#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৩৮(অন্তিম পর্ব)
“জাগ্রতকে নিয়ে বলা একটা কথাও যদি কোনভাবে মিথ্যে প্রমাণিত হয় তাহলে কিন্তু যেই কাজের অভিযোগে ওকে অভিযুক্ত করছেন সেই কাজটা আমিও করতে পারি। মানে খু ন। কাকে করবো বুঝতে পারছেন তো? অভিযোগকারীকে!”
গম্ভীর, দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো ফাল্গুনী কথাগুলো। আয়েশা মোটেও বিরক্ত হলো না। মুচকি হেসে বলল,
“তোমার জায়গায় আমি থাকলে হয়তো আরও বেশি রিয়েক্ট করতাম। তবে তুমি যেমনটা ভাবছ বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। পুরো কথাটা শোন। তাহলে বুঝতে পারবে। আর রিপোর্টের কথা বললাম না? সেটা জাগ্রতর রিপোর্টের কথাই বলেছি। অসুস্থ তোমার শ্বাশুড়ী না থাকলেও জাগ্রত ছিল। পুরো একবছর মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। একটা সময় তো তার পাগলামির জন্য আঁটকে বেঁধেও রাখতে হয়েছে তাকে।”
ফাল্গুনী চমকে উঠলো কথাটা শুনে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আয়েশার দিকে। আয়েশা ছটফটে গলায় বলল,
“আমি না ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না। কোথা থেকে যে শুরু করব গুলিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা তোমার শ্বাশুড়ীর মৃ ত্যু থেকেই বলছি। না তোমাদের বিচ্ছেদ থেকেই বলছি শোন। তোমার শ্বাশুড়ী নাকি তোমাদের বিচ্ছেদের পর থেকে নিজের পছন্দের পাত্রীর সঙ্গে জাগ্রতর বিয়ে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত তাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করছিল জাগ্রতর সঙ্গে। মায়ের অসুস্থতার কথা ভেবে সরাসরি তেমন কিছু বলতেও পারছিল না আবার অন্যদিকে হন্যে হয়ে খোঁজ করে যাচ্ছিল তোমার। একদিকে তোমাকে না পেয়ে অপরাধবোধে বিদ্ধ হতে হতে পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল; অপরদিকে তোমার শ্বাশুড়ী তার মানসিক অসুস্থতার দোহাই থেকে জাগ্রতকে দিয়ে যাচ্ছিল সকল দিক থেকে চাপ। উঠতে বসতে সব মিলিয়ে জাগ্রত ডিপ্রেশনে ভুগছিল ভীষণ। জাগ্রতকে তার মামা-ও অনেক সাহায্য করেছে তোমাকে খোঁজার কাজে। তার বোনকেও বোঝানোর চেষ্টা করেছে ভাগ্নের হয়ে। আর সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল জাগ্রত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাই আমার স্বামীর কাছে নিয়ে যায় জাগ্রতকে। দুজনে অনেক আগে থেকেই ভাল বন্ধু যে ছিল। আর তোমার শ্বাশুড়ীকে আমার স্বামী চিকিৎসা করতো না। তার ডাক্তার ছিল অন্যকেউ। আমার স্বামী ছিল জাগ্রতর চিকিৎসক। আর জাগ্রতর অবস্থা দিনকে দিন খুব খারাপ হচ্ছিল। একসময় তাকে আর বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না, ভর্তি-ই করাতে হয়। তখন তোমার শ্বাশুড়ী ও আসতো হসপিটালে। তখন আমার স্বামী তার অভিজ্ঞ চোখে পর্যবেক্ষণ করতো তাকে রোজ। