#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৪১|
দূর হতে ভেসে আসছে ক্ষীণ আওয়াজ। কেউ একজন নাম ধরে ডাকছে কিন্তু সাড়া দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই আদ্রিকা। ক্লান্ত চোখজোড়া এখনি জেগে উঠতে চাইছে না৷ এইতো কিছুক্ষণ হলো সে ঘুমিয়েছে এখনি কীসের ডাকাডাকি? তবে কি সূয্যিমামা আজ ঘুমাতে যায়নি?
গায়ে হালকা ঝাকুনি অনুভব করলো। যা ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে৷ বিরক্ত মাখা ঘুমকাতুরে চোখ দুটো মেলে সম্মুখে পরখের আবছায়া অবয়ব দেখা মাত্র আদ্রিকার ঘুম কেটে গেল৷ ধীরে সুস্থে শোয়া থেকে উঠে বসে চিন্তিত স্বরে জানতে চাইল,
‘কি হয়েছে? সকাল হয়ে গেছে?’
চারপাশে অস্থির দৃষ্টি ফেলে বাইরের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে প্রহর ঠাহর করার চেষ্টা করল আদ্রিকা৷ কিন্তু বন্ধ জানালা অতিক্রম করে প্রকৃতি দেবী কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে নি৷ তাই কিছু বুঝা গেল না৷
পরখের মুখমন্ডলের অভিব্যক্তি ঠাহর করা আরও দুষ্কর কর্ম। এতোক্ষণ পরখ খানিকটা ঝুঁকে আদ্রিকাকে ডাকছিল, এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আঁধারে আবৃত মুখে জানাল,
‘এখনো সকাল হয়নি। ভোর হতে চলেছে মাত্র।’
‘এতো সকালে ডাকছেন কেনো?’
লম্বা হাই তুলে প্রশ্ন করল আদ্রিকা৷ তার প্রশ্নের কোনো প্রভাব পরল না পরখের উপর। অভিব্যক্তিহীন শুষ্ক কণ্ঠে জানাল,
‘রেডি হয়ে নেও। হাসপাতালে যেতে হবে।’
ধক করে উঠল আদ্রিকার বুক৷ হাসপাতাল শব্দটির সাথে ভয় মেশানো রয়েছে। কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র সারা দেহে আতংক ছড়িয়ে পরে।
নিদ্রা হতে সদ্য জাগ্রত আদ্রিকার পক্ষে পরখ হতে প্রাপ্ত তথ্যটি অনুধাবন করা সম্ভব হলো না। ভ্রু কুঁচকে পরখের দিকে চাইল সে। অথচ নির্বিকার পরখ কক্ষ হতে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে৷ বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামল আদ্রিকা।
‘হাসপাতাল! হাসপাতাল কেনো? পরখ? কে অসুস্থ?’
দরজা পেরিয়ে বাহিরে পা রাখার আগমুহূর্তে পরখ উত্তর দিল।
‘তোমার বাবা।’
পূর্বাকাশে এখনও সূর্য উঁকি দেয়নি৷ সবে মাত্র আকাশে লাল আভা ছড়িয়েছে। ঘোলাটে অন্ধকার সরিয়ে প্রকৃতিতে ফ্যাকাশে আলো দেখা দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো।৷ খুব উজ্জ্বল নয় সে আলো৷ তবুও স্বচ্ছ আলোয় চারপাশ স্পষ্ট ও পরিষ্কার দেখা যায়৷
আদ্রিকার কম্পিত দেহখানা দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজার পাশে৷ অস্থির দৃষ্টি অনতিদূরের প্রধান সড়কে। যেখানে কোনো যানবাহনের অস্তিত্ব নেই৷ জনমানবহীন নিস্তব্ধ সড়কটি মৃত সাপের মতো পরে আছে৷ এবার আদ্রিকা কীভাবে পৌঁছাবে তার বাবার নিকট? অন্তরে তীব্র অস্থিরতার সাথে যুক্ত হলো অসহায়ত্ব। ওদিকে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি পরখের কাছ থেকে৷ আদ্রিকার অস্থিরতার বিপরীতে পরখ বেশ শান্ত৷ নিশ্চুপভাবে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আস্তে-ধীরে কাপড় পাল্টে এখন গিয়েছে গ্যারেজে৷ বাইক নিয়ে সে না হয় দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে৷ কিন্তু আদ্রিকা যাবে কিভাবে? হাতের আঙ্গুলে শাড়ির আঁচল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ভাবতে লাগল আদ্রিকা৷
বাইকের ইঞ্জিন চালু করে গ্যারেজ থেকে বাইক নিয়ে বাইরে এলো পরখ। আদ্রিকার সামনে বাইক থামিয়ে গম্ভীর স্বরে আদেশ করল,
‘উঠো।’
আদ্রিকা অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে৷ পরখ তাকে বাইকে উঠতে বলছে! সে কি ঠিক শুনেছে নাকি এসব তার দূর্বল মস্তিষ্কের ভ্রম? বাজারের প্রবেশ মুখে যে ব্যক্তি তাকে বাইক থেকে নামিয়ে দিয়ে রীতিমতো অপমান করেছে, তার বাইকে উঠে বসতে দ্বিধা হচ্ছে আদ্রিকার৷ তখনি আবারও পরখের শান্তস্বরের অধৈর্য্য বাক্যগুলো শুনতে পেল।
‘যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি রেখে চলে যাব?’
সন্দেহের অবকাশ রইল না আদ্রিকার মনে। এই মুহূর্তে আত্মসম্মানের উর্ধ্বে তার পরিবার। বাবার কাছে পৌঁছাতে হলে পরখের সাহায্য গ্রহণ ছাড়া উপায় নেই৷ ধীর পায়ে বাইকের কাছে এসে পরখের কাঁধে হাত রেখে বাইকে উঠে বসল। ক্ষণপল অপেক্ষা না করে দ্রুত বেগে ছুটতে শুরু করল বাইকটি৷ একহাতে বাইকের পেছনের অংশ চেপে ধরে, অন্যহাত রেখেছে পরখের কাঁধে৷ শুষ্ক গলায় ঢোক গিলে ভয়ার্ত কণ্ঠে দ্বিধাভরে আদ্রিকা জানতে চাইল,
‘আব্বুর কি হয়েছে? হাসপাতালে কেনো?’
আদ্রিয়া ভেবেছিল, পাথুরে পথে চলতে চলতে অনেকখানি শক্ত হয়ে গেছে তার মন৷ সামান্য আঘাতে এখন আর মন কাঁদবে না। জটিল পরিস্থিতিতেও সে ঘাবড়ে যাবে না৷ প্রতিনিয়ত রেস্তোরাঁয় অগণিত অপরিচিত মানুষ আসে। তাদের সামনে হাসিমুখে দৃঢ় চিত্তে কাজ করে আদ্রিকা৷ কই কখনো ঘাবড়ে যায় নি তো সে!
সেদিন ঝরঝরে সাদা ভাতের প্লেটে একটি কালো ভাত দেখে বখাটে ছেলেটা অযথা হাঙ্গামা শুরু করে দিল৷ সামলাতে না পেরে অনু গিয়ে খবর দিল আদ্রিকাকে৷ চট করে আতংক ঘিরে ধরেছিল আদ্রিকাকে৷ রুমিকে কল করে সাহায্য প্রার্থনা করতেই যাচ্ছিল৷ পরক্ষণে মনে হলো, অন্যের উপর কেনো অহেতুক নির্ভরশীলতা! একবার নিজেই প্রচেষ্টা করে দেখা যাক৷
দীর্ঘশ্বাসে বুক ভরে অক্সিজেন টেনে নিয়ে সে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটির সামনে৷ আদ্রিকার জ্বলন্ত দৃষ্টি, ভয়হীন মুখাবয়ব, দীপ্ত ও দৃঢ় কণ্ঠের প্রশ্নবাণে জর্জরিত ছেলেটি একসময় হার মেনে নেয়৷
সেদিন নিজ অফিসরুমে ফিরে ঠকঠক করে গ্লাস হতে পানি পান করে চেয়ারে বসে আপনমনে হেসেছিল আদ্রিকা৷ সাবাশি জানিয়েছিল নিজেকে। এরপর আর কোনো ঝামেলা, ঝঞ্জাট আদ্রিকাকে খুব একটা আতংকিত করতে পারেনি।
ফলস্বরূপ আদ্রিকা মনে মনে নিজেকে ম্যাচুউর বলে আখ্যায়িত করেছে৷ কিন্তু সেই আখ্যানটি আজ একপলকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। জন্মদাতা পিতা হঠাৎ হাসপাতালে কেনো? কয়েক শব্দের বাক্যটি উচ্চারণ করতে গিয়ে আর্দ্র হয়ে উঠল আদ্রিকার কণ্ঠস্বর। সিক্ত নয়ন বেয়ে ঝরে পরল ফোটা ফোটা জল।
সড়ক হতে দৃষ্টি সরিয়ে একনজর রিয়ার মিররে আদ্রিকার ক্রন্দনরত মুখটি দেখে নিয়ে পুনরায় সড়কের দিকে মনোযোগ দিল পরখ৷ মনে মনে সে প্রচন্ড বিরক্ত হলো৷ ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করার স্বভাবটি আজ গেল না মেয়েটির৷
‘কেঁদেকেটে অস্থির হওয়ার মত কিছু হয়নি।’
‘তবে হাসপাতালে কেনো?’
