পারলে ঠেকাও পর্ব-৩০

0
347

#পারলে_ঠেকাও
#পর্বঃ৩০
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মধুজা থানায় চলে এসেছে। উদ্দ্যেশ্য পুলিশের সাহায্য নিয়ে লাবিবকে খুজে বের করা। পুলিশ মধুজাকে আশ্বস্ত করে লাবিবকে খুজতে তারা সব ধরনের তৎপরতা কাজে লাগাবে।

লাবিবের ফোন নম্বর স্ট্রেস করে তার লোকেশন ট্রাক করা হয়। একটি পুরাতন কারখানার দিকে লাবিবের লোকেশন পাওয়া যায়। অতঃপর সেই লোকেশনে গিয়ে পুলিশ লাবিবের মৃতদেহ উদ্ধার করে। লাবিবকে ছু’রিকাঘাত করে কেউ নিষ্ঠুর তম ভাবে মে’রে ফেলেছে। তার দেহ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। যে কেউ এটা দেখে ভয় পেয়ে যেতে পারে। মধুজাও পুলিশের সাথে উপস্থিত ছিল। সে লাবিবের লা’শ শনাক্তের কাজ করে। লাবিবের মৃত্যুতে খুব খারাপ লাগে মধুজার। তার কানে লাবিবের বলা শেষ কথাগুলোই বাজতে থাকে।


মধুজা অক্ষরকে সাথে নিয়ে চলে এসেছে লাবিবের বাড়িতে। লাবিবের ছোট বোন লিয়াকে নিয়ে যাওয়াই তাদের প্রধান উদ্দ্যেশ্য। অনেক আগেই লাবিবের মা বাবা মারা গেছে। তারপর তারা শুধু দুই ভাইবোন একসাথে বড় হয়েছে। লাবিবের ছোট বোন লিয়ার বয়স ১২ বছর। সে ক্লাস সেভেনে পড়ে।

লিয়ার পুরো জীবন জুড়ে তার ভাইয়ের বিচরণ। ভাইয়ের মৃত্যুর তাকে কিভাবে দেখে সেটাই ভাবছিল মধুজা। অক্ষর মধুজাকে ইশারা করে নিশ্চিত করে।

মধুজা সামান্য অভয় পায়। কলিং বেল বাজানোর সামান্য কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর লিয়া এসে দরজা খুলে দেয়। লাবিব যেহেতু অধিকাংশ সময় বাইরে থাকে তাই লিয়া একটু সচেতন থাকে।

মধুজাকে চেনে লিয়া। লাবিবের সাথে অনেকবার তাকে দেখেছে৷ তাই দরজার ফাঁকা যায়গা দিয়ে মধুজাকে দেখে দরজা খুলে দেয় লিয়া। প্রশ্ন করে,
‘মধুজা আপু তুমি। কি চাও বলো?’

‘আমি তোমার ভাইয়ার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।’
‘ভাইয়া তো গতকাল রাত থেকে মিসিং। আমি ফোন করেছি ফোনও তুলছে না। তুমি কি জানো আমার ভাইয়া কোথায়?’

এপর্যায়ে মধুজার চোখে জল চলে আসে। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে মধুজা বলে,
‘তুমি নিজেকে শক্ত করো লিয়া। তোমার ভাইয়া আর বেচে নেই।’

সংবাদটা পাওয়া মাত্র লিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। মা বাবার মৃত্যুর পর ভাই ছিল তার সব। বলা চলে, এই পৃথিবীতে তার একমাত্র অবলম্বন। এখন সেই ভাইকে হারিয়ে বাকশুন্য হয়ে যায় লিয়া।

লিয়া সাথে সাথে কাদতে শুরু করে। মধুজা ও অক্ষর মিলে তাকে সামলায়।

৫৯.
মধুজা লাবিবের পাঠানো একটি গোপন ভিডিও দেখছে। লাবিব মৃত্যুর আগে তাকে এই ভিডিও পাঠিয়েছিল। মধুজার সন্দেহ হচ্ছে এই ভিডিওর জন্য হয়তো লাবিবকে মে’রে ফেলা হয়েছে।

ভিডিওটা দেখা যাচ্ছে কালো মাস্ক পড়া কিছু লোক বলছে,
‘এইবার একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে যখন সবাই ব্যস্ত থাকবে সেই সুযোগে আমরা কোন এক শহীদ মিনারে বো’মা রেখে দেব। আর তারপর সেই বো’মা বিস্ফোরিত হবে। চারিদিকে শুধু হাহাকার। ব্যস আমাদের উদ্দ্যেশ্য সফল৷ এই ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারব।’

ভিডিওটা দেখে মধুজা ভীত হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে অনেক বড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে। মধুজা আর দেরি না করে নিচে ছুটে যায়। অক্ষর ও বর্ণ মিলে লিয়াকে সামলাচ্ছিল।

মধুজা সেখানে উপস্থিত হয়ে অক্ষরকে বলে,
‘একটু এদিকে আসো। তোমাকে কিছু দেখাবো।’

অক্ষর আর অপেক্ষা না করে মধুজার কাছে যায়। ভিডিওটা দেখে অক্ষর নিজেও ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। কন্ঠে প্রবল উৎকন্ঠা নিয়ে বলে,
‘আমাদের এখনই পুলিশকে এই ব্যাপারে জানাতে হবে। যাতে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।’

মধুজা ও অক্ষর মিলে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে এবং ভিডিওটি দেখায়। দেশের সকল শহীদ মিনারে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। তবে কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছিল না ঠিক কোথায় এই না’শকতা ঘটতে পারে।