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে তোমার শ্বাশুড়ী অসুস্থ নয় অসুস্থতার নাটক করছে। একদিন তোমার শ্বাশুড়ীকে সরাসরি বলে বসে এই কথা। তা শুনে বেশ ঘাবড়ায় তিনি। তারপর টাকা দিতে চায় আমার স্বামীকে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল ও করে। কিন্তু আমার স্বামী সোজা গিয়ে বলে দেয় জাগ্রতর মামাকে। আর তখন শুনে ফেলে জাগ্রত। জাগ্রতকে খোলা পরিবেশে নিয়ে বের হয়েছিলেন তিনি হসপিটালের ছাঁদে। আমার স্বামী জাগ্রতকে খেয়াল না করেই এক কথায় তোমার শ্বাশুড়ীর কথা বলে বসে। যা শুনে নেয় জাগ্রত। সেই মুহূর্তে জাগ্রত হাইপার হয়ে পড়ে। আর তার মা ও সেই মুহুর্তে চলে আসে সেখানে। মায়ের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগে তৎক্ষনাৎ তুমুলভাবে। এমনিতেই সর্বদা তোমার নাম নিয়ে কথা বলত তখন আরও বেশি করে তোমার নাম নিয়ে পাগলামি করতে থাকে। বারবার বলে তোমাকে সে মায়ের জন্যই হারিয়ে ফেলেছে। যদি মিথ্যে অসুস্থতার নাটক না করতো তবে ধরে রাখতে পারতো সে তোমায়। এমন হাজারও কথা বলতে থাকে চিৎকার করে। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে জাগ্রত তার মায়ের হাত ধরে নিয়ে নিচে নামার জন্য ফোর্স করে তোমায় খুঁজে এনে দিতে। জোরাজোরি হয় কিছুটা। তিনি তাল ধরে রাখতে পারেন নি, পড়ে গেছিলেন ছাঁদ থেকে বিল্ডিংয়ের পিছনের ঝোঁপে। প্রাণ হারিয়েছিলেন তখনই। স্পট ডেথ। তা দেখে জাগ্রত তৎক্ষনাৎ জ্ঞান হারায়। জাগ্রতর মামা কাউকে জানতে দেননি উনি ছাঁদ থেকে পড়ে মারা গেছেন আর ফেলেছে স্বয়ং জাগ্রত। আমার স্বামীর সাহায্যে ওনার অসুস্থতার জের ধরে বিষয়টাকে উপস্থাপন করেছে যে অসুস্থতা থেকে হাইপার হয়ে পরে গেছিল সিঁড়ি থেকে। তখন জাগ্রতর মামা তাকে র ক্তা ক্ত অবস্থায় এনে ভর্তি করান হসপিটালে কিন্তু অতিরিক্ত র ক্ত ক্ষ র ণ আর ব্রেইন স্ট্রোক করে কিছুক্ষণ পরই মারা যান। আর এই সবটা মিথ্যেকে সত্যি করে উপস্থাপন করতে সম্ভব করেছে আমার স্বামী। সবাই বিশ্বাস ও করে নেয়। জাগ্রতর অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ায় কেউ আর ওনার মৃ ত্যু নিয়ে বেশি মাথায় ঘামায় না তখন। তবে জাগ্রত এসবের কিছুতেই আর ছিল না। অনেক বেশি অসুস্থ ছিল পরবর্তী দুই মাস। কখনো কখনো আঁটকে বেঁধে রাখতে হতো। তারপর ধীরে ধীরে চিকিৎসার সুফল আসতে শুরু করে। সুস্থ হতে থাকে সে। সব মিলিয়ে দীর্ঘ একবছরের অসুস্থতা থেকে