#পাহাড়ের_কোল_ঘেঁষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৩
কাশ্মীর। প্রকৃতির এক অনন্য সুন্দরের অধিকারী। কাশ্মীর দেখলেই মনে হয়, জায়গাটাকে প্রকৃতি তার নিজে হাতে সুনিপুন ভাবে তৈরী করেছে।
পাহাড়ের সাথে সাথে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি চিনার গাছ। লাল হলুদ রঙের মিশ্রিত এই অনন্য গাছগুলো যেন কাশ্মীরের আলাদা এক সৌন্দর্য বহন করে। গাছগুলো সবসময় এই রঙের থাকে না। ঋতু ভেদে তার অপরূপ সৌন্দর্যের রূপ ধরা দেয়। পৃথা যতবারই আসে ততবারই এই অপরূপ জায়গাটাতে মোহিত হয়ে তাকায়। বিশেষ করে এই গাছগুলো। একেকবার একেক সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলে। পৃথা প্রথমদিকে এই গাছগুলো চিনতো না। প্রথমবার সে নামই জানতো না। তার মনে হয়েছিল, সে কোনোদিন এমন গাছ দেখেনি। দেখবেইবা কোথ থেকে! এই গাছ তো শুধু কাশ্মীরেই জন্মায়। সে না চিনে তাকিয়ে থাকতো। তখন ওই সীমিত পরিচয়ের লোকটিই তাকে চিনিয়েছিল। সাথে খুব অভিজ্ঞতার সহিত জানিয়েছিল যে,ঋতু ভেদে এই গাছের রং পরিবর্তন হয়। একেক ঋতুতে একেক সৌন্দর্য নিয়ে চলা ফেরা করে গাছগুলো। কুয়াশা ঠান্ডার ভিড়ে এই গাছগুলোও কাশ্মীরের পর্যটকদের এক অন্যরকম আকর্ষণ।
পৃথা তখন গাছগুলোর সাথে সাথে মানুষটির দিকেও মোহিত হয়ে তাকাতো।
সব মনে আসতেই পৃথা নিভৃতে তপ্ত শ্বাস ফেলল। সে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে একদম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়ালো। সারি সারি পাইন দেবদারু গাছের সাথে সারিবদ্ধ ঘন সবুজ বন। আর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে চিনার গাছ। যেন সব গাছ গুলো একসাথে মিলে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকদের স্বাগত জানাচ্ছে! এই ফুলেল চিরসবুজ তৃণভূমি পৃথার মন বারবার কেড়ে নেয়।
আশ্চর্যের বিষয়, এই কাশ্মীরের প্রথম সব স্মৃতি ওই মানুষটিকে ঘিরেই। লোকটি পাঁচদিনেই যেন সারাবছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে গিয়েছিল। নিজের হাতে একটা অচেনা মেয়েকে আপন করে সব শিখিয়ে দিয়েছিল। পৃথা যেন সব অভিজ্ঞতা ওই মানুষটির কাছ থেকেই পেয়েছিল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিনার গাছগুলোর দিকে দৃষ্টি দিল। সেই চারবছর আগের মতোই এখনের রং। মানে সময়টা একই ঋতু। মাঝখানে একেকবার একেক ঋতুতে আসাতে এগুলোর রং ভিন্ন ভিন্ন দেখেছিল। আর এইবার সবকিছু সেইবারের মতোই মিল। সেই হোটেল রুম, সেই গাছ সবকিছু যেন চারবছর আগের মতোই মিলে গেল।
পৃথাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে সামনে দাঁড়ালেই কাশ্মীরের কিছুটা অপরূপ সৌন্দর্য চোখে পড়ে। পাহাড় অর্ধেকে কে’টে’ই এই হোটেলটা নির্মিত। হোটেলটা বেশ বড়ো হওয়াতেও এজন্যই প্রতিবার রুম পেতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়। পৃথা এগিয়ে গেল পাহাড়ের একদম শেষ প্রান্তে। যেন আরেকটু এগিয়ে গেলেই ঝুপ করে পড়ে যাবে। আর মিলিয়ে যাবে পাহাড়ের মাঝে। এই ভয়ে হোটেল কতৃপক্ষ রেলিং দিয়ে দিয়েছে। পৃথা একদম রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। এরপর থেকে সারি সারি পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। যেন পাহাড়গুলো পৃথাকেই ইশারা করে ডাকছে।
আশেপাশে সব পর্যটক। সবাই হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে এই প্রান্তে আসে উপভোগ করতে। পৃথা তাকালো। সবার চোখেই তৃপ্তির উচ্ছাস। যেন বহুদিনের জমানো আকাঙ্খা পূরণ হচ্ছে! এই থেকেই শুরু এরপর যার যার গন্তব্যস্থল একেক ভ্রমণ জায়গায়।
সেই ভিড়ের অদূরেই এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আর কোলে থাকা বাচ্চাকে বোঝাচ্ছে। ঠিক পৃথার ভাবনার মতো করেই বাচ্চা ছেলেটাকে চিনার গাছ সম্পর্কে বলছে। যেন সেই অভিজ্ঞতার মতো করেই হাতে কলমে শিখিয়ে দিচ্ছে! পৃথা যেন দেখেও দেখলো না। আর সেই যুবকটিও না।
যুবকটি বাচ্চা ছেলেটাকে বলতে বলতে চোখে যেন নিজের আগের স্মৃতি ভেসে উঠল। ঠিক এমন করেই তো চারবছর আগে কেউ একজনকে বলেছিল। এবং সে খুব মনোযোগের সহিত এসব শুনেছিল।
.
