পান পাতার বৌ পর্ব-০৪

0
114

#পান_পাতার_বৌ
চতুর্থ_পর্ব
~মিহি

-“আসলে আমার সমস্যা হলো আমি…”

-“চুপ করে গেলে যে? আচ্ছা খুব সিরিয়াস কিছু? তুমি বিয়ে করতে চাইছো না? এনি কাইন্ড অফ ফোর্সফুলি তোমাকে…”

-“না না! আমার আপনাকে বিয়ে করতে সমস্যা নেই।”

-“আচ্ছা বেশ। আমাদের সামনাসামনি কথা বলা উচিত এটা নিয়ে। এভাবে ফোনে হয়তো তুমি কমফর্টেবল না। সমস্যা না থাকলে কাল বিকালে আমরা দেখা করি?”

-“আমি তো কাল সকালেই বাড়ি ফিরবো।”

-“এত তাড়া? আচ্ছা আমি দেখতেছি, রাখো।”

সীমান্ত কল কেটে দিয়ে ভাবতে লাগলো কী করবে। মা জননীকে পটানো ছাড়া অন্য কোনো ইফেক্টিভ আইডিয়া ঠিক মাথায় আসলো না সীমান্তর। যথারীতি মায়ের ঘরে উঁকি দিল সে। সালমা খানম রাগ করলে সচরাচর বারান্দায় বসে ফোনে আগের আমলের কান্নাকাটির সিনেমা দেখে চোখ লাল করে ফেলেন। সীমান্ত গিয়ে দেখলো ঘটনা তাই-ই। সে সোজা সালমা খানমের পায়ের কাছে গিয়ে বসলো।

-“আরে মা জননী, আপনি রাগ করলে এ সংসার থাকবে? ধ্বংস হয়ে যাবে তো। নিজের ক্রোধের আগুনে এমন নিষ্পাপ সংসারকে জ্বালাতে আপনার বাঁধবে না?”

-“তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী পুড়ে যাক! বংশের রক্ত সব, অকৃতজ্ঞ রক্ত! দূর হ আমার চোখের সামনে থাকে।”

-“আচ্ছা মা শোনো, তুমি এজন্য রাগ করেছো যে আমি ভালোভাবে বিদায় জানাইনি? বেশ তো, তুমি শর্বরীর সাথে আমার একটা মিট-আপের ব্যবস্থা করাও। আমি নিজে গিয়ে ভালো করে বিদায় জানিয়ে আসবো।”

-“সত্যি বলছিস তুই?”

-“একদম, তিন সত্যি!”

সীমান্তর কথায় সালমা খানম যে খুশি বলেন তা বোঝা গেল। মুখে অন্যরকম একটা দীপ্তি প্রকট হলো। সে দীপ্তি আড়াল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে মুখে কপট রাগ স্থাপন করলেন সালমা খানম।

-“হয়েছে যা! আমি দেখতেছি। তোর তো হাজারটা কাজ, ফ্রি কখন তুই?”

-“এই বিকাল পাঁচটার পরে।”

-“আচ্ছা যা।”

সীমান্ত ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বের হলো ঘর থেকে। দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা এবার তার আম্মাজানই করে ফেলবে!

সালমা খানম ফোন বের করলেন আরজু বেগমকে কল করার জন্য। সরাসরি শর্বরীকে কল দিলে সে লজ্জা পেতে পারে কিন্তু মা বললে নিশ্চিত নিষেধ করতে পারবে না। এ বাহানায় দুজন একটু আলাদা সময় কাটানোর সুযোগ পাবে। ভাবতে ভাবতেই আরজুর নম্বর ডায়াল করলেন সালমা।

-“আসসালামু আলাইকুম বেয়ান সাহেবা। আমি সীমান্তর মা বলছি।”

-“ওয়ালাইকুম সালাম। জ্বী জ্বী আপা বলেন।”

-“দুঃখিত আপা, আজ ছেলেটা অমন তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। পুলিশের চাকরি তো, বোঝেনই আপনারা।”

-“সমস্যা নেই। ছেলে যে যথেষ্ট কর্তব্যপরায়ণ তা দেখেই আমরা খুশি।”

-“আপা, শর্বরীর সাথে ঠিকমত আলাপটা হলোই না। সীমান্ত একটু বাইরে দেখা করতে চাচ্ছে কাল বিকালে। আপনাদের আপত্তি নেই তো?”