মুক্তি মেলে। কিন্তু সেই একবছরের সমস্ত কিছু সুস্থ হওয়ার পর জাগ্রত ভুলে গেছিল। প্রথম দুই একমাসের কিছু কিছু কথা মনে করতে পারলেও বাকি দিনগুলোর কিছুই মনে করতে পারেনি। তখন তার আত্মীয় স্বজনরা তাকে যা বলেছিল তাই বিশ্বাস করেছে। বিশেষ করে মামার কথা। তিনি জাগ্রতর ভুলে যাওয়া একবছর নিয়ে বলেছিলেন জাগ্রত সবসময় ফাল্গুনীকে নিয়ে কথা বলতো। ফাল্গুনীর নামে শান্ত হতো আবার ফাল্গুনীর নামেই অশান্ত হতো। এক প্রকার ঘোরে কেটেছে তার দিনগুলো। আরও অনেক কথা বলেছিলেন তিনি। যা বলেছিলেন সব ছিল সত্যিই। তবে মিথ্যে বলেছিলেন জাগ্রতর মাকে নিয়ে। কিভাবে যেন কথাগুলো বলেছিলেন! সম্ভবত কথাগুলো ছিল এমন যে সবসময় জাগ্রতকে বিয়ে করা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করতো তার মা। তাই নিয়েই একদিন কথা কাটাকাটি হয় জাগ্রতর সাথে তারপর হুট করেই ব্রেইন স্ট্রোক করে মা রা যান। আর আমার স্বামীকে পরিচয় করিয়ে দেন তার মায়ের ডাক্তার হিসেবে। জাগ্রত সমস্ত কথাগুলো বিশ্বাস করে নেয়। কোন দ্বিমত পোষণ করে নি। তবে ভেঙে পরেছিল প্রচুর। আত্মসংশয়ে ভুগতে শুরু করেছিল নিজের একবছরের অসুস্থতা আর স্মৃতিহীনতা নিয়ে। এরমাঝে জাগ্রতর নাকি এক বোন আছে সে একবারও খোঁজ খবর নেয়নি যদি জাগ্রতকে দেখাশোনা করতে হয় সেই ভয়ে। যা করার মামা-মামিই করেছে, বিশেষ করে তার মামা। কিছু দিন পর জাগ্রতকে একটা চাকরির জোগার করে দেয় তিনি এখানে। তারপর সেই চাকরি তে জয়েন করে কিছুদিন সময় পার হয়। তবে জাগ্রতর মন মানসিকতা সবসময় খিটখিটে হয়ে থাকতো। কার-ও সাথেই তেমন কথা বলতো না। তোমাকে খুঁজে না পাওয়ার রাগ তোমার ওপর গিয়েই বর্তাতে থাকে তার মনে। তোমার খোঁজ করাও বন্ধ করে দেয়। অভিমানে তোমার নাম নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই দেখে জাগ্রতর মামা জোর করে একটু ঘুরতে পাঠান। পরিবেশ চেঞ্জ হলে যদি মন-মানসিকতার একটু পরিবর্তন ঘটে তাই ভেবে সম্ভবত কুয়াকাটা পাঠিয়েছিল। আর সেখান থেকে আসার পথেই তোমার সাথে দেখা। তোমাদের দেখা হওয়া থেকে শুরু করে তোমার ফিরে আসা অব্দি প্রতিটা মুহুর্ত জাগ্রত তার মামাকে কতোটা উৎফুল্লতার সাথে বর্ণনা করেছে জানো? সে আবার সবটা আমার স্বামীকে বলেছে। আমি শুনেছি আমার স্বামীর কাছে। আর আরেকটা কথা, এই সব কিছুতে আমার স্বামীর ভয়ের কারণ কি জানো? তা হচ্ছে জাগ্রত। কারণ জাগ্রত তার মাকে ভীষণ ভালোবাসতো। ভালোবাসার চেয়েও বেশি ছিল কৃতজ্ঞতা। তাকে এক নতুন জীবন যে দিয়েছিল তার মা! নিজের ছেলে না হওয়া সত্ত্বেও তা কখনো বুঝতে না দিয়ে অসম্ভব ভালোবেসে গেছে। এখন তা ভালোবাসা ছিল নাকি দেখানদারী তাতো সেই ভাল জানতো