#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৩৯|
ব্যস্ত দিন কাটছে আদ্রিকার৷ সকালে কলেজ, বিকালে রেস্তোরায় কাজ সামলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত গড়িয়ে যায়। আজকাল বাড়িতে চুলা জ্বলে না বললেই চলে। খাওয়াদাওয়া চলছে রেস্তোরাঁয়। আদ্রিকার মাঝে যে একাকিত্ব ছিল, সেটা এখন আর নেই। সারাদিনের কাজকর্ম সেড়ে ক্লান্ত শরীর বিছানার নরম গদিতে এলিয়ে দেওয়া মাত্র ঘুম চলে আসে।
তবে কাজের মাঝেও হুটহাট মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয় বেহায়া মনের অভিমান। সেদিন মুরগির কষানোর সময় ব্যস্ত হাতে কুন্তি নাড়ছিল, হঠাৎ করে পরখের কথা মনে পরে গেল। মুরগির সাথে পরখের কি কানেকশন আজও খুঁজে পায়নি আদ্রিকার৷
রেস্তোরাঁয় প্রবেশ থেকে শুরু করে বিদায়বেলা পর্যন্ত আদ্রিকার চোখ পরখকেই খুঁজে। কিন্তু পরখ ভুল করেও কখনও তিনতলায় উঁকি দেয় না৷ সে ইচ্ছে করে আদ্রিকাকে এড়িয়ে যাচ্ছে সেটা আদ্রিকা বুঝতে পারে। তার অভিমানের সুযোগ নিয়ে পরখের দিনকাল বেশ সুখেই কাটছে৷ ভাবতেই হিংসায় গা জ্বলে যায় আদ্রিকার। তাকে অস্থির করে রেখে সে মহাশয় সুখের ভেলায় ভাসছে। পিঠে পাখনা গজিয়েছে দুটো। বাড়ি থেকে কখন বের হচ্ছে, কখন বাড়ি ফিরছে, সারাদিন কি করছে কিছুই জানে না আদ্রিকা। কাউকে জবাবদিহি করতে না হলে ছেলেরা তিড়িংতিড়িং করে নাচতে শুরু করে৷ নিয়মকানুনের ধার ধারে না।
অফিসরুমে বসে সারাদিনের হিসাব গুছিয়ে নিচ্ছে আদ্রিকা। আজকে সে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে৷ অভিমান করে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ায় আদ্রিকার বড্ড ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে৷ কারণ আদ্রিকার অভিমানের প্রভাব পরখের উপর পরছে না৷ সে মহাশয় বিন্দাস নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে৷ আদ্রিকা একাই জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে কেন? দুজনের সংসারে ঝামেলা বাধলে দুজনেরই অশান্তিতে থাকতে হবে৷ এটাই সংসারের অলিখিত নিয়ম।
তাই আদ্রিকা ঠিক করেছে, আজকে বাড়ি ফিরে পরখের সাথে কথা বলবে। রশি হাত থেকে ছুটে যাওয়ার আগেই চেপে ধরতে হবে৷
মেইন কোর্স সেক্টরে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অনুকে। হিসাবপত্র অনুকে বুঝিয়ে দিয়ে আদ্রিকা বেরিয়ে যাবে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও অনুকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছে রায়হান। আদ্রিকা জিজ্ঞাসা করল,
‘অনু কোথায়, রায়হান?’
‘এখানেই ছিল। দোতলায় গিয়েছে বোধহয়। আমি ডেকে আনছি।’
‘প্রয়োজন নেই। আপনি বসুন। আমি নিজেই যাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে, ম্যাম।’
অনুকে খোজার বাহানায় দোতলায় ঘুরে আসার লোভ সংবরণ করা সম্ভব হলো না। মনে মনে প্রজাপতির মতো চঞ্চল আদ্রিকা পেছনের দিকের চিপা সিড়ি দিয়ে চলে গেল দোতলায়।
পরখের অফিস রুমে রুমি এবং অনুকেও পাওয়া গেল৷ ডেস্কে অপরপাশের চেয়ারে বসে কিছু একটা বলছে রুমি। নিজের চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে রুমির কথা শুনছে পরখ। এই পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। কিন্তু যখন দেখল পরখের পাশে দাঁড়িয়ে আছে অনু, এবং অনুর হাতটি পরখের চেয়ারের উপর রাখা তখন আদ্রিকার মুখে আঁধার নামল। আপাতত দৃষ্টিতে তাকিয়ে যে কারো কাছে উক্ত দৃশ্য স্বাভাবিক মনে হবে না। অনুকে কেন পরখের এতো কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াবে? অন্যদিকে পরখ কেনো অনুকে দাঁড়াতে দিবে। দুনিয়ার তাবৎ নারীর প্রতি পরখের আচরণ সুশীল একমাত্র ব্যক্তিগত আদ্রিকা! কেনো?
আদ্রিকা কাছে গেলে পরখের জাত চলে যায়, অন্য মেয়ে কাছাকাছি থাকলে উনার মুখে হাসি ফুটে। বাহ! কী অদ্ভুত নিয়ম।
আদ্রিকা আর ভেতরে গেল না। ফিরে এলো তিনতলায়৷
প্রতিদিনের মত আজও বাড়ি ফিরতে অনেক দেরী হয়ে গেছে পরখের৷ স্লাইডিং ডোর ধরে টান দিলে দেখা গেল দরজা এখনও লক করা। তবে কি আদ্রিকা বাড়ি ফিরেনি? ভ্রু কুচকে হাত ঘড়ির দিকে তাকাল পরখ। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। এতোক্ষণে রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। তবে আদ্রিকা বাড়ি ফিরেনি কেনো?
রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার সময় আদ্রিকার খোঁজ নেওয়া হয়নি। প্রতিদিন আটটার দিকে আদ্রিকা বের হয়ে যায়। তাই আলাদা করে ভাবতে হয় না পরখকে। কিন্তু আজকে ভাবতে হলো৷ আদ্রিকা এখনও তার বিবাহিত স্ত্রী৷ না চাইতেও একটা দায়িত্ব তৈরি হয়েই যায়। তার উপর বিপদ আপদ কিছু একটা হয়ে গেলে সবাই এসে পরখকেই ধরবে।
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে রুমিকে কল করল।
‘কোথায় তুই?’
‘বাড়িতে।’
‘রেস্টুরেন্টে কখন বন্ধ করছিস?’
‘আমি এক ঘন্টা আগে বের হয়ে আসছি। শেষে না তুই বের হইলি?’
‘ওহ হ্যাঁ। আচ্ছা বাদ দে। তুই ঘুমা।’
পরখের মনে পরল, তানজিমের হাতে চাবি দিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে। রেস্তোরাঁ পরিষ্কার করে তালা দিয়ে তানজিম চলে যাবে। সকালে রেস্তোরাঁ খোলার দায়িত্ব তানজিমের উপরেই ন্যস্ত থাকে।
পরখ এবার তানজিমকে কল করল। তানজিম বলল,
‘চাবি আমার কাছেই আছে। কিন্তু আমি তালা দেইনি।’
‘কেনো?’
‘ম্যাম বললেন, সব গুছিয়ে রেখে আপনি চলে যান। আমি তালা দিয়ে দিব।’
‘তুমি ওকে রেস্তোরায় একলা রেখে চলে এলে!’
‘ম্যাম চলে আসতে বললেন। উনার কি যেনো কাজ বাকি আছে। সেটা শেষ করে তারপর বের হবেন। সবে রাত দশটা বাজছিল, তাই আমিও বেশি কিছু ভাবিনি। কিছু হয়েছে স্যার? ম্যাম বাড়ি ফিরেনি?’
‘কিছু না। সকালে ঠিক সময়ে এসে রেস্টুরেন্ট ওপেন করো।’
মোবাইল রেখে পরখ চুপচাপ শুয়ে রইল। মেজাজ আপাতত প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। কি এমন কাজ ছিল যে কালকে করা যেত না? কেনো পুরো বিল্ডিং এ একলা থেকে যেত হলো আদ্রিকাকে? অযথা জেদের বসে বোকামি করার স্বভাব গেল না মেয়েটার। এসব কাজের জন্যই আদ্রিকাকে বড্ড অপছন্দ পরখের। কোথা থেকে এসে ঘাড়ে চেপে বসল, কে জানে! যত ঘাড়ত্যাড়া লোকজনের সাথেই পরখের পরিচয় হয়।
রাগে তাপে গা রি রি করছে পরখের৷ কিন্তু সে পিওর জেন্টলম্যান। কোনোভাবেই নিজের দায়িত্ববোধকে অবহেলা করতে পারল না। আদ্রিকাকে কল দিয়ে রুষ্ট স্বরে জানতে চাইল,
‘কোথায় তুমি?’
সহজ সাবলীল কণ্ঠ ভেসে এলো মোবাইলের অপরপ্রান্ত হতে।
‘রেস্টুরেন্টে।’
‘এখনো বাড়ি আসো নি কেনো?’
‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।’
‘বাকি স্টাফ কোথায়?’
‘চলে গেছে।’
‘বৃষ্টিতে ওরা কীভাবে চলে গেল?’
‘ওরা আগেই বেরিয়ে গেছে?’
‘তুমি রয়ে গেলে কেনো?’
‘হিসাবের কিছু কাজ বাকি ছিল।’
‘ফালতু লজিক আমাকে দেখাবা না। হিসাবের কাজ কালকে করলে রেস্টুরেন্ট ভেসে যেত না৷ এটা তোমার বাবার বাড়ি না, যে যখন ইচ্ছা তখন ফিরবা৷ মন চাইল বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাত কাটায় বাড়ি ফিরলাম। প্রশ্ন করার কেউ রইল না৷ এসব আমার বাড়িতে চলবে না। ভদ্রঘরের মানুষজনের বাড়ি ফেরার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময় অনুযায়ী তোমারও বাড়ি ফেরা উচিত ছিল। রেস্টুরেন্ট থেকে এখনি বের হও তুমি।’
‘বাইরে কোনো গাড়ি নেই।’
‘ক্যাব বুক করো৷’
‘পাচ্ছি না। রাত অনেক হয়েছে৷ সেই সাথে বৃষ্টি। ক্যাব সার্ভিস বন্ধ।’
‘ওহ, তোমার এখন মনে হচ্ছে, রাত অনেকে হয়েছে!’
‘পরখ, আপনি আসতে পারবেন?’
‘এই বৃষ্টির মধ্যে আমি বের হতে পারবো না।’
‘তাহলে আর কি করার! এখানেই থাকি।’
‘ওখানে থাকবে মানে?’
‘আমার অফিসে। শুধু রাতটুকুই তো। আর কয়েকটা ঘন্টা পরে সকাল হয়ে যাবে। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’
‘ঘুমাবে কোথায়?’
‘সোফায়।’
‘যা খুশি করো।’
বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিল পরখ। এমন হেয়ালি কথাবার্তা শোনার সময় নেই ওর। যা ইচ্ছে করুক গে। ওর কি!