.
“ঠান্ডা লাগলে ভেতরে যাও। এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
“ভাবতে হবে না আমারটা।” পৃথার কথায় যুবকটি কোনো প্রতিত্তর করলো না। পৃথা চোখ সরিয়ে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“আমি চলে গেলে আর হয়ত কোনোদিন যোগাযোগ হবে না।” পৃথা ইমোশনাল করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে কথাটা বললো। সে দেখতে চেয়েছিল লোকটির মনে তার জন্য কী আছে! সে কাঙ্খিত উত্তরের আশায় যুবকটির পানে তাকালো।
“আমি প্রতিবছরই এখানে আসি।”
যুবকটির এহেন জবাবে পৃথার রা’গ হলো। সে বেশ শক্ত কণ্ঠে শুধালো,
“এখন আপনার জন্য দেখা করতে প্রতিবছর আমাকে এখানে আসা লাগবে? এই যুগে এসে এমন?”
“সেটা তোমার ব্যাপার।”যুবকটি থেমে আবার শুধালো,
“রুমে ফিরে যাও। ঠান্ডা পড়ছে।”
“ভাবতে হবে না আমারটা। নিজেরটা নিজে ভাবুন।” বলেই পৃথা চলে আসতে গিয়েই থেমে গেল। সে ভেবেছিল লোকটি তাকে পিছু ডাকবে কিন্তু না। সে আবার ফিরে এসে লোকটির উদ্দেশ্যে শুধালো,
“আপনি এমন কেন?”
“যেমন?”
“এই যে এমন দায়সারা ভাব!মনে হয় কোনো ক’ষ্ট আপনাকে ছুঁয়ে দেয় না।” বলেই পৃথা পিছু ফিরে দৌড়ে জায়গা প্রস্থান করলো।
লোকটি পেছন ফিরে তাকালো। সেই চঞ্চল মেয়েটির গো’ম’ড়া চেহারা দেখে তার ঠোঁটের কোনায় হাল্কা প্রসারিত হলো।
.
.
সব তাজা স্মৃতি। এই জায়গায় আসলে সব স্মৃতি যেন হানা দেয় পৃথাকে। এলোমেলো হাওয়া বইছে। ঠান্ডায় পৃথার শিরশিরে অনুভূতি হতেই সে গায়ে ভালোমতো চাঁদর মুড়িয়ে নিল। পরম আবেশে সে চোখ বন্ধ করে নিল। এই বাতাস তাকে এতো কেন শান্তি দেয়!
ইরা হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখলো, পৃথা একদম শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
ইরা ফোন নিয়ে এগিয়ে গেল । সে বুঝতে পারছে না যাবে কিনা! কিন্তু তাকে পাঠিয়েছে পৃথাকে দেখে রাখতে আবার এদিকে সেই পৃথাই জানিয়েছে তাকে যেন কোনো ফোন দেওয়া না হয়। এই কয়দিন শেষবারের মতো সে নিজের মতো করে কাটাবে।
ইরা দীর্ঘক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে ফোন নিয়ে এগিয়ে গেলেও মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে তা আর পারলো না। পৃথাকে তার আর ডাকতে ইচ্ছে হলো না। সে হাতে থাকা মোবাইলটা নিয়ে পেছনে সরে আসলো।
“আপনাকে আমি জানিয়ে দিবো। ও এখন ওয়াশরুমে।”
ইরার কথা শুনে বিপরীত পাশের লোকটি প্রতিত্তর করলো,
“এখনই না বললে ও বাইরে গিয়েছে?”
“হ্যাঁ কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। আসলে সে গোসলে গিয়েছে।”
“ইরা?”
ইরা ছোট করে জবাব দিল। এমন সুন্দর করে কেউ তাকে ডাকেনি।
“জি বলুন।”
“তুমি সত্যি কথা বলছো তো?”
“হ্যাঁ।”
“না কি তোমার বান্ধবী আমার সাথে কথা বলতে চাইছে না?”
“না তা কেন হবে!”
“আমি কী জানি!” বলেই সে ফোন রেখে দিল। আর ইরা এক তপ্ত শ্বাস ফেলল। লোকটির জন্য মায়া হচ্ছে। কিন্তু সেওবা কী করবে! পৃথার কাছে এখন ফোন নিয়ে গেলে ও নির্ঘাত রেগে যেত। আর ইরার নিজেরও ইচ্ছে হয়নি, এমন ভাবনায় বিভোর পৃথাকে বিরক্ত করতে! মেয়েটা এখানে আসলেই আগের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। ইরা বুঝে উঠে পায় না, একটা আপন মানুষ হারালেও তো মানুষ এতদিনে ভুলে যায়। সেখানে পৃথা সামান্য পরিচয়ের একজনকে এতগুলো বছর সযত্নে রেখে দিয়েছে মনের মাঝে! ইরা হেসে আপনমনেই আওড়ালো, “ভালোবাসা বড়োই অদ্ভুত! এর মহার্থ যে বাসে শুধু সেই জানে। বাইরের আর কেউই উপলব্ধিও করতে পারে না।”
#চলবে ইন শা আল্লাহ।