-“না না আপা, আমি বলবোনি শর্বরীকে।”

-“আচ্ছা আপা রাখি তাহলে।”

আরজু বেগম কল কাটলেন। শর্বরী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। কলের কথোপকথনটুকু সবটাই কানে এসেছে তার।

-“মা, কাল সকালে তো আমরা চলে যাবো। তাহলে বিকালে?”

-“আমি আর তোর বাবা যাবো কাল। তুই এখানেই থাক, পরে তোর বাবা নিয়ে যাবে এসে।”

শর্বরী হ্যাঁ না কিছু বললো না। তার মা যে এত সহজে তাকে সীমান্তর সাথে আলাদা দেখা করতে দিতে রাজি হবে এটা তো সে ভাবেইনি। খানিকটা অবাকই হলো সে।

-“শোন! সীমান্তকে খরবদার নিজের অসুখের কথা বলবি না। তোর বেশি লাফালাফির জন্য এ সম্বন্ধ যেন হাতছাড়া না হয়।”

-“মা, বিয়ের পর কি ওনারা জানবে না?”

-“সে তো বিয়ের পর, তখন জানলেও কী? তোকে ফেলে তো আর দিতে পারবে না।”

শর্বরীর মুখটা মলিন হয়ে আসলো। ‘ফেলে তো আর দিতে পারবে না’ এ শব্দগুচ্ছটা গ্রীষ্মের প্রকাণ্ড দাবদাহের মতো শর্বরীর কলিজায় চিড় ধরালো। তার মা মানুষটা কি ইদানিং বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে গেছে নাকি তারই স্বাভাবিক কথাগুলোও অস্বাভাবিক লাগছে?

___________________

-“মানে কী? আগে যদি বিষ খাইয়ে মেরেই ফেলে তাহলে ওখান থেকে পালিয়ে না গিয়ে ইরিনা লাশকে আঘাত করতেছিল? এই মেয়ের মাথার সমস্যা তো ব্যাপক।”

-“বিষটা আদনানের স্যালাইনে মেশানো হয়েছিল। আর মৃত্যুর এক্সাক্ট টাইম বিকাল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। এছাড়া ছুরিতে যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে তা ইরিনার আর ইরিনার হাতের ব্লাড স্যাম্পলও আদনানের। আপাতদৃষ্টিতে এটুকুই বলা যাচ্ছে।”

-“সব প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। এখন ইরিনার বাবা হাজার চেষ্টা করলেও মেয়েকে বাঁচাতে পারবেনা। এত নৃশংসভাবে নিজের স্বামীকে খুন করলো! ছিঃ!”

সীমান্তর চোখে ক্রোধ ঝড়ে পড়ছে। ইরিনার প্রতি তীব্র ক্রোধ! ফরেন্সিক ল্যাব থেকে বেরোতেই ফোন বেজে উঠলো সীমান্তর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে তিনটে বাজে। শর্বরী কল করেছে।

-“আপনি কোথায় সীমান্ত?”

-“চারটেতে আসতে বলেছিলাম তো।”

-“কথা হওয়াটা দরকার আমাদের। আপনি একটু তাড়াতাড়ি আসবেন প্লিজ?”

