#পাহাড়ের_কোল_ঘেঁষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১
“পাঁচদিনের পরিচয়ে কেউ চারটা বছর অপেক্ষা করে না। সে আর ফিরবে না। তুই তোর জীবন আবার নতুন করে শুরু কর।”
বান্ধবীর বলা কথাটায় পৃথার দৃষ্টি ঝাঁ’প’সা হয়ে এলো। সে ঝাঁ’প’সা দৃষ্টিতে মলিন হাসলো। ইরা আরো চেপে ধরা কণ্ঠে জানালো,
“তুইও জানিস তুই বৃথা আশা করছিস।”
পৃথার জবাব না পেয়ে সে আবারো বলে উঠল,
“প্রথম প্রথম তো ভাবতি সে এলো বলে! কিন্তু এভাবে চারটা বছর নষ্ট করলি বৃথা আশার জন্য।”
“নষ্ট কই করলাম! আমি তো ঠিকই এগিয়ে গেলাম। এই যে সেই স্নাতক শেষ করে ফেললাম!”
“এটাকে এগিয়ে যাওয়া বলে না। নিজের আসল সত্ত্বাকে তো হারিয়ে ফেলছিস।”
“কই হারালাম?”
“গুটিয়ে নিয়েছিস।”
“সে তো নিজের প্রয়োজনে।”
“আর আমাদের?”
“তোদের কী?”
“আমরা যে আমাদের হাসিখুশি সেই চঞ্চল অনুকে আর দেখিনি।”
পৃথা জবাব দিল না। ইরার একটা কথাও মিথ্যা নয় তাই সে জবাব খুঁজে পেল না।
“শোন,আর কোনো অপেক্ষা নয়। তুই এখনো জানিসই না যে ছেলেটা আছে কী নেই!”
পৃথা চমকে তাকালো চেঁচিয়ে উঠল,
“ইরা।”
পৃথার ঠোঁট কাঁপছে। ইরার এই কথাটা বলতে মুখেও আটকালো না!
ইরা নিজের মুখ সংবরণ করার চেষ্টায় বোঝানোর ভঙ্গিমায় বলল,
“না মানে এমনও তো হতে পারে যে ছেলেটা বিয়ে করে ফেলেছে। আর তার চেয়ে বড়ো কথা, সে কী তোকে আদৌ ভালোবাসতো? একটা চরিত্রের প্রেমে পড়েছিস। সেটার জন্য দীর্ঘ চারটা বছর কেউ অপেক্ষা করে না। এইবার বেরিয়ে আয়।”
“আমার পরিবার থেকে কে ফোন করেছে ?” পৃথার শান্ত কথায় ইরা নড়েচড়ে বসলো। সে এদিক ওদিক তাকালো। তার মানে অনু সব বুঝে গিয়েছে। তবু সে না বোঝার ভঙ্গিমায় শুধালো,
“মানে?”
“মানেটা তো তুইই জানিস। ”
ইরা চুপ রইল। সে বুঝতে পারলো আর কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই। সে বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে জানালো,
“ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালোই রে। সুন্দর।”
পৃথা চোখ ছোট করে তাকালো,
“বেশ ভালো?”
ইরা কাচুমাছু ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।
পৃথার দৃষ্টি বুঝতে পেরে সে উত্তেজিত হয়ে বোঝানোর ভঙ্গিমায় জানালো,
“এই না না, তুই যা ভাবছিস তা না। আমি শুধুই বোঝাতে চাইছি ভালো। তোর জন্য ভালো।”
“আমি এটা ভাবলাম তুই কেমনে বুঝলি?”
“তোর দৃষ্টি আর ইঙ্গিত সোজা লাগেনি আমার তাই।” ইরার সহজ সরল জবাবে পৃথা হাসলো।
“ছেলেটার খবর তোকে কে দিয়েছে?”
“আন্টি।” বলেই সে পৃথাকে জড়িয়ে নিয়ে শুধালো, “প্লিজ আন্টিকে কিছু বলিস না। উনি তো তোর ভালোর জন্যই বলেছে এসব। অনেক অপেক্ষা করে নিয়েছিস। এবার এর থেকে বেরিয়ে আসার পালা। বেরিয়ে আয়।”
পৃথা অদূরে দৃষ্টি দিল। ক্যাম্পাসের মাঝে সবুজ ঘাসের উপর এক কপোত কপোতী বসে আছে। দুজন গল্পের সাথে হাসাহাসি করে একজন আরেকজনের গায়ে গিয়ে পড়ছে। অন্যদের চোখে এটা মিষ্টি লাগলেও পৃথার কাছে ব্যাপারটা বেশ বি’শ্রী লাগলো। সে চোখ সরিয়ে নিল।
ইরা তাকিয়ে আছে পৃথার জবাবের অপেক্ষায়।
পৃথা ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে শুধালো,
“কাশ্মীর ট্যুরটা কবে রে?”
