#পাহাড়ের_কোল_ঘেঁষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৫(অন্তিম পর্ব)
পৃথা এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না। সে দৌড়ে জায়গা প্রস্থান করলো। পিছন থেকে সাফাদ অনবরত ডেকেই চলেছে। কিন্তু পৃথা কোনো জবাব দিল না। তার এখন শক্ত হওয়ার প্রয়োজন। আশা ছিল দেখা হওয়ার, কিন্তু এমন নিষিদ্ধ আর মনের বিরুদ্ধে দেখা তো সে চায়নি!
পৃথা এগিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ধুপ করে বসে পড়লো। সে কান্নায় ভেঙে পড়লো। ওখানে থাকলে নিশ্চিত কান্না চলে আসতো যেটা সে চায়নি। কারোর হাসির পাত্র সে হবে না।
তার এখনো মনে পরে সেই শেষদিনের স্মৃতিগুলো। পৃথার চোখে সেই দিনের স্মৃতি ফুটে উঠলো। সাফাদ যখন সকালে তাকে বিদায় দিতে আসবে বলেছিল তখন সে কী খুশি! পৃথার খুশি আটকায় কে! সেদিন উ’ত্তে’জনায় সারাটা রাত ঘুম হয়নি। এই পিঠ ওই পিঠ করে রাত পেরিয়ে গেল। ভোর না ফুটতেই সে উঠে গেল।
এক মগ কফি নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। কফি তার কোনোকালেই ভালো লাগতো না কিন্তু সাফাদকে একদিন খেতে দেখেছিল। এরপর থেকে সে সেই অপছন্দের জিনিস নিজের পছন্দ করে অভ্যাসে পরিণত করেছে। তাই সে হাজার বিদঘুটে লাগলেও সে খেয়ে নিল। আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল এই যে, যেভাবে মাত্র পাঁচদিনে সে তার অপছন্দের জিনিসটাকে পছন্দ করে নিয়েছিল ঠিক সেইভাবে মানুষটিও তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
চারদিকে আলো ফুটতেই পৃথা তার সবচেয়ে পছন্দের জামাটা পড়ে নিল। চুলগুলো খোলা রেখে বারবার আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। দেখা শেষ হতেই সে সাফাদের বলা সময়ের এক ঘন্টা আগে বেরিয়ে পড়লো। এরপর হোটেলের সামনের সেই বিস্তীর্ণ জায়গাটার শেষপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালো। কথা ছিল একসাথে সূর্যোদয় দেখবে কিন্তু না, সেদিন সাফাদ আর আসলো না। পৃথা ভাবলো, সাফাদের রুমে গিয়ে দেখবে। কিন্তু কী বুঝে সে আর গেল না।
পৃথা অপেক্ষা করলো। সে নিজের মনেই উত্তর খুঁজে নিল,হয়ত ঘুম থেকে উঠতে দেরি করছে। চারদিকে কোলাহল বাড়তে লাগলো। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা থেকে নয়টা ছুঁতেই তার টনক নড়লো। পৃথাদের চলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। সবাই হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছে কিন্তু সাফাদ!
সত্যিই সেদিন সে আর এলো না।
পৃথা সাফাদের হোটেলে গিয়ে দেখলো। সাফাদের রুমে তালা মারা। তখনও তার অন্যকিছু মাথায় এলো না। সে রিসিপসনিস্ট এর কাছে গেল। তিনি জানালেন, সাফাদ ভোরেই হোটেল থেকে চলে গেছে। পৃথার মস্তিষ্ক থেমে গেল। বাস ছেড়ে দিবে। বারবার সবাই ডাকছে। সে যন্ত্রের ন্যায় হেঁটে বাসে উঠে পড়লো।
সাফাদ কোথায় থাকে সেটাও পৃথার আর জানা হলো না। শুধু একটাই জানতো যে সাফাদ প্রতিবছর এখানে আসে। তাই তো সব দিন দুনিয়া ভুলে পৃথা এখানে আসতো। কিন্তু না। তাও এলো না সে। শেষ দেখাটাও হলো না। পৃথার প্রশ্ন ছিল, কেন করলো সে এমন!
প্রথম অনুভূতি সে ওখানেই ধা’মা’চা’পা দিল। তবু মনের কোথাও তার এখনো অপেক্ষা রয়ে গিয়েছিল! কিসের অপেক্ষা সে জানে না। মাঝখানে চারটা বছর কেটে যাওয়ার পরেও তার আশা রয়ে গিয়েছিল।
পৃথা হাসলো নিজের ভাবনার জন্য। স্মৃতিগুলোকে এখনো তাজা রাখার জন্য তার কষ্ট হলো।
——
“আরে ইয়ার, তুই এভাবে করে তখন চলে এলি। সবাই তাকিয়ে ছিল।”
ইরার কথায় পৃথা কোনো জবাব দিল না। সে আপন ভাবনায় মশগুল। তার আফসোস হচ্ছে, কার জন্য সে অপেক্ষা করেছিল! নিজের জন্য তার দুঃখ হচ্ছে।
“তোর জন্য একজন এসেছে।” ইরার কথায় পৃথা তাকালো।
তার চোখ গেল ইরার পেছনে লুকিয়ে থাকা বাচ্চাটির দিকে। বাচ্চাটি তারই দিকে তাকিয়ে আছে। তার নিষ্পাপ চাহনি দেখে পৃথার মায়া হলো। সে অবজ্ঞা করতে পারলো না। । পৃথা রাগ হওয়া সত্ত্বেও বাচ্চাটিকে কাছে ডাকলো।
বাচ্চাটি এক পা দুপা করে এগিয়ে এলো।
সে আদৌ আদৌ বুলি আওড়ালো,
“তুমি কান্না করছো কেন?”