দোতলা থেকে ফিরে পুরোটা সময় চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিল আদ্রিকা। কোনো কাজে মন বসছিল না। মাথার ভেতর একটা শব্দ মাছির মতো ভনভন করছে।
“শুদ্ধতা, শুদ্ধতা, শুদ্ধতা।”
এই কয়েকদিনে শুদ্ধতাকে সে ভুলে যেতে বসেছিল। একটি ঘটনাকে দীর্ঘদিন মনে পুষে রাখতে পারে না আদ্রিকা। সময়ের সাথে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। কিন্তু আজকে পরখের পাশে অনুকে দেখে হুট করে শুদ্ধতার কথা মনে পরে গেল। শুদ্ধতা নিশ্চয়ই পরখের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে থাকত।
কী বোকা আদ্রিকা! ও ভাবতো পরখের মধ্যে রোমান্টিকতা নেই। একদম কাটখোট্টা গোছের একটা মানুষ পরখ। সবার যে রোমান্টিক হতে হবে, সবসময় ভালোবাসার বুলি ছুটাতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা তো নেই। এজন্য পরখের কটু কথা, রাগান্বিত আচরণকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল। বিস্ময়ের প্রেমবাচ্যের থেকে পরখের কটুকথাই বরং ভালো মনে হয়েছিল। বিনিময়ে কি পেয়েছে? ধোঁকা।
ওমন পুরুষের থেকে পরখ হাজারগুণ ভালো। মুখ দিয়ে যতোই তিক্ততা ঝড়ুক, তবুও ওকে সম্মানের সাথে নিজের ঘরে ঠাঁই দিয়েছে। নিজের নাম দিয়েছে, জীবনে স্থান দিয়েছে৷
কিন্তু শুদ্ধতার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিগুলো অন্য কথা বলছে৷ ওগুলা পড়ে আদ্রিকার চোখ খুলে গেছে। রোমান্টিকতা পরখের মধ্যেও আছে। যা শুধু তার ভালোবাসার মানুষটির জন্য। আদ্রিকার কোনো যোগ্যতাই নেই সেই পরখকে দেখার, জানার। এতোটা পথ পারি দিয়ে এসে আদ্রিকার মনে হচ্ছে, সে আবারও বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়েছে।
নিজের চিন্তাভাবনায় নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়। নির্বোধ মেয়ে। পরখ কখনোই তোকে আশা দেয়নি, স্বপ্ন দেখায়নি। বরং বারবার দূরে ঠেলে দিয়েছে। কথা ও কাজে বুঝিয়ে দিয়েছে তার জীবনে তোর কোনো গুরুত্ব নেই। তুই নিজেই স্বপ্ন বুনেছিস, ঘর সাজিয়েছিস। এখান সেসব ভেঙে গেলে তার কি দোষ?
পাশে কোথায় বাজ পরলো বুঝি। আদ্রিকা চমকে উঠে চেয়ার ছেড়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে ভারী বর্ষণের সাথে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আদ্রিকার সারা গা কাঁপতে শুরু করলো। বেশ তো সাহস দেখিয়ে বলেছিল অফিসে থাকবে। কিন্তু একা এই ভূতুড়ে পরিবেশে সে এক ঘন্টাও টিকতে পারবে না। জানালার পর্দা টেনে সোফায় চুপচাপ করে বসে রইল।
এবার ষোলকলা পূর্ণ করতে ধপ করে নিভে গেল আলো। চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া মাত্র মনে হল সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপতে কাঁপতে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে সামনের দিকে আলো ফেলে দেখল, নাহ, কেউ নেই।
তবে এবার মনে হচ্ছে পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে৷
পেছনের দিকে আলো ফেলে দেখলো সেখানেও কেউ নেই৷
আচ্ছা মুশকিল হলো সামনে আলো ফেললে মনে হয় পেছনে কেউ আছে৷ আবার পেছনে আলো ফেললে মনে হয় সামনে আছে৷
আদ্রিকা দিশেহারা বোধ করল। সোফার উপর ফোনটি উপুড় করে রেখে দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করল। সে একটু শক্ত থাকলে চাইলে বিধাতা তাকে নতুন বিপদে ফেলে দেয়। এভাবে পুরো পৃথিবী আদ্রিকার বিরোধিতা করলে সে কীভাবে টিকে থাকবে? রাগ করে বাড়ি না ফেরা বড্ড ভুল হয়েছে। আদ্রিকা আরেকবার অনুধাবন করল, এসব রাগ, জেদ, অভিমান তার জন্য নয়। বোকা মানুষদের রাগ করব মানায় না৷ রাগের বশবর্তী হয়ে তারা আরও বেশি বোকামি করে ফেলে।
এই বিপদের মুহূর্তে কারো সাহায্য নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু কার কাছে সাহায্য চাইবে?
মা-বাবার কাছে সাহায্য চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আদ্রতাকে বলা যায়। কিন্তু আদ্রতা এখন একা নেই। স্বামী, সংসার যুক্ত একজন নারীকে এভাবে হুটহাট রাতবিরাতে কল দিয়ে সাহায্য চাওয়া যায় না। নারীটি চাইলেও সাহায্য করতে পারে না। স্বামীর অনুমতি এবং অনুকূল পরিবেশের প্রয়োজন হয়৷ যদি সেসব না পায় তবে সাহায্য করতে না পারার অনুতাপে আদ্রতা নিজেই অস্থির হয়ে উঠবে। আদ্রিকার পক্ষে আদ্রতার অস্থিরতার কারন হওয়া সম্ভব নয়। তাই আদ্রতাও বাদ।
শাশুড়িকে কল দেওয়া যায়। কিন্তু তা করলে প্রলয়ঙ্কারী ঝড় আসবে। আদ্রিকার রেস্তোরায় কি করছে? বাড়ির বউ রেস্তোরাঁয় কাজ করছে জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আদ্রিকা সন্দীহান। এছাড়াও আদ্রিকাকে রেস্তোরায় একা রেখে পরখ বাড়িতে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, এই সংবাদে আদ্রিকার শ্বশুরমশাই এর নাক কা/টা যাবে সে বিষয়ে আদ্রিকা নিশ্চিত। যার মাশুল গুনতে হবে পরখকে। স্বামীকে অন্যের দ্বারা অপমানিত হওয়ার কারন বঙ্গনারী হতে পারে না। প্রয়োজনে সে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে কিন্তু স্বামীর অপমানের কারন হবে না৷
রুমিকে কল করা যায়। কিন্তু এতো রাতে স্বল্প পরিচিত একজন যুবকের কাজে সাহায্য চাইতে আদ্রিকার বিবেকে বাঁধছে। এই সময় হঠাৎ আদ্রিকার কল দেখে আদ্রিকা সম্পর্কে রুমির নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে।
সবদিক বিবেচনা করে শুধু পরখের শরণাপন্ন হওয়াটাই সহজ মনে হলো। সে কি পরখকে একটা কল করবে? এসে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকবার না হয় অনুরোধ করবে।
কিন্তু যদি না করে দেয়? না করলে আদ্রিকা শুনবে কেনো? সে পরখের স্ত্রী। আদ্রিকা ডাকলে পরখ আসতে বাধ্য৷ কিন্তু শুদ্ধতা সম্পর্কে জানার পর বিয়ের জোরে পরখের উপর দাবী জানাতেও আদ্রিকার বিবেকে বাঁধছে৷
এই মুহুর্তে কি করা উচিত ভেবে পেল না। বেশিকিছু ভাবার আগে আকাশ পাতাল এক করে একটি শব্দ হল। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে কেঁপে উঠল আদ্রিকা। আবেগ বিবেক সব ভুলে ঝটপট মোবাইল তুলে পরখকে কল করল। ভীতু গলায় মিনতি করে বলল,
‘আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান।’
‘পারব না। ওখানেই থাক।’
‘আমার ভয় করছে।’
‘আগে খেয়াল ছিল না?’
