উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো,
– কোন গাছের সেল পোস্ট দিয়েছে? আপনি কোন গাছ নিতে এসেছেন?
– তিনটে বনসাই, দুটো অপরাজিতা, একটা কামিনী।
আদ্রিকা ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে তাকালো নীহারের দিকে। নীহার নিজেও স্তব্ধ। আর যাই হয়ে যাক, মোকাররম কখনো আদ্রিকার ওই গাছগুলোর দিকে নজর দিতো না। আজকে হঠাৎ কি হলো?
আদ্রিকা কিছু বলার আগেই মাহিনকে গেইট দিয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেলো। ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
– আপনি এসে গেছেন! আমার সাথে আসুন। ওই যে ছাদে আছে গাছগুলো।
আদ্রিকা তেড়ে গিয়ে মাহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
– ওগুলো আমার গাছ।
মাহিন যেনো শুনতেই পেলো না। মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে স্বাভাবিকভাবে জানালো,
– চাচার সাথে আমার কথা হয়েছে৷ কিছু টাকা দরকার। চাচার হাতে এই মুহুর্তে টাকা নেই৷ তাই গাছগুলো বিক্রি করতে বলেছে। অনেক কষ্টে খদ্দের জোগাড় করেছি। ঝামেলা করিস না৷
আদ্রিকা জেদ ধরে আবারও বললো,
– ওগুলো আমার গাছ। আমি বেঁচবো না।
মাহিন বিরক্তিভরা চাহনী ছুড়ে দিলো আদ্রিকার দিকে। কিন্তু সে দমে গেলো না। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে৷ অহেতুক আস্ফালনে ফুঁসছে। অপচয় করার মতো সময় মাহিনের হাতে নেই৷ পাওনাদারগুলো বারবার কল দিচ্ছে। সে নীহারের দিকে তাকিয়ে বললো,
– চাচী, ওরে বুঝান।
তারপর পাশ ফিরে ছাদের দিকে চলে গেলো। ওদের পিছু নিচ্ছিলো আদ্রিকা। নীহার হাত ধরে আটকে দিলো।
আদ্রতার চলে যাওয়া, বিস্ময়ের ধোঁকা – সব মিলিয়ে অনেক কেঁদেছে মেয়েটা। দু চোখের জল ফুরিয়ে এসেছে। এখন আর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে না। বুকের ভেতরটা জ্বলে যায়, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আজ অনেকদিন পর আবারও চোখের কোণে জল জমা হলো। ছলছল চোখে মায়ের দিকে চেয়ে কান্নামাখা কন্ঠে বললো,
– মা, আমার গাছগুলা কেনো বেঁচে দিলো? ওগুলা ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো? ও মা?
নীহার মেয়েকে বুকের মাঝে চেপে ধরে বললো,
– সবকিছু ছাড়া বাঁচা যায়। অভ্যাস হয়ে যায়। আমি আবার নতুন গাছ এনে দিবো।
মায়ের বুকের সাথে মিশে আদ্রিকা কাঁদতে থাকলো। দেখতে থাকলো তার যত্নে গড়া বনসাই দুটোকে কীভাবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামানো হচ্ছে। একে একে ওদের লরিতে তোলা হলো। দশটা বছর ওরা আদ্রিকার সাথে ছিলো। আদ্রিকা নিজের হাতে ওদের একটু একটু করে গড়েছে। ওই যে বাগানবিলাস গাছটা, আর কয়েকটা দিন পরেই হয়তো ওটার গা ভর্তি ফুল আসবে। চারটি ডালে চারটি ভিন্ন রঙের ফুল শোভা পাবে অন্য কারো বাগানে।
একমাস আগেই ওই কামিনী গাছটার কাটিং করেছিলো সে। বেশ সুন্দর এবং আকর্ষণীয় একটি আকৃতি এসেছে। না জানি ওর নতুন মালিক আদ্রিকার কাটিং এর ধরনটি বুঝতে পেরে পরবর্তীতে ঠিকঠাক কাটতে পারবে কিনা! পরের মাসেই গাছটিকে আবার কাটছাট করতে হবে। না হলে আকৃতি নষ্ট হয়ে যাবে।
হঠাৎ আদ্রিকার মনে হলো, ওর বাবা ভীষণ খারাপ একজন মানুষ। খুব নিষ্ঠুর, জঘন্য মানসিকতার একজন মানুষ। মাকে এতোদিন মারধর করতে দেখলেও মোকাররমের প্রতি আদ্রিকার কখনো ঘৃণা জন্মায়নি। গোপনে বাবাকে ভীষণ ভালোবেসে গেছে সে। বিপরীতে বাবার স্নেহের জন্য চিরকাল কাতরেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে সেই মানুষটির প্রতি ঘৃণা জন্মেছে। সব ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। যেখানে সেই মানুষটির ছায়াও পরবে না।
আদ্রিকার চোখের সামনে দিয়ে গাছের টবগুলো সাজিয়ে নিয়ে লরিটি প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
এক হাত বাড়িয়ে আদ্রিকা তখনো কান্না করছে।
‘মা আমার গাছগুলো। গাছগুলো ওরা নিয়ে গেলো।’
মেয়ের কান্না নীহারের সহ্য হলো না। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বাড়ির ভেতর।
চলবে….