ইরা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো,
“তুই আবার সেই জায়গায় যাবি?”
“হ্যাঁ শেষবারের মতো।” বলেই পৃথা হাঁটা ধরলো। আর ইরা পিছু পিছু দৌড়ে পৃথার সাথে পা মিলালো।
——–
“আমি চলে যাবো কাল।” পৃথার কথায় যুবকটি ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“তো?”
পৃথার অভিমান হলো এমন প্রশ্নে। সে অভিমান দূরে রেখে শুধালো,
“আপনি এখানে আরো থাকবেন তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার নাম্বারটা দিবেন?”
“নাম্বার কেন?”
লোকটির এহেন প্রশ্নে পৃথা আ’ঘা’ত পেল। তবু সে নিজের খারাপ লাগাটাকে দূরে রেখে শুধালো,
“আমি চলে যাবো। যোগাযোগ করার আর কোনো উপায় তো নেই।”
“ভালোভাবে পড়াশোনা করো আগে।”
“তাই বলে যোগাযোগ হবে না?” পৃথার কথায় যুবকটি তাকালো। এরপর খুব শান্ত স্বরে জানালো,
“আমাদের এখনো সেই পরিচয় হয়নি।”
“পরিচয় নাহলে আমাকে রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসলেন কেন?”
“ভদ্রতার খাতিরে।”
“শুধুই ভদ্রতা? আমার জন্য আপনার চিন্তা হয়নি? তাই তো এগিয়ে দিতে এসেছেন।”
“চিন্তা করার মতো সেই সম্পর্ক হয়নি এখনো।”
“আপনার তরফ থেকে না হলেও আমার তরফ থেকে তো হয়েছে।” পৃথার বিড়বিড় করে বলা কথাটাতে যুবকটি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো,
“কী বলছো?”
“কিছু না।”
“এখন রুমে ফিরে যাও।”
“কিন্তু…”
“কাল ৬টায় এই জায়গাটাতে এসো।”
পৃথা কিছু একটা বুঝতে পেরে উৎফুল্ল কণ্ঠে জানালো,
“আমি অপেক্ষা করতে পারবো না। এখুনি বলুন।”
“কাংক্ষিত সময়ের জন্য মাঝে মাঝে অপেক্ষা করা ভালো।”
“আমার এতো ধৈর্য্য নেই বাপু।”
“তাহলে অধর্য্যে হয়ে থাকুন।” বলেই যুবকটি পা বাড়ালো।
পৃথা দৌড়ে এগিয়ে গেল।
“এই যে কই যাচ্ছেন?”
“সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রুমে ফিরে যাও।”
“কিন্তু ওই কথাটা!কী জানি বলবেন বলেছিলেন!”
পৃথার কথায় যুবকটি জবাব দিল,
“কাল সকালে।”
পৃথা অভিমানী হয়ে মাথা নিচু করে নিয়ে শুধালো,
“এখন বলবেন না?”
সে জবাবের আশায় দীর্ঘক্ষন মাথা নুইয়ে রাখলো। বিপরীত দিক থেকে কোনো জবাব না পেয়ে সে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো যুবকটি অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছে।
পৃথার মুখভঙ্গিমা বদলে গেল। লোকটির এমন নিরুত্তাপ গা ছাড়া ভাব পৃথার পছন্দ হলেও এই মাঝে মাঝে বি’র’ক্ত লাগে। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পৃথার আশা ছিল যুবকটি পেছনে ফিরে তার দিকে তাকাবে। তাকিয়ে একটা হাসি দিবে। কিন্তু না।
আঁধারের সাথে মিলিয়ে গেল।
পৃথার এখন কাল সকালের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে গো’ম’ড়া মুখে পিছু ফিরে হোটেলের ভেতরে পা বাড়ালো।
কিন্তু সে বোধহয় পেছনে ফিরে তাকালে অন্য কিছু দেখতো। যেটা তার খুশির কারণ হতো। মুহূর্তের মধ্যে উৎফুল্ল করে তুলতো!