‘আচ্ছা, স্যরি। আসুন না।’
‘মাত্র ফিরেছি। এখন আবার বের হতে পারব না। ক্যাব বুক করে নিজেই চলে এসো। না হলে ওখানেই রাত কাটাও।’
খট করে কল কেটে দিল পরখ। দিশেহারা আদ্রিকা পা তুলে সোফায় গুটিশুটি হয়ে বসে আবার ক্যাবের খোঁজ করতে শুরু করল। অভিমান করে কী বোকামিটাই না করে ফেলল সে!
কে বলেছিল একা অফিসে থেকে যেতে! বলিহারি বৃষ্টিটাও আজকের রাতেই ঢল নেমেছে।
আদ্রিকা আসলে এতোটাও বোকা না। সে সব বুঝে। এই যে সবাই মিলে একজোট হয়ে ওকে নাস্তানাবুদ করার পায়তারা করেছে এটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। একটু অভিমান করেও থাকতে দিবে না।
অনেক চেষ্টা করেও কোনো ক্যাব পাওয়া গেল না৷ হাটুতে মুখ গুজে নিজের দুর্দশায় কাঁদতে বসল আদ্রিকা। এছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
হঠাৎ বাইরে ঢংঢং শব্দ হলো। শব্দটা এসে সোজা আদ্রিকার বুকে আঘাত হানল। হার্ট বিট যে বেড়ে গেছে তা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। অতি উত্তেজনায় মিনি স্ট্রোক না করে ফেলে। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে সেই মুহুর্তে ঘর কাঁপিয়ে মোবাইলটি বেজে উঠল। চমকে গিয়ে তড়াৎ করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল আদ্রিকা। শব্দের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতেই কাপাকাপা হাতে মোবাইলটি হাতে নিয়ে দেখল পরখ কল করেছে।
রিসিভ করে হ্যালো বলতেই শোনা গেলো পরখের শীতল কন্ঠস্বর।
‘রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। নেমে এসো।’
আর কিছু শোনার অপেক্ষা না করে টেবিল থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে ভীত হরিণীর মতো ছুটে বাইরে চলে গেলো আদ্রিকা।
প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পরখ। গায়ে একটি কালো রেইনকোট। কলিংবেলের সুইচবোর্ডের সামনে পরখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঢংঢং শব্দের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল।
আদ্রিকাকে দেখে এগিয়ে এল পরখ হাতে ধরে থাকা রেইনকোর্টটি নিজেই আদ্রিকার গায়ে জড়িয়ে দিল।
মুখে কিছু না বলে গটগট করে হেটে গেল বাইকের দিকে৷ পরখকে চুপচাপ বাইকের উপর বসে থাকতে দেখে আদ্রিকা গিয়ে বসল বাইকের পেছনে।
ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে চারপাশ। শুধু ভিজছে না আদ্রিকা এবং পরখ। রেইনকোর্টের আস্তরণ বৃষ্টি থেকে রক্ষা করলেও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। বৃষ্টির চাদরে মুড়ে থাকা রাস্তাঘাট যেনো কুয়াশায় আচ্ছন্ন। দক্ষ হাতে ধীর গতিতে বাইক চালাচ্ছে পরখ।
পেছনে নিশ্চিন্তমনে বসে আছে আদ্রিকা। এক হাত পরখের কাঁধে রেখে অন্য হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুয়ে দিচ্ছে৷ মুঠো ভরে গেলে বৃষ্টির পানি শূণ্যে ছুড়ে দিয়ে আবারও হাত পেতে দিচ্ছে।
বাড়ির সামনে বাইক থামলে আদ্রিকা আবার মুখটি আঁধারে ঢেকে নিল। বিপদে পরে সাহায্য চেয়েছে বলে অভিমান ভুলে যাবে নাকি? কিছুটা অভিমান সে এখনো ধরে রেখেছে।
পরখকে রেখে ধুপধাপ সিড়ি পেরিয়ে ঘরে চলে গেল। শাড়ির নিচের অংশ পুরো ভিজে গেছে। ওয়াশরুমে ঢুকে শাড়িটি খুলে ফেলে গায়ে একটি তোয়ালে জড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল নিজের কক্ষে।
পরখ ওর পিছু নিয়ে গটগট করে কক্ষে প্রবেশ করে আদ্রিকার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিল৷ এক হাতে তোয়ালে সামলে পরখের বুক থেকে মুখ তুলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চাইল আদ্রিকা। ওর এক হাতের কব্জি ধরে শান্ত কন্ঠে পরখ জানাল সতর্ক বার্তা।
‘আর কখনো কোনো মেয়েকে জড়িয়ে আমাকে সন্দেহ করার দুঃসাহস করবে না। আমি তোমার প্রেমিকের মতো দুঃশ্চরিত্রের নই।’
হাত ছেড়ে দিয়ে হনহন করে কক্ষ থেকে বিদায় নিল পরখ। রেখে গেল হতবিহ্বল আদ্রিকাকে। সে আবার কোন মেয়েকে জড়িয়ে পরখকে সন্দেহ করল?