অশ্রুসিক্ত অভিমানী আদ্রিকা কিছুতেই পরখের সান্ত্বনা বাক্যে ভুলল না৷ সকালের শান্ত পরিবেশ, জ্যামহীন সড়ক৷ কয়েক মিনিটের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে পৌঁছে গেল ওরা৷ পুরো শহর ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে থাকে হাসপাতাল চত্বর৷ নিদ্রাহীন রাত জেগে জাগ্রত ভীরু প্রাণগুলো পাহারা দেয় মৃত্যুর আহবানকে৷ এই বুঝি চোখ ফাঁকি দিয়ে সে নিয়ে গেল প্রিয়জনকে।
পার্কিংয়ে বাইক রেখে ত্রস্ত পায়ে হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পরখ। লম্বা পদযুগলের ক্ষিপ্র গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে রীতিমতো ছুটছে আদ্রিকা। হাসপাতালে প্রবেশ মাত্র আদ্রিকার ছোট্ট হৃদয়ের প্রাণ পাখিটি ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে৷ চারদিকে ঔষধ এবং ব্লিচিং পাউডারের মিশ্রিত এক অদ্ভুত গন্ধ৷ দম আটকে আসার যোগাড়৷ করিডোরের ময়লা মেঝের উপর শুয়ে আছে ক্লান্ত মানুষজন। তাদের ম্লান মুখে স্পষ্ট বেদনার ছাপ। প্রিয়জনের সুস্থতা নিয়ে তারা শংকিত৷ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে আশার প্রদীপ এবং সঞ্চিত পুঁজি। তবুও শেষ হয় না অপেক্ষার প্রহর৷ আর কতো রাত নির্ঘুম কাটবে তারা জানে না।
আদ্রিকা ভয়ার্ত, আতংকিত দৃষ্টি মেলে তাদের দেখতে দেখতে পরখের পিছু ছুটছে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে নীহারকে কল দিল পরখ। কল রিসিভ করল আদ্রতা৷ পরিচয় জানানো মাত্র দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে পরখ জানতে চাইল,
‘আঙ্কেল কোন ওয়াডে?’
‘মেডিসিন। তিনতলার বামদিকে, একদম শেষ প্রান্তে চলে আসুন।’
‘ঠিক আছে।’
এতো সকালে ডাক্তারবাবু হাসপাতালে এসে পৌঁছাননি। কর্তৃপক্ষের অনেকে এখনো ঘুমে। হাসপাতালে ডিউটিরত রয়েছে কিছু ইন্টার্ন এবং নিরাপত্তাকর্মী। যারা চেয়ারে বসে টুপছে৷ তাই অহেতুক লিফট চালু রেখে বিদ্যুৎ অপচয় করার পক্ষপাতী নয় কেউ। জরুরি রোগী থেকে শুরু করে জনসাধারণের জন্য সিঁড়ি উন্মুক্ত রেখে লিফট বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে আদ্রিকার আতংকিত শুকনো মুখের দিকে চেয়ে পরখের বোধহয় খানিক মায়া জন্মাল। পকেটে মোবাইলটি রেখে বলল,
‘তোমার বাবা গুরুতর অসুস্থ নন। দুদিন ধরে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। গতরাতে অবস্থা খানিকটা অবনতি হওয়ায় উনাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়৷ এখন কিছুটা সুস্থ আছেন৷ স্যালাইন চলছে৷ এতো চিন্তার কিছু হয়নি।’
পরখের কথায় অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি সামান্যতম সহমর্মিতা খুঁজে পেল না আদ্রিকা৷ বরং মনে হলো, অসুস্থ ব্যক্তির উপর সে যারপরনাই বিরক্ত৷ এতোই যদি বিরক্তবোধ হচ্ছে তবে হাসপাতালে আসতে গেল কেনো? সবই লোক দেখানো আদিখ্যেতা। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আদ্রিকার৷
তৃতীয় তলার শেষ প্রান্তে মেডিসেন বিভাগের পুরুষ ওয়াড৷ বায়ান্ন শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে রোগীর সংখ্যা প্রায় শতাধিক। বারান্দার মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে কিছু রোগী। পাশে বসে ঝিমুচ্ছে রোগীর স্বজন। দুপাশে শয্যাশায়ী ব্যক্তিদের মাঝখানে খুব সাবধানে হেঁটে ভেতরে যেতে হলো আদ্রিকা এবং পরখকে।
হলরুমের সম্মুখে নার্সের কেবিন। পাশেই পরপর তিনটে ভিআইপি কেবিন রোগীর জন্য বরাদ্দ। আদ্রিকা লক্ষ্য করে দেখল, দুপাশে মোট ছয়টি কেবিন স্বদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা যখন তিনশত দুই নাম্বার কেবিনে প্রবেশ করল, তখন দূর হতে কিছু হিংসাত্মক বিষাক্ত দৃষ্টি চেয়ে রইল তাদের দিকে। কতো দূরাবস্থা সম্পন্ন রোগী দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও কেবিনে জায়গা পাচ্ছে না৷ অথচ এই রোগী মাঝরাতে এসে একটি কেবিন দখল করে নিল।
সাদা দেয়াল ঘেরা কেবিনটির দুপাশে দুটি বেড৷ একটিতে শুয়ে আছে মোকাররম। অন্যটিতে জবুথবু হয়ে বসে আছে নীহার। নীহারের পাশে বসে আছে আদ্রতা৷ বেড সংলগ্ন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অনিমেষ চেয়ে আছে জন্মদাতার শুষ্ক মুখটির দিকে৷ কয়েকদিনের ব্যবধানে মোকাররমের চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে৷ আদ্রতার পাশে বসে আছে বিকল্প৷ সেই প্রথম আদ্রিকা এবং পরখকে দেখতে পেল। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে সম্ভাষণ জানাল।
‘আসুন, আসুন। আপনাদের অপেক্ষাই করছিলাম।’
মেয়েকে দেখে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল নীহার৷ আদ্রিকাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আদ্রতা উঠে এসে বিরক্তিমাখা সুরে ধমক দিল,
‘আহ! আবার শুরু করলে, মা! শব্দ করো না। আব্বু ঘুমাচ্ছে।’
মা-মেয়ের মিহি কান্নার সুরের মাঝে পরখ এগিয়ে গেল বিকল্পের দিকে৷ হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল।
‘ইফতেখার পরখ।’
‘বিকল্প মাহমুদ। আদ্রতার কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। দেখা হয়ে ভালো লাগল। যদিও পরিবেশ,পরিস্থিতি কোনোটাই অনুকূলে নেই।’
পরখ ম্লান হেসে ঘুমন্ত মোকাররমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘এখন কেমন আছেন উনি?’
‘স্যালাইন চলছে। ভয়ের কিছু নেই৷ টানা দুদিন বারবার টয়লেট গিয়েছেন অথচ স্যালাইন খাননি। এজন্যই এই অবস্থা। মাঝরাতে দেহে পানির স্বল্পতা দেখা দিয়েছিল। আন্টি একলা মানুষ, ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন। উপায় না পেয়ে আদ্রতাকে কল দিয়েছিলেন। আমরা তখন গভীর ঘুমে। খবর পেয়ে তখনি রওনা দিলাম। এসে দেখি এই অবস্থা। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসায় শেষ রক্ষা হয়েছে৷ না হলে খারাপ কিছু ঘটে যেতো পারত।’
‘ভাগ্যিস আপনারা আশেপাশে ছিলেন। না হলে আন্টি একা মহিলা মানুষ, সেই রাতের বেলা কীভাবে পরিস্থিতি সামলাতেন কে জানে!’
‘আন্টি এখনো অনেক ট্রমায় আছেন। আমি নিজেও ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আদ্রতার বড় চাচা বেশ সাহায্য করলেন। সেই রাতে কোথা থেকে গাড়ি যোগাড় করে দিলেন। নিজেও আমাদের সাথে এসেছিলেন। একটু আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। বয়স্ক মানুষ, আর কতোক্ষণ হাসপাতালে কষ্ট করবেন!’
বাড়ির মেয়ে সদস্যদের কেবিনের ভেতর রেখে পরখ ও বিকল্প বাইরে বেরিয়ে গেল। রাতভর কেঁদেকেটে ক্লান্ত নীহার আদ্রিকার গায়ে হেলান দিয়ে নিস্তেজ চোখে চেয়ে আছে স্বামীর দিকে। যে এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ম্লান স্বরে নীহার বলল,
‘এতো জেদি মানুষটা! দুদিন ধরে বলতেছি, বারবার টয়লেট যাইতেছো। কয়েকটা স্যালাইন এনে খাও। কিছুতেই শুনল না আমার কথা৷ যখন শরীর ছেড়ে দিল তখন স্যালাইন দিয়েও কূল পাওয়া যাচ্ছে না। অহেতুক জেদের কারনে নিজের জীবনটা ধ্বংস করছে, সাথে আমার জীবনটাও শেষ করে দিল। বুড়ো বয়সে এসেও তার জেদ কমে না। এই লোকটাকে নিয়ে আমি কী করব!’