.
.
“পৃথা ”
কানের পাশে কারো চেঁ’চা’নো কণ্ঠস্বর পেতেই পৃথার ধ্যান মগ্ন হলো। সে পাশ ফিরে তাকাতেই মাকে দেখতে পেল।
মেয়ের তাকানো দেখে আসমা শেখ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।এতক্ষন ধরে ডাকার পরে মেয়ের হুঁশ ফিরলো বলে! মেয়েটার ইদানিং এতো এতো বাজে অভ্যাস হয়েছে যে তিনি আর পেরে উঠেন না!
“কিরে?”
“ডাকছো কেন এভাবে?”
“তাহলে শুনেও সাড়া দিচ্ছিলি না তুই?”
পৃথা কিছু না বলে সামনে তাকালো। মাকে এখন কিছু বলতে গেলেই উল্টো বুঝবে।
“আহাদ এসেছে। তোকে বাইরে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।”
মায়ের কথায় পৃথা ফিরে তাকালো।
“কই ও?”
“নিচে চল। তারপর দেখবি।”
“ও যখন তখন এখানে কেন আসে মা?”
মেয়ের কথায় আসমা শেখ ফিরে তাকিয়ে রা’গী স্বরে জানালেন,
“ওমা, বিয়ে ঠিক হয়েছে। আসলে দোষের কিছু তো না। আর ও তো সবসময় আসে না। এতো ল’ক্ষী ছেলেকে এভাবে অ’প’মা’ন কেন করছিস?
“হ্যাঁ ওতো ল’ক্ষী’ই। এখানে কেন এসেছে?”
মেয়ের কথায় আসমা শেখ রে’গে শুধালেন,
“এটা কোন ধরণের কথা পৃথা?”
“আহঃ বলো না।”
“তোর বাবার থেকে অনুমতি নিতে আসছে। তোকে নিয়ে বাইরে যাবে।”
“আর আমি?”
“তুই মানে?”
“আমাকে নিয়ে বাইরে যাবে। অনুমতি নিতে আসছে। আর আমার মতামত জানতে চায়নি? আমার মত আছে কিনা সেটা জানা জরুরী।”
“বিয়ে ঠিক করা মেয়ের সাথে সময় কাটাবে। এখানে এতো মতামত নেয়ার কী আছে? আর আমি এতো কথা বুঝি না। ইদানিং বেশি খি’ট’খি’টে হয়ে যাচ্ছিস তুই। যা গিয়ে দেখা কর।”
পৃথার রা’গ হলো। সে জানে এখানে রা’গা’র কিছু না এবং মাও ভুল কিছু বলেনি কিন্তু তবু তার সব রা’গ যেন উপচে পড়ছে আহাদের উপর। সে রা’গ সংবরণ করার চেষ্টায় জানালো,
“পারবো না আমি।”
“তুই ওকে দেখে নামছিলি না তাই তো?”
পৃথা মিথ্যা কথা বলতে পারে না। সে জবাব না দিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। আর আসমা শেখ মেয়ের জবাব বুঝে নিলেন। মেয়ে তার সত্যি কথা বললে জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ মনে করে না।
পৃথা শুরুতেই আহাদের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেছিল তাই আর ছাদ থেকে নামেনি। বড়োলোকের ছেলে। এরকম ছেলে পৃথার কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। তার উপর সে চারবছর আগের সময়টাতে আটকে আছে! তার প্রথম প্রেম! সব ভালোবাসা যে সেই গম্ভীর চরিত্রের উপরই! তার সাথে পরিচয় হওয়ার পরে তো ভুলেও আর কারোর উপর পৃথার মন পড়েনি।
সেই চারবছর আগের পরিচয়হীন মানুষটার সাথে তুলনা আসতেই পৃথা হাসলো। কিসের কথা ভাবছে সে! মাত্র ৫দিনের পরিচয়! এটা কে কী আদৌ পরিচয় বলে! কিন্তু না বললেও বলতে তো হবেই। অন্তত পৃথার নিজের জন্য। সে নিজেকে না দেখলে হয়ত কখনো জানতেই পারতো না যে মাত্র ৫দিনের পরিচয়ের একটা মানুষ এতটা আপন হওয়া যায়?
#চলবে ইন শা আল্লাহ।