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৪০|
টানা দুদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পর আজকে আকাশ পরিষ্কার৷ গায়ে সোনা রোদ মেখে মানবিক বিভাগের সামনে এসে দাঁড়াল আদ্রিকা। প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রতা। ওকে পেছনে থেকে দেখে চিনতে পেরে উচ্ছ্বসিত আদ্রিকা দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।
দুই সপ্তাহ পর আজকে আদ্রতার সাথে দেখা হয়েছে আদ্রিকার। এতোদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত দিন কেটেছে আদ্রতার। দীর্ঘসময় ক্লাসে উপস্থিত না থাকার ফলে সেমিস্টার ফাইনালে বিকল্প ও আদ্রতার বেহাল দশা৷ তবুও বন্ধুদের সহায়তায় এ যাত্রায় কোনোরকম পাশ করে যাবে বলে মনে হচ্ছে৷
আদ্রিকাকে দেখা মাত্র জড়িয়ে ধরে জন্মদিনের প্রথম শুভেচ্ছা জানাল আদ্রতা,
‘শুভ জন্মদিন, বাচ্চা। আল্লাহ তা’লা তোকে সুখ-সমৃদ্ধিতে মুড়িয়ে রাখুক।’
নিজ জন্মদিন আদ্রিকা কখনো ভুলে না৷ এবারও ভুলেনি। তবে আগের মতো আহ্লাদ করার সুযোগ এ বছর পায়নি। কাজের মাঝে যখনি জন্মদিনের কথা মনে পরেছে তখনি আশেপাশে গোমড়ামুখো পরখকে দেখে জন্মদিনের উচ্ছ্বাস এক ছুটে পালিয়েছে৷ উপযুক্ত মানুষ না পেলে জন্মদিন নিয়ে আহ্লাদ করবে কার কাছে? মানুষের মন বদলায় না। শুধু মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের মানুষগুলো হারিয়ে যায়।
প্রতিনিয়ত অতিবাহিত দিনগুলো আদ্রিকাকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, তুমি আর ছোট বাচ্চাটি নেই। অনেক বড় হয়েছো। এসব আহ্লাদ তোমার জন্য নয়।
কষ্ট হলেও, মেনে নিয়েছিল আদ্রিকা। কিন্তু এই মুহুর্তে আদ্রতার মুখের ঝলমল হাসি যেনো উল্টো সুর তুলেছে। আদ্রিকাদ মনে হচ্ছে এই তো সে আগের খুকিটিই রয়ে গেছে। কিছুই বদলায়নি। সব আগের মতোই আছে।
আদ্রিকার ছলছল চোখ, মুখে উপচে পরা নিঃশব্দের হাসি দেখে আদ্রতা বলল,
‘কী রে, কি হয়েছে? কাঁদছিস নাকি? বারোটায় উইশ করিনি, কারন সরাসরি উইশ করতে চেয়েছিলাম।’
‘কাঁদছি না। বরং এখনও ছোট বাচ্চার মত জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছ দেখে লজ্জা পাচ্ছি।’
‘খুব বড় হয়ে গেছিস বুঝি?’
‘হইনি? বিয়েশাদি হয়ে গেছে, সংসার করছি। শ্বশুরবাড়িতে এসব আহ্লাদ করা যায়!’
‘বিয়ে হলেই কেউ বড় হয়ে যায় না। দেহের বয়স বাড়ে, মনের না। মন চিরকাল একই রকম থাকে। জীবন্ত, সজীব, উচ্ছ্বসিত।’
‘মন একইরকম থাকতে চায়, কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতির চাপে বদলে যেতে বাধ্য হয়।’
‘তোর পরিবেশ, পরিস্থিতি কি জন্মদিন পালনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?’
‘মোটেও না। আমাকে বাঁধা দিবে কে! বরং কাজের চাপে আমি নিজেই ভুলে গেছি।’
‘এতো কীসের কাজ তোর? সেই তো টোনাটুনির ছোট সংসার।’
রসনাবিলাসীতে আদ্রিকার নিয়োগের ব্যাপারে এখনও কেউ জানে না৷ মাঝখানে অনেকদিন আদ্রতার সাথে দেখা না হওয়ায় আদ্রিকা ওকে জানাতে পারেনি৷ আজকে সুযোগ পেয়ে সংবাদটি জানিয়ে দেওয়া উত্তম মনে হল।
‘তোমাকে বলা হয়নি, আমি একটা রেস্টুরেন্টে শেফ হিসেবে কাজ করছি।’
আদ্রতা কিছুক্ষণ বোকার মত চেয়ে রইল। আদ্রিকা কি বলছে, তা সে শুনেছে কিন্তু বুঝতে পারেনি৷ যখন বুঝতে পারল, এগিয়ে এসে আদ্রিকার হাতে হাত রেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘কেনো? তুই কেনো কাজ করছিস? টাকাপয়সার সমস্যা থাকলে আমাকে বলতি৷’
‘তেমন কিছু না। বাড়িতে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছিল না৷ তাই সুযোগ পেয়ে রেস্টুরেন্টে জয়েন হয়ে গেলাম।’
‘তেমন কিছু না, বললেই আমি মেনে নিব না৷ অবশ্যই তোর জীবনে কিছু চলছে, যা আমরা কেউ জানি না৷ তুই আমাকেও বলছিস না৷ কোনো সমস্যা হলে আমাকে অন্তত বল। বিয়ে দিয়েছি, একেবারে জলে ফেলে দেইনি।’
‘সমস্যায় পরলে আমি তোমাকে জানাতাম, না? তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ।’
‘তবে এসব কেনো?’
