পান পাতার বৌ পর্ব-০২

0
163

#পান_পাতার_বৌ
দ্বিতীয়_পর্ব
~মিহি

-“মাইয়ার আগে একবার বিয়া হইছিল, বাচ্চা নষ্ট কইরা বাপের বাড়িত উঠছে এডি কই নাই তোমাগো? এসব লুকাইয়া বিয়া দিবার চাইছিল?”

সালমা খানমের মাথার উপর এবার বোধহয় গোটা আকাশটাই ভেঙে পড়লো। যার সহজ সরল মুখ দেখে তিনি গলে গিয়েছিলেন সে মেয়ের ইতিহাস এত আলকাতরার মতো কালো হবে কে জানতো! বয়স্ক মহিলা তখনো কী যেন বিড়বিড় করছেন, তাকে অপ্রকৃতিস্থের মতো দেখাচ্ছে।

-“কাবেরীর মা’রে কত কইছিলাম মাইয়ারে বিয়া দেস না ওর পছন্দে, টিকবো না। শুনলো না! দেমাগ দেখাইয়া দিল বিয়া, এখন বোঝো।”

ভ্রু কুঁচকালেন সালমা। কাবেরী কে? তার কথাই কি এতক্ষণ বলছিলেন এ মহিলা? কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আলেয়া দৌড়ে এলো। বয়স্ক মহিলাকে বুঝিয়ে ভেতরের ঘরে পাঠিয়ে দিল।

-“ইনি কে আলেয়া?”

-“আমার চাচী শাশুড়ি। যে মেয়ের কথা উনি বলছে সে আমার ননদ। নিজের পছন্দে বিয়ে করছিল। ছেলে সাত মাস বাড়ি থেকে বের করে দিছে। পেটের বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়িতে আসে। সবার অপমান বিশেষ করে আমার চাচী শাশুড়ির, এসবের জন্য মানসিক সমস্যা হয় তার। শেষে একদিন সিঁড়ি থেকে পরে গর্ভপাত হয়। পরের দিনই বিষ খেয়ে মারা যায় কাবেরী।”

-“আহারে। এজন্য বিয়ে-শাদী বাপ মায়ের দেখাশোনাতে করতে হয় রে আলেয়া। আল্লাহ বাপ মায়ের মাধ্যমে সঠিক জোড়া নির্বাচন করায়ে দেন।”

-“ভেতরে আয়। সীমান্ত কতদূর?”

-“আসতেছে মনে হয়।”

কথা শেষ হওয়ার আগেই বাইকের শব্দ কানে আসলো। সীমান্ত বাইক সাইড করে দরজার কাছে আসতেই মায়ের সম্মুখে পড়লো। পাশেই আবার আলেয়া আন্টি।

-“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম। তুমি দেখি ইউনিফর্মে আসছো!”

-“ঐ আর কী, কাজ থেকে আসছি তো।”

-“আসো। আমি শর্বরীকে আনতেছি।”

সীমান্ত মাথা নাড়লো। এছাড়া তার কিছু করার নেই। সালমা খানম গজগজ করতে করতে ভেতরে ঢুকলেন। সীমান্তর সবকিছু বিরক্ত লাগছে। এক হাত পরেই ঘরের দরজা। দরজা এত কাছে কেন এটা ভেবেও বিরক্ত লাগছে। মুখ বাঁকা করে ভেতরে ঢুকতেই পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এলো এক রমণী। কোমড় ছাড়িয়ে চুল তার। সীমান্তর মনে আচমকা কবিতা এসে বাজনা তুললো,”চুল তার কবেকার, অন্ধকার বিদিশার নিশা”। পড়নে মেরুন রঙের একটা শাড়ি। সীমান্ত মেয়েটার চোখে তাকানোর সাহস ক্ষণিকেই হারিয়ে ফেলল। এক পলক তাকাতেই যে ঝঙ্কার সে অনুভব করেছে তা ইতোমধ্যে তার মস্তিষ্ককে সতর্কবাণী পাঠিয়েছে যে আরেকবার তাকালে বিনাশ নিশ্চিত!

-“এই তাওসীফ আয়!”

