পান পাতার বৌ পর্ব-০৩

0
180

#পান_পাতার_বৌ
তৃতীয়_পর্ব
~মিহি

-“তুই কি সীমান্তকে তোর অসুখের কথা বলেছিস?”

-“না তবে বলবো শীঘ্র…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই সপাটে একটা চড় এসে পড়ে শর্বরীর গালে। মায়ের রুক্ষতার তোপে অশ্রু এসে ঠাই নেয় তার শুষ্ক অশ্রুনীড়ে। সে তো কোনো বাক্য ব্যয় ছাড়াই বিয়েতে মত দিয়েছে তবে তার ভবিষ্যত জীবনের সামান্যটুকু সিদ্ধান্ত সে নিতে পারবে না?

-“মা! বিয়েটা হলে ওরা এমনিতেও জানবে। তখন জানার চেয়ে এখন জানানো ভালো নয় কী?”

-“না নয়! একবার বিয়েটা হয়ে গেলে তখন কিছু একটা করা যাবে কিন্তু একবার বিয়ে ভাঙলে তোর জন্য এমন ভালো পাত্র পাবো আর?”

বিয়ের পরে কিছু একটা করা যাবে- এ কথার অর্থ শর্বরী বোঝে। বিয়েটা হয়ে গেলে তার বাবা মায়ের কাঁধ থেকে বোঝাটা নেমে যাবে। তারপর শ্বশুরবাড়িতে সে মার খেয়ে হলেও সংসারটা টিকাতে বাধ্য। সেসব চিন্তা শর্বরী করছে না। সীমান্তর পরিবারের মানুষগুলো বড্ড ভালো। তাদের মিথ্যে বলে একটা চিরস্থায়ী সম্পর্ক শুরু করাটা অনুচিত।

-“এ বিয়ে যদি ভাঙে শর্বরী তবে আমার মরামুখও তুই সেদিনই দেখবি! তোর বাবার অবস্থা দেখিসনা? লোকটা অসুস্থ! তোর বিয়ের চিন্তাতেই মেরে ফেলতে চাস লোকটাকে? ভালোই ভালোই বিয়েটা হতে দে। সামনের সপ্তাহে ওরা আমাদের বাড়িতে এসে আংটি পড়াবে। ব্যাগপত্র গোছা, কাল ভোরবেলায় বাড়ি ফিরতে হবে।”

-“কিন্তু মা, বাবার চিকিৎসা?”

-“তোর বিয়ে নিয়েই চিন্তা, বিয়েটা হয়ে গেলেই সুস্থ হয়ে যাবে।”

-“মা তোমরা কি আমায় কোনোভাবে মিথ্যে বলছো বাবার অসুস্থতা নিয়ে?”

-“বেশি কথা বলা বাদ দে। ব্যাগ গোছা।”

মায়ের আচরণে সন্দেহ হলো শর্বরীর। তার বাবা সত্যিই অসুস্থ নাকি সবটাই তাকে বিয়ে দেওয়ার নাটক সাজানো হলো? শর্বরীর মন খারাপ হয়ে গেল। সে তো কখনো বাবা-মায়ের কথা অমান্য করেনি। এমন জেদও ধরেনি যে পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করবে না তবে এমন নাটকের কারণ কী? ভাবনাটা বড্ড পোড়াচ্ছে শর্বরীকে।

__________

-“আদনানের লাশটা সর্বপ্রথম কে দেখেছে?”

-“ওনার দায়িত্বে থাকা নার্স আশা। উনি রুমে এসে দেখে আদনানের বুকের কাছে ছুরির এলোপাতাড়ি আঘাত। রক্ত দেখে উনি পালস চেক করে দেখেন আদনান বেঁচে নেই। ঠিক সেসময় এটাচড বাথরুম থেকে রক্তমাখা হাত ধুতে ধুতে মিসেস ইরিনা বের হন।”

-“আমিন কেস তো সহজ কিন্তু ইরিনের বাবা সহজ রাখতে দিবেন না। আমাদের উপর প্রেশার দিবেন কেস ঘোরানোর। যেভাবেই হোক ইরিনার বিপক্ষে প্রমাণগুলো সব ঠিকঠাক করে রাখতে হবে।”

-“আই উইটনেস, মার্ডার উইপন সব তো পাওয়া গেছে স্যার। তাহলে আর কী প্রমাণ লাগবে?”