তবে জাগ্রতর কাছে সবটা ছিল অনেক বড় কিছু। তাই জাগ্রত যদি কোনভাবে সবকিছু জানতে পারে তাহলে অপরাধবোধ থেকে সব কিছু ফাঁস করে বসতে পারে। তাতে আমার স্বামীও ফেঁসে যাবে। চাকরীটা তো যাবেই জেল-ও হবে। আর এসব থেকে জাগ্রত আবার অসুস্থ-ও হয়ে যেতে পারে। সম্ভাবনা আছে। তাই সব মিলিয়ে গতকাল রাতে এক প্রকার পালিয়ে চলে এসেছে সে আমাদের নিয়ে। ভয় ছিল একটাই; জাগ্রত না সন্দেহ করে বসে বা কিছু শুনে না নেয়।”
ফাল্গুনীর বাকহারা হৃদপিণ্ডটা ভীষণ জোরেশোরে লাফাচ্ছে। হাত-পা ভেঙে গুড়িয়ে লুটিয়ে আসছে শক্তিহীন হয়ে। জাগ্রত তাকে এতোটা ভালোবাসে ফাল্গুনী তা কল্পনা-ও করতে পারে নি। আর এমন পরিস্থিতিতে কেটেছে তার অতীত এর সময়গুলো তা ভাবলেই ভেতরটা জ্বলে উঠছে। কেঁপে উঠছে অন্তরাত্মা।
জাগ্রতর সাথে বাসে দেখা হওয়ার পর থেকে পরবর্তী সব স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে ঝালিয়ে নিল ফাল্গুনী। মিলে গেল যেন সব হিসেব। জাগ্রতর বলা প্রতিটা কথার হিসেবেও গরমিল হলো না। ফাল্গুনী শরীর ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল মৃত্তিকার গায়ে গা ছেড়ে দিয়ে। মেঝেটাও যেন ধিক্কার জানালো। যেখানে সে প্রত্যেক টা দিন চেষ্টা করেছে কি করে জাগ্রতকে ভুলে থাকা যায় সেখানে জাগ্রত প্রতিটা মুহুর্ত অনুভব করে গেছে তাকে। খুঁজে গেছে নিজের সবটা দিয়ে। কি হতো যদি সে নিরুদ্দেশ না হতো? কি হতো যদি অন্তত একজনকে-ও জানিয়ে যেত তার গন্তব্যের ঠিকানা? তাহলে তো কোন না কোনভাবে তার খোঁজ ঠিক পেয়ে যেত জাগ্রত। আর সেও তো ছিল এক পাষাণ হৃদয়া! একবার-ও নেয়নি জাগ্রতর খোঁজ। যদি একবার খোঁজ নিয়ে দেখতো মানুষটা কেমন আছে কি অবস্থায় আছে তাহলে তো জানতে পারতো মানুষটা কতো কষ্টে আছে তার জন্যে। সে তো তার জায়গায় দিব্যি ছিল। জাগ্রতর-ই বা কি দোষ? সে তো ওই মহিলাটাকে মায়ের আসনে বসিয়ে অন্তর দিয়ে পূজো করতো। তাই তার অসুস্থতার নাটকগুলো কখনো চোখে পড়েনি। আর বাকি যেগুলো চোখে পড়তো তা এড়িয়ে চলতো কৃতজ্ঞতা থেকে। এক কথায় রাস্তা থেকে উঠে আসা প্রাণকে দিয়েছিল ভরা পরিবার যেই মানুষটা; তাকে ভালো না বেসে যাবে কোথায় আর কৃতজ্ঞতা না দেখিয়েই কি করবে? জাগ্রতর জায়গায় সে থাকলে হয়তো আরোও বেশি প্রায়োরিটি দিত মা নামক মানুষটাকে। ফাল্গুনী ভেতরে ভেতরে চিৎকার করে বলল, এই বুঝটা চার বছর আগে কেন এলো না আপনার? কেন? সুস্থ হওয়ার পর আমার উপর অভিমান হলো আপনার? আগেই কেন হলো না? আরও আগেই যদি ঘৃণা করতেন আমায় খোঁজ করা বাদ দিয়ে তাহলে তো আপনার ওমন অবস্থা-ই হতো না। কেন এতো ভালবাসলেন জাগ্রত? কেন এতোটা ভালবাসলেন? কেন আরও আগেই দেখা হলো না আমাদের?