বাবার আচরণে অত্যন্ত বিরক্ত আদ্রতা৷ মানুষের অকারণ জেদ মানিয়ে নেওয়া যায়। নির্বুদ্ধিতা, বোকামিও সামলে উঠা যায়৷ কিন্তু যখন নিবোর্ধ ও বোকা মিশ্রিত মানুষ জেদ করে তখন এদের সামলানো যায় না। মোকাররম একই সাথে নির্বোধ, বোকা এবং জেদি, একরোখা। এই অদ্ভুত মিশেল স্বভাবের মানুষটির সাথে আদ্রতার মা নীহার কীভাবে এতোগুলো বছর সংসার করল, আজও ভেবে পায় না আদ্রতা। অথচ তার বাইশ বছরের ছোট্ট জীবনেই বাবার আচরণে সে অতিষ্ঠ। অযথা বাবাকে শুধরানোর প্রচেষ্টা না করে সে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের জীবনের তরী সামলাতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এড়াতে পারেনি দায়িত্ববোধ। ভুলতে পারেনি বাবা-মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, মায়া।
ঘুমের মাঝে নীহারের ক্রন্দনরত কণ্ঠটি আদ্রতার বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছিল। আতংকে নীল হয়ে গিয়েছিল মেয়েটি। ভাগ্যিস বিকল্প শান্ত মস্তিষ্কে সবটা সামলে নিয়েছে৷ অজানা আশংকা এবং ভয়ে আদ্রতা হতবুদ্ধি হয়ে পরেছিল। মায়ের হাত চেপে ধরে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল অর্ধচেতন বাবার শুষ্ক মুখটির দিকে।
মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদ্রিকা বলল,
‘আব্বুকে হাসপাতালে এনেছো কখন?’
কখন, কীভাবে হাসপাতালে এসেছে নীহার খেয়াল করেনি৷ সে একটা ঘোরের মধ্যে আদ্রতার পিছু ছুটে এসেছে। তাই জবাবটি দিল আদ্রতা।
‘রাত দুটার দিকে।’
‘অথচ আমাকে খবর দেওয়া হলো ভোর পাঁচটায়। এতোটা সময় তোমরা কেউ আমার কথা স্মরণ করোনি। আমিই পর হয়ে গেছি, তাই না?’
‘রাগ করছিস কেনো? তখন আমাদের মাথায় এতোকিছু ছিল না। হাসপাতালে নিয়ে আসা, ভর্তি করানো, ঔষধপত্র কেনা কতো কাজ! ওয়াডে নিয়ে এসে আবার দেখি বেড নেই। মেঝেতে বিছানা করে রাখতে বলছিল। ভাগ্যিস বড় চাচা সাথে ছিলেন। কার কার সাথে যোগাযোগ করে কেবিনের ব্যবস্থা করে দিলেন। এসবের মাঝে অন্যদিকে কীভাবে নজর দেই বল?’
‘হ্যাঁ, আমি এখন তোমাদের কাছে অন্যদিক হয়ে গেছি। বিয়ে দিয়েছ মানে সম্পর্ক শেষ। এ বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করো না। দুদিন ধরে আব্বু অসুস্থ, অথচ মা আমাকে একবারও জানায়নি। কল দিলে বলে সব ঠিক আছে। এই তার ঠিক থাকার নমুনা!’
অভিমানী মেয়েটির হাত জোড়া নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নীহার বলল,
‘তোর বাবা আমাকে কিছু জানায়নি। আমি নিজে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করলাম, পেট খারাপ করেছে নাকি। তখন আমাকে জানাল। তার যে এতো খারাপ লাগছে সেটাও আমাকে জানায়নি। এতো চাপা স্বভাবের লোকটা!’
‘তাই বলে, হাসপাতালে আনার সময়ও আমাকে খবর দিবে না?’
‘তখন মাথা কাজ করতেছিল না রে মা। স্যালাইন দেওয়ার পর মানুষটা যখন চোখ খুলে তাকাল, একটু কথা বলল তখন না আমার চেতনা ফিরল। তারপর আদ্রতাকে বললাম, তোকে খবর দিতে৷’
‘পরখকে কল দিয়েছ। আমাকে নয়।’
‘তুই ছোট মানুষ। সকালবেলা এমন খবর শুনে ঘাবড়ে যাবি। তাই ওকে বলেছিলাম আমার মোবাইল থেকে পরখকে কল দিয়ে জানাতে৷ পরখকে জানানো আর তোকে জানানো তো একই কথা।’
‘সারাজীবন তোমরা আমাকে ছোট বাচ্চা বলে গেলা। আমি যে বড় হয়েছি, বিয়েশাদি করে সংসার করছি সেটা কারও চোখে পরছে না। তাই না? এবার অন্তত আমাকে বাচ্চা ভাবা বন্ধ করো।’
দীর্ঘ ক্লান্তি শেষে ছোট আদুরে মেয়েটার সুবাদে নীহারের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। আদ্রতাও খিলখিল করে হেসে আদ্রিকার নাক টেনে দিয়ে বলল,
‘তুই যতোই বড় হয়ে যা, আমার কাছে তো আমার বাচ্চাটিই রয়ে যাবি। বুড়ো বয়সে চুল পেকে গেলেও তোকে আমি বাচ্চা বলেই ডাকব।’
কেবিনের একপাশে ছোট একখানি বারান্দা। থাইগ্লাস অর্ধেকটা খোলা রাখা হয়েছে৷ খোলা প্রান্ত দিয়ে হুড়মুড় করে প্রবেশ করছে সকালের মিঠা রোদ। সূর্যের উজ্জ্বল হাসির পানে উদাস নয়নে চেয়ে আদ্রিকা বলল,
‘তোমাদের অতি আদর আমার স্বভাব নষ্ট করে দিয়েছে। কেউ একটু কটু কথা বললেই মন খারাপ হয়ে যায়। ভ্যা ভ্যা করে কান্না করি। তোমাদের উচিত ছিল, আমাকে সারাক্ষণ বকাঝকার উপরে রাখা৷ তাহলে এখন আমার এতো মন খারাপ হতো না।’
চলবে…
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৪২|
মোকাররম মজুমদারের ভাগ্য বোধহয় সুপ্রসন্ন ছিল, তাইতো পরেরদিন সকালেই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে গেল৷ তবে কিছুদিন ঔষধপত্র এবং পূর্ণ বিশ্রামের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷
গতদিন হাসপাতাল থেকে ভার্সিটি গিয়েছিল পরখ। দুপুরে রেস্তোরাঁয় না গিয়ে আবার চলে এসেছিল হাসপাতালে। বাকি সবার সাথে সেও একটি রাত হাসপাতালের কেবিনে আধোঘুমে কাটিয়ে দিয়েছে ৷
আজ সকালবেলা জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় আদ্রিকা পরল বিপাকে৷ সে এখন বাবার বাড়ি যাবে নাকি স্বামীর বাড়ি৷ বাবার অসুস্থতাকালীন এই বিরূপ পরিস্থিতিতে পূর্বের মান-অভিমান বিশেষতই কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেছে৷ কিন্তু পরখের সাথে তার সম্পর্কটি আর পাঁচটা সাধারণ সম্পর্কের মত নয়৷ তাই তো সে আদ্রতার মত বিকল্পের সাথে সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে চলতে পারছে না৷ পরখকে রেখে সে একাই কীভাবে বাবার বাড়ি চলে যাবে, ভেবে পাচ্ছে না। পরখ কি যেতে চাইবে ওর সাথে?
সড়ক হতে একটি ফাঁকা অটো নিয়ে এসেছে বিকল্প। সেখানে ইতোমধ্যে মোকাররমকে বসানো হয়েছে৷ পাশে বসেছে নীহার৷ উল্টোদিকের আসনে বসে আদ্রতা তাকাল আদ্রিকার দিকে৷ তাড়া দিয়ে বলল,
‘দাঁড়িয়ে রইলি কেনো? তাড়াতাড়ি উঠে পর।’
আদ্রিকার অপেক্ষায় অটোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিকল্প। সবাইকে ঠিকমতো বসিয়ে দিয়ে সে ড্রাইভারের পাশে বসবে৷ আদ্রতার কথা শুনে আদ্রিকা দ্বিধা নিয়ে তাকাল পরখের দিকে৷ অন্য সকল কাজের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হলেও প্রসঙ্গ যখন পরখের, তখনি ভাঙা কাচের ন্যায় ঝুরঝুর করে ভেঙে পরে আদ্রিকা। আদ্রিকার এমন নড়বড়ে স্বভাবের জন্য পরখ কি দায়ী নয়? অবশ্যই সে দায়ী। পুরো দায় পরখের উপরেই বর্তায়। স্বামী হিসেবে যে ভরসাটুকু তার দেওয়ার কথা ছিল, তা দেয়নি বলেই আদ্রিকার পায়ের নিচের মাটি আজও নড়বড়ে।
সকলের আগ্রহভরা দৃষ্টির সামনে পরে বিব্রত দেখাল পরখকে। আদ্রিকার ভরসা নেই৷ অন্তত পরখের প্রসঙ্গে আদ্রিকা বরাবর অপরিণত আচরণ করে বসে। তাই পরিস্থিতি দ্রুত সামলে নিয়ে পরখ বলল,
‘আমি বাইক নিয়ে এসেছি৷ আপনারা চলুন, আমরা বাইকে আসছি।’
সায় জানিয়ে বিকল্প অটোতে উঠে বসল। হাসপাতাল চত্বর থেকে অটোটি বেরিয়ে যাওয়ার পর বাইক আনতে পার্কিং এর দিকে গেল পরখ। একা দাঁড়িয়ে না থেকে আদ্রিকাও পিছু নিল। হাঁটার ফাঁকে পরখ বলল,
‘ওমন বোকার মত দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?’