-“আই উইটনেসকে টাকা খাওয়ালে সে যে তোমাকে খুনী বানাবে না তা কে জানে? পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট আসুক। ততক্ষণ ইরিনার দিকে নজর রাখতে বলো কনস্টেবল আছিয়াকে। এ মেয়ে বাবার সিকিউরিটি ফাঁকি দিয়ে হাসপাতালে ঢুকে একটা মানুষ খুন করতে পারলে জেল থেকে পালানোর ঝুঁকিও নিতে পারে।”

-“স্যার, আদনানের পরিবারের লোকেদের সাথে একবার কথা বলেছেন?”

-“হ্যাঁ, আসার সময় দেখলাম অবস্থা ভালো না। আদনানের মা ইরিনাকে অভিশাপ দিচ্ছেন। আশ্বস্ত করলাম সঠিক বিচার হবে। এখন ফরেন্সিক রিপোর্টটা পেলে হয়।”

সীমান্তর মন মেজাজ একদম ভালো নেই। না চাইতেও শর্বরীর মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। কোনোভাবেই মাথা থেকে বের করতে পারছেনা মেয়েটাকে। এদিকে এই কেইসের ভেজাল! এটেম্প টু মার্ডার কেস থেকে এখন মার্ডার হয়ে গেছে। সীমান্তর আগেই সন্দেহ হয়েছিল এই ইরিনা মেয়েটা ভয়ঙ্কর। মানুষের চোখ দেখলেই বোঝা যায় তার মধ্যে কতটুকু ঝাঁঝ! সীমান্ত ঠিক চিনেছিল ইরিনাকে।

-“আচ্ছা আমিন, আদনানের বাড়ির কাজের মেয়েটা কোথায়? আসমা না কী যেন নাম।”

-“এতকিছুর পর হয়তো ভয় পাইছে স্যার! ইরিনা মেয়েটাকেও আঘাত করছে কিনা কে জানে!”

-“মেয়েটার জবানবন্দী নেওয়া দরকার ছিল। আচ্ছা যাই হোক, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আসুক আগে তারপর বাকি বিষয় দেখা যাবে।”

সীমান্ত কিছু বলার আগেই ফোন বেজে উঠলো তার। যথারীতি মা জননীর কল। সীমান্ত ফোন না ধরে রেখে দিল। এখন মায়ের সাথে কথা বলা মানেই মেজাজের আরো চৌদ্দটা বাজানো। কিন্তু সালমা খানম থামলেন না। ক্রমাগত কল করতেই থাকলেন। একসময় বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করলো সীমান্ত।

-“সমস্যা কী মা?”

-“তোর বাবার বুকে ব্যথা করতেছে। তাড়াতাড়ি আয়, আমি কী করবো বুঝতেছিনা।”

-“মা..মা শান্ত হও। দারোয়ান কাকাকে ডাক্তার ডাকতে পাঠাও, আভি এম্বুলেন্স পাঠাচ্ছি।”

-“তুই আয় বাবা, আমি…”

ফোনটা কেটে গেল। সীমান্ত হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ বাবার কী হলো!দুশ্চিন্তায় ঠিকঠাক বাইকটাও চালানোর শক্তি পাচ্ছে না সে। কোনোরকম বাড়িতে ঢুকে চিৎকার করে মাকে ডাকা শুরু করলো। চেঁচামেচির এক ফাঁকে দেখলো তার বাবা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে। মুহূর্তেই মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল সীমান্তর। ততক্ষণে সালমা খানমও এসে দাঁড়িয়েছেন। মুখে তার বিরাট হাসি ঝোলানো।

-“তুই তো ধুপধাপ চলে গেলি ওখান থেকে! ঠিকমতো বিদায় জানাবি না? এই নে এই কাগজে শর্বরীর ফোন নম্বর আছে।”

সীমান্ত কাগজটা হাতে নিয়ে সেটা মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল। কাগজটা কুঁচকাতে কুঁচকাতে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সীমান্ত।

-“মা, তোমার এ ধরনের নাটক করা উচিত হয়েছে? তোমার এই নাটকের জন্য আমি একটা কেস ফেলে এসেছি। তুমি কি ভুলে যাও তোমার ছেলে পুলিশ?”

