#পালাবদল
#পর্ব_২
দুটো গয়না সেনকাকুর দোকানে বন্ধক রেখে সুবর্ণা নতুন জীবন শুরু করে| সে আগেভাগেই জানত মা বাবার কাছে এতটা অঙ্ক নেই যা তাদের মা-ছেলেকে প্রতিপালনে সক্ষম| কাজেই সবার আগে অ
আর্থিক বন্দোবস্ত করতে হবে| বুদ্ধিটা অবশ্য সুবীর বাবুই দিয়েছিলেন| বাড়ি একটু ভাঙাচোরা হলেও অনেকে ভাড়া নিতে চায়, একতলার খানিকটা পোর্শন যদি একটু সারিয়ে সুরিয়ে ভাড়া দিয়ে দেয়, তাহলে মাসে মাসে বেশ কিছু টাকা হাতে আসতে পারে| তাহলে ভুটকুনের পড়াশোনার খরচ নিয়ে অন্ততঃ ভাবতে হবে না|
ওই গয়না দিয়ে হিসেবমতো যেটুকু টাকা পেল সেটা দিয়ে ঘরদোর খানিক সারিয়ে নিল| একটা ভাড়া বসিয়ে খানিক নিশ্চিত হল ছেলেটার ভবিষ্যত নিয়ে| ভুটকুনের স্কুলের ফিস, খাওয়া দাওয়ার খানিকটা অন্ততঃ কুলিয়ে নেওয়া যাবে|
কিন্তু এখানকার অতি সাধারণ জীবনযাত্রা মানতে পারে না ভুটকুন| তার পিজ্জা চাই, পাস্তা-চাউমিন চাই, মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি বাবা যেমন খাওয়াত, কিন্তু সবসময় সেগুলো জোগান দিতে পেরে ওঠে না সুবর্ণা| টাকাপয়সা কম, অধিকাংশ দিন কুঁচো মাছের তরকারি আর ডাল| সেটুকুই জোটানো দায় হয়ে যায় মাঝেমধ্যে! তখনই শুনতে হয় পচা মা, এসব খাবার কেউ খায়!সে চিকেন খাবে, বিরানি খাবে| খারাপ লাগে, বড্ড খারাপ লাগে, কিন্তু কি করবে সে? সুবর্ণার সেই আর্থিক বল কোথায়?
হঠাৎ একদিন ছেলেকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিল সে| পথে দেখা নম্রতার সঙ্গে| ঠিক দেখা বললে ভুল হবে বোধহয়, নম্রতাই তাকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে নেমে এল| তুই সুবর্ণা না? বাব্বা কতদিন বাদে দেখলাম তোকে! এতদিন কোথায় ছিলিস? এক শহরে থেকেও তোর দেখা পাই না তো?
সুবর্ণা তাকিয়ে ছিল নম্রতার দিকে, ফর্সা রঙ বরাবরই ছিল, এখন মাজা ঘষায় যথেষ্ট চকচকে| একটা অন্যরকম আত্মবিশ্বাস ছবি চেহারায়| সফলতার বোধহয় এমনই জ্যোতি থাকে| নিজেকে সামলে হাসল সুবর্ণা, দেখা করার চেষ্টা করেছিলি কোনদিন? কোনদিন খোঁজ নিয়েছিলি বন্ধুটা কেমন আছে?
আসলে কি বল তো, হঠাৎ এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম| তুইও তো আর কোন খোঁজখবর রাখিস নি| বিয়ে করে এতোদিনের বেস্টফ্রেন্ডকে একেবারে ভুলেই গেলি?
সুবর্ণাও হাসল, ওই যে বললি ব্যস্ততা| ওটাই আসল কথা|
সামনেই একটা নামী কোম্পানির পিজ্জা আউটলেট| নম্রতার জোরাজুরিতে ঢুকতেই হল তাদের| ছোট্ট ভুটকুন পিজ্জা পেয়ে ভারী খুশি| গম্ভীর মুখে ঘোষণা করল আমি একা একটা চিজ বাস্ট পিজ্জা খাব| তুমি খুব ভাল আন্টি| রোজ এখান দিয়ে যাওয়ার সময় মাকে বলি কিন্তু মা বড্ড দুষ্টু কিছুতেই কিনে দেয় না|
লজ্জায় মাথা নীচু করল সুবর্ণা| চেনা বন্ধুর সামনে বে আব্রু হওয়ার লজ্জা যে বড় বেশি, আসলে কি বল তো এগুলো বেশি খাওয়া তো বাচ্চাদের জন্য ভাল না| তাই এসব দিতে চাই না| ও তো ছোট মানুষ, ও কি আর নিজের ভালোমন্দ বোঝে? প্রথম থেকে আনহেলদি ইটিং হ্যাবিট বানালে পরবর্তীতে সমস্যা বাড়বে|
সুবর্ণাকে আপাদমস্তক দেখল নম্রতা| পরনে সস্তার শাড়ি, সস্তার লিপস্টিক| হাতের ব্যাগটাও ফুটপাত থেকে কেনা, আর্থিক অবস্থা যে যথেষ্ট খারাপ চেহারার হাল দেখেই বোঝা যাচ্ছে| গরীবরা নিজেদের এসব বুঝিয়েই সান্ত্বনা দেয় বটে| মুখে কিছু বলল না নম্রতা, ঘাড় নেড়ে কফিতে চুমুক দিল| তারপর বল? সংসার জীবন কেমন চলছে?
অর্ণব আর আমার সঙ্গে থাকে না রে| আমি এখন একঘেঁয়ে হয়ে গেছি| তাই নতুন মানুষ এসেছে জীবনে… না চাইতেও কেঁদে ফেলল সুবর্ণা, চুপ করে বসে থাকল নম্রতা| কাঁদুক একটু, কাঁদলে মন হাল্কা হয়| থেমে থেমে বলতে থাকে, অনেক চেষ্টা করেছিলাম জানিস, নিজের জন্য নয়, ভুটকুনের জন্য| কিন্তু যা ভেঙে গেছে, হাজার চেষ্টায়ও কি তাকে জোড়া লাগানো যায়!
নিজেকে সস্তা করলে এমনটা তো ঘটবেই| নিজের দাম তুই না দিলে কে দেবে বল? নিজের দাম জান, নিজেকে সময় দে| দেখবি বাকিরাও তোকে গুরুত্ব দেবে| তুই যে খেলাচ্ছলে গয়নার নকশা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতিস, এখনো করিস? নাকি সংসারের জাঁতাকলে পিষে…
ভাল বলেছিস সংসারের জাঁতাকল… সত্যি এখন আর ওসব ছেলেমানুষী করার সময় হয় না রে, মাথায় অনেক চাপ| মা বাবাকে দেখতে হবে, ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে| একটা কাজের বড্ড দরকার| টাকাপয়সার ছাড়া এখনকার দিনে কি কিছু হয় বল|
গয়নার ডিজাইন করবি? ইউনিক প্রফেশন| টাকাও আছে বেশ|ভেবে দেখতে পারিস|
আমার ডিজাইন করা গয়না কিনবে কে? কেন কিনবে? বাজারে হাজারো নামীদামী জুয়েলার্স রয়েছে| তাদের ছেড়ে আমাকে মানুষ পাত্তা দেবে কেন?
( চলবে,,,
©️ Monkemoner dakbakso – Anindita