ফাল্গুনী দু-চোখ অঝোরে অশ্রু ঝরছে। মুখে কোন রা নেই; নেই কোন শব্দ। সব শব্দগুলো গোল পাকিয়েছে কন্ঠে। আঁটকে বসে আছে কন্ঠস্বর। আয়েশা নিজেও বসে পরলো মেঝেতে। ফাল্গুনীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোমার কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি বোন। কিন্তু আমি আর সময় দিতে পারছি না। জাগ্রত কখন চলে আসে বলা যায় না। আমি চলে যাচ্ছি। ভাল থেকো। আর আরেক টা কথা। আমার স্বামী যা করেছে জাগ্রতর ভালোর জন্য করেছে। দয়া করে নজর রেখো এমন কিছু যাতে না ঘটে যা থেকে আমার স্বামীর বিপদ হয়। আসছি।”
চলে গেল আয়েশা। ফাল্গুনী বসে রইলো মেঝেতে। কিছুক্ষণ পর জাগ্রত ফিরে এলো থানা থেকে। ফাল্গুনী দরজা খুলে জাগ্রতর মুখটা দেখে যেন আরও ভেঙে পড়লো। জাগ্রত ভেতরে এলে দরজা বন্ধ করে জাপটে জরিয়ে ধরলো জাগ্রতকে পেছন থেকে। কিছুক্ষণ শক্ত করে জরিয়ে ধরে রাখলো। অতঃপর ছেড়ে দিল হটাৎ করে। সামনাসামনি দাঁড়াল জাগ্রতর
চোখে চোখ রেখে। আচমকা আঁকড়ে ধরলো জাগ্রতর ঠোঁট যুগল। আলতো স্পর্শে মাতাল স্বর্গসুখে ভাসিয়ে নিল জাগ্রতকে। যুগলবন্দী হলো যেন দুই আত্মার। খুব অল্প কয়েক মুহুর্ত পরেই ফাল্গুনী গুটিয়ে নিল নিজেকে। জাগ্রতকে ছেড়ে দাঁড়াল খানিক দুরত্বে। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে ত্রস্ত পায়ে চলে গেল বেডরুমের দিকে। লজ্জা যেন আর পিছু মুড়তেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দিল।
জাগ্রত অকস্মাৎ হামলায় খেই হারিয়ে বসেছিল নিজ সত্তার। কি থেকে কি হয়ে গেল মাথার উপর দিয়ে গেছে তার সব। এই জরিয়ে ধরলো? আবার এই চুমু খেল। তাও আবার ঠোঁটে। এটা নিশ্চই শোক প্রকাশ ছিল না? তবে কি ছিল? জাগ্রত ঠোঁটে এক আঙ্গুল স্পর্শ করে ছুঁয়ে দেখল একটুখানি। এখনও যেন সেই বুক কাঁপানো অনুভূতির রেষ টা রয়ে গেছে।
জাগ্রত ধীরে ধীরে বেডরুমের সামনে এলো। ভেজানো দরজা আলগা করে ভেতরে ঢুকলো নিঃশব্দে। ফাল্গুনীকে দেখতে পেল সে বিছানা গোছগাছ করছে। সিঙ্গেল পাতলা কম্বলটা ভাজ করতে গিয়ে যেন হিমশিম খাচ্ছে বেচারি। কম্বলের দুই মাথা যেন এক হচ্ছেই না। জাগ্রত ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তৃপ্তি জড়ানো হাসি। ফাল্গুনীর হাত থেকে কম্বলটা নামিয়ে রেখে হাত ধরে দাঁড় করালো এক ঝটকায়। ফিচেল হেসে বলল,
“আজকে কি হলো বউটার? রোমান্টিক কোন ভূত-পেত্নী ভর করেনি তো? নাকি আমিই স্বপ্ন দেখছি?”
