#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব১৪
#রাউফুন
‘এইডা কি ঠিক হইলো আম্মাজান? আমার মাইয়া, আমার আম্মারে আপনে আমার অনুমতি ছাড়া বিয়া দিয়া দিলেন? আমি বাপ হইয়া জানবারও পারলাম না৷ আমার মাইয়া ওহন বাচ্চা মানুষ। ওর বয়েস টা চিন্তা করতে পারলেন না?’ শাশুড়ী হালিমা খাতুনের দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে বললেন আজিজ সাহেব!
‘আম্মা আমি জানি, আপনে আমার ঝুমরে ম্যালা ভালোবাসেন। ওর কোনো ক্ষতি আপনে চাইবেন না। আসলেই তো ঝুমের বাপ ঠিকই কইছে, ওর বয়েস টা দেখছেন? বাচ্চা মেয়ে আমাগো। ওঁকে আপনে বিয়া দিয়া দিলেন? ক্যান এমন অদ্ভুত, কদাচিৎ একটা সিদ্ধান্ত নিলেন? ক্যান আম্মা?’
‘তোমগোর আমার উপরে বিশ্ব্যেস আছে না? সুফিয়া, তুমি নিজেই তো কইতাছো আমি আমার ঝুমুর সোনার কোনো দিন কোনো ক্ষতি চাই নে? তাইলে এহন আমার সিদ্ধান্তের উপরে ক্যান ভরসা করতে পারতাছো না?’
‘আপনে বুঝতাছে না, তীর্থ আর ঝুমুর দুইজনাই ছোডো! ওগো কি বিয়া কইরা সংসার করনের বয়স হইছে?’
এতক্ষণ তীর্থর বাবা মা চুপ করে ছিলেন। রুমি বরং খুশিই হয়েছে। ঝুমুরকে তো তার ভীষণ পছন্দ। তিনি এই বিষয় নিয়ে কথা বললেন না। কিন্তু আসলাম বললেন,
‘মায়োই-সাব, কিছু মনে কইরেন না। তীর্থ আমার পোলা। আর আমিও তো ওর বাপ হইয়া জানবার পারলাম না। এতো অল্প বয়সে কি ওঁরা সংসার জিনিসটা বুঝবো? আমি এই বিয়া কোনো মতেই মানতে পারতাছি না।’
‘আমার বয়স হইছে, কহন কি হইয়া যায় জানি না। তাই ম’র’নে’র আগে আমি আমার প্রিয় নাতনীর বিয়াডা দেইখা যাইতে চাইছিলাম। কিন্তু এহন দেহি তোমগোর একাকজনের একাক কথা। তোমগোর ওগো নিয়া ভাবতে হইবো না। আমার কাছেই থাকবো ওঁরা দুইজন। আমার নাত জামাই আর নাতনী। ওগোর ভরনপোষণ এর দায়িত্ব আমার। আমার বাঁইচা আছি যতদিন ততদিন এই তো দেখুম ই কিন্তু আমার মৃ’ত্যু’র আগে ওঁগো দুইজনরে আমার সম্পত্তির ভাগও দিয়া যামু। যাতে ভবিষ্যতে ওগো সমস্যা না হয়। আশা করি আর কেউর কোনো কথা কইবার নাই। আমি এক্ষণ উঠি। সুফিয়া ধর তো আমারে লইয়া যা। ঘরে যাইয়া বিশ্রাম নিমু।’
আজিজ সাহেব আর আসলাম এবারে কোনো রকম ভনিতা করলেন না। আসলাম সম্পত্তির কথা শুনে ভেতরে ভেতরে খুশি হয়ে সব কিছু মেনে নিলেন। আর কারোর কোনো দ্বিধা নেই এই বিয়ে নিয়ে।
এসব কথা আড়াল থেকে শুনছিলো ঝুমুরের ছোট মামি। তা দেখে হালিমা বেগম লাঠিতে ভর করে এগিয়ে এলেন। আচমকা হালিমা খাতুন কে দেখে চমকে উঠে ঝুমুরের ছোট মামি। হালিমা খাতুন তা দেখে মুচকি হাসলেন। এরপর ফিসফিস করে ছোট ছেলের বউয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘তোমার চাল তো কামে লাগলো না বৌ। এরপর আরও শক্তপোক্ত চাল চালিও বুঝলা? আমি এই হালিমা বাঁইচা থাকতে তুমি কেন? কেউ-ই আমার ঝুমুর সোনার ক্ষতি করতে পারবা না।’
সুফিয়া বেগম কিছুই বুঝলেন না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। নিজের মাকে জিজ্ঞেস করলে কোনো রকম আশানুরূপ উত্তর না পাওয়াই হতাশ হলেন।