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আদ্রিকাও প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
‘আপনি আমাদের বাড়িতে যাবেন?’
‘যাওয়া নিষেধ আছে?’
‘সেটা বলিনি। কিন্তু আপনি আগে কখনো আমাদের বাড়িতে সেভাবে যাননি। তাই বললাম।’
‘তুমি শিওর, আমি তোমাদের বাড়িতে এর আগে যাইনি?’
‘আমাকে আনতে একবার গিয়েছিলেন।’
গ্যারেজ থেকে বাইকটি বের করে রাস্তায় নামিয়ে তাতে উঠে বসে পরখ বলল,
‘একবার নয়, তোমাদের বাড়িতে আমি প্রায়ই যাই।’
পরখ কেনো বাবার বাড়িতে যায়,বুঝতে পারল না আদ্রিকা। বিয়ের আগে থেকে কি বাবার সাথে পরখের পরিচয় ছিল? থাকার কথা নয়। বাবার পরিচিতের গণ্ডি খুবই ছোট। সেখানে পরখ নামে কেউ কখন ছিল না। তাহলে এতো সখ্যতা, ঘনিষ্ঠতা কবে থেকে গড়ে উঠল? বিয়ের পর? বিয়ে করা বউয়ের সাথে ভালোমন্দের একটা সম্পর্ক নেই, অথচ শ্বশুরবাড়ির সাথে গলায় গলায় ভাব। এটা কেমন বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?
আদ্রিকাকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পরখ কর্কশ কণ্ঠে জানাল,
‘বাইকে উঠবা নাকি চলে যাব?’
আদ্রিকা বাঁকা চোখে একনজর তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে বাইকে উঠে বসল। আদ্রিকার সাথে সব সময় ত্যাড়া কথা না বললে এই লোকের বোধহয় ভালো লাগে না। বাকি সবার সামনে ভদ্রটি সেজে থাকে অথচ আদ্রিকার সামনে ভদ্রতার ধার মাত্র ধারে না।
মোকাররমকে ঠিকঠাকভাবে কক্ষে পৌঁছে দিয়ে সবাই একটু স্বস্তির শ্বাস নিল। ভাই ফিরেছে খবর শুনে পাশের বাড়ি থেকে ছুটে এসেছে মোজাম্মেল। নিজের মধ্যে যতোই দ্বন্দ থাকুক, এক ভাইয়ের বিপদে অন্য ভাইয়ের মন কাঁদবেই। তার উপর মোকাররম মোজাম্মেলের ছোট ভাই। ছোটদের প্রতি বড়দের আলাদা মায়া, মমতা থাকে। সেই টানেই উদ্বিগ্ন মোজাম্মেল ছুটে এসেছে৷ আজ অবশ্য মোজাম্মেল এর সাথে মনোয়ারা, মৃদুল, মাহিন সকলকে দেখা যাচ্ছে।
সবাইকে মোকাররমের ঘরে বসতে দিয়ে মেয়েদের নিয়ে নীহার বাইরে বেরিয়ে এলো। বাড়িতে যতোই রোগী থাকুক, আত্মীয়স্বজনের খাওয়ার ব্যবস্থা করা চাই। এই সকালবেলা সবার জন্য অন্তত চায়ের আয়োজনটুকু করতে হবে। এমনিতেই মোকাররম এখন বিপদমুক্ত। শরীর অত্যাধিক দূর্বল হয়ে পরায় সপ্তাহখানেক বেডরেস্টে থাকবে হবে এই যা৷
রান্না ঘরে দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে দ্রুত নাস্তার ব্যবস্থা করছে নীহার। দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পরখ বলল,
‘আন্টি, আমাকে এবার বের হতে হবে।’
নীহার ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে জানতে চাইল,
‘এতো সকালে কোথায় যাবে?’
‘ভার্সিটিতে ক্লাস আছে৷ এখন না বেরোলে দেরী হয়ে যাবে।’
‘দুই মিনিট বসো। নাস্তা করে যাও।’
‘অফিসে গিয়ে খেয়ে নিব আন্টি। অনেক দেরী হয়ে গেছে আমার।’
‘কোনো দেরী হবে না। তুমি আদ্রিকার ঘরে গিয়ে বসো। আমি এক্ষুণি তোমার নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর দুপুরে এখানে এসে খাবে কিন্তু।’
‘রেস্তোরাঁয় যেতে হবে আন্টি। গতকালও যেতে পারিনি।’
‘তবে কাজ শেষ করে রাতে এসো। এখানে খাওয়াদাওয়া করে দুজনে একসাথে ফিরে যাবে।’
পরখকে আদ্রিকার কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া মাত্র দুটো রুটি, একটি ডিম ভেজে আদ্রিকার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নীহার বলল,
‘যা, ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি খাবার দিয়ে আয়।’
নিজের বাড়িতে এতোদিন পর এসে আরেকজনকে নিয়ে এমন আদিখ্যেতা দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে আদ্রিকার। তার উপর তাকে দিয়েই করাচ্ছে সেবাযত্ন। নাখোশ চেহারায় প্লেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল আদ্রিকা, পেছন থেকে নীহার ধমকে উঠল,
‘পানির গ্লাসটা কে নিয়ে যাবে? মাথায় কোনো বুদ্ধি নাই এটার৷ কীভাবে সংসার করে কে জানে!’
এতোদিনে আদ্রিকা বুঝে গেছে, সংসার করতে করতে বুড়ি হয়ে গেলেও মেয়েকে মায়ের ধমক খেতেই হবে। মায়ের কাছে বাচ্চারা সবসময় আনাড়ি থাকে। তাই নীহারের কথায় বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে নিজের কক্ষের দিকে গেল।
বেশ আরাম করে নাস্তা খাচ্ছে পরখ। যেন এটা তার নিজের বাড়ি, নিজের কক্ষ, নিজের পড়ার টেবিল। পাশের বিছানায় বিরস মুখে আছে আদ্রিকা। নিজের বাড়িতে পরখের এমন সাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা দেখতে ভালো লাগছে না। মনে খানিকটা হিংসার অনুভূতি হচ্ছে। রান্নাঘর থেকে নীহারের ডাক ভেসে এলো,
‘আদ্রিকা, চা নিয়ে যা।’
চায়ের কাপ হাতে নেওয়ার ব্যস্ততায় নিজের অহেতুক আগ্রহী মুখখানা লুকিয়ে আদ্রিকা জানতে চাইল,
‘পরখ কি মাঝেমাঝে এই বাড়িতে আসে নাকি?’
গরম তাওয়ায় রুটি ছড়িয়ে দিয়ে নীহার বলল,
‘আসে তো মাঝেমধ্যে।’
নীহার খেয়াল না করলেও চাকতিতে রুটি বেলতে থাকা আদ্রতা কাজ থামিয়ে আদ্রিকার দিয়ে চেয়ে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল,
‘কেন? তুই জানতিস না? তোকে বলেনি কখনো?’
মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে আদ্রিকা কোনোরকমে বলল,
‘সবসময় কি বলে আসে নাকি! কখনো হুটহাট এসে ঘুরে গেলে আমাকে জানায় না৷’
‘সময় পেলে এমনিতেই এসে খোঁজ খবর নিয়ে যায়৷ দুই চার মিনিটের বেশি একদমই বসে না৷ কেমন আছি, কি করতেছি – দুটো কথা বলেই চলে যায়। বুড়ো বুড়ি একলা থাকি। ছেলেটা মাঝেমধ্যে এসে কথা বলে যায়, ভালোই লাগে।’
নীহার আপনমনে পরখের আসা যাওয়ার বিভিন্ন বর্ণনা দিতে থাকে। চায়ের কাপ হাতে চুপচাপ বেরিয়ে যায় আদ্রিকা।
সন্ধ্যা পেরিয়ে পরখ যখন আবার ‘চুপকথা’য় এলো তখন মোকাররমের ঘরে পরিবারের বাকি সদস্যরা চায়ের আড্ডায় বসেছে। পরখকে দেখে নীহার আবারও আদ্রিকার উপর আদেশ জারি করল,
‘রান্নাঘর থেকে পরখকে চা এনে দে।’
নিজের শান্তি ভঙ্গে বিরক্ত আদ্রিকা কটমট করে পরখের দিকে একনজর তাকিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে চা এনে দিল।
রাতের খাবার এ বাড়িতে খাওয়ার কথা থাকলেও সে আয়োজন বাতিল করা হয়েছে।
বিকালবেলা মোজাম্মেল এসে এ বাড়ির সবাইকে দাওয়াত দিয়ে গেছে। অসময় হোক, তবুও বাড়িতে দুই মেয়ে তাদের জামাইসহ একসাথে উপস্থিত। বংশের দুটো মেয়ের সদ্য বিয়ে হলো অথচ বড় চাচা হয়েও এতোদিনে দাওয়াত করে খাওয়াতে পারেনি মোজাম্মেল। তাই নিয়ে উনার কষ্টের অন্ত নেই। তাই আজ সুযোগ বুঝে সবাইকে রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়ে গেলেন৷ মোকাররম অসুস্থ, তাই সে যাবে না৷ অসুস্থ মানুষকে বাড়িতে একা রেখে নীহারের পক্ষেও যাওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা নব বিবাহিত দুই দম্পতিকে দাওয়াত রক্ষার্থে যেতে হলো।
যদিও আদ্রতার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল মাহিনের সম্মুখীন হতে। ও বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার সময় আদ্রতার অস্বস্তি খেয়াল করে বিকল্প অবশ্য বলেছিল,
‘তোমার যেতে ইচ্ছে না করলে জোর করে যাওয়ার দরকার নেই। আমরা তিনজন চলে যাই৷’
‘আমার কথা জানতে চাইলে কি বলবে?’
‘তোমার শরীর খারাপ বা মাথা ব্যথা৷ কিছু একটা বাহানা দিয়ে দিব।’
‘আমার জন্য মিথ্যে বলার দরকার নেই। আমি ঠিক আছি। তাছাড়া তুমি আছো তো, আমার সাথে৷ ভয় কীসের!’
মোজাম্মেল মজুমদারের বাড়ির দোতলার ডাইনিংরুমে বিশাল একটি টেবিল। একপাশে বসেছে মোজাম্মেল মজুমদারের পরিবার, অন্যপাশে অতিথিবৃন্দ। বাড়ির মহিলারা খাবার বাটি নিয়ে এসে টেবিল ভরিয়ে ফেলছে। সাহায্য করার জন্য আদ্রিকা ও আদ্রতাও রান্নাঘরের দিকে গেল। রান্নাঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অতি সুদর্শনা একজন নারী৷ লক্ষ্মী প্রতিমার মতোন তার আদল। গায়ে জড়িয়েছে সর্ষেফুল রঙ্গা সুতি শাড়ি৷ প্রস্ফুটিত ফুলটির দিকে অবাক নয়নে চেয়ে রইল ওরা দু বোন৷ ওদের বিস্মিত দৃষ্টি দেখে মৃদু হাসল মৃদুলের স্ত্রী, শান্তি৷ নববধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
‘আমাদের মাহিনের বউ, প্রভাতী৷ ছেলের কপাল দেখো, চাঁদের মতো সুন্দর বউ পাইছে।’
আদ্রিকা ও আদ্রতা কিছু বলার আগেই খিলখিল করে হেসে উঠে প্রভাতী বলল,
‘সাথে এটাও বলো, চাঁদের মতো কলঙ্ক আছে আমার গায়ে। বাচ্চাকালে প্রেম করেছি। প্রেমিকের সাথে কতোবার পালিয়েছি সেটার হিসাবও দেও।’
এমন কথা শুনে আদ্রিকা ও আদ্রতা থমথমে খেলেও প্রভাতীর আচরণে অভ্যস্ত শান্তি বলল,
‘তোমার মুখে কিচ্ছু আটকায় না, প্রভাতী। নিজের সম্পর্কে কেউ এভাবে বলে!’
‘লোকে যা বলে আমিও তাই বললাম, ভাবী। একবিন্দুও বাড়িয়ে কমিয়ে বলিনি।’
শান্তি বিরোধ করার আগেই মৃদুলের গলার আওয়াজ শোনা গেল।
‘খাবার আনতে গিয়ে হারিয়ে গেলে নাকি?’
প্রভাতী মুখ বাঁকালেও বাকি তিনজন দ্রুত খাবারের বাটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
খাবারের আয়োজনে আছে পোলাও, বেগুন ভাজি, মাছ ভাজি, মুরগীর ভুনা, গরুর গোশত, ডিমের কোপ্তা। টেবিলে সবাই একসাথে বসায় প্রত্যেকে খাবার পরিবেশনের কাজে সাহায্য করছে৷ মনোয়ারা বেগম খাবারের দিকে তাকিয়ে বিরস মুখে জানতে চাইলেন,
‘সাদা ভাত রাঁধতে বলছিলাম, সেটা কই? আমি যে পোলাও খাই না, সেটা তুমি জানো না, বড় বউ?’
শান্তি নিশ্চুপে তাকাল প্রভাতীর দিকে। কিন্তু প্রভাতীর মাঝে কোনো হেলদোল নেই৷ সে নিজের প্লেটে খাবার উঠাতে ব্যস্ত৷ বাধ্য হয়ে শান্তি বলল,
‘রাইসকুকারে ভাত বসানো আছে। আমি এনে দিচ্ছি।’
শান্তি চলে যাবার পর কী যেনো ভেবে প্রভাতীও চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্নাঘরে চলে গেল। অপরিচিত পরিবেশে অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে আদ্রিকা, আদ্রতা, বিকল্প ও পরখ৷ অন্যদিনে মোজাম্মেল মজুমদারের পরিবারের মুখ থমথমে। নিস্তব্ধতা ভেঙে শব্দ করে উঠল মৃদুলের মোবাইল৷ ঝটপট কল রিসিভ করে হু, হা দুটো শব্দ উচ্চারণ করে কল কেটে দিয়ে মাহিনের উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোর মোবাইল কই?’
মাহিন চোরাচোখে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে জবাব দিল,
‘প্রভাতীর কাছে।’
‘তোর মোবাইল ওর কাছে কেন?’
‘গেম খেলে। ক্রাশ ক্যান্ডি না কী যেন নাম।’
‘ওর মোবাইল কি হইছে? ওটাতে খেলতে পারে না? তোর বন্ধুবান্ধব আমাকে কল দিয়ে তোর খোঁজ করে। মোবাইল নিজের কাছে রাখবি।’
‘ওর মোবাইলেও খেলে। ওটার চার্জ শেষ হয়ে গেলে আমারটা নিয়ে রাখে।’
‘পাসওয়ার্ড দিছিস কেন?’
‘পাসওয়ার্ড দেওয়া লাগে! আমার মোবাইলে ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এড করা৷ দুদিন পর পর আমার মোবাইলের পাসওয়ার্ড ও বদলে দেয়। আমি নিজেই আমার মোবাইলের লক খুলতে পারি না৷’
মৃদুল তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে নিশ্চুপ রইল। কিন্তু মোজাম্মেল মজুমদার পারলেন না৷ দাঁত কটমট করে ছেলেকে বললেন,
‘লজ্জা করে না তোর? বউয়ের হাতের পুতুল হয়ে গেছিস তুই। বউয়ের ভয়ে এককোনায় লুকিয়ে থাকিস। তুই যে আমার ছেলে ভাবতেই আমার লজ্জা লাগে।’
এবার মাহিনও বারুদের মতো জ্বলে উঠল। গলার স্বর নিচু করে ধমক দিক বাবাকে।
‘তোমার সাহস আছে তো তুমি বলো ওরে৷ শাসন করে দেখাও দেখি।’
‘তোর বউ আমি শাসন করব? কেমন পুরুষ তুই!’
‘পুরুষত্বের খোঁচা দিবা না, আব্বা। জানের মায়া সবার আছে। ওর বাপ কেমন তুমি জানো না? আমি বউকে ধমকাই, শাসন করি আর সে বাপের কাছে নালিশ দিক৷ তারপর ওর বাপ এসে আমাকে ধোলাই দিক, এটাই চাও তুমি? দেখছো আম্মা, আব্বার কান্ডকারখানা দেখছ তুমি?’
মনোয়ারা বেগমের মুখখানা আরও শুষ্ক দেখাল৷ আদ্রতা ও আদ্রিকার উপস্থিতির কথা বোধহয় একমাত্র উনিই মনে রেখেছেন। লজ্জাজনক পরিস্থিতি এড়াতে ছেলেকে ধমকে উঠলেন,
‘চুপ থাক। খাইতে বসে এতো কথা কীসের?’