ফাল্গুনী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জা করছে ভীষণ; পাশাপাশি জরিয়েও ধরতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে সারাজীবন সামনে থাকা মানুষটার বুকে মাথা রেখে কাটিয়ে দিতে।
জাগ্রত আবারও একইভাবে দুষ্টু হেসে বলল, “আমার কিন্তু ওইটুকুতে মন ভরে নি। কিছু টের পাওয়ার আগেই ছেড়ে দিলে। শুধু টের পেলাম মিনি সাইজের যেন কারেন্ট লাগল বুকে। আবার চট করে ছেড়েও দিল কারেন্ট বউ আমার। কিন্তু কারেন্ট তো এতো সহজে ছাড়ে না আমি জানি। একবার ধরলে শরীরটাকে নিঃশেষ না করে ছাড়ে না। তুমি কেন ছাড়লে? আমি তো এখনও শেষ হইনি। এই দেখ দিব্যি বেঁচে আছি এখনও। একদম হাট্টাকাট্টা তাগড়া শরীর নি…।”
জাগ্রতর ঠোঁট চেপে ধরলো ফাল্গুনী। মাথা নেড়ে বোঝাল এমন কথা না বলতে। তারপর মাথাটা আলগোছে এলিয়ে দিল জাগ্রতর বুকে। জাগ্রত ফাল্গুনীর মাথায় চুমু খেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে নিল প্রেম আলিঙ্গনে। কিছুসময় পর বলল,
“ঝিমলির ফ্যামিলি থেকে কেউ আসে নি এখনও। থানা থেকেও ফোন করে খবর দেওয়া হয়েছে। আর সোহাগ আছে পুলিশের হেফাজতে। কোর্টে চালান করা হবে ওকে। ঝিমলির লেখা শেষ চিঠি আর ওর ফোনে পাওয়া ভিডিওগুলোই ওর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবে।”
–
সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত; আর তারপর রাত পেরিয়ে মধ্যরাত। আকাশের চাঁদটা তার জায়গায় থেকেও যেন জায়গা পরিবর্তন করছে রাতের সঙ্গে জুটি বেঁধে। মধ্যরাতের এই নিকষ ভূতূড়ে পরিবেশটা ঠিক যতোটা নিস্তব্ধ ও শান্তিপূর্ণ জাগ্রত আর ফাল্গুনীর হৃদয়টা ঠিক ততটাই অশান্ত আর শোরগোলে পরিপূর্ণ। দুজনের হৃদয় আজ পরিপূর্ণতার শোরগোলে মজেছে পুরোদস্তুর। দুজনের হৃদপিণ্ডের ঢিপঢিপ আওয়াজ যেন পুরো পৃথিবী শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে দুজনের কাছেই।
ফাল্গুনী ঠাঁই নিয়ে লেপ্টে আছে জাগ্রতর বুকে। জাগ্রতর ফর্সা বুকটায় আঙ্গুল চালিয়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। জাগ্রত হাত বুলিয়ে যাচ্ছে ফাল্গুনীর এলোমেলো চুলবাহারে। একটু পরপর চুমু খাচ্ছে দু’হাতে শক্ত করে জাপ্টে ধরে। নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে আকস্মিক দুষ্টু কন্ঠে জাগ্রত বলে উঠলো, “ফাগুন, আমার কিন্তু এতোটাও জলদি ছিল না। মানে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম, ভালই চলছিল। কেমন একটা প্রেম প্রেম ভাব জমে উঠছিল। তুমিই আজ হুট করে কেমন বেঁকে বসলে। সারাদিন হুটহাট জরিয়ে ধরলে, চুমু খেলে, যখন তখন চোখ ডাবিয়ে তাকিয়ে-ও ছিলে। রাতে আবার সেজেগুজে এসে বললে একটা প্রিন্সেস কবে আসবে? নেহাত ইনসিস্ট করলে তাই আর প্রসেসিং না করে থাকতে পারলাম না। যাইহোক, নেড়েচেড়ে মানুষ করতে পারবে তো?”