সীমান্তর কথায় সালমা খানম নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। নীরব অভিমানে গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। বিড়বিড় করতে করতে চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন। সীমান্তর রাগ তখন আকাশচুম্বি। জোরে জোরে পা ফেলে সেও নিজের ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিল। ঘরে ঢোকার পর সে লক্ষ করলো হাতে এখনো সেই কাগজটা যেটাতে শর্বরীর নম্বর লেখা। কী ভেবে যেন সীমান্ত ডায়াল করলো। ভেবেছিল অপরিচিত নম্বর শর্বরী রিসিভ করবে না কিন্তু দ্বিতীয় রিংয়েই কল রিসিভ হলো। সীমান্ত কিছু বলার আগেই শর্বরী সালাম দিল।

-“ওয়ালাইকুম সালাম। তুমি চিনলে কিভাবে?”

-“আন্টি আপনার নম্বর দিয়েছিল আপনাকে।”

-“ওহ আচ্ছা।”

-“তখন ওভাবে বেরিয়ে গেলেন যে?”

-“একটা মার্ডার হয়ে গিয়েছিল। ঐটার তদন্তের জন্য যেতে হয়েছিল।”

-“আপনি কি রেগে আছেন?”

-“এমন কেন মনে হচ্ছে?”

-“শুনেছিলাম রেগে থাকলে মানুষ জোরে জোরে শ্বাস নেয়। আপনিও তাই করছেন এখন।”

-“পড়ো লোকপ্রশাসনে অথচ কথাবার্তা সাইকোলজিস্টের মতো! বাব্বাহ!”

-“এটুকু বুঝতে অত সাইকোলজি জানতে হয় না জনাব, একটুখানি জানাই ইনাফ। এই যেমন আপনি নির্ঘাত রাগ করে দরজা বন্ধ করে কল করেছেন।”

-“তুমি কী করে জানলে?”

-“এমনি মনে হলো যে আপনি এই ধরনের মানুষ যারা রাগ করলে দরজা বন্ধ করার পর রাগ কমে।”

-“ভালোই বলেছো। আসলে আমি ঐ ধরনেরই মানুষ তবে তোমার উপর যখন রাগ করবো তখন তোমাকে সহ দরজা বন্ধ করবো। রাগের যেটুকু ঝাল আর ঝাঁঝ তা তোমাকেই অনুভব করতে হবে প্রিয়তমা।”

-“রাগ কোথায় এখন আপনার?”

-“তুমি রাগপরী? কেমন রাগটুকু সব টেনে নিলে! একটুও রাগটাগ লাগছে না আর।”

-“পুলিশের রাগ টানতে পেরেছি, মেডেল দিবেন কবে আমাকে?”

-“উমম…বাসর রাতে?”

শর্বরী চুপ হয়ে গেল। খারাপ মনটা কখন যে ভালো হলো কথা বলতে বলতে বুঝেই উঠতে পারেনি কিন্তু এখন প্রচণ্ড লজ্জা লাগছে তার। সীমান্ত এভাবে লজ্জায় ফেলে কেন তাকে? পরক্ষণেই শর্বরীর মাথায় অন্য এক বিষয় এসে উপস্থিত হয়।

-“আমার আসলে আপনাকে কিছু বলার আছে সীমান্ত।”

-“বলেন মহারানি, আপনার কথা শুনতে তো ব্যাকুল আমি।”

-“আ…আসলে আমার একটা…এ..একটা…”

-“তোতলাচ্ছো কেন? কী হয়েছে বলবে তো।”

-“আসলে আমার একটা সমস্যা আছে….”

চলবে…