‘কথা কি এমনি বলি? যখন তখন আব্বা আমাকে কথা শোনায়। অথচ নিজেও প্রভাতীর সামনে কেমন চুপসে যায়, সেটা কি আমি দেখি না৷ গত মাসে তো খুব সাহস দেখিয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি গেল। প্রভাতীর নামে নালিশ করেই আসবে। অথচ ওখানে গিয়ে যেই দেখল, ভরা সালিশে একটা ছেলেকে আমার শ্বশুর বেধড়ক পিটাচ্ছে ওমনি মুখ লুকিয়ে চুপচাপ ফিরে এলো। কই, আমি তো সেসব নিয়ে আব্বাকে খোঁচা দেই না।’
মাহিনের কথা শুনে খুকখুক করে কেশে উঠল পরখ। স্বল্প পরিচিত অতিথির সামনে পারিবারিক আলোচনায় সে প্রচন্ড বিব্রত। অথচ এ বাড়ির লোকেরা কেমন স্বাভাবিকভাবে আলোচনা করে যাচ্ছে।
রান্নাঘর থেকে একটি ভাতের প্লেট নিয়ে এসে শ্বাশুড়ির সামনে রাখল শান্তি। ওর পেছন পেছন গটগট করে হেঁটে এসে মনোয়ারা বেগমের সামনে ঠাস করে একটি তরকারির বাটি রেখে কোমর দুলিয়ে প্রভাতী নিজের চেয়ারে এসে বসে পরল। ওর বাটি রাখার শব্দে সকলের চোখ তখন মনোয়ারার দিকে। মনোয়ারা অবশ্য তরকারির বাটি দেখে আঁতকে উঠে বললেন,
‘ভাজি কেন? আমি লালশাক ঝোল করতে বলেছিলাম।’
দুটো বেগুন ভাজি প্লেটে তুলে নিয়ে প্রভাতী স্বাভাবিকভাবে জানালো,
‘ঝোলের জন্যই চুলায় বসিয়ে দিয়েছিলাম। ঝোল না হয়ে ভাজি হয়ে গেলে আমার কি করার?’
সবাই তখনো প্রভাতীর দিকে তাকিয়ে তার উচ্চারিত শব্দগুলো বুঝার চেষ্টা করছে। শান্তি বলল,
‘আমি না তোমাকে রেসিপি বলে দিলাম।’
‘হ্যাঁ, তোমার রেসিপি মতো পেয়াজ, মরিচ ভেজে নিয়ে শাক দিছি৷ লবণ দিয়ে নেড়েচেড়ে ঢাকনা একটু গেম খেললাম। কিছুক্ষণ পর ঢাকনা তুলে দেখি পানি শুকায় শাক ভাজি হয়ে গেছে। এখানে আমার কি দোষ?’
আসন্ন হট্টগোলকে সামলে নিতে শান্তি বিনীতস্বরে অনুরোধ করল,
‘জ্বাল বেশি হওয়ায় পানি শুকিয়ে গেছে। এবেলা ভাজি দিয়েই খান, আম্মা। কালকে আমি ঝোল করে দিব। দাওয়ারের এতো রান্নাবান্না করে শাক রান্নার সময় পাইনি আজকে।’
সবাই নীরবে খাওয়া শুরু করলে পোলাও মুখে দিয়ে আদ্রিকা ফিসফিস করে আদ্রতাকে বলল,
‘পোলাওয়ে লবণ কম হয়েছে।’
আদ্রতা চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ঝামেলা না করে চুপচাপ খা।’
খাওয়া শেষে পুরুষ সদস্যরা খোশগল্পে মেতেছে৷ মনোয়ারা বেগম নিজের কক্ষে শুয়ে পরেছেন। রান্নাঘরে থালাবাসন ধুচ্ছে মেয়েরা। প্রভাতী এটা ওটা প্রশ্ন করছে, আদ্রতা সেগুলোর উত্তর দিচ্ছে। হঠাৎ আদ্রিকার নাকের দিকে ইশারা করে প্রভাতী বলল,
‘তোমার নাকে এটা কি?’
আচানক এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আদ্রিকা। আদ্রতা মুচকি হেসে জবাব দিল,
‘ওটাকে নোলক বলে।’
‘বেশ সুন্দর দেখতে। কোথায় কিনেছো?’
এবার আদ্রিকা গোমড়া মুখে জবাব দিল,
‘কিনি নি। এটা দাদীর ছিল। আমাকে দিয়ে গেছেন।’
‘এতোগুলো নাতি নাতনিকে রেখে তোমাকে দিয়ে গেছেন! তোমাকে কি বেশি ভালোবাসত?’
‘জানি না। আমি তখন ছোট ছিলাম।’
‘এটা কী সুন্দর! তোমাকে কত্তো কিউট দেখাচ্ছে! আমিও নোলক বানাবো।’
পাশ থেকে শান্তি বলল,
‘তোমাকে নোলক মানাবে না। তুমি নথ বানিও। নোলক শুধুমাত্র আদ্রিকার নাকেই ভালো দেখায়। এজন্য বোধহয় আমার দাদী শ্বাশুড়ি আদ্রিকাকেই উনার নোলক দিয়ে গেছেন। উনি জানতেন, এটা পরে আদ্রিকার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। দেখো না, বিয়ের পরেও আদ্রিকার স্বামী ওকে নোলক পরিয়েই রেখেছে। ভালো লাগে তাই নোলক সরিয়ে নাকফুল পরায়নি। সুন্দরের কদর করতে জানে সে।’
শান্তির কথা শুনে লজ্জায় রাঙা হয় আদ্রিকা৷ সত্যি কি পরখ তার নোলক পরিহিতা বধূর সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারে? এজন্যই কি নাকফুল গড়িয়ে দেয়নি? নাকি পরিবর্তন বুঝার মতো করে কখনো বিশেষ পর্যবেক্ষণ করেনি?
ফিরে আসার সময় আদ্রিকা নিজের আগ্রহী মনকে আটকাতে না পেরে প্রভাতীকে প্রশ্ন করেই বসে,
‘তুমি সত্যিই পালিয়ে গিয়েছিলে?’
প্রভাতীও আদ্রিকার মতো চাপাস্বরে উত্তর দেয়,
‘হ্যাঁ। তবে ছেলের সাথে পালিয়ে যাইনি।’
‘তবে?’
‘প্রেমে বাঁধা দিচ্ছিল বলে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বান্ধবীর বাড়ি চলে যেতাম। সেখান থেকে আবার আব্বা নিয়ে আসত। সেই কথা গ্রামে নানান ভাবে ছড়িয়েছে।’
‘সেসব শুনে তোমার খারাপ লাগে না?’
‘কেনো খারাপ লাগবে? আমি কি করেছি সেটা আমি ভালো করে জানি। নিজের চোখে আমি নিরপরাধ থাকলেই চলবে। বাকি কে কি বলে বলুক। আমার কিছু যায় আসে না।’
‘মাহিন ভাই কিছু বললেও না?’
‘মাহিন? ও কেনো লোকের কথা শুনে আমাকে অবিশ্বাস করবে? আজব! শুধুমাত্র আমার কথা হবে ওর জন্য মূখ্য। বাইরের মানুষের কথা শুনে নাচলে এতোদিনে আমি ওর ব্যবস্থা করে ফেলতাম৷ আমার আব্বাকে তো চিনো না৷ সেই রাগী মানুষ। আমাদের এলাকার মেম্বার। দশগ্রামের লোকে আমার আব্বাকে ভয় পায়৷ একবার আব্বার কাছে নালিশ করলে তোমার মাহিন ভাইয়ের কলিজা কেঁপে উঠবে। মজার কথা বলি শুনো, এ বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দ করে না৷ কিন্তু সামনাসামনি কিছু বলতে পারে না। সবাই আমাকে ভয় পায়৷ আমার কথার বিপরীতে কথা বলার সাহস করে না কেউ।
আজকে কি হয়েছে জানো? দুপুরবেলা বাবা তোমাদের দাওয়াত করার কথা বলতেই আমার শ্বাশুড়ি সেই ক্ষেপে গেছিলো। কোনোভাবেই বাড়তি খরচ করতে দিবে না। কিন্তু আমি যেইনা বের হয়ে বললাম, বাড়ির নতুন জামাইকে একবেলা দাওয়াত করে খাওয়ানো উচিত৷ আপনি দাওয়াত করেন৷ ওমনি শ্বাশুড়িআম্মা একদম চুপ হয়ে গেল। আসলেই উনাকে ভয় দেখাইতে আমারও বেশ মজা লাগে।’
চলবে..
#অক্ষরময়ী
#পরিণয়ে_নোলককন্যা (কপি নিষেধ)
|৪৩|
“শুদ্ধতা,
তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই।
রাগ আমার নিজের প্রতি, নিজ অপারগতার প্রতি।
আজকাল দিনগুলো কী ভীষণ যন্ত্রণায় অতিবাহিত হচ্ছে!