ফাল্গুনী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল জাগ্রতর কথায়। জাগ্রত যে কথাটা কি মিন করে বলেছে তা ঠিক বুঝল। জাগ্রতর বুকে একটা চিমটি বসিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কোন কথার পেছনে কোন কথাটা বলেছিলাম আর আপনি সেই কথাটাকে কোথায় নিয়ে বসিয়ে দিলেন? নিজে থেকে কাছে এসেছি বলে খুব কথা শোনাচ্ছেন দেখছি মিনিটে মিনিটে। নতুন শাড়ী পড়ে সাজুগুজু করেছিলাম বলেও প্রশংসার নামে ঠেস মেরেছেন মুখ ভরে ভরে। বেশি মুখ নাড়ালে না নিরুদ্দেশ হয়ে যাব আগের মতো, তারপর খুঁজে ফিরবেন এই বেহা……”
ফাল্গুনীকে এক লহমায় বুক থেকে ছিটকে সরিয়ে দিয়ে উঠে গেল জাগ্রত। ফাল্গুনী জিভ কামড়ে মাথায় চাটি মারল। কোনমতে গায়ে শাড়ী পেঁচিয়ে নিয়ে ছুটল জাগ্রতর পিছু পিছু। শুরু হলো খুনসুটির সংসার।
একবছর পর,
হাসি কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে লাকির সামনে। হাসির পাশে চুপচাপ দাঁড়ানো খুশি। সে একটু একটু করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত। দুজনেই পরিপাটি, যেন যাচ্ছিল কোথাও। লাকি গম্ভীর কণ্ঠে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে দুজনে মিলে?”
খুশি জবাব না দিলেও হাসি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো না। বলল, “ইউএনও মেডাম এর কাছে যামু একটু। আঁখির বাপের লগে দেহা করনের ব্যাবস্থা কইরা দিতে পারব নাকি তা একটু আলাপ করতাম। মানুষ হোইক বা ডাকাইত, নাঅয় পশুই ; দেহি না তো মেলা মাস গেল। আমার খুব দেখবার ইচ্ছা করে।”
খুশি ভাবল এই বুঝি বোম ফাটলো বলে।৷ কিন্তু লাকি একটুও রাগ না করে নিজেই বলল, “চলুন আমিও যাব। তবে ভাববেন না আপনার স্বামীকে দেখতে যাচ্ছি। ওই রতন জমিদার টা কেমন আছে কি অবস্থায় আছে তাকে দেখতে যাব। নেতাটাকে একটু রাজনৈতিক ভাষণ শুনিয়ে আসি গিয়ে।”
এক বছর আগে হাসি রুখে দাঁড়িয়েছিল নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে। যে সাহস সে লাকির মতো ছোট্ট মেয়েটার মাঝে দেখেছিল তা পুষে নিয়েছিল নিজের ভেতরে। নিজের সাথে এবং নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে হওয়া প্রতিটা অন্যায়কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরেছে আইন এর সামনে। ফাল্গুনী, আঁখি, বিলাসি দেবী আরও অনেকেই সাক্ষী দিয়েছে তাতে। সব মিলিয়ে রতন এর থেকে বেশি শাস্তি প্রাপ্ত হয়েছে সুভাষ চন্দ্রের ভাগে।
শুভ এখন আর গ্যারেজের মেকার নয়। সে এখন স্কুলে যায়। পড়াশোনা করে ভীষণ উৎসাহ নিয়ে। হাসি আর শুভকে নিসান আর আঁখি সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু হাসি যায় নি। খুশি আর লাকিদের সাথে থাকে এখন। তবে তাতেও খুশিকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। শেষমেশ লাকির কথা আর ফেলতে পারেনি। থেকে গেছে তাদের সঙ্গে। চড়কায় সুতো তোলা আর সেলাই এর কাজ করে নিজের সমস্ত খরচ চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি খুশিকেও আর্থিক সাহায্য করে চলেছে। লাকি এখন মাঝে মাঝে মা বলে ডাকে হাসিকে। যদি হাসি আর খুশি দুজনেই উত্তর নেয় তবে বলে ওঠে যশোদা মা নয়, ডেকেছি দৈবকী মাকে। খিলখিলিয়ে ছোট্ট নিষ্পাপ বাচ্চার মতো হেসে উঠে হাসি সে ডাক শুনে। লাকি আঁড়চোখে তা মুগ্ধ হয়ে দেখে। সেও হাসে। হাসে তৃপ্তিতে।