‘আয় করা খারাপ? নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা অন্যায়? নাকি রেস্টুরেন্টে রান্নাবান্না করার চাকরিটা ভালো না?’
‘সেসব নয়, বাচ্চা৷ কোনো কাজকে আমি ছোট করে দেখছি না। কিন্তু তুই বাইরে কাজ করছিস, ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছি না৷ আমাদের কতো আদরের বাচ্চা তুই! এসব কখনো করেছিস!’
‘বেশি আদরে মানুষ করে পুরো অকর্মার ঢেকি বানিয়ে রেখেছো৷ একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারতাম না৷ রান্না শিখতে কতো কাঠ খড় পো/ড়াতে হয়েছে জানো?’
‘এখন রান্নায় এতো পটু হয়ে গেছিস যে রেস্টুরেন্টের শেফ হয়ে গেলি! শ্বশুরবাড়িতে কেউ আপত্তি করেনি?’
‘শ্বশুর-শাশুড়ি এখনো জানে না। পরখের আপত্তি নেই। আমি যেখানে কাজ করি সেটা উনার ফ্রেন্ডের রেস্টুরেন্ট৷ উনারও কিছু শেয়ার আছে।’
‘তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন যদি আপত্তি করে, তখন কি করবি?’
‘কি আর করব! চাকরি ছেড়ে দিব।’
‘কেন? কাজ করতে তোর ভালো লাগলে উনাদের কথায় ছেড়ে দিবি কেন?’
‘শুধু শুধু ঝামেলা করতে আমার ভালো লাগে না৷ উনাদের ভালো না লাগলে চাকরি করব না৷ চাকরি না করলে আমার খুব বড় কোনো ক্ষতি তো হয়ে যাবে না। জেদ করে ঝামেলা বাড়ানোর কী দরকার!’
‘অন্যের পছন্দ-অপছন্দের উপর নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি। তুই যতো ছাড় দিবি, মানুষ ততো পেয়ে বসবে। একের পর এক আবদার করেই যাবে। নিজের জায়গা ছেড়ে দিতে দিতে একসময় দেখবি তোর পায়ের তলার মাটিটাই নাই। তাই অন্যের কথায় কান না দিয়ে নিজের যেটা পছন্দ সেটাকে গুরুত্ব দিতে শিখ।’
ঘাসের উপর বসে আছে দু বোন। আদ্রতার কথা শুনে একটি দূর্বাঘাসের ডগা ছিড়ে দাঁতে কাটল আদ্রিকা। পরক্ষণে থু থু করে ফেলে দিয়ে বলল,
‘উনারা আপত্তি করলে তখন দেখা যাবে। এখন যেহেতু কোনো ঝামেলা হচ্ছে না, এভাবেই চলুক।’
‘তোর চাপ হয়ে যাচ্ছে না?’
‘নাহ, বরং আমার ভালোই লাগছে৷ আগে বাড়িতে একা বসে থাকতে ভালো লাগত না৷ পরখ সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকত, আর আমি বাড়িতে একলা। একদম সময় কাটতে চাইত না৷ এখন কোন ফাঁকে দিন কেটে যায় বুঝতে পারি না৷ কলেজ থেকে বাড়ি যাই৷ ফ্রেশ হয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে রান্নার আয়োজন করি। আরেকজন শেফ আছে উনি আগেই সবকিছু গুছিয়ে রাখেন। আমি শুধু রান্নাটা করি৷ কাস্টমারদের সার্ভ করার জন্য আলাদা লোক আছে। ক্যাশ কাউন্টারে একজন আছে৷ আমাকে খুব একটা কাজ করতে হয় না। কাজের তেমন প্রেশার নেই।’
‘চাপ নিয়ে কিছু করতে হবে না। তোর ভালো লাগলে আপাতত কর৷ এখন ক্লাসে যা। কলেজ ছুটি হলে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকবি।’
‘কেনো?’
‘তোর জন্মদিনের ট্রিট নিবি না?’
‘যাহ! আমি এখনও ছোট বাচ্চা আছি নাকি! কেক কেটে জন্মদিন পালন করব এখন?’
‘সেকি রে! ভূতের মুখে রাম নাম। এই তো কয়েকদিন আগেই রেড ভেলভেট কেক চাই বলে আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেছিলি, সেই আদ্রিকা এখন কোথায় গেলো?’
‘সেই আদ্রিকা এখন বড় হয়ে গেছে। ওসব কেকের বায়না এখন করে না।’
‘সত্যি তো? রেড ভেলভেট কেক কিন্তু? আরেকবার ভেবে দেখ।’
‘ভেবেই বলছি।’
‘ভ্যানিলা, চকলেট?’
‘উহু। কিছুই লাগবে না।’
‘বাব্বাহ! এতো উন্নতি! মায়ের কাছেও এবার বায়না করিস নি শুনলাম। সব বায়না কি বরের কাছে?’
উত্তরে আদ্রিকা লাজুক হেসে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আজকে আসি। ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছে।’
ক্লাস শেষে আদ্রিকা অপেক্ষা করতে রাজি না হলেও আদ্রতা ঠিকই অপেক্ষায় রইল। প্রধান ফটক পেরিয়ে ইফফাতের সাথে কথা বলতে বলতে আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে আদ্রিকা। হঠাৎ ইফফাত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আদ্রিকাকে বলল,
‘উনি মনে হয় তোমাকে ডাকছেন।’
আদ্রিকা পেছনে তাকিয়ে আদ্রতাকে দেখে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পরল। একটি অপরিচিত ছেলের সাথে আদ্রিকাকে দেখে মুখখানি গম্ভীর করে আদ্রতা জানতে চাইল,
‘কে এটা?’