“কই!”
বাচ্চাটি পৃথার গালে হাত রেখে চোখ মুছে দিয়ে জানালো,
“এইতো পানি।”
বাচ্চাটির এমন আদরমাখা কাজে পৃথা হাসলো। এই জল তো তার বাবার জন্যই এসেছিলো। মুছার কথা ছিল তার। অথচ!
পৃথা বাচ্চাটিকে কোলের উপর বসালো।
“আচ্ছা মামী তোমার কী হয়েছে? তুমি কিসে কষ্ট পেয়েছো?”
পৃথা চমকালো।
“মামী?”
“হ্যাঁ। আমার মামীই তো।”
পৃথা ইরার দিকে তাকালো। ইরা এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝানোর চেষ্ঠা করলো সে কিছু জানে না। পৃথা মাথা ঘামালো না। বাচ্চারা হলো ফুলের মতো। নরম মাটি। ওদের যখন যেটা ইচ্ছে হয় তখন সেটাই ডেকে ফেলে। পৃথা ইরাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
“ও এখানে কেন? তুই এনেছিস?”
ইরা না বোধক মাথা নাড়লো।
“তো?”
“আমাকে মামা এনেছেন।”
বাচ্চাটি নিজে থেকেই বলে উঠল। আকারে ইঙ্গিতের কথাও বাচ্চাটি খুব সহজে বুঝে নিল। পৃথা তাকালো। স্মার্ট বাচ্চা। কেউ আড়ালে কোনো ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলতে পারবে না।
পৃথা নাক টেনে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার মামা কে?”
“আমি।”
বলেই সাফাদ এগিয়ে এলো। সাফাদকে এগিয়ে আসতে দেখে পৃথা মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিল। সে ইরার উদ্দেশ্যে বলল,
“উনি এখানে কী করছে! চলে যেতে বল।”
“চলে যাওয়ার জন্য তো আসিনি।”
“কেন এসেছে!”
“আমার বাবাইকে নিতে এসেছি।” বলেই সাফওয়াজের হাত ধরলো। কিন্তু সে এলো না। আদৌ আদৌ বুলি ছাড়লো,
“আমি মামীর সাথে থাকবো। কখন নিয়ে যাবে মামীকে?”
পৃথা এবার দ্বিতীয়বারের মতো চমকালো। এই কী বলছে!
সাফাদ পৃথার কাছে এগিয়ে এলো। সে তার থেকে একটু দুরুত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে শুধালো,
“মুদ্রার এপিঠ দেখেছো আর ওই পিঠ দেখবে না?”
পৃথা চোখ সরিয়ে নিল।
সাফাদ বলতে শুরু করলো,
“যেদিন আমার দেখা করার দিন ছিল,সেদিন খুব সকালে আমার বোনের স্বামী মা’রা যায়। আমার আপন বলতে তখন একটা ছোট বোনই ছিল। নিজের হাতে মানুষ করে ভালোবাসার মানুষের কাছে তুলে দিয়েছিলাম কিন্তু পারলাম না। গ’র্ভ’বতী অবস্থায় স্বামীর লা’শ দেখতে হলো। হুট্ করেই দু’র্ঘ’টনা ঘটে যায়। তখন আমার মাথা থেকে সবকিছু বেরিয়ে গিয়েছিল। শুধু বোনকে আগলে রাখার কথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কাউকে বলার সুযোগটুকুও ছিল না। আর মাথায়ও ছিল না। আমার ভুল হয়েছিল সেদিন। কিন্তু
বোনের অবস্থা খারাপ শুনে উদভ্রান্তের ন্যায় চলে গিয়েছিলাম। বোনের মানসিক অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তার বলেছিল, এরকম চলতে থাকলে বোনের সাথে সাথে তার বাচ্চাকেও হারাতে হবে। এরপর একদিকে দুলাভাইয়ের ব্যবসা অন্যদিকে বোনকে সামলানো। সব দিক দিয়ে সে এক অন্য সাফাদ। ব্যস্ততায় দিন গেলেও রাতে মনে পড়তো তোমার কথা। সেইবারই একদিন সময় করে এসেছিলাম। কিন্তু শুনেছি, পৃথা নামের কেউ এরপরে আর আসেনি। অনেক খোঁজ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।আর পরেরবার থেকে অনেকবার কাশ্মীর আসতে চেয়েও ব্যস্ততার জন্য পেরে উঠেনি। তাই বলে তুমি মোটেও হারিয়ে যাওনি। রয়ে গিয়েছিলে আমার মনে।”
সাফাদ এগিয়ে এসে পৃথার হাত ধরতেই পৃথা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে হাত সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো না। এই দিনটার জন্য সে কতই না অপেক্ষা করেছিল! কিন্তু পরমুহূর্তে নিজের ভাবনার জন্য সে লজ্জিত হলো।
সাফাত পৃথাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
“চারবছর অপেক্ষা করতে পারলে আর চারটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারলে না?”
সাফাদ কিছুসময় থেমে আবার শুধালো,
“এবার অপেক্ষার অবসান হওয়ার পালা। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আমাদের অনুভূতি হয়েছিল, পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই নাহয় এর সুন্দর সমাপ্তি হোক।”
পৃথা ঝাঁপসা চোখে হাসলো। অবশেষে তার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো বলে!
#সমাপ্ত।