সারাক্ষণ চাপা একটা অস্থিরতা ঘিরে রাখে আমাকে।
থেকে থেকে মনে হয়, একটু চেষ্টা করলেই বুঝি তোমাকে আটকে রাখতে পারতাম,
পারতাম তোমার হাসির কারন করে হতে।
কিন্তু সেই বিশেষ চেষ্টাটি আমি করিনি।
এই আফসোস, এই আত্মগ্লানি আমাকে অনেক রাত ঘুমাতে দেয় না।
জানো, আজকাল রাতগুলো বড্ড দীর্ঘ হয়।
সকালগুলো কয়েক শত ক্রোশ দূর।
ঠিক তোমার মতো।
তবে তুমি কিন্তু খুব বেশি ভেবো না৷
আমি মেনে নিয়েছি,
তোমার আমার মাঝে দীর্ঘ রজনীর নিকষ তমসার এ দূরত্ব।”
খোলা জানালা দিরে দূর আকাশে তাকিয়ে ভীষণ আবেগ নিয়ে লাইনগুলো বিড়বিড় করল আদ্রিকা৷
তবে তা অনতিদূরে বিছানায় অর্ধশায়িত পরখের কানে ঠিকই পৌঁছালো। কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে স্লাইডের কিছু কাজ করছিল সে৷ আদ্রিকার কথাগুলো শুনে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকাল। শান্ত, গভীর স্বরে বলল,
‘কারো ব্যক্তিগত ডায়েরি লুকিয়ে পড়া একটি জঘন্যতম অপরাধ৷ নিজের এই অসভ্য আচরণের জন্য তোমার লজ্জা হওয়া উচিত৷ অথচ তোমার মধ্যে লজ্জা, অপরাধবোধের ছিটেফোঁটাও নেই। উলটো রসিয়ে রসিয়ে নিজের অপরাধের ফিকির শুনিয়ে যাচ্ছো৷ ইউ আর সাচ অ্যা টেরিবল পারসোন৷’
বরাবরের মতো পরখের অপমান গায়ে না মেখে জানালা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মিষ্টি করে হাসল আদ্রিকা। পড়ার টেবিলের চেয়ারে পা তুলে আরেকটুখানি আরাম করে বসল।
মোজাম্মেল মজুমদারের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত গড়িয়ে গেছে৷ এতো রাতে আর ফিরে যেতে দিল না নীহার। পাশের বন্ধ কামরার তালা খুলে দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে ঠাঁই হয়েছে আদ্রিকা ও পরখের। পাশের কক্ষ দুটোর মানুষগুলো বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। নিশুতিরাতে চাপাস্বরে আদ্রিকা বলল,
‘আপনার ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল লাইনগুলো। বিচ্ছেদের পর লিখেছেন নিশ্চয়ই?’
এমনিতেই উন্মাদিনীর সাথে একই কক্ষে আবদ্ধ হয়ে পরখের ভেতরকার অস্বস্তি, অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। তাকে আরেকটু কোনঠাসা করতেই বুঝি তালাবন্ধ একটি অধ্যায়ের আলোচনা সভা বসিয়েছে আদ্রিকা। নিজ গৃহে এই আলোচনা উঠলে পরখ নিশ্চিতভাবে কক্ষ ত্যাগ করে উক্ত আলোচনার ইতি টানত। কিন্তু এই মুহূর্তে তা সম্ভব হলো না। যদিও তৎক্ষনাৎ ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়াল পরখ। অন্তত কক্ষের বাইরে সে যেতেই পারে।
পরখের এহেন কান্ডে আদ্রিকার বিশেষ ভাবান্তর হলো না। টেবিলের উপর একটি হাত রেখে তার উপর গাল ঠেকিয়ে পরখের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,
‘সবাই শুয়ে পরেছে। এখন বাইরে গেলে দরজা খোলার শব্দে আপনার আন্টি দৌঁড়ে আসবে। আদরের জামাইয়ের কোনো সমস্যা হলো কিনা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তির ঘুম হবে না।’
নিজ স্বার্থে অন্যকে বিরক্ত করা পরখের পছন্দ নয়৷ এতো রাতে কারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর চেয়ে আদ্রিকার প্রলাপবাক্য শোনা উত্তম।
ফিরে এসে ল্যাপটপ গুছিয়ে রেখে পরখকে বিছানায় শায়িত হয়ে নিদ্রার প্রস্তুতি নিতে দেখে আদ্রিকা আবারও প্রশ্ন করল,
‘আপনাদের ব্রেকাপ হয়েছে কেনো?’
মুদিত চক্ষু জোড়া মেলে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করল না পরখ। বড্ড অবহেলায় জবাব দিল৷
‘ব্রেকাপ হয়েছে কে বলল?’
সবজান্তা আদ্রিকা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘ব্রেকাপ না হলে সারাক্ষণ ওমন আমসত্ত্ব মুখ নিয়ে ঘুরতেন নাকি! প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হলে তবেই লোকে নারীসঙ্গ মাত্র এমন ছ্যাঁত করে উঠে। আপনাকে প্রথম দেখায় আমি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলাম। নিশ্চয়ই কোনো সুন্দরী ললনা আপনার নরম মনটি ভেঙেছে।’
‘তুমি তো সবজান্তা সমশের।’
‘সব না জানলেও কিছুটা আন্দাজ করাই যায়। আমি এতোটাও বোকা নই। বুঝলেন?’
‘বুঝলাম।’
‘তো আপনাদের ব্রেকাপ হলো কেনো?’
‘তুমি যেহেতু সবই বুঝতে পারো, আরেকটু বুদ্ধি খাটিয়ে এটাও প্লিজ বুঝে নেও এবং আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।’
পায়ের কাছে রাখা পাতলা কাঁথাটা টেনে নিয়ে মাথা পর্যন্ত ঢেকে অপরপাশে মুখ করে শুয়ে পরল পরখ৷ তা দেখে মুখ ফুলালো আদ্রিকা। জরুরি একটা আলোচনায় পরখের এমন হেয়ালি কি মানা যায়? আদ্রিকা ভেবেছিল, অন্তত নিজ প্রণয়কাব্যে পরখ আগ্রহ দেখাবে৷ কিন্তু একি! এই মহাশয় পিঠ দেখিয়ে চলে গেল। অস্থির লাগছে আদ্রিকার। সবটা না হলেও ঘটনার কিছুটা তাকে জানাতেই পারে পরখ৷ বউয়ের কাছে ধরা পরেও মহাশয়ের ভাব কমেনি। নাকি প্রাক্তনের ব্যাপারে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে? অস্বস্তির কি আছে ভেবে পেল না আদ্রিকা৷ সে তো নিজেই জানতে চাইছে৷
‘আচ্ছা, শুনুন না। পরখ?’
পরখ জবাব দিল না৷ ঘুমের ভান করে পরে রইল। আদ্রিকা জানে, পরখ ঘুমায়নি। এতো দ্রুত কেউ ঘুমায় নাকি! তাই আবার ডাকল।
‘আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ড এখন কোথায়? বিয়ে হয়ে গেছে? শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’
‘উইল ইউ প্লিজ স্টপ?’
পরখের বিরক্তিঝরা কণ্ঠস্বর আদ্রিকার মাঝে নতুন উন্মাদনার জন্ম দিল। সে আরও উৎসাহ নিয়ে শুধাল,
‘অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে?’
পরখ কোনো জবাব দিল না। মৌনতা সম্মতি লক্ষণ, তাই মেনে নিয়ে আদ্রিকা ভাবুক হলো৷ ভীষণ উদাসীনতা ঘিরে ধরল তাকে।
‘আমার মনে হচ্ছে, আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ড এর বাবা আপনাদের প্রেমের সম্পর্কে বাগড়া দিয়েছে। মুভিগুলো এমনি তো হয়৷ মেয়ের পছন্দ করা ছেলেকে বড়লোক বাবার পছন্দ হয় না৷ তারপর জোর করে মেয়ের অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে নায়কগুলো গরীব থাকে। বেকার, বডাদ অসহায়। এদিকে আপনি ধনী পরিবারের ছেলে। তবে আপনাকে বাতিল করে দিল কেনো?’
এলোমেলো যুক্তি মিলাতে ব্যস্ত হলো আদ্রিকা। ওদিখ পরখ কোনো সাহায্যই করছে না। চঞ্চল মস্তিষ্কে এলোমেলো দৃষ্টি মেলে তাকাল আদ্রিকা। সন্দিহান গলায় বলল,
‘বাবার অনেক টাকাপয়সা থাকলে কী হবে, আপনি তো তখন বেকার ছিলেন। হয়তো এইজন্য আপনাকে রিজেক্ট করে দিয়েছে৷ বেকার ছেলের কাছে কে মেয়ে বিয়ে দিতে চাইবে!’
মুখ হতে পর্দা সরিয়ে আদ্রিকার দিকে তাকাল বজ্রাহত পরখ৷ সে কি ঠিক শুনেছে? এই পাগল মেয়ে, একমাত্র তাকে অপমান করল?
পরখের স্থির দৃষ্টি দেখে ভয়ে আড়ষ্ট হলো আদ্রিকা। আমতাআমতা করে বলল,
‘না মানে, সিনেমাতে এমনটাই তো হয়।’
‘জীবন কোনো সিনেমা নয়।’
‘তবে উনার বাবা আপনার সাথে বিয়ে দিল না কেনো?’
‘আমার গলায় তুমি ঝুলবে তাই। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমার তার সাথে কোথাও বিয়ে হলে তুমি বেশি খুশি হতে।’
‘কারো প্রেম পরিণতি না পেলে আমার খুব মন খারাপ হয়।’
উড়ে এসে জুড়ে বসা দুঃখে আদ্রিকাকে দুঃখী হতে দেখে পরখ খুব বেশি অবাক হলো না। বুদ্ধিহীন রমণীর থেকে এইটুকু হতাশামূলক কর্মকাণ্ড আশা করাই যায়।
পাশ ফিরে বৈদ্যুতিক বাতির সুইচটি টিপে আলো নিভিয়ে দিলো। মুহূর্তেই অন্ধকারের তলিয়ে গেলো কক্ষটি। কথোপকথনের মাঝে এমন গেঁয়োর আচরণ পরখ দ্বারাই সম্ভব। রণে ভঙ্গ দেওয়ায় আদ্রিকা মুখ ফুলিয়ে উদাস হতেই যাচ্ছিল, হঠাৎ মনে পড়ায় উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
‘আপনি কি এজন্যই বিদেশ যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন?’