আদ্রিকা মিষ্টি হেসে ইফফাতের সাথে আদ্রতার পরিচয় করিয়ে দিল।
‘ও হচ্ছে ইফফাত। আমার ক্লাসমেট। অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আর ইফফাত, এই হচ্ছে আমার বড় বোন আদ্রতা।’
জবাবে ইফফাত সালাম জানাল। সালামের জবাব নিয়ে আদ্রতা আরেকবার জহুরি দৃষ্টি দ্বারা ছেলেটিকে দেখে নিয়ে আদ্রিকার হাতে খাবারের পট ধরিয়ে দিয় বলল,
‘এখানে পায়েস আছে। আমি নিজে হাতে রান্না করেছি। মায়ের হাতের পায়েসের মত ওতোটা ভালো হয়নি৷ কিন্তু খাওয়া যাবে।’
হাতে ধরে রাখা পটটির দিকে তাকিয়ে আদ্রিকা মাথা দুলিয়ে সায় জানাল। মুখ তুলে চাইলে আদ্রতা তার জলে সিক্ত আঁখিজোড়া দেখে ফেলবে। আদ্রতা আর অপেক্ষা করল না। রিক্সা নিয়ে চলে গেল। ইফফাত বলল,
‘তোমরা একসাথে থাক না? উনি তোমাকে রেখে চলে গেল যে!’
‘আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়িতে থাকে।’
‘ওহ। তোমার জন্য পায়েস রেঁধেছে, আজকে কি বিশেষ কোনো দিন?’
‘নাহ। এমনিতেই দিয়ে গেল। বোনের হাতের রান্না বিশেষ দিন ছাড়া খেতে নেই বুঝি?’
‘তা কেনো! আমি এমনিতেই জানতে চাইলাম। মনে হলো আরকি।’
‘তুমি পায়েস খাবে?’
‘এই নাহ। উনি এগুলো তোমার জন্য দিয়েছে।’
‘অনেকটা দিয়েছে। সাথে চামচও আছে। চলো, সামনের হোটেলে বসি। তুমি অর্ধেকটা খাও। বাকিটা আমি বাড়িতে গিয়ে খাব।’
হোটেলে বসে ইফফাত বেশ মজা করে পায়েস খেলো৷ আদ্রিকা এক কাপ চা নিয়ে বসে রইল চুপচাপ। বাড়ি ফিরতে আজকে খানিকটা দেরী হয়ে গেছে। মনটাও বিশেষ ভালো নেই৷ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে রুমিকে জানাল, আজকে রেস্তোরাঁয় যাবে না। রুমি জানতে চাইল, কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা। শরীর ঠিক আছে কি?
আদ্রিকা জানাল, সব ঠিক আছে৷
রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখল, ঘরে কোনো খাবার নেই৷ কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না। তাই এ বেলা ভাত রান্নার ঝামেলায় গেল না। আদ্রতার সাথে কথা বলার পর মনের ভেতর অদ্ভুত উদাসীনতার সৃষ্টি হয়েছে৷ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেই উদাস ভাব।
সামান্য একটু ময়দা গুলিয়ে একটি পরোটা তৈরি করে নিল। আদ্রতার দেওয়া পায়েস এবং পরোটা খেয়ে চলে গেল নিজের কক্ষে৷ উদাসীনতার সাথে পাল্লা দিয়ে আসে অলসতা৷ মনের ভেতর অজানা এক ব্যথার সাথে গুমোট ভাব নিয়ে চুপচাপ একান্তে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে।
তাই তো এই দিনদুপুরে বিছানায় গা এলিয়ে দিল আদ্রিকা।
রেস্তোরাঁ থেকে আজকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে পরখ। পুরো বাড়িতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আদ্রিকার খোঁজ করেও যখন পেল না তখন নিজের কক্ষে চলে যাওয়াই উচিত মনে হল। আজকে সেকেন্ড ইয়ারের সিটি ছিল। খাতাগুলো জমা করে নিয়ে এসেছে বাড়িতে। সন্ধ্যা থেকে রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত কিছু খাতা নিরক্ষণ করে পরখ বাইরে এলো। বসার ঘর পুরো অন্ধকার। কেউ আলো জ্বালায়নি। সুইচ চেপে আলো জ্বালিয়ে আদ্রিকার কক্ষে উঁকি দিল। আদ্রিকাকে কাঁথা মুড়ে ঘুমাতে দেখে সামান্য ভ্রু কুঁচকাল। এই অবেলায় জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছে কিনা কে জানে!
ডাকতে চেয়েও ডাকল না। ফিরে এসে রান্নাঘরে চলে গেল। নাহ, রান্নাবান্না কিছুই হয়নি। রাতভর অভুক্ত থাকা পরখের পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের জরুরি কাজ রেখে পরখ চাল, ডাল ধুয়ে কিছু সবজি কেটে নিল। তেল মশলা দিয়ে সবকিছু মেখে খিচুড়ি বসিয়ে দিল চুলায়। আলু ভর্তার জন্য দুটো আলু ছুলে খিচুড়ির সাথে দিয়ে দিল।
কাঁচা পেয়াজ এর সাথে বেশি ঝাল দিয়ে আলু ভর্তা আর খিচুড়ি পরিবেশন করে পরখ গেল আদ্রিকাকে ডাকতে। নিচু স্বরে আদ্রিকা জানাল,
‘ক্ষুধা নেই৷ আপনি খেয়ে নিন।’
এমন অদ্ভুত কথা শুনে রাগ হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিল পরখ। আরেকবার সাধল না। না খেলে, না খাবে৷ পরখের কি? সে ফিরে এসে পেট ভরে খেয়ে নিল। রাত জেগে খাতাগুলো দেখতে হবে। আদ্রিকার অকারণ মুড সুয়িং দেখার সময় নেই পরখের।
পরখ চলে যাওয়ার সময় কক্ষের আলো নিভিয়ে যায়নি। আলোটা বড্ড চোখে লাগছে আদ্রিকার। তবুও সে বৈদ্যুতিক বাতিটির দিকে চেয়ে রইল। চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় আলোটা চোখে সয়ে গেল। আলোকিত সাদা বৃত্তটি ধীরে ধীরে একটি কদম ফুলের আকার নিল। একটা থেকে দুটি কদম ফুল, তারপর তিনটি। ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ একটি কদম ফুলের তোড়া স্পষ্ট হলো।
বৃষ্টি ভেজা কদম ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক। ঠোঁটে তার মন ভুলানো হাসি। দু হাতে ফুলগুলো আঁকড়ে কী যেনো বলছে৷ কথাগুলো আদ্রিকা শুনতে পেল না। কিন্তু যুবকের ঠোঁট দুটোর নড়াচড়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ করে যুবকটি সামান্য ঝুঁকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির ঠোঁটে চুমু খেলো৷ লজ্জায় নত হয়ে এলো মেয়েটির মুখমণ্ডল।
কিন্তু একি! মেয়েটির ঠোঁটে যুবকটি চুমু এঁকে দিতেই আদ্রিকার দেহ এভাবে কেঁপে উঠল কেন? কেনো আদ্রিকার ঠোঁটে শিহরণ বয়ে গেল?