সীমান্ত মায়ের ডাকে সোফায় এসে বসে। মনে মনে আওড়ায়,”তাওসীফ যোবায়ের সীমান্ত, তুমি শেষ বাবা! এ রমণীর মায়াজালে জড়ালে তুমি আর সংসারের মোহ মায়া ফেলতে পারবে না।

-“বোসো মা, দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।”

-“আসসালামু আলাইকুম।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম। মাশআল্লাহ! ঠিক চাঁদের টুকরো যেন। তোমাকে তো আমি আগেই দেখেছি মা, কথাবার্তা তো হয় নাই। দেখো, তোমাকে আমি আমার মেয়ে করে নিয়ে যাবো। তাই মায়ের সাথে মেয়ের আলাপ হওয়া অধিক জরুরী। বুঝছো?”

-“জ্বী।”

-“বেশ তোমার সাথে আমি আলাদা কথা বলতে চাই যদি অনুমতি দাও।”

-“অনুমতি নিতে হবে না। আপনি তো আমার গুরুজন।”

-“মাশআল্লাহ চলো।”

সীমান্ত হা করে তাকিয়ে থাকলো। পাত্রী দেখতে এসে পাত্র-পাত্রীকে আলাদা কথা বলানো হয় কিন্তু তার মা কী করলো এটা? এভাবে ধোঁকা? মনটা মুহূর্তেই বিষণ্ণ হয়ে উঠলো তার। সবার অলক্ষ্যে পর্দার ওপারে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টাও কিয়ৎ কম করলো না। হতাশ চোখে হাওয়ায় দুলতে থাকা পর্দা ছাড়া আর কিছু পেল না দেখার।

__________

-“দেখো শর্বরী, তুমি লোকপ্রশাসন নিয়ে পড়ছো। পড়াশোনাতেও ভালো। বিয়ে নিয়ে তোমার মনে কোনো সঙ্কোচ থাকলে আমায় বলো। জোর করে মেয়ে নিতে চাই না আমরা।”

-“কোনো অসুবিধে নেই আন্টি। আমি রাজি। বাবা-মা আমার জন্য যাকে পছন্দ করবেন আমি তাকেই বিয়ে করবো।”

-“আমার ছেলে পুলিশ। ওর চাকরিতে জীবনের ঝুঁকি থাকে। আমি ভয়ে ভয়ে থাকলেও ওকে শাসনেই রাখি তবুও ছেলেটা ঘরমুখী হয়নি কখনো। আমি তোমায় বলবো না ওকে ঘরমুখী করার দায়িত্ব তোমার। আমি শুধু চাই ও ক্লান্ত হলে তুমি যেন পাশে থেকে ওকে এটা বোঝাতে পারো যে কেউ একজন আছে ওর জন্য। মা তো সারাজীবন থাকবে না।”

-“আপনি খুব ভালো।”

-“তো? পছন্দ হয়েছে এই মাকে? যাবে তার সঙ্গে?”

শর্বরী লজ্জা পেল। এভাবে প্রশ্ন করলে কী উত্তর দিবে সে। সালমা খানম হেসে ফেললেন।

-“ওকে পাঠাচ্ছি। ওর সাথে কথা বলো কিছুক্ষণ।”

শর্বরী হ্যাঁ না কিছু বললো না। মাথা নিচু করেই রাখলো, তুললো না একটুও। সীমান্ত এসে সে লজ্জারত নিচু মুখখানা দেখলো। তার হৃদস্পন্দন আরো দ্রুতগামী হলো। এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসে।

-“আপনি শর্বরী?”

সীমান্তর ডাকে মাথা তুললো শর্বরী। প্রচণ্ড সুপুরুষ সীমান্ত, তার উপর ইউনিফর্ম গায়ে যেন রূপ একটু বেশিই বেড়েছে। মুখের ঔজ্জ্বল্য ছাপিয়ে যাচ্ছে ক্লান্তির রেশখানিও।

-“এই যে? এভাবে দেখলে তো নজর লাগবে আমার।”

শর্বরী লজ্জায় চোখ বন্ধ করলো। এই লোকটা বড্ড ঠোঁটকাটা তো! এভাবে কেউ বলে?