সকালে ভার্সিটি যেতে হবে৷ এদিকে রাতের মধ্য প্রহর পেরিয়েছে সেই কখন! একটু ঘুমিয়ে না নিলে সকালে কীভাবে ক্লাস নিবে পরখ? অথচ এই উন্মাদিনীর অত্যাচারে দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না সে।
হাত বাড়িয়ে আবারও আলো জ্বালালো পরখ৷ আলো সইতে চোখ সরু হয়ে এলো। বিরক্তমাখা সুরে প্রশ্ন করল,
‘তুমি কি বললে?’
‘আপনি এজন্যই আপন-পর সকলকে তুচ্ছ করে বিদেশ ছুটে যাচ্ছেন।’
‘কীসের জন্য?’
‘অবশ্যই, নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য। মেয়ের বাবা নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক বকাঝকা করেছে, অপমান করেছে। আপনার আবার যা আত্মসম্মান! সেই থেকে পন করেছেন, নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করেই ছাড়বেন। কিন্তু মাঝখানে আমি এসে বাগড়া দিয়ে দিলাম। প্রেমঘটিত ব্যাপার তো নিজের পরিবারকে জানানো যায় না। তাই আপনার বাবাও বোধহয় জানেন না। না জেনে জোর করে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এজন্য আপনি আমাদের উপর বিরক্ত, ক্ষিপ্ত। তাই না?’
আদ্রিকার আষাঢ়ের গল্প শুনে হতবাক পরখ ভাষা হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ থমকে তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
‘জ্বি, একদম ঠিক। চমৎকার ভেবেছো৷ তুমি ভীষণ বুদ্ধিমতী, আদ্রিকা। এবার প্লিজ আমাকে ঘুমাতে দেও৷’
পরখের কণ্ঠের তাচ্ছিল্যভাব বুঝতে পেরে আদ্রিকা ঠোঁট ফুলিয়ে ভ্রু উচু করে আরও কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
‘তবে আপনি কি ওই মেয়েটার সাথে দেখা করতে বিদেশ যাচ্ছেন? মেয়ের বাবা কি মেয়েকে সুইজারল্যান্ড পাঠিয়ে দিয়েছে?’
‘উইল ইউ প্লিজ শাট ইউর মাউথ?’
এবার পরখ বেশ জোরে ধমকে উঠল। পাশের কক্ষের মানুষগুলো শুনলে শুনুক। আদ্রিকার কিছু যায় আসে না। কিন্তু এই মেয়ের বাচালতা আর কোনোভাবেই সহ্য করা যাচ্ছে না।
ধমকে কেঁপে উঠে আদ্রিকা সোজা হয়ে বসল। অভিমান করে ঘুরিয়ে নিল মুখ। তার পিঠের দিকে চেয়ে পরখ প্রশ্ন করল,
‘না ঘুমিয়ে ওখানে বসে আছো কেনো?’
আদ্রিকা ওভাবেই মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিল,
‘বিছানা আপনি দখল করে নিয়েছেন৷ আবার আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমানো আপনার পছন্দ নয়, তাই।’
‘সারারাত চেয়ারে বসে থাকবে?’
‘শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের কোনো অনাদর করতে নেই। আপনার শান্তির ঘুম নষ্ট করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
‘ওখানে বসে না থেকে ওপাশে এসে ঘুমাও।’
‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না৷ আপনি ঘুমান।’
‘তোমার বাবার বাড়ির বিছানা আমার বাড়ির বিছানার মতো ছোট নয়। অনায়াসে দুজন ঘুমানো যাবে।’
বলতে দেরী নেই, আদ্রিকা ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটে এলো। বসে থাকতে থাকতে কোমর বাকা হয়ে যাওয়ার দশা। বিছানায় উঠে বসতে শোনা গেল পরখের গলা।
‘মাঝখানে দূরত্ব রেখে শুবে।’
আদ্রিকা নীরবে মুখ মুচড়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরল।
সকালে ঘুম ভাঙল নীহারের ডাকে৷ চিৎকার চেচামেচি শুনে আড়মোড়া ভেঙে ঝটপট উঠে বাইরে ছুটে এলো আদ্রিকা৷ মনোযোগ দিতেই বুঝা গেল নীহার তাকেই বকছে৷ বসার ঘরে এ বাড়ির দুজন জামাই নাস্তা খেতে বসেছে। অথচ নীহার সেসব গ্রাহ্য না করে বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অপরাধে আদ্রিকাকে বকছে। যেনো আদ্রিকা এ বাড়ির পিচ্চি সদস্য।মায়ের এহেন আচরণে লজ্জায় মাথা কাটা গেলো আদ্রিকার৷
রান্নাঘরে ছুটে নীহারকে বলল,
‘চিৎকার করছ কেনো? এই তো উঠে গেছি।’
‘জামাই উঠছে সেই কখন আর এই বেহায়া মেয়ে পরে পরে ঘুমাচ্ছে। ছি! ছি! লজ্জায় মাথা কাটা গেলো আমার।’
‘উনার ঘুম শেষ তাই উঠে পরেছেন। আমার শেষ হয়নি তাই ঘুমাচ্ছিলাম। এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?’
‘তোর জামাই যে সকালে কাজে যাবে সেই চিন্তা নাই তোর? সকালে উঠে কি খাবে, কখন বেরোবে সেসব নিয়ে তোর কোনো মাথা ব্যথাই নাই। এভাবে সংসার করিস?’
আদ্রিকা বিরক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রতার দিকে তাকাল। তাকেও ঠোঁট চিপে হাসতে দেখে বড্ড হতাশ হলো। এ বাড়িতে কেউ তাকে আগের মতো আদর করছে না। সব আদর, আহ্লাদ পরখের জন্য৷
মোকাররমের জন্য খাবার গুছিয়ে নিয়ে নীহার বলল,
‘আমি তোর বাবার খাবার নিয়ে যাচ্ছি। তোরা খেয়ে নে। আর তুই, তাড়াতাড়ি খেয়ে রেডি হতে যা।’
আদ্রিকা অবাক হয়ে শুধাল,
‘রেডি হবো কেনো? এই সাত সকালে তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ নাকি? এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছো!’
‘ঢং দেখো মেয়ের! কলেজ যাবি না তুই?’
‘একদিন মিস দিলে কিছু হয় না।’
নীহার কিছু বলার আগেই বিরোধ জানাল আদ্রতা।
‘কদিন বাদে তোর টেস্ট পরীক্ষা এখন ফাকিবাজি করলে চলবে না। ভাইয়া বলছিল, তোর নাকি বড্ড ফাকিবাজি করিস। একটুও পড়তে চাস না। এমন করলে কিন্তু চলবে না। আজকে কলেজ থেকে সোজা বাড়ি চলে যাবি। এই কয়েকটা দিন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর।’
‘আব্বু অসুস্থ আর তুমি আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলছ?’
‘এখন সুস্থ আছে। যতোটুকু আছে, তা দূর্বলতা। আমি আর বিকল্প এখানে কিছুদিন আছি৷ তোকে চিন্তা করতে হবে না। তুই পরীক্ষার চিন্তা কর৷’
‘বাহ! তোমরা আছো, আর তাড়িয়ে দিচ্ছ। হিংসুটের দল।’
আদ্রিকার নাটুকেপনা দেখে আদ্রতা মিষ্টি করে হাসল। এগিয়ে এসে আদ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল,
‘পরীক্ষা শেষ করে অনেকদিনের জন্য চলে আসিস৷ তখন কেউ তাড়িয়ে দিবে না৷’
আদ্রিকা আনমনে নিচু গলায় বলল,
‘তখন একেবারে চলে আসব। চাইলেও আর ফিরে যাওয়া হবে না।’
‘কি বিড়বিড় করতেছিস?’
‘কিছু না। যাই আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’
নাস্তা শেষে ওরা আজকে একসাথে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরল। বাইকের পেছনে বসে বুক দুরদুর করছে আদ্রিকার। এই বুঝি পরখ ওকে মাঝপথে নামিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তেমন কিছুই পরখ করল না। বাইক এসে থামাল মানবিক বিভাগের সামনে। ঝটপট নেমে পরে পরখের সামনে এসে দাঁড়াল আদ্রিকা। হেলমেট পরিহিত মুখটির দিকে তাকিয়ে ভাবমূর্তি কিছু বুঝা গেল না। নীরব কিছুসময় পেরিয়ে পরখ বাইক ঘুরিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যের দিকে। যাওয়ার আগে কিছু বলেও গেল না। না দিলো কোনো প্রণয়মাখা বার্তা, না জানালো কোনো বিদায়সম্ভাষণ।
চলবে..
#অক্ষরময়ী