কম্পনরত ঠোঁটে আলতোভাবে আঙ্গুল ছুঁয়ে আদ্রিকা সরু চোখে চাইল সাদা আলোর দিকে। ঘোলাটে আলোয় স্পষ্ট হলো যুবকটির মুখমণ্ডল। চিরপরিচিত মানুষটিকে দেখে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল আদ্রিকার সর্বাঙ্গ। স্মৃতির পাতা হাতড়ে হুড়মুড় করে তেড়ে এলো কিছু নিষিদ্ধ মুহূর্ত।
আর দেরী করল না আদ্রিকা। চট করে শোয়া থেকে উঠে বসল। তবুও পিছু ছাড়ল না স্মৃতিরা। দু হাতে মাথা চেপে ধরে আদ্রিকা নিজেকে প্রবোধ দিল।
সে তোমার জন্য নিষিদ্ধ আদ্রিকা। তার কথা ভাবাও পাপ। এ অন্যায়, ঘোর অন্যায়।
কিন্তু স্মৃতিরা থেমে রইল না। মনতরীর চর থেকে শুরু করে ভূবনভোলা একাডেমির প্রতিটি স্থান স্পষ্ট হতে শুরু করল। যুবকটির আকর্ষণীয় চেহারা, মনোমুগ্ধকর আচরণ সবই যেনো জীবন্ত এই মুহুর্তে।
এমনি একটি দিনে শুরু হয়েছিল বিস্ময়ের সাথে আদ্রিকার প্রণয় যাত্রা। এজন্যই কি আজকে সে মস্তিষ্ককে হানা দিল? আর কিছু ভাবতে পারছে না আদ্রিকা। মন-মস্তিষ্কের নীরব যুদ্ধে সে বিধ্বস্ত। পাপ-পূণ্যের খেলায় কে জিতবে এই মুহূর্তে সেটি মূখ্য বিষয় নয়। বরং এই খেলায় প্রতিনিয়ত কলঙ্কিত হচ্ছে আদ্রিকার কোমল, পবিত্র মন৷
গা হতে কাঁথা সরিয়ে আদ্রিকা বিছানা থেকে নামল৷ হাতের উল্টো পিঠে দ্রুত চোখের জল মুছে ঠান্ডা মেঝেতে কদম ফেলে চলল পরখের কক্ষে৷
বেচারা পরখ ভদ্র ছেলের মতোন তার রকিং চেয়ারে বসে ছিল। টেবিলের উপর একগাদা খাতাপত্র তার মনোযোগের অপেক্ষায়। এমন সময় ক্ষেপাটে হাওয়ার মতো কক্ষে আগমন ঘটল আদ্রিকার। পরখের রকিং চেয়ারটি সামান্য ডানে ঘুরিয়ে নিয়ে বিনাবাক্যে ব্যয় করে পরখের কোলে বসে পরল। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব পরখ ঝাঁঝালো কিছু কথা বলার আগেই দু হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুপটি করে রইল আদ্রিকা।
নিজেদের টালমাটাল অবস্থা সামলে নিতে কিছুসময় নীরবতায় কাটাল দুজনে। চেয়ারে হেলান দিয়ে পরখ তার সাবধানী কণ্ঠে শুধাল,
‘আদ্রিকা, আর ইউ ওকে?’
নিশ্চিন্তে চোখ বুজে আপন খেয়ালে বিচরণরত আদ্রিকা ছোট করে জবাব দিল।
‘হুম।’
পরখ আর কিছু জানতে চাইল না। খানিক বিশ্রামের আশায় সেও নিজের চোখ বুজে নিল।
রাত কতোটা গভীর হয়েছে পরখের জানা নেই৷ কক্ষে বৈদ্যুতিক বাতির কৃত্রিম আলো। ঘুমকাতুরে চোখ জোড়াকে কড়া শাসনে এনে নিজের বুকের দিকে তাকাল। সেখানে মুখ গুজে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আদ্রিকা। ওর গালে হাত রেখে বার কয়েক ডাকল পরখ। গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোনো সাড়া এলো না।
এভাবে বসে কেউ গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতে পারে জানা ছিল না পরখের। হতাশ পরখ চেয়ার ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সমস্ত অলসতা ঝেড়ে ফেলল। কালকের মধ্যে রেজাল্ট শীট তৈরি করতে হবে।
ঘুমন্ত আদ্রিকাকে পাঁজাকোলে তুলে নিজ কক্ষ ত্যাগ করে চলল আদ্রিকার কক্ষের দিকে। আদ্রিকার বিছানায় ওকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা দিয়ে দিল। বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছে। সকালে বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা প্রবল। হয়তো শেষ রাতেই শুরু হয়ে যাবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
খোলা জানালাটি বন্ধ করে দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করার আগে ঘুমন্ত আদ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে পরখ ফিসফিস করে অন্তিম মুহূর্তে জানাল জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
‘শুভ জন্মদিন, আদ্রিকা।’
চলবে..
#অক্ষরময়ী