হালিমা খাতুন যেতেই ঝুমুরের ছোট মামি লায়লা ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছিলো। ননাশের মেয়েকে এই বাড়ির সম্পত্তি দেওয়াটা তার একদম পছন্দ না। এই ঝুমুর আসার পর থেকেই তাদের রুমটা দখল করেছে। আবার তার একমাত্র ছেলেটার আদরও কমে গেছে। দাদির আদর পাচ্ছে না বললেই চলে।সবটা মিলিয়েই রাগের বশবর্তী হয়ে আজ সকালে ঝুমুরের বদনাম করতে চাইছিলো। তাই তো গোপনে সে ঝুমুরের ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু বদনাম করতে গিয়ে বিষয়টা আরও বড় হয়ে গেছে। খারাপ তো হলোই না, উল্টো এখন ভালো হচ্ছে। যাতে করে লস টা তাদেরই। তীর্থ আর ঝুমুরের বিয়ে হওয়ার ফল স্বরুপ পাশা উল্টে গেছে। সে সাবধানে করলেও তার শাশুড়ী মা কিভাবে যেনো জেনে গেছেন। বাড়িতে মানুষ বলে সে বেঁচে গেছে। তবে শাস্তিটা তোলা রয়েছে তার জন্য যতটা আন্দাজ করতে পারছ সে। না পেলো শাশুড়ীর মনে জায়গা আর না পাবে স্বামীর মন। একুল ওকুল দুকুল ই গেলো তার। এসব ভেবেই আরও রাগান্বিত হলো সে ঝুমুরের উপর।
•
তীর্থ দু-হাতে ঝুমুরের দু-পা জাপ্টে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে আর অনুনয় বিনয় করছে। তার মনে হচ্ছে বুকের পাজরটা ভেঙে যাবে এক্ষুনি। কান্নার দাপটে হিচকি উঠে, নাকের পানি চোখের পানিতে একশাঁ।
‘জ্ঞানত আমি কাজটি করিনি। যা হয়েছে তা আমার অজ্ঞাত অবস্থায়। আমি হুশে ছিলাম না। আমায় ক্ষমা কর আমার পুষ্প৷ আমি জানি আমার পুষ্পকে যে আঘাত করেছি, এরপরে, এরপরে আর ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। আমি জানি পুষ্প। তবুও প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে।’
‘পা ছাড়ো তীর্থ ভাই।’ গম্ভীর মুখে বললো ঝুমুর।
‘আমি তো পা ছাড়বো না, পুষ্প!’
‘কে পুষ্প? কার পুষ্প? কি তখন থেকে, পুষ্প পুষ্প করছো?
‘তোকে পুষ্প বলছি!’
‘তোমার জন্য না আমি কালো, কালিই বলো!’
তীর্থ কান্না করতে করতেই মাথা দুলিয়ে হাসে। তারপর চোখ মুছে বললো, ‘তুই আমার কালো পুষ্প। কালো গোলাপ দেখেছিস? আমার পছন্দের ফুল হলো কালো গোলাপ। আমার খুবই বেশি পছন্দের কালো গোলাপের মতোই তুইও আমার হৃদয়ের সবটা জুড়ে রয়েছিস৷ তুই হইতো জানিস না, আমিও না অদ্ভুত, তোকে জানতে বা বুঝতে দিয়েছি কখনোই? উঁহু। আমি যে তোকে মনে মনে পুষ্প কন্যা বলি জানিস? আমার কাছে তুই একটা পবিত্র ফুল। আর আমি সেই ফুলকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছি। আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তুই, তুই, তুই এক কাজ কর আমার গলা টিপে মেরে ফেল। বিশ্বাস কর, আমি এই অপরাধ বোধ আর নিতে পারছি না। আর পারছি না। এই তোর রাগ হচ্ছে না? আমি তো তোর কাছে অন্যায় কারী, অপরাধী, তবে এতোটা হাম্বল আছিস কি করে? রাগ কর, চেঁচা, বকে নে, আমায় আঘাত কর, যা ইচ্ছে কর। বিনিময়ে আমায় ক্ষমা করে দে শুধু।’
‘আমি কোনো পা’পের বোঝা মাথায় নিবো না। তাছাড়া আমরা এখন স্বামী স্ত্রী। বিয়েটা যেভাবেই হোক তুমি আমার স্বামী এখন। এভাবে আর পা ধরবে না, উঠো!’