মধুজা ভিডিওটা কয়েকবার দেখে। শেষের দিকে কেউ একজন বলছিল ‘স্কু’। কথাটা শোনামাত্র মধুজা বুঝতে পারে হয়তো কোন স্কুলে না’শকতার পরিকল্পনা করা হয়েছে। মধুজা আর দেরি না করে পুলিশকে এই ব্যাপারে জানায়। এই ঘটনাটা জেনে পুলিশ আরো ভীত হয়ে পড়ে কারণ ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা উপস্থিত হয়েছে শহীদ মিনারে সম্মান জানানোর জন্য। এমতাবস্থায় সারা ঢাকা শহরের এতগুলো স্কুলে নিরাপত্তা নেওয়া বেশ কঠিন। অনলাইনে, টিভিতে নিউজ ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই ভীষণ ভয় ও উৎকন্ঠার মধ্যে সময় পার করছিল।

মধুজা ও অক্ষর দুজনে বেশ চিন্তিত ছিল। অক্ষর মধুজাকে বলে,
‘চলো তো আমরা আশেপাশের কয়েকটা স্কুল ঘুরে আসি।’

মধুজা রাজি হয় এবং অক্ষরের সাথে আশেপাশের কিছু স্কুল দেখতে যায়।

৬০.
আরহা মন খারাপ করে তার বাড়ির কাছাকাছি একটি স্কুলের সামনে এসে বসে আছে। আমিনুল হক নিজের এক বন্ধুর ছেলের সাথে আরহার বিয়ে ঠিক করেছে। আরহাকে এখন সেই ছেলেটাকেই বিয়ে করতে হবে। আগামী মাসে বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। অথচ আরহার মনে এখনো বর্ণর রাজত্ব। সে হাজার চেষ্টা করেও বর্ণকে ভুলতে পারছে না। আসলে ভালোবাসা তো এমনই। কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে এত সহজে তাকে ভোলা যায়না।

বর্ণর কথা ভাবতেই আরহার বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে। আরহা নিজেকে নিজেই আশ্বস্ত করে বলে,
‘আমরা যা চাই সবসময় তা পাই না। পাওয়া না পাওয়া মিলিয়েই তো আমাদের জীবন। এক জীবনে মানুষের সব আশা পরিপূর্ণ হয়না। কিছু ইচ্ছা, কিছু স্বপ্ন ভেঙে যায় নিমেষেই। যাইহোক যে আমাকে চায়না তার জীবনে জোর করে আমি জড়িয়ে যেতে পারব না। শুধু চাই সে যেন ভালো থাকে।’

আরহা এসবই ভাবছিল তখন আরহাদের পাশের বাড়ির একটি মেয়ে, যে এই স্কুলটিতে পড়ে সে এসে বলে,
‘আরহা আপু সবাই তো শহীদ মিনারে ফুল দিচ্ছে। তুমি দিবা না? চলো আমার সাথে। তুমিও ফুল দিবে।’

আরহা মৃদু হেসে মেয়েটির সাথে এগিয়ে যায় শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার উদ্দ্যেশ্যে। শহীদ মিনারে উঠে আরহা ফুল দেয় তখনই হঠাৎ সেখানে বিকট একটি শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। সবাই দূরে ছিটকে পড়ে।


মধুজা ও অক্ষর বিভিন্ন স্কুলে ঘুরছিল। সবখানে সবকিছু ঠিকঠাকই লাগছে। পুলিশও যথেষ্ট ভালো ভাবে পাহারা দিচ্ছে। এমন সময় মধুজা ফেসবুকে লগ ইন করামাত্র একটি নিউজ দেখে থমকে যায়। গুলশানের ঐদিকে একটি স্কুলের শহীদ মিনারে বাকি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেই স্কুলে পুলিশ পৌছানোর আগেই ঘটনাটি ঘটে গেছে।

সংবাদটি দেখে মধুজা বলে ওঠে,
‘ড্যাম ইট। এত চেষ্টা করেও আমরা পারলাম না।’

অক্ষর মধুজার মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘আমরা তো চেষ্টা করেছিলাম। এমনটা হওয়ারই ছিল তাই হয়েছে। তুমি আর মন খারাপ করো না।’

‘তুমি চলো। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি ঘটনাস্থলে যেতে চাই।’

অক্ষর প্রথমে রাজি না থাকলেও মধুজার জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। পুরো ঘটনাস্থলে সাংবাদিক,পুলিশ সহ সাধারণ মানুষের ঢল নেমেছে। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে মানষকে আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ভেতরে উদ্ধার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে ৪৯ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি সবার অবস্থা আশংকাজনক।

মধুজার খুব খারাপ লাগে এসব খবর শুনে। ভীড়ের মাঝে মধুজার চোখ যায় আমিনুল হকের দিকে। ভীষণ উদ্বীগ্ন লাগছিল তাকে। মধুজা আমিনুল হকের কাছে যায়। গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আপনি এখানে কি করছেন? এত চিন্তিত লাগছে কেন আপনাকে?’

আমিনুল হক কাদো কাদো গলায় বলেন,
‘আরহা আজ এসেছিল এই স্কুলে। আমার খুব টেনশন হচ্ছে। মেয়েটার কোন খবর পাচ্ছি না। আমার মেয়েটার কিছু হয়ে গেল না-তো?’

আরহার কথা শুনে মধুজাও বেশ চিন্তিত হয়। এরমাঝে পুলিশ একটি ডেড বডি বাইরে নিয়ে আসে। যার পুরো শরীরের অধিকাংশ ঝলসে গেছে। তার হাতে শুধু বিভিন্ন কালারের চুড়ি দেখা যাচ্ছে। চুড়িগুলো দেখে ডুকরে কেদে ওঠেন আমিনুল হক। বলেন,
‘এগুলা তো আজ সকালে আরহা পড়েছিল।’

আরহার ব্যাপারে এমন কথা শুনে মধুজাও কাদতে শুরু করে দেয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