নিসান আঁখিকে নিয়ে এখন চাকরিসূত্রে ঢাকার উত্তরায় বাসা নিয়ে থাকে। সাথে থাকে চন্দনা ও তার স্বামী দুজনেই। তাদের বাড়ির নীচতলাটার অর্ধেক এখন ভাড়া দেওয়া। বাকি অর্ধেকটায় মাঝে মাঝে গিয়ে থাকার জন্য খালিই রেখেছে। আঁখির এখন ফাল্গুনীদের কাছে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। নিসান মাঝেমধ্যে পুরে পরিবার নিয়ে ঘুরে আসে গাজীপুর থেকে। আঁখি এখন আর সেই আগের বোকা আঁখি টা নেই। চন্দনা রাণীর আন্ডারে ট্রেনিং নিতে নিতে বেশ কড়া কড়া কথা শিখেছে। কেউ কথা শোনাতে এলে তাকে এপিঠ ওপিঠ তেল ছাড়াই ভেজে তুলতে সক্ষম। শুধু নিসান এর সামনে গেলেই ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। যেন বর তো নয় আস্ত এক বাঘ বা সিংহ। শ্বশুর মশাইয়ের সাথে তো একেবারে বাবা-মেয়ের সম্পর্ক। নিজের বাবার থেকে যা পায়নি তা শ্বশুর নামক বাবাটার কাছ থেকে যেন সুদে আসলে উসুল করে নিয়েছে। সব না পাওয়া আদর আহ্লাদ পেয়ে গেছে এই নতুন জীবনে পাওয়া বাবা আর মা নামক মানুষটার কাছ থেকে। আর সব মিলিয়ে ভালোবাসাময় পূর্ণতা পেয়েছে স্বামী নামক মানুষটার কাছ থেকে। মানুষটা যেন অলৌকিক দূত হয়ে এসেছিল তার ভাঙাচোরা জীবনটাকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে।
ফাল্গুনী দু মাসের অন্তঃসত্ত্বা। জাগ্রতকে নিয়ে সংসারটা চলছে বেশ জমজমাট। কখনো খুনসুটি তো কখনো ভালোবাসা নিয়ে বেশ আছে দুজনে। দুজনেই দুজনকে চোখে হারায়। ফাল্গুনীর মাকে জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে জাগ্রত তার বাসায়। বড় একটা বাসা-ও নিয়েছে শ্বাশুড়ী মাকে নিয়ে আসার আগে। তাকে তো আরও আগেই আনার জন্য জোরাজুরি করতো জাগ্রত কিন্তু সে তার বৃদ্ধা মাসিকে ফেলে কোথাও যাবে না বলে পণ করে বসেছিল। মাসিকে সহ নিয়ে আসতে চাইলে ওদিকে তিনি আবার গো ধরে ছিলেন তিনি তার স্বামীর ভিটেতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন। তারপর ছয় মাস পেরোতেই দুনিয়ার সকল মায়া ত্যাগ করে পারি জমালো মানুষটা পরপারে। তারপর জাগ্রত আর কোন কথা শুনলো না। এক প্রকার ধরে বেঁধেই নিয়ে এলো নিজের কাছে। বিলাসি দেবীর সঙ্কোচ ছিল মেয়ে জামাই এর বাড়িতে পরে থাকবে চিরকাল! কিন্তু জাগ্রত জামাই থেকে ছেলে হয়ে দেখিয়েছে। নিজের মায়ের আসনে বসিয়ে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে আসছে সর্বদা। বাসায় বিলাসি দেবী-ই যেন ঘরের কর্তী। তেমনটাই মেনে চলে ফাল্গুনী আর জাগ্রত। জাগ্রতর মামা-মামীরা-ও অত্যন্ত সম্মান করে তাকে। সব মিলিয়ে ফাল্গুনীর জীবনে থাকা সমস্ত অপূর্ণতা আর আফসোস মিলিয়ে গিয়ে উদয় হয়েছে নতুন ভালবাসার সূর্য। যে সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে স্বার্থক হয়েছে জাগ্রত আর ফাল্গুনীর পুনর্মিলন। অন্ধকার মিলিয়ে গেছে দুজনের সুপ্ত ভালোবাসার কাছে হার মেনে নিয়ে।
~ সমাপ্ত