‘না, না, আমি কোনো ভাবেই পা ছাড়বো না। আগে বল, ক্ষমা করেছিস!’
কোনো জবাব না দিয়ে ঝুমুর পা ঝামটা দিলো। তীর্থ হঠাৎই ঝুমুরের পা দুলানোই একটু বিচ্যুত হলো বটে, কিন্তু আবার ঝুমুরের পা জাপটে ধরলো। ঝুমুর পরলো মহা মুসিবতে। সে পা ছেচড়ে টেনে টেনে বিছানায় গেলো। কোনো রকম কথায় সে বললো না আর৷ এদিকে তীর্থও পা ছাড়বে না। জেদ করে ধরেই রইলো। ওভাবেই কোনো রকম ঝুমুর বিছানায় উঠে শুয়ে পরলো। আর তীর্থও দুই পা ধরে ফ্লোরে বসে রইলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠার পর দেখা গেলো তীর্থ তখনও ঝুমুরের পা ধরে আছে। ঝুমুর অনুভব করলো তার পা ভার হয়ে আছে। তীর্থ তার পায়ের উপরেই মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। তীর্থর এমন পা’গ’লা’মিতে বড্ড নাজুক হয়ে পরে ঝুমুর। ঝিম ধরে যাচ্ছে তার পা। ঝুমুর পা সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমে যেতে নেবে তীর্থ হুরমুর করে ঘুম ঘুম চোখে আবার পা জড়িয়ে ধরলো। চোখ কচলে বলল, ‘বল না ক্ষমা করেছিস!’
‘তোমার এমন জঘন্য ভুলের কোনো ক্ষমা হয়? তোমার কাছে এতোটাই সহজ মনে হচ্ছে বিষয়টা?’
‘আমি তো বলছি, আর এমন করবো না। কথা দিচ্ছি!’
‘এখন তুমি যা খুশি করতে পারো, আমি তোমার স্ত্রী!’
‘আমি আমার জ্ঞানে, অজ্ঞানে আর কোনোদিনও তোকে স্পর্শ করবো না যতক্ষণ না পর্যন্ত তুই আমাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারবি।’
‘এখন ছাড়ো আমি যাবো!’
‘বল ক্ষমা করেছিস?’
‘তুমি কি ছাড়বে? আমি ওয়াশরুম যাবো।’
‘তো যা না করলো কে?’
‘পা না ছাড়লে যাবো কি করে? কি শুরু করছো তুমি?’ দাঁত কিড়মিড় করে বললো ঝুমুর।
‘বাহ, আমার পুষ্প কন্যার তো দেখি বেশ উন্নতি হয়েছে। শুদ্ধ ভাষাত কথা বলছে দেখি।’
‘তুমি কি পা ছাড়বে নাকি এখানেই ইয়ে করবো?’
‘পারলে কর!’
‘পা ছাড়ো। এখন উঠো।’
‘ক্ষমা করেছিস বল?’
‘হু! উঠো!’
‘সত্যিই?’
ঝুমুর ফের দাঁতে দাঁত চিপে বললো, ‘ হ্যাঁ সত্যি!’
‘তিন সত্যি?’
‘হ্যাঁ তিন সত্যি!’
তীর্থ পা ছাড়লো। ঝুমুর চলে গেলো। আর মনে মনে ভাবলো, ‘আমার মনে তোমার জন্য আবার যদি প্রেম পুষ্প ফোটাতে পারো তবে এই ভুলের ক্ষমা তুমি পেয়ে যাবে তীর্থ ভাই! আজ আমি কিছুতেই মন থেকে ক্ষমা করতে পারলাম না। আমি যে ওতো উদার নয়, অজ্ঞাত, আর জ্ঞাত যেভাবেই হোক, আমার সঙ্গে যা হয়েছে সেটা তো ভুলার নয় তাই না? ওই তিক্ত দিনটা আমি শেষ নিঃশ্বাস অব্দি মনে রাখবো।’
#চলবে