শর্বরীর কাতর স্বরে সীমান্ত একেবারেই গলে গেল। কালেক্ট করা প্রমাণগুলো থানায় জমা রেখে সে রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে বের হলো বেশ তাড়াহুড়ো করে। পৌঁছাতে লাগলো পনেরো মিনিট। সব মিলিয়ে পঁচিশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করিয়েছে সে শর্বরীকে।

-“অনেকটা অপেক্ষা করালাম তাই না? সচরাচর ছেলেরাই আগে এসে বসে থাকে কিন্তু …”

-“কিন্তু আপনি এমন একটা জবে আছেন যেখানে থেকে যদি আপনি আমার জন্য পাঁচটা মিনিট সময়ও বের করতে পারেন, আমার জন্য যথেষ্ট।”

-“বউ বউ লাগতেছে তোমাকে একদম।”

শর্বরী লজ্জায় নুইয়ে পড়লো। প্রেম শব্দটা তার জীবনে আসেনি কখনো। সেজন্য এসব কথাগুলো তার অন্তরে কাঁপন তোলে অতি সহজেই। হাত পা কাঁপতে শুরু করে তার। সীমান্তর মুখের হাসিটাও তাকে একেবারে আবৃত করে ফেলে লাজরাঙা অনুভূতির চাদরে।

-“নুইয়ে পড়া লজ্জাবতী, আইসক্রিম খাবেন?”

শর্বরী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। দুই কাপ আইসক্রিম অর্ডার করলো সীমান্ত। শর্বরী মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে সে কিভাবে কথাগুলো সীমান্তকে বলবে। যদিও মা নিষেধ করেছে তবে কথাগুলো না বললে শর্বরী কিছুতেই স্বস্তি পাবে না আর এই অস্বস্তি নিয়ে বিয়ের মতো একটা বড় সিদ্ধান্ত কিভাবে নিবে সে?

-“আইসক্রিম এসে গলে যাচ্ছে, কী এত ভাবছেন বউ?”

-“না..না কিছুনা।”

-“শর্বরী তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো? আমি তোমার মুখের সংকোচ দেখে দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি যে তুমি বোধহয় এ বিয়েতে অখুশি।”

-“না না..বিষয়টা তেমন না। আসলে আমার রেস্টুরেন্টে আসার অভ্যেস নেই। কোনো ছেলের সাথে তো না-ই।”

-“আমি কি যেমন তেমন কেউ নাকি? হবু বর বলে কথা! তবে তোমার যেহেতু আনকমফর্টেবল লাগতেছে, তাহলে বাইরে কোথাও যাই? নাহলে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি?”

শর্বরী খানিকটা স্বস্তি পেল। এই বদ্ধ জায়গায় কথা বলার চেয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা আসলেই স্বস্তির। সীমান্ত কিভাবে যেন ঠিকই শর্বরীর মনের কথাটা ধরে ফেলেছে। বিল পরিশোধ করে আইসক্রিম হাতে নিয়ে দুজন বের হলো। রাস্তার বাম পাশে শর্বরীকে রেখে ডানপাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলো সীমান্ত।

-“কী যেন বলবে বলছিলে? বলো।”

-“আপনি আমাকে কেন বিয়ে করতে চান?”

-“এটা তো বলেছিলাম তোমায়। তুমি-ই প্রথম মেয়ে যাকে দেখার পর আমার মনে হয়েছে আমার বিয়ে করা উচিত। সেজন্য তোমাকেই নিজের দায়িত্ব দিতে চাই।”

-“আমি আসলে…”

-“এইতো তোতলাচ্ছো! আরে আমি কি বাঘ? এত ভয়? খেয়ে ফেলবো তোমাকে? আইসক্রিম তুমি যে গিলে ফেলবো।”

কথাটা বলেই সীমান্ত শর্বরীর দিকে তাকালো। সে দৃষ্টিতে দৃষ্টি ফেলতে গিয়ে শর্বরী যেন আরো লজ্জা পেল। সীমান্তর সবকিছুই তাকে লজ্জায় ফেলে!

-“আমার আসলে একটা অসুখ আছে। ছোটবেলা থেকেই এটা। ওষুধও খেয়েছিলাম কিন্তু বিশেষ কোনো…”

সীমান্তর ফোন বেজে উঠলো। চ’কারান্ত শব্দ করে চোখের ইশারায় অনুমতি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো সীমান্ত। আমিন বরাবরের মতো ফ্যাঁসফেসে গলায় দুঃসংবাদ দিল,”স্যার, ইরিনা ম্যাম সুইসাইড করছেন…”

চলবে…