-“শর্বরী প্লিজ! এভাবে লজ্জা পেয়ো না। আমার কিছু হয়ে গেলে তার দায় তোমার এ লজ্জার। কারো লাজরাঙা মুখ যে একজনকে খুনও করে ফেলতে পারে এটা তুমি জানো না? ফাঁসিতে ঝোলানো হবে তোমায়।”

-“হয়েছে! পুলিশ হয়েও এত সিনেম্যাটিক কথা কোত্থেকে আসে হ্যাঁ?”

-“পুলিশ দেখে বিয়ে-বাসর করবো না নাকি? সব তো করবো। তাহলে?”

-“আপনি যান বাইরে। কথা শেষ।”

-“শর্বরী, সত্যি কথা বলি একটা! আমি মারাত্মক বিবাহবিরোধী মানুষ ছিলাম। তারপর তোমাকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে সাতাশটা বসন্ত বৃথা আমার। আগামী পঞ্চাশটা বসন্ত যেন বৃথা না যায় তার দায়িত্ব তোমার বুঝছো?”

-“আপনি বড্ড বেহায়া!”

-“লে! ভদ্রলোক হয়েই তো আছি, চুমু-টুমু তো খাইনি। তাতেই বেহায়া?”

-“ছিঃ! নির্লজ্জ লোক, যান আপনি বাইরে। ফুপু কী না কী ভাববে!”

সীমান্ত মুচকি হাসলো। সে হাসিতে সাত খুন মাফ! শর্বরীর মুগ্ধ নয়ন সে হাসিতে দেওয়ানা হলো অল্পক্ষণেই। শর্বরী দু’হাতে মুখ ঢাকলো। সীমান্ত লুকিয়ে তা দেখলো ঠিকই।

বসার ঘরে এসে সোফায় বসে পড়লো সীমান্ত। তার মুখের হাসি আশ্বস্ত করলো সালমা খানমকে। শর্বরীর বাবা শফিক হোসেন আর মা আরজুর সাথে আলাপে গেলেন তিনি।

-“বেয়াই সাহেব, মেয়ে আমাদের পছন্দ। আমার বড় ভাই সৌদিতে আছেন। তিন মাস পর দেশে ফিরবেন। আপনাদের আপত্তি না থাকলে উক্ত সময়ে সীমান্ত আর শর্বরীর বিয়ে পড়ানো হবে। ততদিন ওরাও একে অপরকে চিনুক ভালো করে। এখনকার ছেলেপেলে! একদিন দেখেই তো আর বিয়ে করতে চায় না।”

-“তা বেশ বলেছেন বেয়ান সাহেবা। আমাদের আপত্তি নেই।”

সীমান্ত লক্ষ করলো পর্দার আড়ালে একজোড়া পায়ের উপস্থিতি। সীমান্ত মুচকি হাসলো। অবশেষে তার অগোছালো জীবন গোছানোর এক রমণীই পছন্দ করেছে তার মা। সীমান্তর চোখে বারবার শর্বরীর লাজরাঙা মুখখানা ভাসছে। তৎক্ষণাৎ সীমান্তর বুকের মাঝে অদ্ভুত এক কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। পকেটে ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। বিরক্ত লাগলো সীমান্তর। এই অসময়ে কে ফোন করলো? ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আমিন। কী আর করার, দরকার বোধহয় কোনো। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলো সীমান্ত। ঘরের ভেতরে নেটওয়ার্কের বেজায় সমস্যা। সীমান্ত ফোন কানে ধরেই বাইরের দিকে এগোলো। বাইরে এসেও ঠিকঠাক কিছু শুনতে পারছে না। কেবল অপরপাশ থেকে আমিনের চ্যাঁ চোঁ শোনা যাচ্ছে। রাগে আর বিরক্তিতে সীমান্তর তখন খুন খারাবি করে ফেলার দশা! এমন সময় অস্ফুট স্বরে আমিনের ভাসা ভাসা গলার আওয়াজ পেল সে, “স্যার! সর্বনাশ হয়ে গেছেএএ…”

চলবে…